পরের মাসে নিলয় ও তিয়াসা বেরিয়ে পড়লো গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। স্টেশনে পৌঁছে নিলয়ের মনে পড়লো যাহ সেতো আইডি কার্ডটাই আনতে ভুলে গেছে। দু'জনের তখন মাথায় হাত।শেষমেস নিলয় তিয়াসাকে বললো,
-- তুমি এক কাজ করো তুমি এই গাড়িতেই চলে যাও। ভোরবেলা শিলিগুড়ি স্টেশনে নেমে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি বাড়ি থেকে আইডি কার্ড নিয়ে লোকাল ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি পৌঁছাবো দশ থেকে পনের মিনিটের ব্যবধানে।
তিয়াসা অবাক হয়ে নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- বেশ ভালো বললে তো! এটা বেশ ভালো হানিমুন হচ্ছে!
-- এ ছাড়া আর কী উপায় আছে?
-- আরে আমরা দু'জনেই ফিরে যাই। তারপর একসাথেই কাল আবার রওনা দেবো।
-- রিজার্ভেশন পাবো না। তোমার খুব কষ্ট হবে।অতশত ভেবো না। আইডি কার্ড ছাড়া আমাদের ঘোরা সম্পূর্ণ হবে না। যেখানে সেখানে ঢুকতে বাঁধা দেবে। আরে আমি তো তোমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাবো। শুধু রাতটা। কোন অসুবিধা হবে না। তুমি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়েই রাত কাটিয়ে দেবে।আর অমত কোরো না সোনা।
অগত্যা তিয়াসা চুপ করে গেলো। তিয়াসার সিট দেখিয়ে তড়িঘড়ি নিলয় গাড়ি থেকে নেমে গেলো প্রয়োজনীয় কথা সেরে। দশ পনের মিনিট পরে এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী, ও বছর দুয়েকের কন্যা সহ গাড়িতে উঠে তিয়াসার ঠিক সামনের সিটে বসলেন। তিয়াসা আনমনা ভাবেই গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সামনে বসা ভদ্রলোক তিয়াসাকে দেখে বলল,
--- আরে তিয়াসা না? একা নাকি? কোথায় চললি? মুখটা বাংলার পাঁচের মত করে রেখেছিস কেন?
তিয়াসা তাকিয়ে দেখে সৌম্য। সৌম্য এখন এতটাই মোটা হয়ে গেছে তিয়াসা তাকে দেখে চিনতেই পারেনি।
-- আরে তুই তো মধ্য বয়সে চলে গেছিস মোটা হয়ে।আমি তো তোকে চিনতেই পারিনি।
পাশে বসা সৌম্যর থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট মহিলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,
-- তোর বউ? পরিচয় করিয়ে দে। কবে বিয়ে করলি?
মেয়েটির দিকে ফিরে তাকিয়ে সৌম্য বললো,
-- দীপিকা, এ হচ্ছে আমার কলেজ ক্লাসমেট।অনেকদিন পরে দেখা।
দীপিকা হাত জোড় করে নমস্কার করে মেয়ের চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-- আমার মেয়ে দিশা।
সৌম্য তিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো,
-- এই তোর সঙ্গী কোথায়?
-- আর বলিস না। একটা পাগল জুটেছে কপালে।
সৌম্য হা করে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে নিলয়ের আইডি কার্ড না আনা তারপর কী ঘটলো সব সবিস্তারে বলতে লাগলো। তিয়াসা প্রচণ্ড হাসছে কথা শেষ করে। সে হাসিতে দীপিকা আর সৌম্যও যোগ দিলো। কিন্তু এ হাসির মধ্যে যে সৌম্যর এক বেদনা লুকিয়ে আছে তা পাশে বসে থাকা দীপিকা কিংবা তিয়াসা কেউই টের পেলো না।
তিয়াসাকে ভালোবেসে বলতে না পারার কষ্টটা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে সে। বাবার অঢেল টাকা,সম্পত্তির মালিক হয়েও জীবনে মনের মত একটি সঙ্গিনী সে আজও খুঁজে পায়নি। পরিচিত,অপরিচিত যারাই দীপিকা আর দিশাকে তার সঙ্গে দেখে সকলেই তার স্ত্রী বলে ভুল করে। সেও সত্যিটা মুখ ফুটে আজও কাউকে বলতে পারেনি। এই বিষয়টা নিয়ে সে খুব একটা ভাবেও না। কিন্তু আজ তার প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে দেখতে পেয়ে জমাট বাঁধা কষ্টগুলো যেন বুকের ভিতর তোলপাড় করছে।
দীপিকা আর দীপ্ত দুই ভাইবোন। দীপিকা ভালোবাসে পাড়ারই একটি ছেলেকে। এই দীপ্ত আবার নিলয়ের বন্ধু। দুই পরিবার থেকেই বিয়েতে রাজি ছিলো। সুজয় তখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাইনাল সেমিস্টার দিয়েছে। একদিন সুজয় দীপিকাকে ফোন করে। ফোনটা তখন ঘরেই ছিল কিন্তু দীপিকা এদিকওদিক থাকার ফলে ফোনটা রিসিভ করতে পারে না। তার বাবা অনিমেশ মুখার্জী বারবার ফোনটা বাজছে দেখে রিসিভ করেন। সুজয় দীপিকা ভেবেই কথা বলতে শুরু করে।
-- এই জানো আমি না কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই চাকরি পেয়ে গেছি। রেজাল্ট বেরোলেই জয়েন করবো। তারপর আমার বাবা,মা তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন।
অপর প্রান্ত থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সুজয় তখন বলে,
-- কথা বলছো না কেন? আর তো মাত্র কটাদিন। তারপরেই তুমি সম্পূর্ণভাবে আমার। এই কিছু বলবে তো?
এবার দীপিকার বাবা বলেন,
-- আমি দীপার বাবা বলছি। তুমি কে বলছো বলো তো?
সুজয়ের তখন মাথায় হাত! আমতা আমতা করে তার পরিচয়টা দিলো। তারপর অনিমেশ বললেন,
-- তুমি যখন চাকরি পেয়েই গেছো আর পাড়ারই চেনা পরিচিতির মধ্যে। দীপাও তোমায় ভালোবাসে।তাহলে মেয়ের বাবা,মা হয়ে না হয় আমরাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তোমাদের বাড়ি যাবো। তুমি চাকরির খবর দিয়ে দীপাকে খুশি করতে চেয়েছিলে আর আমি তোমাদের বিয়ের পাকা কথা বলতে যাবো বলে তোমায় খুশি করলাম। কি খুশি তো?
সুজয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে কী উত্তর দেবে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু বললো
-- মেসোমশাই আমার প্রণাম নেবেন। বলেই ফোনটা কেটে দিলো।
দীপিকার বাবা তার স্ত্রীকে ডেকে সব জানালেন। তিনিও সুজয়কে চেনেন। আর তাদের মেয়ে যখন তাকে ভালোবাসে, ভালো চাকরিও পেয়েছে সুতরাং তিনিও এই প্রস্তাবে ভীষণ খুশি। এরপর তারা মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ মজা করলেন। মেয়েকে ডেকে বললেন,
-- সুজয় ফোন করেছিলো। বারবার ফোনটা বাজছিল দেখে আমিই ফোনটা ধরেছিলাম। কারণ ওখানে জাস্ট 'এস ' বলে সেভ করা ছিল। সুজয়কে তুমি চেনো? ছেলেটিই বললো ওর নাম সুজয়।
দীপিকা তখন রীতিমত কাঁপতে কাঁপতে বললো,
-- বাবা,আমাদের পাড়ার ছেলে।
-- হু সেটাও বলেছে ও। কিন্তু আমি জানতে চাইছি ওর সাথে তোমার সম্পর্কটা কী?
দীপিকা বুঝতে পারে ধরা যখন পরেই গেছে আর লুকিয়ে কোন লাভ নেই। যা হবার হবে। তাই সে মাথা নিচু করে বাবাকে বললো,
-- ওকে আমি ভালোবাসি। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফাইনাল সেমিস্টার হয়ে গেছে। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে তিনজন চাকরির জন্য সিলেক্ট হয়েছে।তারমধ্যে ও একজন। হয়ত চাকরিটা হয়ে যাবে। বেশ বড় চাকরি। বছরে তিনমাস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য যেতে হবে। বাকি ন'মাস কলকাতাতেই থাকতে পারবে।
-- চাকরিটা ও পেয়ে গেছে। সেটাই খবর দিতে তোমায় ফোন করেছিলো।
তারপর হেসে পরে মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
-- একটু পরীক্ষা করছিলাম তোমায়। দেখলাম না তোমার সৎ সাহস আছে। এই বিয়েতে আমাদের কোন অমত নেই। দীপ্ত বাড়ি আসলে আমরা সবাই মিলে ঠিক করবো কবে সুজয়দের বাড়িতে যাবো।
দীপিকা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।অনিমেশ হো হো করে হাসতে শুরু করেছেন ততক্ষনে। আর দীপিকার মা বললেন
-- দম ছাড়লাম এখন।আমার মনে হচ্ছিলো আদালতে কোন কেস চলছে।
বলে তিনিও হাসতে শুরু করে দিলেন।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment