"সুখের আশায়" ( নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী ) ########################### দু'টো ধানক্ষেতের মাঝবরাবর যে সরু রাস্তাটা থাকে ,যাকে গ্রামের ভাষায় আল বলে ; সেই রাস্তা ধরে ধীরা জোড় পায়ে হাঁটতে লাগে | যে ভাবেই হোক বিমলকে স্কুল থেকে বেড়োনোর পরেই কথাটা বলতে হবে | আল বরাবর পনের থেকে কুড়ি মিনিট হাঁটার পর বড় রাস্তা | বিমলের স্কুল ছুটি হয় চারটে নাগাদ | বড় রাস্তার উপরেই একটা বেশ বড় বটগাছ | ওই অবধি আসতে ওর সময় লাগে মিনিট দশেক | তার মানে চারটে দশের মধ্যেই ধীরাকে ওই বট গাছের কাছে পৌঁছাতেই হবে | মা ,বাবা যে তার বিয়ের একদম দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেছেন আজকের মধ্যেই এটা বিমলকে জানাতেই হবে | বিমলের সাথে পরিচয় সেই ছেলেবেলা থেকে | এক সাথে স্কুলে পড়া ,একসাথে বড় হওয়া | পাশাপাশি দু'টি গাঁয়ে দু'জনের বাস | কখন যে বন্ধুত্ব থেকে একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে তা নিজেরাই বোধকরি কখনো বুঝতে পারেনি | কেউ কোনোদিনও পরস্পরকে "আমি তোমাকে ভালোবাসি"- কথাটাও বলেনি |কিন্তু দু'জনের মনই জানে ওরা একে অপরকে ভালোবাসে | বিমল খুবই শান্ত স্বভাবের ছেলে | মেধাবী ছাত্র | বি .কম .পাশ করেই গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক পদে নিয়োগ পত্র পেয়ে যায় |এদিকে ধীরারও ইচ্ছা বি.এ. পাশ করার পর স্কুল টিচার হওয়া | সেও চাকরীর চেষ্টা করতে থাকে | কিন্তু হঠ্যাৎ করেই তার বাবা ছেলেবেলার বন্ধুর ছেলের সাথে ধীরার বিয়ের একদম পাকা কথা দিয়ে বাড়িতে এসে সব জানান | সুভাষ পুলিশে চাকরী করে ,কলকাতার বাইরে থাকে | একা রান্নাবান্না কোরে খেতে হয় বলে তার বাবা ,মা তাকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চান | সন্ধ্যায় পাড়ার চায়ের আড্ডায় বাল্যবন্ধু সুশোভন চ্যাটার্জী এ কথা পারতেই ধীরার বাবা অখিলেশ বাবু তার নিজের মেয়েটির কথা বলেন | সঙ্গে সঙ্গেই সুশোভন বাবু রাজী হয়ে যান | হাতে মাত্র পনেরো দিন সময় | বাড়িতে এসে তিনি যখন ধীরার মাকে সব জানান ; আড়াল থেকে ধীরা সব শোনে | মাথায় তার বাজ ভেঙ্গে পড়ে | পরের দিনসে বাড়িতে কাউকে কিছুই না বলে বেড়িয়ে পড়ে যেভাবেই হোক বিমলকে সব জানাতে হবে | বড় রাস্তায় উঠেই সে দেখতে পায় বিমল সাইকেল চালিয়ে আসছে | ধীরাকে দেখেই সে জানতে চায় , -- তুমি এখন এখানে ? --তোমার সাথে দরকারী একটা কথা আছে | ধীরা আস্তে আস্তে বিমলকে সব কথা জানায় শান্ত স্বভাবের বিমল সব শুনে বলে , --তুমি বাড়ি যাও | আমি মাকে কালই তোমাদের বাড়ি পাঠাবো | --কিন্তু আমার বাবা যদি রাজী না হন ? উনি যে ভীষণ এক কথার মানুষ | --চিন্তা কোরো না | সব ঠিক হয়ে যাবে | --বাবা যদি রাজী না হন ,আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো | বিমল একগাল হেসে বলে , --মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেছে | আরে জম্ম ,মৃত্যু ,বিয়ে -বিধাতায় ঠিক করে রাখেন | তিনি যদি আমাদের দুজনের মিলন লিখে থাকেন ; তাহলে যে ভাবেই হোক মিলন আমাদের হবেই | ভেবো না , বাড়ি যাও | মাকে আমি সকালেই তোমার বাবার কাছে