অসিত খেয়ে অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর অঞ্জলী শ্রাবণীকে ডেকে বললেন,
-- কুহু আজ একটু তাড়াতাড়ি স্নান করে নিবি। তোর জন্য আমি ঘরেই একটু পুজো দেবো।
-- কিসের পুজো মা? ওমা,আমি তো স্নান করতে পারবো না। প্লাস্টারে জল লেগে যাবে তো -
-- তাই তো । তাহলে চল আমি নিজেই তোর মাথা ধুইয়ে গা স্পঞ্জ করে দিই
-- বললে নাতো কিসের পুজো করবে?
-- সেদিন তোর ওই অবস্থায় যখন বাপ,ছেলে মিলে আমায় না নিয়ে চলে গেলো তখন আমি আর কী করবো? বসে বসে ঠাকুরকে ডেকে যাচ্ছিলাম। ওই সেই কারণেই তোর নামে একটু পুজো দেবো।
-- বাবাকে দেখছি না। বাবা কী বেড়িয়েছেন?
-- হ্যাঁ বললো কী কাজ আছে। চা,বিস্কুট খেয়েই বেরিয়ে গেছেন।
শ্রাবণী উপরে উঠতে গেলে অঞ্জলী তাকে বললেন,
-- তুই গিয়ে উপরেই থাক। আমিই উপরে আসছি। বারবার তোকে উঠানামা করতে হবে না।
-- মা, তোমাকে তো আগেই বলেছি আমার হাতে ব্যথার জন্য সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে অসুবিধা হবে না।
-- সে যাই হোক। তুই যা আমি আসছি।
শ্রাবণী উপরে গিয়ে ভাবতে থাকে নিজের মায়ের সাথে এই নতুন মায়ের কোন পার্থক্য নেই। একদম মায়ের মত ওকে আগলে রেখেছেন। বাবাও ঠিক তাই। নিজের বাবার কাছ থেকে কোনদিন কোন আদর,ভালোবাসা পাইনি কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় সে শুন্য স্থান এই বাবা'ই পূরণ করে দিয়েছেন। কিন্তু এতকিছু স্বর্তেও অসিতের পূর্ব ব্যবহারই শুধু নয় কেন যে সে অসিতকে একদম পছন্দ করতে পারে না নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি আজও।
অঞ্জলী উপরে গিয়ে শ্রাবণীর মাথা ধুইয়ে গা স্পঞ্জ করে, চুল আঁচড়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু করে বলেন,
-- লক্ষী মা আমার।খুব ভালো থাকিস জীবনে।
-- কী ব্যাপার বলো তো মা? আজ কী কোন বিশেষ দিন?
-- হ্যাঁ বিশেষ দিন তো অবশ্যই। আজ তোর নামে আমি পুজো দিলাম।
কথাটা বলে তিনি আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে নিচে নেমে গেলেন। শ্রাবণীও সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিচুতে গিয়ে দেখে মেঝেতে আসন পাতিয়ে ধান-দূর্বা, প্রদীপ জ্বালিয়ে অঞ্জলী ওর জন্য অপেক্ষা করছেন। খুব খটকা লাগে ওর। তবে কি উনি সবকিছু জেনে গেছেন? কিন্তু কী করে জানবেন? একমাত্র বাবা ছাড়া তো কেউ জানে না যে আজ তার জন্মদিন। কলেজ থেকে সার্টিফিকেট আনতে গিয়েই বাবা জেনেছেন। তবে মায়ের আজ এই আয়োজন দেখে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে মা পুরোটাই জেনে গেছেন। তাহলে মা তো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন। উনি বাস্তবতাটা মেনে নিয়েছেন। তবে উনি কাউকে কিছু বলছেন না কেন?
অঞ্জলী শ্রাবণীকে দেখতে পেয়ে বললেন,
-- আয় এই আসনটাই বোস। পুজোর জন্য একটু পায়েস করেছি। তোর উদ্দেশ্যে পুজো। ঠাকুরকে নিবেদন করে নিয়ে এসেছি। আয় তো তোর মুখে একটু দিই।
শ্রাবণী পায়েস দেখে চোখের জল সংবরণ করতে পারে না। তার চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। নিজের জন্মদিনে মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। অঞ্জলী ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন,
-- গৃহ দেবতা আমার কথা শুনেছেন। তাই পুজোটা দিলাম। এই আশীর্বাদটাও সেই জন্যই।
বাটি থেকে পায়েস তুলে তিনবার শ্রাবণীর মুখে দিলেন।শ্রাবণী মাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতে গেলে উনি বলেন,
-- দাঁড়া তোর বাবা এসে গেছেন। উনাকে ডেকে আনি। আমি একাই আশীর্বাদ করবো কেন? উনি যখন এসেই গেছেন আশীর্বাদটা করে নিন।
সকালে অরুণাভ বেরিয়ে শ্রাবণীর জন্মদিন উপলক্ষে একটা কাপড় কিনে এনেছেন। কিন্তু কিভাবে দেবেন সেটাই বুঝতে পারছিলেন না। অঞ্জলী তাকে আশীর্বাদের জন্য ডাকলে তিনি একটি সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু আজকের এই আয়োজনে অরুণাভ নিজেও বিভ্রান্ত!
-- কী বলো অঞ্জু? খালি হাতে কিভাবে আশীর্বাদ করি। এই কাপড়টা দিয়ে আশীর্বাদ করি আমার মাকে।
অঞ্জলী হেসে দিয়ে বললেন,
-- হ্যাঁ ঠিকই তো! আমিও তো খালি হাতে আশীর্বাদ করলাম। তুমি আশীর্বাদ করতে শুরু করে দাও আমি আসছি।
অঞ্জলী চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী বাবাকে বলে,
-- কী হচ্ছে বাবা এগুলো? আজ ছাব্বিশে জুন আমার জন্মদিন তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না। মা কী করে জানলেন?
-- আমারও সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমার মনেহচ্ছে অঞ্জু পুরো সুস্থ শুধু হয়নি আমার আলমারির ভিতর তোর সব কাগজপত্র ও দেখেছে। তাই এইভাবেই তোর জন্মদিন পালন করলো।
-- কিন্তু মা সে কথাটা কাউকে কিছু বলছে না কেন?
-- হয়ত ভয়ে
-- কিসের ভয়?
-- তোকে হারানোর ভয়। মা সুস্থ হয়ে গেছেন এটা জানতে পারলে তুই যদি এখান থেকে চিরদিনের মত চলে যাস সেই ভয়ে।
ওদের কথার মাঝে অঞ্জলী একটা সোনার চেন যা কুহুর পাঁচ বছরের জন্মদিনে তাকে দেওয়া হয়েছিল তিনি সেটি নিয়ে এসে শ্রাবণীর গলায় পরাতে পরাতে বললেন,
-- মায়ের আশীর্বাদ। সারাজীবন এটা গলায় রাখবি।
শ্রাবণী অবাক হয়ে বললো,
-- মা এত দামী একটা চেন দেওয়ার কী দরকার ছিলো বলো তো?
-- আমার কাছে অসিত আর তুই হচ্ছিস সব থেকে দামী। এইসব কিছু আমার কাছে তুচ্ছ! তোরা দু'জনে সুস্থ থাক,ভালো থাক ব্যাস আর কিছু আমার চায় না।
অরুণাভ আর শ্রাবণী দু'জনে অঞ্জলীর দিকে তাকিয়ে থাকেন কিন্তু কেউ কোন কথারই উত্তর করেন না। অঞ্জলী যখন ঘরে চেন আনতে গেছিলেন তখন খুব আস্তে অরুণাভ শ্রাবণীকে 'শুভ জন্মদিন' - বলে উইশ করেন। শ্রাবণী ছলছল চোখে বাবাকে প্রণাম করে।
ক্রমশ -
No comments:
Post a Comment