- সত্যি করে একটা কথার উত্তর দেবে?
-- বলুন
-- না থাক। তুমি যাও খেয়ে নাও।
শ্রাবণী কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে অসিত কী তাকে বলতে চেয়েছিল।তাই সেও আর কোন আগ্রহ দেখায় না।নিজের ঘরে চলে আসে।
অসিতের আর জ্বর আসেনি তারপর।দু'দিন পরে তারা কলকাতা ফিরে আসে। বাড়িতে ফিরে আসার পর লতিকামাসী শ্রাবণীর হাতে একটা খাম দিয়ে বলে,
-- গতকাল এই চিঠিটা এসেছে। পিওন ভাই তোমায় খুঁজছিল।
শ্রাবণী চিঠিটা হাতে নিয়েই বুঝতে পারে এটা কোন হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমের জবের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। আনন্দে তার চোখে জল এসে যায়। চিঠিটা খুলে দেখেই দৌড়ে গিয়ে বাবা,মাকে প্রণাম করে। মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু করে। কী ব্যাপার তারা কিছুই বুঝতে না পেরে জানতে চান কী হয়েছে? শ্রাবণী বাবার হাতে চিঠিটা দিয়ে বলে,
-- বাবা,আমি চাকরি পেয়েছি। সবকিছু সম্ভব হয়েছে তোমার আর মায়ের জন্য।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অরুণাভর ইশারায় মায়ের সামনে সে আর কিছু বলে না। অরুণাভ এবং শ্রাবণী খেয়াল করেন অদ্ভুতভাবে অঞ্জলী ভীষণ খুশি হয়েছেন তার কুহুর চাকরির খবরে।
-- হ্যাঁরে কুহু নার্সের চাকরি মানে তো তোর সিপ্টিং ডিউটি পড়বে, কোথায় কোন হাসপাতালে?
শ্রাবণী ইচ্ছে করেই কলকাতায় চাকরির কোন চেষ্টা করেনি। নার্সিং ট্রেনিং নিতে নিতেই সে কলকাতার বাইরে নানান জায়গায় ফর্ম ফিলাপ করেছে।পড়াশুনায় বিন্দুমাত্র ফাঁকি না দিয়ে রেজাল্টও খুব ভালো করেছে। তাই অতি সহজেই সে সরকারি হাসপাতালে চাকরি পেয়ে গেছে। মৌখিক একটা পরীক্ষা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু নিজের বুদ্ধিমততায় সেখানেও সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। তার পোষ্টিং হয়েছে বীরভূমের গ্রামীণ এক সরকারি হাসপাতালে। শ্রাবণী মায়ের কথা শুনে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-- মা, আমার পোষ্টিং অনেক দূরে হয়েছে। আমি বাড়ি থেকে যাতায়াত করবো না। ওখানে গিয়ে আমায় থাকতে হবে।
-- সে কোথায়? কতদূরে? বাড়ি থেকেই তুই যাবি।গাড়ি আছে তো?
অরুণাভ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারেই দেখেছেন কোথায় পোষ্টিং তার। তিনি অঞ্জলীকে ধরে খাটে বসিয়ে বললেন,
-- ছেলেমেয়ে বড় হলে তারা উচ্চ শিক্ষার জন্য, চাকরির জন্য বাড়ির বাইরে থাকে। খোকাও তো চার বছর বাড়ির বাইরে ছিল। হ্যাঁ মাঝে মাঝে বাড়ি আসতো। সেইরূপ কুহুও আসবে।
-- আরে জায়গাটার নাম বলো না - । অতু একটা ছেলে আর কুহু একটা মেয়ে। সেসব ভাববে তো?
শ্রাবণী মাকে পুণরায় জড়িয়ে ধরে বলে,
-- আমিও সব পারবো মা। আমি তো তোমারই মেয়ে। আমার কোন অসুবিধা হবে না।
অঞ্জলী কুহুকে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। চোখে তার জল। কিন্তু আর কোন কথা বললেন না।
শ্রাবণীর বীরভূমে চাকরির খবর অসিতের কানেও গেলো। এমনিতেই সেদিন সী-বিচের ঘটনার পর থেকে তার মনমেজাজ ভালো ছিল না তার উপর শ্রাবণীর অন্যত্র চাকরির খবরে তার মেজাজ আরও বিগড়ে গেলো। ভেবেছিল মা বুঝি বাঁধা দেবেন কিন্তু বাবা মাকে এমনভাবে বুঝিয়ে ফেলেছেন তিনিও ব্যাপারটা নিয়ে আর কোন কথা বলছেন না। শ্রাবণী সব সময়ের জন্যই অসিতকে এড়িয়ে চলে এটা অসিত বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছে পুরীর থেকে আসার পর এটা আরও বেড়েছে।
দেখতে দেখতে শ্রাবণীর যাওয়ার দিন চলে এলো। অসিত ভেবেছিল বাবা তাকে বলবেন পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো বাবা,মা দু'জনেই ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে তাকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগেরদিন শ্রাবণী তার ঘরে জামাকাপড় গুছাতে ব্যস্ত ছিল। অসিত বেশ কয়েকবার পর্দার এপাশ থেকে উঁকিঝুকি দিয়েছে। ভিতরে ঢুকবার চেষ্টা করেও কী ভেবে আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু কিছুতেই নিজের ঘরে থাকতে পারছে না। বিশাল বড় বারান্দার এদিক ওদিক করে বেড়াচ্ছে। পায়ের আওয়াজ পেয়ে শ্রাবণী বুঝতে পেরেছে এটা অসিত। তাই বুঝেও না বোঝার ভান করে নিজের কাজে মন দিয়েছে।
আর এদিকে অসিত শেষ পর্যন্ত নিজেকে দমন করতে না পেরে উদভ্রান্তের মত শ্রাবণীর ঘরে ঢুকে বললো,
-- তোমার সাথে আমার কথা আছে
-- বলুন কী বলতে চান? আপনার তো নিশ্চয় খুব আনন্দ হচ্ছে আপনার শত্রু আপনার বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে
অসিত চুপ করে আছে দেখে পুণরায় বললো,
-- আমি বাবা,মায়ের জন্য মাঝে মাঝে ছুটি পেলে আবার আসবো তবে দু'একদিনের জন্য। তখন দেখবেন আবার আগের মত ব্যবহার করতে শুরু করবেন না। আমি শুধু বাবা,মা'ই নয় আপনার কাছেও কৃতজ্ঞ। আমি গরীব ঘরের সন্তান। বাবার স্নেহ,ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত জন্ম থেকেই। কিন্তু আপনাদের বাড়িতে এসে আমি বাবার স্নেহ কী সেটা বুঝতে পেরেছি। যদি কখনো বাবা,মায়ের শরীর খারাপ হয় আমায় জানাবেন। তাদের সেবার দায়িত্ব আমার।
অসিত সরাসরি শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- বাবা,মায়ের শরীর খারাপ হলে জানাবো তোমায় আর আমার শরীর খারাপ হলে ?
শ্রাবণী যেন জানতো এরূপ একটা প্রশ্ন তার দিকে আসতে পারে। তাই সে একটুও অবাক না হয়ে হেসে পরে বললো,
-- মা,বাবা দু'জনেই আছেন তো।
এবার অসিত শ্রাবণীর সামনে গিয়ে একটা হাতে তার কোমর আর এক হাতে শ্রাবণীর গলার কাছটা ধরে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে খুব আস্তে করে বললো,
-- আমার শরীর খারাপ হলে - আমার তোমাকে চাই।
বলেই নিজের মুখের মধ্যে শ্রাবণীর ঠোঁট দুটো ঢুকিয়ে নিল। শ্রাবণী কোন বাঁধা দিল না একদম।চোখ বন্ধ করে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পরে অসিত নিজেই ওকে মুক্ত করে দিয়ে বললো,
-- কিছু বললে না তো?
-- কৃতজ্ঞতা! আমি তো আগেই আপনাকে বলেছি আমি আপনাদের আশ্রিতা।আপনাদের দয়ায় আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি ।আমার সাথে আপনি যা --
কথাটা শেষ করতে পারে না শ্রাবণী। অসিত নিজের দুহাতে পাগলের মত নিজের চুলগুলো টানতে টানতে বলে -
--- আমি তোমায় ভালোবাসি শ্রাবণী।আমাকে আর এভাবে আঘাত কোরো না। আমি ভীষণ কষ্ট পাই তোমার এইভাবে কথা বলার জন্য। আমি ভালোবেসে তোমায় কাছে টানি। আমার ভালোবাসার মধ্যে কোন খাদ নেই। হ্যাঁ একটা সময় আমি তোমার সাথে খুব দুর্ব্যবহার করেছি। তারজন্য আমি বহুবার ক্ষমা চেয়েছি। প্লিজ তুমি আর আমায় আমার পূর্বের ব্যবহার নিয়ে কথা শুনিও না। সত্যি করে বলো তো আমার প্রতি তোমার কী কোন দুর্বলতা নেই? সেদিন পুরীতে আমি অসুস্থ্য হলে তুমি যা করেছো সবই কি তোমার কর্তব্য? তারমধ্যে একটুও ভালোবাসা ছিল না?
শ্রাবণী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসিতের পাশ কাটিয়ে নিচুতে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অসিত সেটা দেখতে পেয়ে বলে উঠলো,
-- প্লিজ শ্রাবণী কিছু বলে যাও আমাকে। তোমাকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না। আমার জীবনে প্রথম ভালোবাসা তুমি। এভাবে উত্তর না দিয়ে যেও না।
শ্রাবণী ধীর,স্থির ভাবে বললো,
-- অনেক রাত হল। মা এখুনি খেতে ডাকবেন। চলুন খেতে যাই।
শ্রাবণীর এই নিলিপ্ত কথায় অসিত আরও ভেঙ্গে পরে। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে সে শুনতে পায় অসিতের গুমরে কেঁদে ওঠার আওয়াজ।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment