Monday, November 7, 2016

"বাঁচতে চাই"                 (নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী)                বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে বাদল যেদিন প্রাইমারী স্কুলে যেদিন যোগদান করতে যায় সেদিন মা দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন ,"এবার সুন্দর লক্ষ্মীমন্ত দেখে একটা বৌ আনবো | ব্যস তাহলেই আমার ছুটি |" বাদল মাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলেছিলো ,"তোমায় ছুটি আমি কোনোদিনও দেবো না | তুমি ছুটি নিলে আমায় কে দেখবে ? তোমার আগে যেন আমি ছুটি পাই এই পৃথিবী থেকে |"  সরলাদেবী ছেলেকে বুকের সাথে চেঁপে ধরে বলেছিলেন ,"বালাই ষাট !! একথা আর কখনো মুখে আনবি না বাবা |"             আজ বড্ড মনে পড়ছে মায়ের কথা |সত্যিই মা তো আগেই ছুটি নিয়ে চলে গেলেন সারাজীবের জন্য | হাসপাতালের বেডে শুয়ে বাদল হিসাব কষতে থাকে তার জীবনের পাওয়া না পাওয়া গুলিকে নিয়ে | তার জীবনের আয়ু মাত্র কয়েকমাস | কয়েক মাসই বা কেন ? হয়তো যেকোনো সময়ই সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারে |        গ্রামের অতি সাধারণ সরল ছেলে বাদল | অভাবের সংসার | মা ,বাবা , আর সে | গ্রাজুয়েট হওয়ার পর তাকে বেশিদিন বসে থাকতে হয়নি | গ্রামেরই একটা স্কুলে শিক্ষতায় সে নিযুক্ত হয় | মায়ের জোড়াজুড়িতে চাকরীর দু'মাসের মাথায় সে বিয়েতে মত দেয় | মা নিজে পছন্দ করে তার বাদলের বৌকে বরণ করে ঘরে তোলেন | মীনা খুব সংসারী না হলেও বাদলের   মা যথাসম্ভব চেষ্টা করতেন ঝামেলা যাতে না হয় | তাই তিনি সংসারের কোনো কাজের দায়িত্ব মীনার উপর ছাড়েন না | নিজে হাতে রান্নাবান্না করা , খেতে দেওয়া সব করতেন | বাদলের বাবা ছিলেন অসুস্থ | তারএ্যাজমা ছিলো ;তাই সর্বদায় শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে  কষ্ট পেতেন | বাদলের বিয়ের প্রায় আটমাস বাদে তিনি মারা যান | তখন বাদলের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা | নির্দিষ্ট সময়ে তাদের একটি সুন্দর ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয় | সুখে ,দুঃখে ,অভাব ,অনটনের মধ্য দিয়ে বছর চারেক কেটে যায় বাদলের বিবাহিত জীবন | এরই মাঝে বাদলের মাতৃ বিয়োগ হয় | সে শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হঠ্যাৎ করেই বাদলের শরীরটা খারাপ যেতে থাকে | গ্রামের ডাক্তারের হেফাজতে থেকে দিন পনের বাদেও যখন অবস্থার কোনো  উন্নতি সে দেখতে পায় না , তখন সে শহরে এসে বড় ডাক্তার দেখায় | নানান পরীক্ষা নিরীক্ষায় ধরা পরে বাদলের ব্লাড ক্যান্সার | সে বাড়িতে ফিরে এসে তার বৌ মীনাকে বলে ,"যে ক'কাঠা ধানীজমি আছে তার থেকে দু'কাঠা জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাবো ভাবছি |" শুনেই মীনা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে | সে চিৎকার করে তার স্বামীকে জানিয়ে দেয় ,"যে রোগ কোনোদিনও ভালো হবে না ,তার জন্য ভিটামাটি বিক্রি করে দিলে মেয়েকে নিয়ে তো আমাকে পথে বসতে হবে |" চিরশান্ত বাদল ঝগড়ার ভয়ে একথার কোনো উত্তর দেয় না |          বাদল তার স্কুলে যেয়েসহকর্মীদের তার অসুস্থতার কথা জানায় | স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা মিলে বেশ কয়েক হাজার টাকা চাঁদা তুলে তারা বাদলের হাতে তুলে দেয় | বাদল তার গ্রামের কাউন্সিলারের সহায়তায় কোলকাতার এক কাউন্সিলারের মাধ্যমে কলকাতায় এক সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় | সমস্ত চেষ্টা ,তদ্বির সে ওই অসুস্থ্য শরীর নিয়েই করে | মাঝে মধ্যে কখনো সখনো স্কুলের কোনো সহকর্মী তাকে সঙ্গ দেন | কিন্তু মীনা একবারের জন্যও তার অসুস্থ্যতা সম্পর্কে কোনো খোঁজ নেওয়া বা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় তার সাথে যাওয়া কোনোটাই কখনোই সে করে না | উল্টে সে মেয়েকে বাদলের কাছে আসতে নিষেধ করে দেয়  | মেয়েও মায়ের বকুনি এবং মার খাওয়ার ভয়ে মা থাকতে বাদলের কাছে ঘেঁষতে সাহস পেতো না |                                   হাসপাতালের বেডে শুয়ে নানান সময়ে নানান কথা ভাবতে ভাবতে তার দু'চোখের কোল বেয়ে জল পড়তে থাকে | সেই যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তদ্বির করতে এসে ভর্তি হয়ে সেখানেই থেকে যায় - আজ এক মাসেরও বেশী হতে আসলো মীনা বা তার বাপের বাড়ির কেউই একবারের জন্যও দেখতে আসেনি | এখানে ভর্তি হওয়ার পরেই সে স্কুলে ফোন করে জানিয়েও দিয়েছিলো যাতে তার বাড়িতে খবর দিয়ে দেওয়া হয় ; সে কোন হাসপাতালে ভর্তি আছে | বাদল নিশ্চিত বাড়িতে স্কুল থেকে জানিয়ে গেছে | কিন্তু কেউই আসেনি |                                       মৃত্যু নিশ্চিত জেনে বাদল ভাবে যে কটাদিন বাঁচবে সে তার মেয়ের কাছেই যেয়ে থাকবে | মীনা তাকে না দেখুক অন্তঃত মেয়েকে তো সে সবসময় চোখের সামনে দেখতে পাবে | পালাবে - হাসপাতাল থেকে আজই সে পালাবে |কারণ তার যে শারীরিক অবস্থা তাতেকরে হাসপাতাল থেকে তাকে বাইরে বেড়োতে বা তারা কিছুতেই ছুটি দেবে না | রাত গভীর | সবাই ঘুমে অচেতন | বাদল বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে বাইরে বেড়িয়ে আসে | হাপাতালের গেটের থেকে রাস্তায় বেড়িয়ে কিছুটা হেঁটে এসে সে খুব হাঁফিয়ে যেয়ে একটা ইটের পরে বসে পরে | আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুটতে শুরু করলে সেও উঠে দাঁড়িয়ে একপা ,দু'পা করে বাস রাস্তায় এসে দাঁড়ায় | বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে এগোলেও দুর্বল শরীরে তার মাথার ভিতর ঝিমঝিম করতে থাকে ;মনেহচ্ছে এক্ষুনি বুঝি সে পড়ে  যাবে | হঠ্যাৎ তার নজরে আসে সুন্দর ফুঁটফুঁটে একটি মেয়ে ঠিক যেন তার মেয়ের বয়সী রাস্তার উপর থেকে ছুটে আসছে | সঙ্গে সঙ্গে তার যেন শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায় | মুহূর্তেই ভুলে যায় সে অসুস্থ্য | দৌড়ে যেয়ে মেয়েটাকে বুকে চেঁপে ধরে এপারে এসে বসে হাঁফাতে লাগে | বাচ্চা মেয়েটিও তার বুকের সাথে লেপটে থাকে | খুব সকাল , রাস্তায় বেশী একটা যানচলাচল ও লোকজনও নেই | পথচলতি দু'একজন আঁড়চোখে তাঁকিয়ে দেখে চলে যাচ্ছে | হঠ্যাৎ এক সাহেব এসে বাদলের কাঁধে হাত রেখে তাকে ধন্যবাদ জানান | এবং মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে বাদলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন | বাদলের কাঁপাকাঁপা হাতটি ধরে সাহেব ভদ্রলোক ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় জানতে চাইলেন  ,"তুমি কি অসুস্থ্য ?" বাদল তার অসুস্থ্যতার কথা জানাতেই তিনি তাকে বলেন ,"কোথায় ট্রিটমেন্ট করছো ? তোমার বাড়ি কোথায় ? কে ,কে আছেন তোমার ?"  বাদল কথাগুলির উত্তর দেওয়ার আগেই মাথাটা তার ঘুরে গেলো |সাহেব তাকে খপ করে ধরে ফেললেন | যখন বাদলের জ্ঞান ফেরে সে তখন একটা নার্সিংহোমে সাহেব গলায় স্টেথিস্কোপ ঝুলিয়ে তার নাড়ী দেখেছেন ,অন্য সকল ডক্টরেরা তাকে স্যার বলে সম্মোধন করছেন | বাদল হতভম্বের মত সাহেব ডাক্তারের মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে দেখে সাহেব হেসে পরে বললেন ," কোনো ভয় নেই ,আমি ডক্টর এডওয়ার্ড পিটার ,এমেরিকায় থাকি , তোমার নামটা কি ?" সাহেবের এই অমায়িক ব্যবহারে বাদলের দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো | বাদল সাহেবকে  তার নাম বলার পর তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বাদলকে যা বললেন তার সারমর্ম কললে দাঁড়ায় - প্রতিবছর তিনি কলকাতায় আসেন কারণ এখানে তার শ্বশুরবাড়ি | এই নার্সিংহোমের মালিক তার শ্বশুর ধনঞ্জয় ব্যানার্জীর | সাহেব ও তার স্ত্রী দু"জনেই ক্যান্সার স্পেশালিস্ট | কিন্তু বাদলের এখন যা শারীরিক অবস্থা তা এখানে থেকে ট্রিটমেন্ট করা সম্ভব নয় | বাদল তার একমাত্র মেয়েকে বাঁচিয়ে তাকে ঋণী করেছে | ঈশ্বর তাকে অনেক দিয়েছেন | মানব সেবায় তিনি তার জীবনের মূলমন্ত্র বলে মনে করেন | যদি বাদল তাকে একটা সুযোগ দেয় ,তাহলে তাকে সাথে করে এমেরিকায় নিয়ে যেয়ে তার চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে তিনি রাজি আছেন | কারণ এখনো ঠিকভাবে চিকিৎসা করাতে পারলে সে আরও কয়েকবছর বেঁচে যেতে পারে |   জীবনের শেষ সূর্যাস্তযখন দোরগোড়ায় উপস্থিত তখন অকস্যাৎ নুতন করে সূর্য্য উদয়ের সম্ভাবনাকে সে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে তাকে চোখের জলে সানন্দে গ্রহণ করলো | তার মনেহলো যেন স্বয়ং ভগবান তার সামনে উপস্থিত |   বাদল পাড়ি দিলো আমেরিকায় ডক্টর পিটার ,তার স্ত্রী ও তার একমাত্র কন্যার সাথে | দীর্ঘ তিন বছর ডক্টর পিটার ও তার স্ত্রীর তত্বাবধানে থেকে বাদল নুতন করে বাঁচার দিশা পেলো | এই তিন বছরে ডক্টর পিটারের বাঙালি ব্রাহ্মণ ডক্টর স্ত্রী মধুরিমা বাদলকে ভায়ের আসনে বসিয়ে দিদির মতই তার সমস্ত দুঃখ ,কষ্টগুলি জেনে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে সেগুলিকে ভুলিয়ে রাখার | বাদলও অনেকদিন পর মায়ের জায়গায় কাউকে বসাতে পেরে নিজের জীবনের সমস্ত কষ্টগুলি উজাড় করে বলতে পেরেছে | যন্ত্রনাদায়ক ঘটনাগুলি ভুলে যেতে না পারলেও দিদির সামনে ভুলে থাকার অভিনয় সে করে গেছে | যাতে দিদি তার ভায়ের জন্য কষ্ট না পায় | ছোট্ট লিজা তার আঙ্কেলকে খুব ভালোবাসে | ধীরেধীরে বাদল অনেকটাই সুস্থ্য হয়ে উঠে | দেশে যখন সে আসতে চাইলো ডক্টর পিটার তাকে জানালেন , তাঁরা যখন কলকাতায় আসবেন তখন বাদলকে সঙ্গে নিয়েই আসবেন | কিন্তু বাদলকে কথা দিতে হবে আবার তাঁরা যখন ফিরবেন তখন তাকেও ফিরতে হবে কারণ এই রোগের চিকিৎসা বন্ধ করা যাবে না এবং এটা খুবই ব্যয়বহুল | প্রয়োজনে সে তার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে তাদের সাথে ফিরতে পারে ,তিনি বাদলের জন্য রোজগারের কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবেন | ডক্টর পিটারকে যত দেখে বাদল তত যেন তার মনেহয় উনি মানুষরূপী ভগবান | পূর্বজন্মে কোনো পূর্ণের ফলে তার মতো মানুষের সাথে তার দেখা হয়েছে |বলা বাহুল্য এই তিনবছরে পিটার ফ্যামিলি মাত্র একবার কলকাতায় এসেছিলেন |

নুতন করে বাঁচার আশা নিয়ে বাদল যখন তার গ্রামে পা রাখলো ;সকলেই যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠে | তাদের ছোট খাটো কথার জবাব দিয়ে বাদল তার নিজের বাড়িতে পা রাখলো | কিন্তু একি ?বাড়ির চেহারা তো পুরোটাই পাল্টে গেছে | দারিদ্রের ছাপ কোথাও তো নেই ! হঠ্যাৎ চোখে পরে নিজের আট বছরের মেয়েকে | ইশারা করে কাছে ডাকে | কিছুটা সময় নিলেও বন্যা বাবাকে ঠিক চিনতে পারে | মেয়ের কাছেই সে জানতে পারে একজন কাকু তাদের সাথে থাকেন ,যাকে মা বহুবার বাবা ডাকতে  বলেছেন ,কিন্তু সেতো জানে এটা তার বাবা না - তাই সে তাকে কাকু বলেই ডাকে | কিন্তু স্কুলে বন্ধুরা মাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করে |

সিদ্ধান্ত নিতে বাদলের মুহূর্ত সময় লাগলো না | সে তার মেয়ে বন্যাকে বললো ," তুই আমার সাথে যাবি মা ?"
"কোথায় যাবে বাবা -তুমি আমায় নিয়ে ?"
বাদল আকাশের দিকে তাঁকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে একটা আঙ্গুল আকাশের দিকে তুলে বললো ,"ওই আকাশ পথে অনেক দূরে ....যেখানে আমি আর তুই থাকবো |"

নুতন করে বাঁচার স্বপ্ন  নিয়ে নিজের মেয়েকে সকলের অলক্ষে বলতে গেলে তাকে চুরি করে নিয়ে পিছন ফিরে আর না তাঁকিয়ে নুতন ঠিকানার উর্দ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো |

বি: দ্রঃ - একজনের অনুরোধে আমার এই গল্পটি লেখা | জানিনা আমার সেই ফেসবুক ভায়ের ভালো লাগবে কিনা | আমি বাদলকে মেরে ফেলতে পারিনি ; কারণ আমি চাই কাকতালীয়ভাবে হলেও আমার সেই ভাইটি সুস্থ্য হয়ে যাক | তোমরা সকলে তাকে আশীর্বাদ কোরো |
নন্দা  2.11.16  9-40pm.

No comments:

Post a Comment