-- তোমাকে এসব কিছু খেতে হবে না।ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসো। আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি। বাপ,ছেলে দু'জনের কেউই মাথামুন্ডু কিছু না বুঝে চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলেন।
সকলের খাওয়া শেষে সৌম্যর মা বিপাশা একগ্লাস দুধ নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলেন দীপিকা চোখ বন্ধ করে আছে আর তার চোখ থেকে সমানে জল পড়ে যাচ্ছে। পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-- এবার আমায় সব খুলে বলো। তার আগে তুমি এই দুধটুকু খেয়ে নাও।
দীপিকা গ্লাসটা হাতে ধরে সামান্য দুধ খেয়ে বললো,
-- আর খাবো না।বমি হয়ে যাবে।
আবার বিপাশা সস্নেহে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
-- এ সময় অনেকের বমি হয়
-- আপনি কী করে বুঝলেন?
-- আমিও তো একজন মা। বুঝবো না ? এবার আমাকে আস্তে আস্তে সব বলো। আগে বলো তোমার নামটা কী?
-- দীপিকা।দীপিকা মুখার্জী। আমার বাবা একজন উকিল। আমার এক দাদা আছে। সে চাকরি নিয়ে বর্তমানে দেশের বাইরে। হঠাৎ করেই চাকরি পেয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে।আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিলো। তাকে আমি ভালবাসতাম। যেহেতু বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাই মেলামেশায় আমাদের কোন বাঁধা ছিল না। এইভাবেই আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ি। কিন্তু আমি যাকে ভালোবাসি সেই ছেলেটি অর্থাৎ সুজয় এই বাচ্চা আমায় রাখতে দেবে না। এখনো বিয়ের বেশ কয়েকমাস বাকি। এই বাচ্চা রাখলে নাকি তার পরিবার সকলের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না।
-- বোঝো কান্ড! ছেলেটি কী করে?
-- ইঞ্জিনিয়ার। সবে চাকরি পেয়েছে। বাবা,মাকে আমি একথা বলতে পারিনি। কারণ আমি ভালোবাসি বলেই বাবা,মা বিয়েতে মত দিয়েছিলেন। এখন কী করে একথা তাদের জানাবো?
-- তাহলে কী করবে এখন?
-- আমি যদি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকি আমার সন্তানও বাঁচবে। আর আমি ম*রে গেলে সে তো আমার সাথেই চলে যাবে। তাই গাড়ির সামনে ম*রতেই গেছিলাম। আমি বেঁচে থাকলে আমার সন্তানও বেঁচে থাকবে। কারণ সারা জীবন ধরে এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না যে আমি আমার সন্তানকে মে*রে ফেলেছি। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি।
-- কিন্তু এখন কী করবে?
-- জানিনা। আপনারা যদি আমায় একটু আশ্রয় দেন বাচ্চাটা হওয়া পর্যন্ত তারপর আমি অন্য কোথাও চলে যাবো।
-- কোথায় যাবে ? কার কাছে যেতে চাও? কতদূর পড়াশুনা করেছো?
-- কোথায় যাবো জানি না। তবে আমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি।
-- ঠিক আছে। আমি দেখছি। সৌম্যর বাবাকে বলে তার অফিসে তোমার কোন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। তবে একটা কথা দাও আমাকে আর কখনো তুমি ম*রে যাওয়ার কথা মনেও আনবে না।
দীপিকা বিপাশাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। তিনি গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-- চলো তুমি কোথায় শোবে দেখিয়ে দিই। একটা কথা সব সময় জেনো পৃথিবীতে যার কেউ নেই তার ভগবান আছেন। আর তার ইশারা ছাড়া কোন কাজ ঘটে না। তোমার সন্তান পৃথিবীতে আসবে। তার কারণ কী জানো? এইজন্যই আমার সৌম্যর সাথে তোমার দেখা হয়েছে। নিজের ছেলে বলে বলছি না আজকের যুগে এরূপ ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।কিন্তু তবুও মুহূর্তের জন্য হলেও তুমি খেতে বসে ওয়াসরুমে ঢুকলে আমার মনের মাঝে এক সন্দেহের দানা বেঁধেছিলো।
সৌম্যর মায়ের চেষ্টায় দীপিকা তাদের অফিসের এক দায়িত্ব পেলো। কিন্তু কাজ করবে বাড়িতেই ল্যাপটপে। এটাও সৌম্যর মায়ের ইচ্ছানুসারে। কোন কাজ না করে মেয়েটা বাড়িতে খামোখা বসে থাকলে উল্টোপাল্টা চিন্তায় তার সন্তানের ক্ষতি হবে মনেকরে তিনিই এই উপায় ঠিক করেন। একথা সত্যি দীপিকার মত একটি মেয়ে নয় এরূপ অনেককেই বসিয়ে খাওয়ানোর মত ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু দীপিকার মন ভালো রাখতে এই ব্যবস্থা। কিছু মাসোহারারও ব্যবস্থা করলেন।তবে দীপিকা কখনোই সেটা নিতো না।তিনি দীপিকা যে ঘরটাতে থাকে সেই ঘরের একটি আলমারিতে রেখে দিতেন প্রতি মাসে।
বিপাশা তাকে বহুবার বলেছেন তার বাড়ির ঠিকানা দেওয়ার কথা।তারা নিজেরা গিয়ে কথা বলবেন দীপিকাকে যেতে হবে না। কিন্তু দীপিকা রাজি হয়নি। সৌম্যর সাথে দীপিকার দেখা হয় না বললেই চলে। দীপিকা সব সময় তার নির্দিষ্ট ঘরটিতেই তার কাজ নিয়ে থাকে। সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে কোনদিন দেখা হয় আবার কোনদিন বা দেখা হয় না। কিন্তু কথা কখনোই হয় না। তার খাবারদাবার ,ডাক্তার দেখানো সবই বিপাশার আন্ডারে। সৌম্যর বাবা এই অযাচিত ঘটনায় মোটেই খুশি নন। কিন্তু দীপিকার এই অবস্থায় তিনি মুখেও কিছু বলছেন না। তবে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মেয়েটির জন্য অন্য কোথাও সে যাতে কিছু করতে পারে। যদিও তিনি তার সৌম্যকে চেনেন তবুও তার মনের ভিতরে একটা ভয় কাজ করে। তাই দীপিকার জন্য কলকাতার বাইরে ভালো কোন বন্দোবস্ত করতে পারেন কিনা তারজন্য তিনি অবিরত চেষ্টার কসুর করছেন না।তবে সবই বিপাশা,সৌম্যর অগোচরে। তিনি ভালোভাবেই জানেন তার গিন্নী বাচ্চা ডেলিভারির পর একটু বড় না হলে তাকে কিছুতেই ছাড়বেন না।
দেখতে দেখতে দীপিকার ডেলিভারির সময় চলে আসলো। একদিন অনেক রাতে সৌম্য মায়ের সাথে নিজেই ড্রাইভ করে তাকে নিয়ে নির্দিষ্ট নার্সিংহোমে ভর্তি করলো। একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো দীপিকা। হাসপাতালের রেকর্ড বুকে পিতার জায়গায় সে সুজয়ের নামটাই রাখলো। কিন্তু ঠিকানা দিলো সৌম্যদের বাড়ির।
বিপাশার একমাত্র সন্তান সৌম্য। কিন্তু সে কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না। তাই দীপিকার এই সন্তানকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতে শুরু করলেন।কিন্তু সৌম্যর বাবা বিমান এর মধ্যেই কলকাতার বাইরে দীপিকার জন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করে ফেললেন মোটা অঙ্কের এক ডোনেশনের মাধ্যমে। এখন মাঝে মধ্যে দিশার ইনজেকশন এবং নানান কারণে শরীর খারাপের জন্য সৌম্যকে যেতে হয় তার সাথে। কারণ বিপাশা পায়ে চোট পেয়ে বেশ কিছুদিন কাহিল হয়ে আছেন। ওই ঘরের মধ্যেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যেটুকু চলতে পারেন তাই চলছেন।
দেখতে দেখতে বেশ কয়েকমাস কেটে গেলো। প্রসাদ এনে দিশার মুখে ভাতও হল। এবার বিমান তার মনের কথাটা বিপাশাকে জানালে তিনি বললেন,
-- তোমার যা ক্ষমতা তাতে মেয়েটিকে তার বাচ্চা সমেত এখানে রাখতে কোন অসুবিধা হত না। কিন্তু তুমি মুখে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারি মেয়েটির এখানে থাকা তোমার মোটেই পছন্দ নয়। তুমি যেমন এই পর্যন্ত ওর সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছো আমিও তোমার সিদ্বান্তকে মেনে নেবো। তবে এত ছোট বাচ্চা নিয়ে দীপিকা ওই পাহাড়ে গিয়ে একাএকা হিমসিম খাবে। তাই বলি কী বাচ্চাটা আর একটু বড় হোক। তখন নাহয় ওকে সেখানে পাঠিয়ে দিও। তুমি সেইভাবেই ওখানে কথা বলে নাও।
বিমান তার গিন্নীর কথামত তাদের কাছে আরও কিছুটা সময় চেয়ে নিলেন। তবে একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন যে বিপাশা মেয়েটিকে অন্যত্র পাঠাতে আপত্তি করবেন না।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment