খুব আস্তে আস্তে সে খাটের যে পাশে অসিতের মাথা রয়েছে সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারে অসিত ঘুমাচ্ছে অকাতরে। কিন্তু মুখটা খুব একটা স্বাভাবিক মনেহয় না। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কী করবে কিছুই মাথায় আসে না। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে প্রথমে সে অসিতের পায়ের জুতো, সক্স খুলে গায়ের উপর একটা চাদর দিয়ে দেয়। পা টা টানাটানি করেও সরাতে পারে না। ওটা ঝুলন্ত অবস্থা়তেই থাকে। নিজের ঘরে ঢুকে ফাষ্ট এইড বক্সটার থেকে একটা প্যারাসিটামল আর একটা অ্যান্টাসিড নিয়ে নিজের ঘরে তালা দিয়ে অসিতের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ওষুধটা দেবে কী করে? কিছুই তো খায়নি মনেহয়। খালি পেটে তো ওষুধ দেওয়া যাবে না। খাবারের প্লেট থেকে ডালের বাটিটা নিয়ে উপর থেকে ডালের জলটা একটা কাপে ঢালে। নিজে খাটের উপর উঠে অসিতের কাঁধটা ধরে মুখের কাছে ডালের কাপটা ধরে বলতে থাকে,
-- শুনছেন? এটা একটু চুমুক করুন।
বারবার বলার পর অসিত চোখ খুলে শ্রাবণীর দিকে জবা ফুলের মত লাল চোখদুটি তুলে তাকিয়ে সামান্য খেয়ে নেয়।
অনেক কষ্টে ওষুধটা খাইয়ে দিয়ে পাশেই বসে থাকে। অনেকবার ভেবেছে জলপট্টি দেবে। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে যায় মা জ্বরের ওষুধ খাইয়ে কখনো জলপট্টি দিতেন না।গায়ে কাঁথা চাপা দিয়ে রাখতেন। তাতে নাকি জ্বর তাড়াতাড়ি ঘাম দিয়ে ছেড়ে যায়। বারবার গলায় ,কপালে হাত দিয়ে দেখে ঘাম হচ্ছে কিনা। বেশ কিছুক্ষণ পর ঘাম হতে শুরু করলে অসিত চোখ খুলে শ্রাবণীকে তখনও বসে আছে দেখতে পেয়ে অতি ক্ষীণ স্বরে বলে,
-- তুমি এবার ঘরে যাও। কেউ দেখে ফেললে তোমার বদনাম হবে। কাল ওই অবস্থাতে বললে তুমি যেতে না। জ্বর আমার প্রচুর থাকলেও জ্ঞান আমার পুরো ছিল। তাই তখন বলিনি। আমার জন্য সারা রাত তোমায় জেগে থাকতে হল। এরজন্য তোমার কাছে আমি ঋণী। আর এখানে থেকো না।
শ্রাবণী খাটের থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-- আপনাদের বাড়িতে থাকি।আপনাদের ভালোমন্দ দেখা আমার ডিউটি। লোকের কথায় আমার কিছু যায় আসে না। আপনি শুয়েই থাকবেন। কাল প্রচুর জ্বর ছিল আপনার শরীর এখন দুর্বল।
-- তাতে তোমার কী?
-- না,আমার কিছুই না। আপনার কিছু হলে বাবা,মায়ের চিন্তার শেষ থাকবে না।তাই বললাম। আমি আসছি।
শ্রাবণী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। অসিত ওই একইভাবে শুয়ে থাকলো। অঞ্জলী সকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলের ঘরে ঢুকলেন। তখন শ্রাবণী তাদের ঘরেই রয়েছে। কিন্তু অসিতের শরীর খারাপ সম্পর্কে সে কিছুই তাদের জানায়নি। এখানে আসার পর থেকে অসিত রোজ সকালে গিয়ে চা নিয়ে আসে। ছেলে তখনো ওঠেনি দেখে তিনি তার ঘরে ঢুকে দেখেন অসিত ঘুমাচ্ছে। গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গিয়ে দেখেন গা গরম। তখন তিনি অরুণাভকে ডেকে আনেন। অরুণাভর পিছন পিছন শ্রাবণীও এসে ঘরের ভিতর দাঁড়ায়। অরুণাভ ও অঞ্জলীর উদ্বিগ্নতা দেখে অসিত বললো,
-- চিন্তা কোরো না। ওষুধ খেয়েছি। ঠিক হয়ে যাবে।
অরুণাভ শ্রাবণীর দিকে ফিরে বললেন,
-- কী করি বলতো মা? ডাক্তার ডাকবো এখানে? তুই তো কিছু ওষুধপত্র এনেছিলি? জ্বরের ওষুধ আছে তাতে?
শ্রাবণী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়। অরুণাভ তখন অসিতের কাছে জানতে চান
-- তুই ওষুধ খেয়েছিস কী ওষুধ খেয়েছিস? কোথায় পেলি?
শ্রাবণী অসিতের দিকে তাকিয়ে পড়লে অসিত বাবাকে বলে
-- আমার কাছে ছিলো।
অঞ্জলী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- কুহু ওতো রাতে কিছু খায়নি দেখতে পাচ্ছি। তুই খাবারের ব্যবস্থা কর তো হোটেলে ফোন করে।
কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার এলো। অঞ্জলী অনেক জোরাজুরি করে ছেলেকে খাবার খাওয়ালেন। শ্রাবণী মায়ের হাতে ওষুধটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
-- চিন্তা কোরো না মা। এই ওষুধেই ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা ঘরে যাও ব্রেকফাস্ট করে নাও। আমি এখানে আছি।
-- আমরা খাবো তুই খাবি না?
-- হ্যাঁ খাবো তো। তোমরা খেয়ে এখানে আসো তারপর আমি যাচ্ছি।
বাবা,মা উঠে চলে গেলে শ্রাবণী অসিতের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- কাল থেকে বাইরের জামা প্যান্ট পরেই আছেন। এবার এটা খুলতে হবে।
অসিত কথার উত্তর না দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলে শ্রাবণী তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যায় -
-- আমি পারবো। আমার সাহায্যের কোন দরকার নেই।
-- জানি আপনি পারবেন। আমিই তো আপনাদের সাহায্য প্রার্থী। আমি কিইবা করতে পারি আপনাদের জন্য এই সেবাটুকু ছাড়া।
-- তোমার সেবার আমার কোন দরকার নেই। অন্তত এই মুহূর্তে এইসব কথা তুমি বোলো না। আমার ভালো লাগছে না। তুমি তোমার ঘরে চলে যাও। আমি নিজেই সব পারবো।
-- সেটাও আমি জানি।
ব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে হাতে দিতে দিতে বললো,
-- ব্রাশ করে ওয়াসরুমে গিয়ে ড্রেসটা চেঞ্জ করে আসুন।
-- এই তুমি কী চাও বলো তো? তোমার ইচ্ছামত আমায় চলতে হবে?
-- না, আপনি এখন অসুস্থ্য। আমি এগুলো আপনাকে দিয়ে করাতে না পারলে ওই বয়স্ক মানুষ দু'টো এসে এই কাজগুলো করবেন। সেটা আমি থাকতে হবে না। যা বলছি সেটাই করুন।
অসিত আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেলো। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর শ্রাবণী অসিতের জামা প্যান্ট কেচে ব্যালকনিতে মেলে দিলো।
অসিত শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-- জীবনে কোনদিন ব্রাশ না করে কিছু খাইনি। কিন্তু আজ সেটাও আমাকে করতে হল তোমার জন্য।
-- বেশিদিন আমার অত্যাচার আপনাকে সহ্য করতে হবে না। অনেক জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছি।একটা জব পেয়ে গেলেই আপনি নিস্তার পেয়ে যাবেন।
-- মা,বাবা জানেন?
শ্রাবণী উত্তর দিলো না সে কথার। শুধু বললো,
-- চুপচাপ শুয়ে থাকুন আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। এখুনি বাবা,মা চলে আসবেন।
শ্রাবণী চলে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই অসিত তাকে বললো,
-- সত্যি করে একটা কথার উত্তর দেবে?
-- বলুন
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment