দেখতে দেখতে শ্রাবণীর এক্সাম শেষ হয়ে গেলো। আর ঠিক তার দু'দিন পরেই অসিতের জন্মদিন। বেশ কয়েক বছর বাদে অসিত এবার জন্মদিনে বাড়িতে। অঞ্জলী আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছেন। স্নান, পুজো সেরে রান্নাঘরে। ছেলের পছন্দ মত বাজার হয়েছে। আজ আবার অরুণাভকে ব্যবসার প্রয়োজনে বেরোতেই হবে। অসিত যে তার জন্মদিন উপলক্ষে ছুটি নিয়েছে মা,বাবাকে সে কথা জানায়নি। সে ঘুম থেকে উঠে নিচুতে চা খেতে চলে আসে। শ্রাবণীও মায়ের সাথে রান্নাঘরে। লতিকা তো আছেই। শ্রাবণীও জেনে গেছে আজ অসিতের জন্মদিন। সেও মায়ের সাথে টুকটাক কাজ করে চলেছে। অঞ্জলী চা নিয়ে কুহুকে বললেন,
-- চল, চা টা দিয়ে আসি। উইশ করেছিস অতুকে?
--তুমি যাও আমি আসছি। না উইশ করা হয়নি করবো।
শ্রাবণী বুঝতে পারছে অসিত একটু একটু করে তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে অন্তত তার কার্যকলাপে এটাই তার মনেহচ্ছে। কিন্তু সে কিছুতেই আর নতুন কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না। এখনো সে নিলয়কে ভুলতে পারেনি। আর তাছাড়া যে মানুষটা প্রতি মুহূর্তে তাকে অবিশ্বাস করেছে,অপমান করেছে তাকে ক্ষমা করা গেলেও ভালোবাসা যায় না। তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা হারিয়েও আজও সে বুকের মাঝে তাকে সযত্নেই লালন করে চলেছে।
অঞ্জলী চা নিয়ে ছেলের কাছে এসে বললেন,
-- শুভ জন্মদিন অতু।খুব ভালো থাকিস।
অসিত মাকে প্রণাম করে বলে,
-- মা,বাবা কি আজ বেড়িয়েছেন?
-- হ্যাঁ ব্যবসার কী প্রয়োজনে তাকে আজ বেরোতেই হয়েছে।হ্যাঁরে তোর আজ অফিসে না গেলে হবে না?
-- আমি তো আজ অফিসে যাবো না মা। আজ তো আমি ছুটি নিয়েছি।
-- তাহলে একটু তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিস। আমি বারোটার ভিতর তোকে আশীর্বাদ করবো।
-- ঠিক আছে মাতাজী।আমি ঠিক সময়ে হাজির হয়ে যাবো। সকালে কী খাবো মা?
-- তুই বল? যা বলবি করে দেবো
-- নুডুলস করো সেদিনের মত করে
-- কুহুকে তো বললাম এখানে আসতে। সেদিন নুডলসটা ওই বানিয়েছিলো। দেখি আজ বলে দেখি ।
অসিত কোন উত্তর দেয় না। চা শেষ করে পেপারটা নিয়ে বসে। বেশ কিছুক্ষন বসে পেপার পড়া শেষ করে অনেকদিন পর ছোট ফুলের বাগানটিতে গিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। আগে এই বাগানে সে রোজই আসতো। কিন্তু এবার বাড়িতে ফিরে বেশি আসা আর হয়ে ওঠেনি নানান মন খারাপের কারণে। আজ বাগানে ঢুকে নানান ধরনের নতুন ফুলগাছ আর তাতে ফুল ফোটা দেখে মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেলো। মালীদাদা তাকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলেন
-- শুভ জন্মদিন দাদাবাবু।
--- তুমিও জানো আজ আমার জন্মদিন।
-- কেন জানবো না। দিদিমণি আজ আমাদের সকলকে দুপুরে খেতে বলে গেছেন। অবশ্য মা'ই বলে পাঠিয়েছেন দিদিমণিকে দিয়ে।
-- আচ্ছা মালীদাদা, এই নতুন নতুন ফুলগাছগুলো কবে লাগালে?
-- বেশিদিন হয়নি গো দাদাবাবু। দিদিমণি সুযোগ পেলেই গাছ কিনে নিয়ে এসে নিজের হাতে লাগায়। আমাকে লাগাতে দেয় না। বলে 'যখন মা একদম সুস্থ হয়ে যাবেন তখন তো আমি আর এখানে থাকবো না,এই গাছগুলো দেখলে তোমাদের আমার কথা মনে পড়বে।'
-- মা সুস্থ হয়ে গেলে উনি কোথায় যাবেন কিছু বলেছেন?
