Monday, March 13, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৩৫ পর্ব )

অপর প্রান্ত থেকেও ' হ্যালো ' বলে শুরু করেই শ্রাবণী বলে,
-- আমি শ্রাবণী বলছি - মা, বাবা কেমন আছেন?
-- ভালো আছেন। শুধু বাবা,মায়ের খবরটাই জানতে চাইলে আমি কেমন আছি জানার কোন ইচ্ছে নেই তোমার?
-- না, আসলে কাল রাতে আপনার এতগুলো মিসড কল দেখে ভাবলাম ওদের কিছু হয়েছে কিনা। আচ্ছা ঠিক আছে রাখি -
-- না,রাখবে না - আমি কথা বলবো -
-- বলুন কী বলতে চান।
 শ্রাবণী মনেমনে ভাবে লোকটা পূর্বে যত খারাপ ব্যবহার করেছে তার দ্বিগুণ সে ফেরৎ পেয়েছে তার কাছ থেকে। শত হোক তার বাবা,মায়ের জন্যই আজ সে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আর এটাও সত্যি অসিত তাকে এখন ভালোবাসে। সে বাসে না সেটা অন্য কথা। কিন্তু এত দুর থেকে আর দুর্ব্যবহার করা ঠিক হবে না।
-- কাল এতবার ফোন করলাম ধরলে না কেন?
-- নাইট ডিউটি ছিল আই সি ইউ তে। ফোন এখানে অ্যালাউ না।
-- আমাকে নিয়ে তুমি কিছু ভাবলে?
-- কী ব্যাপারে বলুন তো?
-- বুঝেও না বোঝার ভান কোরো না। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। তুমি জানো আমি তোমায় ভালোবাসি। এইভাবে আমাকে আর কষ্ট দিও না।
-- আসলে কী বলুন তো? এটা আমি কোনদিনও ভুলতে পারবো না আমি আপনাদের আশ্রিতা। আমি জানি এই কথাটা আপনাকে আমি বহুবার বলেছি। আপনার বাবা,মা কবে যে আমার বাবা,মায়ের জায়গাটা নিয়ে ফেলেছেন সেটা বলতে পারবো না। প্রথম প্রথম বাবার কথামত তাদের বাবা,মা ডাকতাম। আর এখন আমি তাদের নিজের বাবা , মা'ই মনে করি। সব চেয়ে বড় কথা যেটা সেটা হল ভালোবাসাটা দুই পক্ষ থেকে আসে। আমি মানছি আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু তারমানে এই নয় আমাকেও আপনাকে ভালোবাসতে হবে। আমি আপনাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ! আমার ভালোবাসা আপনাদের সকলের প্রতিই আছে।কিন্তু আপনি যে ভালোবাসার কথা বলছেন সেটা নয়। আর এটা সম্ভব হবেও না কোনদিন।
  অসিত শ্রাবণীর এই ধীর,স্থিরভাবে কথাগুলো শুনে কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।সত্যিই তো জোর করে সব কিছু পাওয়া গেলেও ভালোবাসা পাওয়া যায় না। অসিতকে চুপ করে থাকতে দেখে শ্রাবণী বলে,
-- আপনার কথা মনেহয় শেষ হয়ে গেছে।এবার রাখি?
-- কবে আসবে তুমি বাড়ি?
-- বলতে পাচ্ছি না। দেখি কবে ছুটি পাই। 
 শ্রাবণী ফোন কেটে দেয়। কথাগুলো বলতে পেরে শ্রাবণীর বুকটা অনেকটাই হালকা হয়। সে ভালোভাবেই জানে ভালোবাসা হারানোর ব্যথা। নিলয়কে সে এখনো ভুলতে পারেনি। কিন্তু কিছু করার নেই। অসিত তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে জেনেও সে কিছুতেই অসিতকে নিলয়ের জায়গা দিতে পারবে না। নিলয়ের সাথে কোন যোগাযোগ না থাকলে কী হবে আজও সে নিলয়কেই ভালোবাসে। আর যে মা তাকে নিজের মেয়ে বলে মেনে নিয়ে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছেন অসিতের কথা মেনে নিয়ে মাকে পুণরায় অসুস্থ্য করতে পারবে না। বাবার দুর্ব্যবহারের জন্য সে বাবাকে পর্যন্ত ত্যাগ করেছে। আর যতই কৃতজ্ঞতা থাকুক না কেন অসিতের ওই দুর্ব্যবহার ভুলে সে অসিতকে ভালোবাসতে পারবে না।

শ্রাবণী ফোনটা কেটে দেওয়ার পর অসিত অনেকক্ষণ চুপ করে খাটের উপর বসে থাকে। আর মনেমনে বলতে থাকে - " ভালো তো তোমার আমাকে বাসতেই হবে। সে আজ হোক বা কাল। আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে এভাবে কুঁড়িতেই শেষ হতে দেবো না। তুমি যদি জেদী হও আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ জীবনে তুমি শুধু আমার।"

  অসিত তখন অফিসে। বিকেলের দিকে পিঠে ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে বাবা,মাকে না জানিয়ে শ্রাবণী হঠাৎ বাড়ি এসে উপস্থিত হয়। হঠাৎ করে শ্রাবণীকে দেখে আনন্দে অঞ্জলী আর অরুণাভ আত্মহারা! তখন বাড়িতে কাজের লোক বলতে শুধু লতিকা। অন্যান্যরা তখন সব যে যার বাড়িতে। শ্রাবণীকে পেয়ে সকলে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। শ্রাবণী সকলকে জড়িয়ে ধরে ধরে আদর করছে। তারা সকলে এতটাই গল্পগুজবে মেতে আছে মেইন দরজা দিতেই ভুলে গেছে। সকলে মিলে চা,জল খাবার খেতে খেতে যখন গল্প করছে ঠিক সেই সময়ে অসিত এসে ঢোকে।
-- মা,কতদিন বলেছি মেইন দরজাটা দিয়ে রাখবে দিনকাল ভালো না --
কথা শেষ হয় না ভিতরে এসে দেখে শ্রাবণী সকলের মধ্যমনি হয়ে গল্প জুড়েছে। শ্রাবণীকে দেখেই অসিতের বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-- কখন এলে ?
 অসিত কখনোই কারও সামনে শ্রাবণীর সাথে দুর্ব্যবহার ছাড়া কোন কথা সাধারণত বলেনি। আজ হঠাৎ করেই সকলের মধ্যে তাকে দেখেই মুখ ফস্কে তার কথা বেরিয়ে গেলো। শ্রাবণী উত্তর দেওয়ার আগেই অঞ্জলী বললেন,
-- এই তো একটু আগেই এসেছে। কাউকে কিছুই না জানিয়ে একা একা অত দূর থেকে চলে এসেছে। তবে ওর এই হঠাৎ আসাটা আমরা সবাই এনজয় করছি খুব। অসিত শুধু মায়ের কথাগুলি শুনলো কোন উত্তর দিলো না। উপরে ওঠার আগে একবার আড়চোখে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।
  কিছুক্ষণ পরেই ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে এলো চা,জলখাবার খেতে। শ্রাবণী তখন রান্নাঘরে লতিকামাসীর সাথে গল্প জুড়েছে। অঞ্জলীও রান্নাঘরে। শুধু অরুণাভ একা চুপচাপ বসে ফোন ঘেঁটে চলেছেন। ছেলে আসার সাথে সাথেই তিনি হাক দিলেন,
-- কই গো অসিত এসছে ওর চা দাও।
রান্নাঘর থেকেই অঞ্জলী উত্তর দিলেন,
-- আসছিইই 
 অঞ্জলীর সাথে শ্রাবণী নিজেই চা টিফিন নিয়ে এসে অসিতের সামনে রেখে আবার রান্নাঘরের দিকে যেতে উদ্যত হলে অরুণাভ বললেন
-- কোথায় চললি ? এখানে বোস।সবাই মিলে একটু সময় কাটাই। আজ মনটা বেশ ফুরফুরে আছে। মেয়েটা কতদিন পরে বাড়ি এসেছে। আমার তো আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে।
 অসিত ভাবে বাবা,মা শ্রাবণীকে কত ভালোবাসেন। একদম দিদির জায়গাটায় বসিয়েছেন। সত্যিই যদি মায়ের কোনদিনও সবকিছু মনে না পড়ে তাহলে তো মায়ের কাছে অসিত, কুহু ওরফে শ্রাবণী দুই ভাইবোন। তাহলে তো অসিতের ভালোবাসা কোনদিনও পূর্ণতা পাবে না। অসিতের বারবার মনেহয় মায়ের দিদির কথা সব মনে পড়ে গেছে। কিন্তু যেকোন কারণেই হোক মা ইচ্ছাকৃত সে কথাটা কাউকেই বলেন না। 
 অঞ্জলী, শ্রাবণী দু'জনেই এসে বসে। অসিত সেখানে শুধুই শ্রোতা আর বাকি সবাই বক্তা। অসিতের একটাই কাজ মাঝে মাঝে আড়চোখে শ্রাবণীকে দেখা।

ক্রমশ


  



  

No comments:

Post a Comment