"শুভ দৃষ্টি"
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
রাত পোহালেই বিয়ে | সোমা অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তার কাকা ,কাকিমাকে বলতে পারলো না ,তার আর অরুনের সম্পর্কের কথা | আর কি করেই বা বলবে ? মা ,বাবা মারা যাওয়ার পর কাকু ,কাকিমা যদি তাঁদের কাছে সোমাকে না নিয়ে আসতেন তাহলে তো তার কোনো অস্তিত্বই আজ আর থাকতো না | এত বড় অকৃতজ্ঞ সে কি করে হবে ? ভুলেই তো গেছিলো সে অরুনের কথা | অনেক বছর আগে যখন মা ,বাবা দু'জনেই বেঁচে তখন অরুনেরা থাকতো সোমাদের বাড়ির কাছে | কতই বা বয়স হবে সোমার তখন | নবম শ্রেণীর ছাত্রী সে | বাবার হঠ্যাৎ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর পর মা বছর খানেকের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন | বিছানা ছেড়ে আর ওঠেননি | কাকু ,কাকিমা তখন দেশের বাইরে | ফোন করে অরুনই সোমার কাকুকে জানিয়েছিলো সোমার মায়ের অসুস্থ্যতার কথা ; সেটা সোমার মায়ের নির্দেশেই | লন্ডন থেকে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসা চারটিখানি কথা নয় | দেওরকে ফোন করার দিন সাতেকের মধ্যেই সোমার মা মারা যান | সোমা তখন সম্পূর্ণ একা | অরুনের মায়ের সাথে সোমার মায়ের একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো পাশাপাশি বাস করার সুবাদে | তিনি সোমাকে তার নিজের কাছেই নিয়ে রাখেন , ছেলেকে দিয়ে দুষসংবাদটি সোমার কাকুকে ফোন করে জানিয়ে দেন | সোমার মা মারা যাওয়ার আট ,ন দিন বাদে তার কাকু ,কাকিমা এসে সোমাকে নিয়ে যান | এই ক'দিনে সোমার সাথে অরুনের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে | সেটা সম্পূর্ণ ভাবেই একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক |সদ্য মা হারা সোমা সব সময় মন খারাপ করে থাকতো বলে অরুন সব সময় চেষ্টা করতো তাকে নানান ধরণের গল্পের মাঝে ডুবিয়ে রাখতে ; যাতে তার কষ্ট কিছুটা অন্তত কমে | সোমার চলে যাওয়ার আগেরদিন অরুন তাকে বলেছিলো ," যেখানেই থাকিনা কেনো - তোমার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে | আমি ছেলেবেলা থেকেই খুব আশাবাদী মানুষ | পৃথিবীটাতো গোল ; একদিন না একদিন তোমার সাথে আমার আবার দেখা হবেই "|সোমা সে কথার কোনো উত্তর দিয়েছিলো না ; শুধু চলে আসার সময় সকলের সামনে অরুনের দিকে তাঁকিয়ে বলেছিলো ,"আসি" | এরপর দীর্ঘ দশ বছর পর তাদের দেখা | কাকু রিটায়ার করে লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছেন | সল্টলেকে একটি সুন্দর ফ্লাট ও কিনেছেন | তাদের একমাত্র ছেলে লন্ডনই থেকে গেছে | তার মেমবৌ কলকাতা আসতে চায়নি | তাই সোমাকে নিয়েই তারা দেশে ফিরে এসেছেন | একদিন সন্ধ্যায় সোমা নিউ মার্কেট থেকে কিছু মার্কেটিং করে ফিরছিলো , হঠ্যাৎ একটি সুদর্শন ছেলে সোমার দিকে এগিয়ে এসে বললো ," আপনাকে খুব চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিনা |" সোমার ছেলেটিকে গায়ে পড়া মনে হলো | সে ছেলেটির দিকে কটাক্ষ দৃষ্টিপাত করে বললো ," তাহলে যেদিন মনে পড়বে আর আবার আমার সাথে দেখা হবে সেদিনই বলবেন |" মেয়েটির এরূপ ব্যবহার পাবে অরুন তা বুঝতে পারেনি | সে কোনো কথা না বলে সোমার পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যায় | তারপর হঠ্যাৎ একদিন সেই নিদৃষ্ট জায়গাতেই দেখা | প্রথমে সোমাই দেখে অরুনকে | ভাবে অরুন বুঝি তাকে ফলো করছে | সে দ্রুত দোকান থেকে বেড়িয়ে যেতে যায় ; আর ঠিক তখনই সোমাকে অরুনের চোখে পরে | সে সরাসরি সোমাকে প্রশ্ন করে , "আপনার নাম সুমনা না ? ডাক নাম সোমা বাড়ি ছিল বালিগঞ্জে , পরে কাকুর সাথে লন্ডন চলে যাওয়া , কি আমি সব ঠিক বলছিতো ?" -- হ্যাঁ ,সব কিছু ঠিকঠাক | কিন্তু আপনি কি করে জানলেন ?--- সেটা তো ছেলেবেলা থেকেই জানি | মাঝে মনে করতে একটু সময় লেগেছে | আসলে কি জানেন ? পৃথিবীটা তো গোল ,আমরা ঠিক ঘুরতে ঘুরতেই পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যাই | অনেকদিন আগের কথা | কিন্তু এই কথাটাই সোমার মনে পড়েছে বারবার | ভেবেছেও একদিন না একদিন হয়তো অরুনের সাথে হয়তো দেখা হবে | কলকাতায় এসে অনেক পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে | আজ অরুনের সাথে দেখা হয়ে সোমার এই প্রথম মনে হলো মনের কোনো একটি জায়গায় যেন অরুনের জন্য একটু জায়গা ছিলো ; যেটা হয়তো তার নিজেরও অজান্তেই ছিলো | তানাহলে অরুনকে দেখে সোমার এতটা আনন্দ হচ্ছে কেন ?-- আপনি ,মানে তুমি অরুন ? অরুন হাসতে লাগে | আর হাসতে হাসতেই বলে ,"সেদিনই মনে পড়েছিলো কিন্তু ততক্ষনে বাড়িতে পৌঁছে গেছি | ব্যস সেই শুরু | তারপর প্রায় রোজই দেখা ,গল্প করা ,এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানো ,ফোনে যখন তখন কথা চলতেই থাকে | অরুনের কাছ থেকেই সোমা জানে অরুনের মা বছর দুই আগে মারা যান | তিনি চেয়েছিলেন তার বৌ দেখে যেতে ,চেষ্টাও করেছিলেন - দু ,একটি মেয়ে দেখেছিলেনও কিন্তু অরুন দেখে সব 'পছন্দ হয়নি '-বলে মাকে জানিয়ে দিয়েছে | বেশ হাসি ,খুশিতেই দিনগুলি চলে যাচ্ছিলো | কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অরুনের হঠ্যাৎ "বাইরে যাচ্ছি ,কাজ আছে কদিন দেখা করতে পারবোনা ,ফোনে কথা হবে -" বলে অন্তর্ধান আজ নিয়ে পনেরদিন সোমা অরুনের কোনো খবর জানে না | অরুনের এই ব্যবহার সোমার কাছে কেমন হেঁয়ালী লাগে | দু ,একদিন ফোনে কথা হলেও এখন ফোন সব সময় 'নট রিচেবেল' | আর এই কদিনের মধ্যেই সোমার কাকু ,কাকিমা তাড়াহুড়ো করে তার বিয়ের সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছেন | কিন্তু সোমা কাকু ,কাকিমার ভালোবাসার প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে পারেনি | জানাতে পারেনি অরুনের কথা | বুক ফেঁটে চৌচির হয়ে গেলেও মুখে জোড়করে হাসি এনে কাকু ,কাকিমার সর্ব কাজে সম্মতি দিয়েছে | বর বিয়েবাড়ি পৌঁছে গেছে | শাঁখ ,উলুধ্বনি সব কিছুই সোমার কানে আসছে | কনে সাজে আত্মীয় পরিবিষ্ট হয়ে আপ্রাণ চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে | সাতপাঁক ঘুরে শেষ | এবার শুভদৃষ্টি |সোমা পানপাতা কিছুতেই মুখ থেকে সরাচ্ছে না দেখে স্বয়ং কাকুই যেয়ে সোমার কানে কানে বললেন ,
--- মা রে একটু ছেলেটার মুখটার দিকে তাকিঁয়ে দেখ মা ,আমি কি তোকে কষ্ট দিতে পারি ? ওর মুখটা দেখলেই তোর সব কষ্ট কর্পূরের মতো উবে যাবে মা |
সোমা পানপাতা সরিয়ে দেখে অরুন তার দিকে তাকিঁয়ে মিটিমিটি হাসছে | তখন সোমার কষ্ট চলে যেয়ে রাগে সর্বশরীর জ্বলে যাচ্ছে | মনে হচ্ছে একটা লাঠি দিয়ে অরুনকে বেশ করে কয়েক ঘা বসিয়ে দেয় আর কি ! কিন্তু ফুলশয্যার আগে অরুনকে একাকী পাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয় | অগত্যা নিজের রাগ নিজের মনের মধ্যে পুষিয়ে রাখা | মাঝে মাঝে তার সাথে চোখাচোখি হতেই অরুন দুস্টুমির হাসি হাসছে আর সোমার রাগ দ্বিগুন বেড়ে যাচ্ছে |
ফুলশয্যার রাত | অরুন ঘরে ঢুকে যেইনা দরজা বন্ধ করেছে ,অমনি সোমা বাঘিনীর মতো অরুনের হাত ধরে টেনে নিয়ে খাঁটের উপর বসিয়ে বলে ,"বল ,কেনও আমায় কষ্ট দিলে এত ?"
অরুন দু'হাত দিয়ে সোমাকে বুকের সাথে চেঁপে ধরে বলে ," আর কখনো কোনোদিন যাতে তোমাকে ,আমাকে কষ্ট পেতে না হয় ; সেই জন্যই এই ব্যবস্থা | তুমি কাকুর সাথে চলে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারি তোমায় আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম | যারফলে মার পছন্দ করা কোনো মেয়ে আমার পছন্দ হত না | তোমার কাছ থেকে তোমাদের ঠিকানা জেনে একদিন তোমার অনুপস্থিতিতে সোজা তোমার কাকুর কাছে যেয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে তোমাকে নিজের করে পেতে চাইলাম |তোমার মত আছে জেনে কাকু ,কাকিমাও রাজি হয়ে গেলেন | ভাবলাম তোমার কাছে কথাটা গোপন রাখি ,কাকুকেও তাই বললাম | আর একটা কথা ভেবেছি - এই কারণে তুমি আমায় আজ খুব আদর করবে !
সোমা অরুনের দু'বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অরুনের বুকে ,পিঠে কিল ,ঘুষি মারতে মারতে বললো ," আদর ? তোমাকে আমি আজ এত মারবো -- এত মারবো ----"অরুন হোহো করে হাসতে হাসতে সোমাকে আবার বুকের সাথে চেঁপে ধরে |
নন্দা 21.3.2010