পাঠাবো | কিন্তু না ,অখিলেশ বাবু বিমলের মায়ের কথা রাখেন না | যেহেতু তিনি তার বাল্যবন্ধুকে কথা দিয়ে ফেলেছেন তাই তিনি অতি শান্তভাবে হাত জোড় করেই ফিরিয়ে দেন | তবে একথাও তিনি বলেন যে দু'দিন আগে যদি তিনি এ প্রস্তাব নিয়ে আসতেন তাহলে তাকে খালি হাতে ফিরতে হত না | ধীরার মাকে তিনি বলে দেন ,মেয়েকে জানিয়ে দিতে যদি সে তার সম্মান ক্ষুন্ন করতে না চায় ; তাহলে সে যেন এই বিয়েতে আপত্তি না করে | সে যদি সুভাষের সাথে বিয়েতে মত না দেয় তাহলে তার বাবাকে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হবে | জীবনে কোনোদিন কথার খেলাপ আমি করিনি ,গ্রামের ভিতর যেভাবে মাথা উঁচু করে আমি বেঁচে আছি বাকি জীবনটাও যেন সেই ভাবেই বাঁচতে পারি | আমার বাঁচা ,মরা এখন তোমার মেয়ের হাতে | ও যদি চায় বিমলকে বিয়ে করতে পারে তবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়ে | তবে সে ক্ষেত্রে তাকে তার বাপের মরা মুখ দেখতে হবে | অসহায় ,নিরুপায় ধীরা বাপের কথাকেই মেনে নিয়ে ,ছেলেবেলার ভালোবাসাকে গলা টিপে মেরে ,আজম্ম লালিত স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে সুভাষের গলায় মালা পড়ায় |বিয়ের প্রায় মাস খানেক বাদে সুভাষ তার কর্মস্থলে চলে যায় ; টুকিটাকি সাংসারিক জিনিসপত্র কিনে সে সাতদিনের মধ্যেই ধীরাকে তার কাছে নিয়ে যাবে এই কথা বলে | কিন্তু নিত্য সে রাতে ফোন করে ধীরার সাথে কথা বলতো | মেয়েদের জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যেগুলি তারা মেনে নিতে বাধ্য হয় | বুকে পাথর চাপা দিয়ে , ছেলেবেলার ভালোবাসাকে গলা টিপে মেরে ,চোখের জল লুকিয়ে লুকিয়ে মুছে , বাবার মুখের দিকে তাঁকিয়ে - ধীরাও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো সুভাষকে মেনে নেওয়ার| কিন্তু সুভাষ যাওয়ার পর রাতে যেদিন প্রথম তার ফোন আসে না ; সেদিন কিছুটা হলেও এক অজানা আশংখায় ধীরার বুকটা কেঁপে উঠেছিল | আর তার এই আশঙ্ক্ষাকে সত্যি প্রমান করে পরেরদিন সকালবেলাতেই ভয়ংকর দুংসংবাদটি আসে | সুভাষ যেখানে থাকতো অথ্যাৎ গুয়াহাটিতে কোনো একটি শপিংমলে জঙ্গিহানার মোকাবেলা করতে যেয়ে সুভাষ জঙ্গি পুলিশের সংঘর্ষে প্রাণ হারায় |তিনদিন পর সুভাষের লাশ বাড়িতে আসে | আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই ধীরাকে 'অপয়া' বলেই ভাবতে থাকে | এমনকি অনেকেই তাকে সামনাসামনিও একথা বলে | দেড় মাসের বৈবাহিক জীবন শেষ করে যে মেয়েটি ক'দিন আগেই লালবেনারসী শাড়ি , একমাথা সিঁদুর আর গা ভর্তি গয়না নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে গেছিলো -সেই মেয়েটিই আজ সাদা থান পড়ে নিরাভরণ হয়ে পুনরায় বাপের বাড়িতেই চলে আসে | এই ঘটনার পনের ,বিশদিনের মাথায় ধীরা বুঝতে পারে সে সন্তান সম্ভাবা | নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্নায় সে রাতের অন্ধকারে নিজেকে শেষ করে দিতে চায় | পুকুরপাড়ে যেয়ে সে যখন জলে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হয় তখন পিছন থেকে হঠ্যাৎ কে যেন তাকে হাত ধরে টান দেয় | পিছন ফিরে বিমলকে দেখে সে চম্কে যায় | বিমল এত রাতে এখানে এলো কি করে ? তবে কি সে রোজই এখানে আসে ? --তুমি এখানে ? এত রাতে ? সে কথার উত্তর না দিয়ে বিমল তার কাছে জানতে চায়, --এ কি করতে যাচ্ছিলে তুমি ? --আর তো আমার বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়না | সব দরজায় আমার সামনে আজ বন্ধ | বাবার কথা অনুযায়ী অসহায়ের মতো নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়েসব কিছু মানিয়ে নিতে চেয়েছিলাম | কিন্তু আমার কপাল মন্দ | তাই দেড় মাসের মধ্যেই আমি বিধবা হলাম | এই বেশেই হয়তো জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম | কিন্তু সেখানেও ঈশ্বর বাঁধ সাধলেন ! আমি মা হতে চলেছি - এই ভাবে বাঁচার কোনো অধিকার নেই | সকলে বলে আমি নাকি অপয়া , প্রথম প্রথম এই কথায় খুব কষ্ট পেয়েছি কিন্তু এখন নিজেই নিজেকে অপয়া ভাবি | --তারমানে তুমি দু'দুটি জীবনকে একসাথে মারতে চলেছিল ? আমার প্রতি কি তোমার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই ? একবারও তুমি আমার কথাটা ভাবলে না ? দুজনে মিলে এর একটা সমাধান তো আমরা বের করতেই পারি | বিমল খুব শান্তভাবে কথাগুলি ধীরাকে বলে | তারপর ধীরাকে অনেক বুঝিয়ে ভোররাতে ধীরাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে নিজের বাড়িতে আসে | সকালবেলা সে তার মাকে বলে , --বাবা মারা যাওয়ার পর তুমি আমাকে অনেক কষ্ট করেই মানুষ করেছো | আমি কোনদিনও তোমার কথার অবাধ্য হয়নি | তুমি তো জানো মা , আমি সেই ছেলেবেলা থেকেই ধীরাকে ভালোবাসি | কিন্তু ধীরার বাবা অন্য জায়গায় কথা দেওয়াতে তোমায় খালি হাতে ফিরতে হয়েছিলো | দেড় মাসের মাথায় ধীরা স্বামী হারা হয় | আমরা কি পারিনা মা, ওর জীবনটাকে সুন্দর ভাবে গড়ে দিতে | --আমরা আর কিবা করতে পারি বাবা ! --আমি যদি ওকে বিয়ে করতে চাই ; তুমি কি আপত্তি করবে ? --তা কি করে সম্ভব ? একটা বিধবা মেয়েকে বিয়ে করলে পাড়ার লোক কি বলবে ? -- কিন্তু মা তাহলে তো দু'টো জীবনই নষ্ট হয়ে যাবে | --দু'টো জীবন মানে ? --ধীরার এই অবস্থায় আমি তো অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হতে পারবো না | সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমার আর ধীরার দুজনের জীবনই শেষ হয়ে যাবে | পাড়ার লোকের কথা ভাবতে গেলে তোমার ছেলের জীবনটা যে নষ্ট হয়ে যাবে | আমি তোমার দুটি পায়ে পড়ি মা | তুমি আর একবার ধীরার বাবাকে যেয়ে বলো | এবার তোমাকে খালি হাতে ফিরতে হবে না | অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে বিমলের মা শোভাসিনীদেবী রাজী হন ধীরার বাবার কাছে যেতে |তিনি যেয়ে অখিলেশ বাবুকে বলেন যে তার সদ্য বিধবা হওয়া কন্যাকে পুত্রবধূ হিসাবে পেতে চান | অবাধ্য অশ্রুতে অখিলেশবাবুর চোখ দু'টি ভোরে গেলো | তিনি শোভাদেবীকে বললেন ,
--বাবা হয়ে মেয়ের সুখ খুঁজতে গিয়ে তার জীবনে চরম দুর্ভোগ ডেকে এনেছি | আপনি আবার আমার অভাগী মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইছেন ; এটা তো আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি | এ যে আমার জীবনে চরম পাওয়া | আমাকে আপনি সারাজীবনের জন্য ঋণী করলেন দিদি !
রেজিস্ট্রি করে বিমল ধীরাকে বিয়ে করলো | নিদৃষ্ট সময় মত ধীরার একটি কন্যা সন্তান হয় | বিমল আনন্দে ধীরাকে চুমায় ,চুমায় ভরিয়ে দেয় | কিন্তু ধীরার দু'চোখ বেয়ে জল পড়তে দেখে বিমল বললো ,
-- তুমি খুশি হওনি ?
--কিন্তু ওতো তোমার ----
ধীরার কথা শেষ হয়না | বিমল হাত দিয়ে ধীরার মুখ চেঁপে ধরে বলে ,
-- চুপ ,কখনো আর এ কথা বলবে না | ও তোমার আর আমার সন্তান | ও এসছে বলে আমাদের ভালোবাসার কোনো চিড় ধরেনি | ওর জন্যই এত তাড়াতাড়ি আমি তোমায় পেয়েছি |
--তুমি মানুষ ? নাকি দেবতা ?
--আমি ?
বলেই হাসতে হাসতে বলে ,
--আমি তোমার স্বামী , আমাদের সন্তানের বাবা | আপাতত এটুকুই আমার পরিচয় |
===========শেষ=============
নন্দা 12.9.16 2AM.
--বাবা হয়ে মেয়ের সুখ খুঁজতে গিয়ে তার জীবনে চরম দুর্ভোগ ডেকে এনেছি | আপনি আবার আমার অভাগী মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইছেন ; এটা তো আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি | এ যে আমার জীবনে চরম পাওয়া | আমাকে আপনি সারাজীবনের জন্য ঋণী করলেন দিদি !
রেজিস্ট্রি করে বিমল ধীরাকে বিয়ে করলো | নিদৃষ্ট সময় মত ধীরার একটি কন্যা সন্তান হয় | বিমল আনন্দে ধীরাকে চুমায় ,চুমায় ভরিয়ে দেয় | কিন্তু ধীরার দু'চোখ বেয়ে জল পড়তে দেখে বিমল বললো ,
-- তুমি খুশি হওনি ?
--কিন্তু ওতো তোমার ----
ধীরার কথা শেষ হয়না | বিমল হাত দিয়ে ধীরার মুখ চেঁপে ধরে বলে ,
-- চুপ ,কখনো আর এ কথা বলবে না | ও তোমার আর আমার সন্তান | ও এসছে বলে আমাদের ভালোবাসার কোনো চিড় ধরেনি | ওর জন্যই এত তাড়াতাড়ি আমি তোমায় পেয়েছি |
--তুমি মানুষ ? নাকি দেবতা ?
--আমি ?
বলেই হাসতে হাসতে বলে ,
--আমি তোমার স্বামী , আমাদের সন্তানের বাবা | আপাতত এটুকুই আমার পরিচয় |
===========শেষ=============
নন্দা 12.9.16 2AM.
No comments:
Post a Comment