দুপুরের ঘটনার পর আবার রাতে খাবার টেবিলে দেখা অসিত আর শ্রাবণীর। ওরা সবাই একসাথেই খেতে বসে। অসিত খেতে এসেছে দেখে শ্রাবণী রান্নাঘরে গিয়ে লতিকামাসীর সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল তার খাওয়া শেষ হওয়ার পরই সে খেতে আসবে। কিন্তু অরুণাভ এবং অঞ্জলীর বারবার ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে তাকে এসে বসতেই হল। অঞ্জলী অসিত এবং তার কুহুকে আগের মতই খাওয়ার ব্যাপারে জোরাজুরি করতে থাকেন। অরুণাভ আজ খাবার টেবিলে একটু বেশিই যেন চুপ। শ্রাবণী যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠে তখন অরুণাভ সেটা খেয়াল করেন এবং এটাও বোঝেন শ্রাবণী অসিতের সাথে কিছু একটা ফয়সালা করতেই উপরে যাচ্ছে। শ্রাবণী অসিতের ঘরে ঢুকে গেলে তিনি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দু'জনের সব কথাই শুনেছিলেন। মেয়েটার দায়িত্ব কর্তব্য দেখে তার প্রতি দিনকে দিন ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। অসিত খেতে খেতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-- মা কালকে তোমায় আমি ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবো।
-- কুহুও তো যাবে।
-- না,আর কেউ যাবে না। আমি একাই তোমাকে নিয়ে যাবো।
-- না,কুহু আমার সাথে যাবে। কুহু না গেলে আমি যাবো না।
-- বাচ্চাদের মত বায়না কোরো না মা। আমি এখন এসে গেছি তোমাদের সব দায়িত্ব আমার।
শ্রাবণী খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে যাচ্ছে দেখে অঞ্জলী বললেন,
-- হ্যাঁরে কুহু তোর কী হয়েছে? মুখটা এমন গম্ভীর লাগছে কেন? খেতে বসে তো আজ একটাও কথা বললি না?
-- কিছু হয়নি মা। তুমি খেয়ে নাও আমি বাকি খাবার ফ্রিজে দিয়ে তবে যাবো শুতে। লতিকামাসীর শরীরটা আজ ভালো নেই। আমি এসব করে নেবো বলেছি।
-- ওমা তাই নাকি? আমাকে কিছু বলেনি তো?
অসিত মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললো,
-- এবার এসে তো দেখছি বাড়ির কাজের লোকেরাও তোমায় কিছু না বলে অন্যকে সবাই সব জানাচ্ছে।
-- না, তা কেন? কুহুকে বলাও যা আমাকে বলাও তাই। ও বাচ্চা মেয়ে ওকি ওইসব বোঝে?
অসিত পুনরায় বিদ্রুপ করে বললো,
-- বাচ্চা? হ্যাঁ তা বটে!
অসিতকে হাসতে দেখে এবার অরুণাভ বেশ গম্ভীর স্বরে বলেন,
-- বিহেভ ইউর সেলফ! সবকিছুতে ব্যঙ্গ কোরো না। কৃতজ্ঞতা বলে একটা কথা আছে। সেটা মনেহয় ভুলে গেছো। আমার সামনে কুহুর সাথে এরূপ আচরণ তুমি করবে না।
-- তা বটে! তোমাদের কুহু! খুব ভালো।
মা শুনতে না পায় তাই খুব আস্তে আস্তেই বললো,
-- তাহলে তোমরা তোমাদের কুহুকে নিয়েই থাকো আমিই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবো।
কথাটা অঞ্জলী শুনতে না পেলেও অরুণাভ ও শ্রাবণী শুনে দু'জনেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লো।
ইতিমধ্যে সকলে খেয়েদেয়ে যে যার ঘরে চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী বাকি খাবার ফ্রিজে তুলে দিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে নিজের জীবনের কথা ভাবতে লাগে। মানসিক কোন কষ্ট পেলেই তার নিলয়ের কথা বেশি করে মনে পড়ে। মায়ের আদর,মায়ের ভালোবাসা ,জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মায়ের যে কষ্ট সে দেখে এসেছে সেই সব মনে পড়লেই তার চোখ থেকে অবিরল ধারায় জল পড়তে থাকে। যে কটাদিন এখানে সে এসেছে তারপর থেকে রোজই রাতে শুতে যাওয়ার আগে শ্রাবণী অরুণাভদের ঘরে ঢুকে নিজেই তাদের প্রেসারের ওষুধ খাইয়ে তারপর শুতে যায়।কিন্তু আজ সে তাদের ঘরে না ঢোকাতে অঞ্জলী নিজেই উঠে আসছিলেন। তাকে বাঁধা দিয়ে অরুণাভ এসে দেখেন লাইট অফ করে শ্রাবণী সোফায় শুয়ে আছে ।তিনি এসে লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে শ্রাবণীর পাশে বসেন। শ্রাবণী দু'হাতে তখন চোখের জল মুছছে। মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
-- তোর কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। তুই আসার পর তোর মা প্রায় সুস্থই হয়ে উঠেছে। কাল অসিত ওর মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাবে আর আমি আর তুই তোর কলেজে গিয়ে তোর মার্কশিটটা আনতে যাবো। এরপর তোকে আমি হায়ারস্টাডিতে ভর্তি করে দেবো। অসিতের পড়াশুনা শেষ। ও চাকরিও পেয়ে গেছে। এই কলকাতাতেই। বাড়ি থেকেই যাতায়াত করবে। আমি তোকে কোন হোস্টেলে কিংবা কোন বাড়ি ভাড়া করে রেখে পড়াবো। সন্তানের জায়গা দিয়েছি তোকে; আমি তো তোকে ভেসে যেতে দিতে পারি না।
শ্রাবণী কী বলবে কিছুই বুঝতে না পেরে হাউ হাউ করে শুধু কেঁদেই চলেছে।
অরুণাভর সাথে তাদের ঘরে গিয়ে তাদের দু'জনের হাতে ওষুধ দিয়ে কিছুক্ষণ মায়ের কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি ঘুমিয়ে গেলে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে যায়। উপরে কুহেলীর ঘরটাআগে অসিতের ঘরটা পরে। নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে অন্য ঘরে লাইট জ্বলছে। কিন্তু নিজের কৌতূহল দমন করে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পরে।
সকালবেলা অসিত তার মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাবে। কিন্তু অঞ্জলী কুহু না গেলে যাবেন না। ছেলের সাথে সামান্য কথা কাটাকাটিও হয় এই নিয়ে। শেষমেস শ্রাবণী নিজের থেকে এসে বলে সেও যাবে সাথে। অসিত জানতে পেরেই বলে ওঠে,
-- আমি আমার মাকে নিজেই নিয়ে যেতে পারবো।
-- আচ্ছা আমাকে নিয়ে আপনার সমস্যাটা কী বলুন তো?
-- আমি জাস্ট তোমায় সহ্য করতে পারি না।
-- কিন্তু আমার দ্বারা আপনাদের তো কোন অপকার হয়নি !
-- এখনো হয়নি তবে হতে কতক্ষন?
-- কী চাইছেন আপনি ? আমি এখান থেকে চলে যাই?
--- একদমই তাই -
-- আমি তো আপনাকে বলেছি বাবাকে বলে আমায় তাড়িয়ে দেন
-- এই শোনো আমার বাবা,মাকে - বাবা,মা বলে ডাকবে না
-- তাহলে আপনিই বলে দিন কী বলে ডাকবো?
-- তোমার সাথে এই ফালতু বকবক করার সময় আমার নেই
-- সেটা তো আপনি করছেন। আমি তো শুধু সাথে যেতে চেয়েছি
-- তুমি আমার সামনের থেকে দয়া করে সরে যাও। তোমায় দেখলে আমার ভিতরে একটা ইরিটেশন হয়।
-- কিন্তু এখন যদি আমি না যাই চেষ্টা করে দেখুন মাকে সরি আপনার মাকে নিয়ে যেতে পারেন কিনা --
ক্রমশ -
No comments:
Post a Comment