Saturday, November 19, 2016

""কি পেলাম"                      নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী   বিকালের দিকে   মমির ফোন পেয়ে রাহুল একটু অবাকই হয় | হঠ্যাৎ করেই.মমি বলে ," রাহুল , আমার সাথে তুমি আজই দেখা করবে |রাত যতই হোকনা কেনো ,অফিস থেকে ফেরার পথে আমাদের বাড়ি আসবে | " বিয়ের সব কেনা কাটা শেষ | চারদিন মাত্র বিয়ের বাকি | মমির সাথে কথা হয়েছে এই চারদিন দেখা ,সাক্ষ্যাৎ হবেনা ,শুধু ফোনে কথা হবে | মমি একজন বেশ বড় সংগীত শিল্পী | বেশ নামডাক তার | মনামী মজুমদার - এক ডাকেই সকলে তাকে চেনে | কিছুদিন ধরেই নুতন করে রেকডিং এর কোনো ডেট নিচ্ছে না , বিয়ের আগে বেশ কিছুটা সময় বাবা ,মায়ের সাথে কাটানো আর বিয়ের পরে হানিমুনের প্রোগ্রামটাও রেডি হয়ে আছে - সে কাউকে কোনো বিপদে ফেলতে চায়না বলেই সব কাজ একবারে শেষ করে আবার ফিরবে তার প্রিয় গানের জগতে | মমি তার বাবামায়ের একমাত্র সন্তান | রাহুল ভেবেই পাইনা কি এমন হলো যে জরুরী তলব ! রাহুল রাত আটটা নাগাদ মমিদের বাড়ি গেলো | ড্রয়িংরুম পার হয়েই মমির মাবাবার ঘর ,ঠিক তার পরের ঘরটা মমির | সে ড্রয়িংরুমের ভিতর ঢুকে "মাসিমা"- বলে জোড়ে ডাক দিলো | মমির মা তার ভেজানো দরজার ঘরের ভিতর থেকেই বললেন ,"যাও  বাবা ,মমি ঘরেই আছে | রাহুল মমির ঘরে ঢুকে দেখলো জিনিসপত্র একটু অগোছালো , কিন্তু বেশ বড় ,বড় দুটি ব্যাগ গুছানো | " কি ব্যাপার বলো তো ?" মমি পিছন ফিরে কি একটা করছিলো- রাহুলের গলা শুনে বললো ," ও এসে গেছো তুমি ?তোমার সাথে খুব দরকারি একটা কথা আছে | "  "হ্যা- বলো , তোমার জরুরি তলব পেয়ে শুনতেই তো আসলাম |"রাহুল ,আমার জীবনে এত বড় সুযোগ কোনোদিন আসবে আমি তা স্বপ্নেও ভাবিনি | আমি খুব বড় একটা বিদেশী  কোম্পানি থেকে রেকডিং এর অর্ডার পেয়েছি | তারজন্য আমায় আমেরিকায় যেতেই হচ্ছে | তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো | এই বিয়েটা আমি করতে পারছি না | তুমি অনায়াসে অন্যকোনো ভালো মেয়ে পেয়ে যাবে | ওই তারিখেই বিয়েটা সেরে ফেলো | তাহলে --মমির কথার মাঝেই রাহুল চিৎকার করে ওঠে  -  " কি পাগলামি হচ্ছে এগুলি ? বাড়িতে ডেকে এনে ইয়ার্কি হচ্ছে ? "  " এটা পাগলামি বা ইয়ার্কি নয় ,যা সত্যি তাই বলছি | আমার কথা শেষ এবার তুমি আসতে পারো |" রাহুল হতভম্ব | দীর্ঘ চার বছরের সম্পর্ক ওদের | এ ভাবে সবকিছু কিভাবে শেষ হয়ে যায় ? সে উঠে যেয়ে মমিকে ধরতে যায় | মমি একটু সরে যেয়ে বলে ," আসলে কি জানো রাহুল ? আমি আগে বুঝতে পারিনি আমার জীবনে গান ছাড়া অন্য কাউকেই ভালোবাসতেই পারিনা | গানই আমার প্রথম ও শেষ প্রেম | অনেকদিন ধরেই আমি বুঝতে পারছিলাম বিয়ে করে গুছিয়ে সংসার আমার দ্বারা হবে না | আমি গান পাগল মানুষ | গানই আমার জীবনে সব | বলবো ,বলবো করেও কথাগুলি বলতে অনেক দেরী করে ফেললাম | তারজন্য আমাকে ক্ষমা কোরো | নাও - অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে | প্রচুর গোজগাছ   বাকী | তুমি এবার বেড়িয়ে পর |"    প্রেমে প্রত্যাখ্যাত ,অপমান ,লজ্জা ,আবেগ - সব কিছু মিলেমিশে রাহুল বাকরুদ্ধ | কিছুক্ষন পরে রাহুল খেয়াল করে মমি ঘরে নেই | এত বড় অপমান ! কি করে করলো মমি ? এইতো সেদিন দু'জনে মিলে কত প্লান করলো তাদের নুতন জীবন নিয়ে | কোথায় হানিমুনে যাবে তাও পর্যন্ত ঠিক করে ফেললো দু'জনে| কত স্বপ্ন দু'জনের অন্তর জুড়ে | মমির ভিতর সে স্বপ্নের কোনো কৃপণতা কখনোই রাহুলের চোখে পড়েনি | প্রায় ত্রিশ মিনিট রাহুল একা ঘরে বসে | মমি ফিরছে না দেখে রাহুলের নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগলো | সে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো | মাসিমাদের ঘরের কাছে এসে বুঝতে পারলো এবার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ | কি ঘটে গেলো কিছুই বুঝতে পারলো না সে | শুধু আশাহত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এলো | কিন্তু কেন জানি তার মনে হতে লাগলো ,মমি যা বলছে তা ঠিক নয় | এটা কিছুতেই সত্যি হতে পারেনা | ও মিথ্যা বলছে সব | সারারাত ছটফট করতে করতে ভোর হতেই সে বেড়িয়ে পড়লো মমিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে | সেখানে পৌঁছে সে অবাক হয়ে গেলো | মমিদের বাড়িতে বাইরে থেকে তালাবন্ধ | কিন্তু কেন ? কোথায় গেলো সবাই  ? আশেপাশে জিজ্ঞাসা করেও কোনো সদুত্তর সে পেলোনা | সব কিছুই রহস্যের আবরণে ঢাকা পরে থাকলো | মন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও মমির প্রতি কোনো খারাপ ধারণা তার আসছে না | কিন্তু কি এমন হলো যা মমি তাকে জানাতে পারলোনা !অফিস ,বাড়ি আর মমির এই অসংলগ্ন কথাবার্তা সব মিলেমিশে একাকী জীবনে রাহুল উদভ্রান্তের মতো হয়ে গেলো | কোনো বন্ধুবান্ধব ,আত্মীয়স্বজন কেউই মমিদের কোনো খবর রাহুলকে দিতে পারলোনা |

এইভাবে প্রায় ছ'মাস কেটে গেলো | হঠ্যাৎ একদিন অফিসে এক বন্ধুর ফোন ; বন্ধুটি তাকে জানালো আজকের খবরের কাগজটা যেন সে দেখে | " কেন কি আছে কাগজে ?" "তুই দেখ ,আমি পরে তোকে ফোন করছি |" বলেই ফোনটা কেটে দিলো | রাহুল খেয়াল করেছে আজ অফিসে আসার পর থেকে সকলে তার আঁড়ালে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে | পেপারটা চাওয়াতে একজন অনিচ্ছা সমেত তার হাতে পেপারটা ধরিয়ে দিলো | রাহুল কাগজটা ধরেই প্রথম পৃষ্টায় খবরটা দেখে চমকে ওঠে | "বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী মনামী মজুমদার দীর্ঘ ছমাস রোগভোগের পর মুম্বাই ক্যান্সার হাসপাতালে আজ ভোর চারটে নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন |"বিস্তারিত পড়বার ক্ষমতা রাহুলের আর থাকে না | চশমার কাঁচ চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় | আর পরিষ্কার হয়ে যায় মমির ছমাস আগের অসংলগ্ন কথাবার্তা | সব পুরানো স্মৃতি আবার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে | কিন্তু মমি এটা কি করলো ? এই ছ'টা মাস তো একসাথেই আমরা থাকতে পারতাম ! সেই হারানোর কষ্টটা তো আমাকে পেতেই হলো | এত বড় সঙ্গীত শিল্পী তুমি ,তোমার মৃত্যুতে শুধু আমি কেনো -সারাদেশ জানবে এটা তুমি একবারও ভাবলেনা ? তুমি কি ভেবেছিলে মমি ? আমাকে আঘাত করলে ,অপমান করলেই আমি তোমাকে ভুলে যাবো ? তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হবো ? আমার সমস্ত মন ,প্রাণ জুড়ে একটাই নাম -'মমি' ; যাকে ছাড়া আমার কল্পনার জগতও অন্ধকার | আমার ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে না পেরে দীর্ঘ ছ'মাস আমার কাছ থেকে দূরে থাকলে --আর এখন তো সারা জীবন !! কিন্তু আমি কি পেলাম ?

নন্দা   12.1.15

No comments:

Post a Comment