-- না, তা বলেননি আমিও আর জিজ্ঞাসা করিনি।
-- দাদাবাবু, দিদিমণি মানুষটা ভীষণ ভালো। ও আসাতেই কিন্তু বৌদিমনি সুস্থ হয়েছেন। ভীষণ খেয়াল রাখেন বাড়ির সকলের। এই তো আমার সেদিন কাশতে কাশতে বুকে ব্যথা হয়ে গেছিলো। দিদিমণি কী একটা ওষুধ এনে দিলো দু'বার খেয়েই আমার কাশি কমে গেলো।
অসিত কোন কথার উত্তর না দিয়ে নিজের মনেই ভাবে 'তোমার আর কোথাও যাওয়া হবে না শ্রাবণী। তোমাকে সারাজীবনের জন্য আমি এখানে আটকে রাখবো।'
অসিত ঘরে এসে দেখে অলরেডি তার নুডুলস রেডি টেবিলে। শ্রাবণীও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু অসিত আসার সঙ্গে সঙ্গে সে রান্নাঘরের দিকে যেতে শুরু করলে অঞ্জলী তাকে বলেন,
-- কুহু তুইও খাবি আয়।
-- আমি তোমার সাথে খাবো মা
-- কিন্তু আমি তো অতুকে আশীর্বাদ করে তবে আজ খাবো।
-- আমিও ওই সময় খাবো।
অসিত বুঝতে পারে প্রতিটা মুহূর্তে শ্রাবণী তাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর। কিন্তু কোন কথা না বলে একাই খেয়ে উপরে চলে যায়।
কখনো কখনো অসিতের মনেহয় মা এখন পুরোই সুস্থ। তিনি বুঝতে পেরেছেন দিদি আর সত্যিই নেই। কিন্তু।কাওকে ধরা দেন না। তবে এটাও সত্যি শ্রাবণী না আসলে মাকে কিছুতেই সুস্থ করা যেত না। তারজন্য শ্রাবণীর কাছে বাড়ির সকলেই কৃতজ্ঞ। খামোখা শ্রাবণীর সাথে দুর্ব্যবহার করা উচিত হয়নি। এখন নিজের কাছে নিজেই অনুতপ্ত অসিত!
স্নান সেরে অসিত তার আলমারি থেকে শ্রাবণীর পছন্দ করে কিনে আনা শার্টটা পরে নিচুতে নামে। ইতিমধ্যে অঞ্জলীও তার আলমারি থেকে শ্রাবণীকে দিয়ে অনলাইনে কিনে আনা পাঞ্জাবী পায়জামা বের করে রাখেন অতু স্নান সেরে নিচুতে আসলে তাকে দেবেন বলে। কিন্তু অসিতকে ওই জামাটা পরা দেখে ভীষণ খুশি হন।
-- জামাটা তোকে খুব মানিয়েছে বাবা। কুহুর পছন্দ আছে। আমিও তোর জন্য অনলাইনে ড্রেস এনেছি। সেটাও কুহুই পছন্দ করেছে। এটা বিকেলে পরিস।
শ্রাবণী এসে ঘরের মেঝেতে আসন পেতে, প্রদীপ জ্বালিয়ে, ধান দূর্বা,পায়েস,মিষ্টি সবকিছু গুছিয়ে দিলো। এই সময়ে অঞ্জলী তার নিজের ঘরে কাপড় পরতে গিয়েছিলেন। অসিত শ্রাবণীর সব কাজ মনোযোগ সহকারে দেখছিল। তারপর খুব আস্তে তাকে বললো,
-- তুমি আমাকে উইশ করলে না? আমায় কোন গিফট দেবে না তুমি?
শ্রাবণী অসিতের দিকে এতক্ষণে তাকিয়ে দেখে সে তার পছন্দ করা জামার সাথে একটা নীল জিন্স পরেছে। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। সেও খুব আস্তে বলে,
-- একজন আশ্রিতার কাছ থেকে উইশ পেতে চাইছেন? ওকে,শুভ জন্মদিন। আর আমি আপনাকে কী গিফট করবো আমি নিজেই তো আপনাদের দয়ায় বেঁচে আছি।
--- সব সময় এইসব কথা কেন বলো? পায়ে পা লাগিয়ে আমার সাথে ঝগড়া না করলে তোমার ভালো লাগে না?আমার ভুল আমি স্বীকার করেছি কিন্তু তুমি আমায় ক্ষমা করনি ।
-- আমি ক্ষমা করা না করার কে? ছাড়ুন এসব কথা। আজ আপনার জন্মদিন আজ আর কথা বাড়াবেন না। দিনটা আপনার ভালো কাটুক।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment