Monday, March 13, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৩৪ পর্ব)

প্রায় মাসখানেক হতে চললো শ্রাবণী বাড়ি থেকে গেছে। রোজই বাবা,মায়ের সাথে তার কথা হয়। কিন্তু এই এক মাসের মধ্যে সে একবারের জন্যও অসিতকে ফোন করেনি। অসিতের প্রতি মুহূর্তে মনে পড়লেও, প্রতি ক্ষণে শ্রাবণীর ফোনের অপেক্ষা করলেও নিজে ফোন করার সাহস পায়নি। রোজই রাতে খাবার টেবিলে বাবা,মা শ্রাবণীর কোন না কোন আলোচনা করবেনই। আর এটাই জন্যই সে সারাটাদিন মুখিয়ে থাকে। কিন্তু শ্রাবণীকে নিয়ে তাদের কোন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে না। শুধু চুপচাপ খেয়ে যায়। কিছুদিন ধরেই অঞ্জলী লক্ষ্য করছেন অসিত খাবার আগের মত খায় না,কথা কম বলে। ডিনার টেবিলেও চুপচাপ। একদিন খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলেন
-- হ্যাঁরে অতু কিছুদিন ধরেই তোকে একটু অন্যমনস্ক লাগছে। খাওয়াদাওয়াও ঠিকমত করছিস না; কী হয়েছে তোর?
-- কই কিছু হয়নি তো!ঠিকই তো আছি। খাচ্ছি তো।
-- না,বাবা আমার ঠিক সুবিধা মনেহচ্ছে না।
অসিত একটু মুচকি হেসে বলে,
-- মায়েরা সন্তানদের ক্ষেত্রে একটু বেশিই দেখে।
-- আচ্ছা ঠিক আছে। একটা কথা বলি শোন চাকরি তো অনেকদিন হল।এবার তোর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখি।
 অসিত খেতে খেতে প্রচণ্ড বিশুম খেলো। মা জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-- বিয়ের কথা শুনেই বিশুম খেলি?
 অরুণাভ মা,ছেলের কথা চুপচাপ শুনছিলেন। তিনি এবার হেসে পড়ে অঞ্জলীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- মেয়ে খোঁজার আগে তোমার ছেলের কাছে জানতে চাও সে মেয়ে পছন্দ করে রেখেছে কিনা?
 অসিত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- সে রকম হলে আমি নিজেই তোমাদের বলবো। এখনো সে সময় আসেনি। আচ্ছা আমার খাওয়া হয়ে গেছে আমি এবার উঠছি।
 অসিত যেন পালিয়ে গেলো। অঞ্জলীকে একটু গম্ভীর দেখে অরুণাভ বললেন,
-- কী গো তুমি আবার কী ভাবছো?
-- না তেমন কিছু না। কুহু অনেকদিন হল বাড়ি আসে না। কয়েকদিনের জন্য যদি ছুটি পেতো মেয়েটা। আজ রাতে ওকে বলবো।
 -- বলে দেখো যদি আসতে পারে।

  এই একমাসে শ্রাবণী রোজ ডিউটি করেছে। অন্যের সুবিধার জন্য তার ডিউটিও করেছে একটাই কারণে সে মাইনে পেয়ে একবার এখানে আসতে চায়। কলকাতায় এসে শপিং করে সকলকে কিছু দিতে চায়। রাতে অঞ্জলী তাকে বলার সাথে সাথেই সে বলে ওঠে,
-- হ্যাঁ মা আমি এই মাসে যাবো বাড়িতে। কয়েকদিন থাকবো তোমার কাছে। কতদিন দেখি না তোমাদের।
 অঞ্জলী ভীষণ খুশি হয়ে ফোন রেখেই পাশেই শুয়ে থাকা অরুণাভকে বলেন,
-- এই শুনছো কুহু বললো এই মাসেই ও নাকি বাড়ি আসবে।
-- কবে আসবে কিছু বললো?
-- না, তা তো জানতে চাইনি।
-- জানতে পারলে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।
-- কাল আমায় একটু মনে করিয়ে দিও।আজ আর ফোন করবো না। ওর আজ নাইট ডিউটি। তাও আবার আই সি ইউ তে।কাল জিজ্ঞাসা করবো।

  অসিত খেয়ে উপরে উঠে গিয়ে নিজের ব্যালকনিতে বসে শ্রাবণীর কথা ভাবতে থাকে। এক সময় শ্রাবণীর সাথে খুব দুর্ব্যবহার করেছে মনে পড়লেই নিজের প্রতি নিজের প্রচণ্ড রাগ হয়। কিন্তু এটাও ঠিক সে যে অনুতপ্ত সে কথাও তো বারবার তাকে জানিয়েছে।'সরি' বলেছে কতবার। হয় মেয়েটার মন বলে কিছু নেই নয়তো ওর মনে চাপা কোন কষ্ট আছে। যা ও কারো সাথেই ভাগ করতে চায় না। বারমুডার পকেট থেকে ফোনটা বের করে কন্টাকসে গিয়ে শ্রাবণীর নামটা এনে অনেকক্ষণ দোলাচলে কাটিয়ে ফোন করে। রিং হয়ে যায় শ্রাবণী ফোন ধরে না। প্রথম বারে এই ফোন না ধরাটা অসিতের খুব আত্মসম্মানে লাগে। পরে তার জীদ চেপে যায় ফোন করতেই লাগে। কিন্তু প্রতিবারই সে বিফল হয়। কষ্ট,অভিমান আর আবেগে একান্তে দু'হাতে মুখ ঢেকে সে কাঁদতে থাকে।

  এদিকে শ্রাবণীর সেদিন প্রথম আই সি ইউ এর ডিউটি। ক্রিটিকাল সব রোগীদের মাঝে সব সময়ের জন্য তদারকিতে ব্যস্ত। এখানে প্রথম ডিউটি বলে সে আজ একটু ভয়ে ভয়েই আছে। আই সি ইউ তে ফোন সব সময়ের জন্যই সাইলেন্ট মুডে রাখতে হয়। শ্রাবণীর ফোন আসা বলতে এখনকার বাবা মা আর এখানে এসে দু'একজন  বন্ধু বান্ধব যা হয়েছে। আর আজ সে ফোনটা মেট্রন ম্যামের ড্রয়ারে সাইলেন্ট করে রেখে এসেছে। আই সি ইউ এর ডিউটিতে এক সেকেন্ডও বসার উপায় নেই। প্রথম দিন এখানে ডিউটি করতে এসেই সে বুঝতে পেরেছে। কেউ নাকের নল খুলে ফেলছে, কেউ যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। এক এক জন এক এক রকম সমস্যার সৃষ্টি করে। সমানে বেড টু বেড ঘুরে বেড়াতে হয়। রাতের খাবার টুকুও খেলো গোগ্লাসে। এখানে কর্তব্যে বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেওয়া মানে একটা মানুষের জীবন শেষ হয়ে যাওয়া।
  ফোন সে আর সারারাত হাতেই নেয়নি। ভোরে ডিউটি শেষে যখন সে হোস্টেলে ফিরবে তখন ফোনটা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পরে।
  আর এদিকে সারাটা রাত অসিত একের পর এক ফোন করেই চলেছে। সারা রাত না ঘুমিয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরে। সকালে আর উঠতেই পারে না। অঞ্জলী এসে দেখেন ছেলে অকাতরে ঘুমাচ্ছে। আবার জ্বর হল কিনা ভেবে কপালে হাত দিয়ে দেখে নেন। কিন্তু অসিত এতটাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো যে মায়ের হাতের স্পর্শ টুকুও সে টের পায়নি। অঞ্জলী আর অসিতকে না ডেকে নিচুতে চলে যান। তিনি বুঝতে পারেন অসিত আজ আর অফিসে যাবে না।
  এদিকে হোস্টেলে ফিরে স্নান,খাওয়া সেরে শ্রাবণীর এক কলিগকে ফোন করা জরুরী হয়ে পড়ে। কারণ এই কলিগের সাথেই সে ডিউটি পরিবর্তন করে কলকাতা আসবে ঠিক করেছে। ফোন করতে গিয়ে দেখে অসিতের ষোলোখানা মিসড কল। শ্রাবণী মনে ভাবে মা,বাবার নিশ্চয় শরীর খারাপ করেছে সেটা জানাতেই অসিত তাকে এতবার ফোন করেছে। অসিতের নম্বরটা অসিত নিজেই ফোনে সেভ করে দিয়েছিল সেটা শ্রাবণী জানে। শ্রাবণী এটাও জানে এই ফোনটা বাবা নয় অসিতই কিনে এনেছিল। তাই তার এই ফোন নিতে এত আপত্তি ছিল। কিন্তু বাবার কথা সে ফেলতে পারেনি। তাই ফোনটা নিতে বাধ্য হয়েছিল।
  অসিত এতটাই গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল শ্রাবণীর ফাস্ট রিংয়ে তার ঘুম ভাঙ্গেনি। দ্বিতীয়বার ফোন করতেই অসিত ঘুমের ভিতর ফোনটা রিসিভ করে ' হ্যালো 'বলে।

ক্রমশ 

No comments:

Post a Comment