চা নিয়ে শ্রাবণী চরম সংকটে পড়েছে দেখে অরুণাভ তাকে আশ্বস্ত করে বললেন,
-- তুই চা টা আমার কাছে দে আমি নিয়ে যাচ্ছি।
-- সেটাই ভালো হবে বাবা। আমাকে দেখলে উনি যদি আবার ক্ষেপে যান?
কিন্তু পরক্ষণে কী মনে হয় শ্রাবণী অরুণাভর দিকে তাকিয়ে বলে,
-- বাবা তোমাকে এখন আর সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হবে না। দাও আমিই নিয়ে যাই। আমি যাইনি কেন মা শুনলে আবার নানান প্রশ্ন করবেন।
-- কিন্তু
-- আরে বাবা! বাঘ,ভালুক তো নয় যে খেয়ে ফেলবেন। বড়জোর একটু রাগারাগি করে কথা শুনাবেন।
শ্রাবণী চা নিয়ে উপরে উঠে এলো। দুই ভাইবোনের পাশাপাশি দু'টি ঘর। শ্রাবণী গিয়ে অসিতের ঘরে ঢুকলো।অসিত তখন স্নান করে খালি গায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। শ্রাবণী টেবিলের উপর চা টা রেখে বললো,
-- আপনার চা
বলেই বেরিয়ে আসতে গেলো
-- মিনিমাম কার্সিটুকুও নেই। কারো ঘরে ঢুকতে গেলে দরজায় নক করতে হয় সেটাও জানো না?
কথাটা বলতে বলতে তড়িঘড়ি একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে দিলো অসিত।
শ্রাবণী অতি বিনয়ের সাথে বললো,
-- ভুল হয়ে গেছে। আর কোনদিনও এই ভুল হবে না।
কথাটা বলে শ্রাবণী বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পেলো,
-- বাড়িতে এতগুলো মাস মাইনে লোক রয়েছে তাদের কেউ তো এসে চা টা দিয়ে যেতে পারতো।
দুপুরে খাবার টেবিলে অনেকদিন পর মায়ের হাতের রান্না পেয়ে অসিত তৃপ্তি ভরেই খেলো। শ্রাবণী পুরো চুপ আর অরুণাভ মা,ছেলের কথোপকথনের মাঝে অযাচিতভাবে কিছু বলে উঠছেন। বাপ ,ছেলে সকলের ঘটনা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি; তা তাদের আচরণেই বোঝা যাচ্ছে।কিন্তু এত কিছু স্বর্তেও এবার এসে মাকে দেখে মায়ের শরীরের উন্নতি হচ্ছে বুঝতে পেরে তার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু বাইরের মেয়েটাকে কিছুতেই সে সহ্য করতে পারছে না।শ্রাবণী চুপচাপ খাচ্ছে দেখে অঞ্জলী তার প্লেটে মাছের টুকরোটা তুলে দিতে দিতে বললেন,
-- কুহু, তুই আজকে এত চুপচাপ কেন? রোজ তো বাপ মেয়ের কথার ফুলঝুরি ওঠে।
শ্রাবণী হেসে পরে বললো,
-- মা,রোজ বাপ,মেয়ের কথার ফুলঝুরি ওঠে তাই আজ মা,ছেলের কথার ফুলঝুরি চলছে।
অরুণাভ ফিক করে হেসে দিলেন দেখে অসিত বলে উঠলো,
-- তুমি হাসছো কেন বাবা? এই কথাটাতে তোমার হাসির কী হল?
-- আচ্ছা খোকা , আমি কোন কথাতে হাসবো আর কোন কথাতে রিয়াক্ট করবো সেটাও তুই বলে দিবি?
আবার বাপ, ছেলের কথাবার্তা ঝামেলার দিকে যাচ্ছে দেখে শ্রাবণী বলে উঠলো,
-- বাবা, মাকে যেন কবে আবার ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে।
অরুণাভ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,
-- ভালো কথা মনে করেছিস কালই তো তোর মায়ের ডাক্তার দেখানোর কথা।
অঞ্জলী একমনে খাচ্ছিলেন। কথাটা তার কানে যাওয়াতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,
-- আমার তো কোন অসুখ নেই, তোমরা মাঝে মাঝে আমায় নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছ কেন বুঝি না।
অসিত কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই শ্রাবণী বলে উঠলো,
-- একটা বয়সের পর আমাদের সকলেরই মাঝে মাঝেই চেকআপ এ যাওয়া উচিত মা।
অসিত শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
--- সব ব্যাপারে তোমার কথা না বললেও চলবে। এখন তো আমি এসে গেছি। বাবা,মায়ের দায়িত্ব আমার।
ছেলের কথা শুনে অরুণাভ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু পাশের চেয়ারে বসে থাকা শ্রাবণী তার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় নিষেধ করে। তারপর অসিতের দিকে তাকিয়ে নিজেই বলে ওঠে,
-- ঠিকই তো। এখন থেকে সব দায়িত্ব তো তোমার।
একটু আগেই যে আপনি করে কথা বলেছে তার মুখ থেকে তুমি টা শুনে অসিত আরও রেগে গিয়ে বলে উঠলো,
-- আমাকে তুমি বলার --
কথা শেষ হয় না শ্রাবণী চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- মা, তুমি এবার ওঠো। লতিকামাসীকে তো বলতে হবে আজ দুপুরে কী কী রান্না হবে।
অসিত এবং তার বাবা দু'জনেই বুঝতে পারে শ্রাবণী মায়ের সামনে ঝগড়া যাতে না হয় তার জন্যই কথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অসিত কিছুতেই মানতে পারছে না তাদের পরিবারের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ে বাইরের একটি মেয়ের নাক গলানো।
অঞ্জলী রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলেন। অরুণাভ তার নিজের ঘরে। অসিত খেয়েই রাগে গজগজ করতে করতে উপরে চলে গেছে। শ্রাবণী নিজের মনটাকে শক্ত করে অসিতের সাথে কথা বলতে উপরে গিয়ে ঘরের বাইরে থেকে গলা চড়িয়ে ভিতরে ঢোকার অনুমতি নিয়ে অসিতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অসিতের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-- দেখুন আপনার সাথে কোন ঝামেলা করার ইচ্ছা আমার নেই। আপনাকে আপনি থেকে কোনদিন তুমি করে কথা বলার মানসিকতাও আমার নেই। কিন্তু মা যদি কিছু সন্দেহ করেন তাই তখন তুমি বলেছিলাম। এই তুমিটা আমি মায়ের সামনে বারবার বলবো। আপনি না চাইলেও বলবো।আর শুনুন আমাকে এখানে বাবা নিয়ে এসেছেন। আমি আসার পর শুনেছি মা নাকি অনেকটাই সুস্থ আছেন। যতদিন না বাবা আমাকে তাড়িয়ে দেন ততদিন পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো। তিনি আমাকে এখানে না রাখতে চাইলে সেই মুহূর্তেই আমি এই বাড়ি ত্যাগ করবো। কিন্তু আপনি দুর্ব্যবহার করে আমাকে তাড়াতে পারবেন না। তাতে আপনিই নিজের কাছে নিজে ছোট হবেন। একজন অসুস্থ্য মানুষ আমায় আঁকড়ে সুস্থ হওয়ার পথে এগোচ্ছেন আর সেই মানুষটি আপনার মা - আপনার কেন তাতে এত অসুবিধা হচ্ছে? আমি চোর,ডাকাত কিংবা এরূপ কোন দলে কাজও করি না। আপনাদের টাকাপয়সা,ধনসম্পত্তির প্রতি আমার কোন লোভও নেই। আমার ঠিকুজি,কুষ্টি বাবা না জানতে চাইলেও আপনার ইচ্ছা হলে আমার কাছ থেকে সব জেনে নেবেন। কিন্তু দোহাই আপনার মায়ের সামনে নর্মাল বিহেভ করুন।
অসিত অবাক হয়ে শ্রাবণীর কথাগুলো শুনে বলে উঠলো,
-- তোমার কথাবার্তা শুনে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।রীতিমত আমাকে শাসাচ্ছ! এত সাহস কোথার থেকে পাও? এত দেখছি মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি!
-- সে আপনি যা খুশি তাই ভাবতে পারেন।আপনাকে শাসানোর সাহস আমার যেমন নেই ঠিক সেইরূপ ইচ্ছাও নেই। কথাগুলো ভেবে দেখবেন। তাতে আপনার এবং আপনাদের পরিবারেরই মঙ্গল হবে। আর হ্যাঁ আপনি বাবাকে রাজি করান এই বাড়ি থেকে আমায় বের করে দেওয়ার জন্য। তিনি বললেই আমি বেরিয়ে যাবো।
-- আপাতত তুমি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। তোমাকে আমি সহ্য করতে পাচ্ছি না। বাকিটা পরে দেখছি।
শ্রাবণী আর কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে গেলো।
অসিতের তখন রাগে সর্ব শরীর জ্বলে যাচ্ছে। সে নিজের মাথাটা দু'হাতে চেপে ধরে খপ করে খাটের উপর বসে পড়লো।
ক্রমশ -
No comments:
Post a Comment