প্রতিদিনই রাতে খাওয়ার পর অসিত শ্রাবণীর ঘরে ঢুকে ঠিক এভাবেই কিছুটা সময় কাটায়। শ্রাবণীও নিজের অজান্তেই যেন এই সময়টার অপেক্ষা করতে থাকে। অসিতের এই বকবকানিতে তার কান ঝালাপালা হলেও কোথাও যেন একটা ভালোলাগাও কাজ করে। আস্তে আস্তে নানান বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হতে থাকে। অনেক সময় মতের বিরোধ আবার কখনো মতের মিল। রবিবারের দিনগুলিতে শ্রাবণী খুব কম সময়ই উপরে থাকে। দু'জনে নিচুতেই বাবা,মায়ের সামনে টুকটাক কথা বলে এখন। অরুণাভ এবং অঞ্জলী ওরা এক জায়গায় হলেই নানান কাজের অছিলায় অন্য কোথাও চলে যান এটা অসিত বেশ খেয়াল করেছে।
দেখতে দেখতে শ্রাবণীর প্লাস্টার খোলার সময় হয়ে আসলো। কিন্তু তার আগেরদিন যেতে হবে এক্সরে করতে। অরুণাভ অসিতকে জানিয়ে দিলেন সে যাতে শ্রাবণীকে নিয়ে যায়। শ্রাবণী মাকে বলল,
-- মা, তুমি আর আমি যাই চলো। আমরা ট্যাক্সি করে চলে যাবো।
-- কেন রে অসিত গেলেই তো ভালো হবে। তুই বরং ওর সাথেই চলে যা।
অগত্যা শ্রাবণী অসিতের সাথেই বেরোলো। গাড়ি বের করে সে শ্রাবণীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। শ্রাবণী এসে গাড়ির পিছন দিকে বসতে গেলে অসিত তাকে বলে,
-- ম্যাডাম,আজ সামনে আসুন। আপনি পিছনের সিটে বসলে আমি তো আপনার গাড়ির ড্রাইভার হয়ে যাবো।
কথাটা বলেই হাসতে থাকে।
শ্রাবণী বেশ ঝাঁঝালো সুরে বলে,
-- তাহলে সেদিন কেন পিছনে বসতে বললেন? আর আজই বা কেন আপনার মনেহল আমি পিছনের সিটে বসলে গাড়ির মালিক হয়ে যাবো?
-- তোমার সারাজীবনের ড্রাইভার হতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার হতে চাই না। সেদিন তোমার কাঁচা প্লাস্টার ছিলো। সিটবেল্ট বাঁধলে ব্যথা লাগতে পারতো। আর আজ সে ভয় নেই। এই একটু সময় নাহয় দম বন্ধ করেই আমার পাশে বসে গেলে। আমার তো ভালো লাগবে।
মিটিমিটি হাসতে থাকে অসিত। শ্রাবণী আর কথা না বাড়িয়ে সামনের সিটে গিয়ে বসে। অসিত ঝুঁকে পড়ে শ্রাবণীর সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলে,
-- আমার এটুকুই লাভ। এই যে বেল্ট বাঁধার অজুহাতে তোমার একটু হলেও তো কাছে এলাম।
আবারও অসিতের হাসি। শ্রাবণী চোখ বন্ধ করে বসে আছে দেখে অসিত যেন একটু বেশিই সময় লাগাচ্ছে বেল্টটা বাঁধতে। সেটা বুঝতে পেরে শ্রাবণী বলে ওঠে,
-- এতক্ষণ কী করছেন আপনি? একটা বেল্ট বাঁধতে কতক্ষণ সময় লাগে?
-- ঠিক ততক্ষণ সময় লাগবে যতক্ষণ না তুমি চোখ খুলে আমার দিকে তাকাবে।
-- যত্তসব!
বলেই অসিতের দিকে তাকিয়ে দেখে অসিত একদম তার বুকের কাছে একদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
অসিতের সে দৃষ্টি দেখে এই প্রথম শ্রাবণীর বুকের ভিতর ধক করে কেঁপে উঠলো। আচমকা অসিত শ্রাবণীর ঠোঁট দুটোতে হালকা একটা পরশ দিয়ে বললো,
-- পারলাম না নিজেকে সামলাতে। চেষ্টা করেছি আজ এতদিন ধরে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করতে। কিন্তু আজ এত কাছে তোমায় পেয়ে আর পারিনি। প্লিজ কিছু মনে কোরো না।
অসিতের আজকের এই মুহুর্তের পরশ শ্রাবণীর মনেও এক তৃপ্তি এনে দেয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও সে অসিতের প্রতি রাগ,অভিমান ভুলে যায়। কিন্তু হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে নিলয়ের মুখটা ভেসে ওঠে। ততক্ষণে অসিত গাড়ি চালাতে শুরু করেছে।
এক্সরে করে সব ঠিক আছে দেখে ডক্টর শ্রাবণীর প্লাস্টার খুলে দেন। ফেরার পথে গাড়ি চালাতে চালাতে অসিত বলে,
-- তোমার প্লাস্টার খুলে দিয়েছেন আর সব ঠিক আছে এটা খুব আনন্দের খবর। কিন্তু আমার মনটা অন্য দিক থেকে ভীষণ খারাপও লাগছে।
-- ওঃ আমার হাতটা ঠিক হয়ে গেছে বলে আপনার খারাপ লাগছে?
-- আমার কথাগুলির সব বাঁকা মানে করো কেন? আমার এই কথাটার মানে তোমার মনে এটাই আসলো?
-- তাছাড়া আবার কী?
-- আসলে প্লাস্টার খোলা হয়ে গেছে এবার তো তুমি এখন থেকে চলে যাবে। খুব খারাপ লাগছে আমার।
আচ্ছা তোমার কী একটুও খারাপ লাগছে না?
-- আনন্দ হচ্ছে! রোজ রাতে আর আমার বকবকানি শুনতে হবে না মনে করে।
এবার শ্রাবণী মুচকি হাসছে দেখে অসিত বলে,
-- কাছে থাকতে তো বুঝলে না; দেখো এবার গিয়ে কাজ ছাড়া যখনই থাকবে আমার কথা তোমার মনে পড়বেই।
-- আপনার এত কনফিডেন্ট আসে কোথা দিয়ে? এ জিনিস কখনোই হবে না
-- হবে হবে হতেই হবে। আমার ভালোবাসার মধ্যে কোন খাদ নেই। জীবনে তুমি ছাড়া অন্য কারও প্রেমে আগে পড়িনি। জানি না আগে তুমি কারও প্রেমে পড়েছ কিনা। তাহলে বুঝতে প্রেমে পড়লে কী হয়!
কথাটা শুনেই শ্রাবণী একটু উদাস হয়ে গেলো। নিলয়ের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়তে লাগলো। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে দেখতে পেয়ে অসিত হাসতে হাসতে বললো,
-- নির্ঘাত পুরনো কারও কথা মনে পড়ে গেছে।
শ্রাবণী যেহেতু অন্যমনস্ক ছিলো অসিতের কথাটা ভালোভাবে না শুনেই মুখ থেকে ওর 'হু' কথাটা বেরিয়ে আসলো। আর সেটা শুনেই অসিত আরও জোরে জোরেই হাসতে লাগলো। শ্রাবণী ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
-- পাগলের মত হাসছেন কেন?
অসিত সুর করে এক লাইন গেয়ে উঠলো,'যখন কেউ আমাকে পাগল বলে -'।
-- কী হল বললেন না হাসছেন কেন?
অসিত হাসতে হাসতেই উত্তর দিলো,
-- না কিছু না।
গাড়ি থেকে নেমে শ্রাবণী আর কোন কথা না বলে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। অসিত গাড়িটা গ্যারেজ করে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে।
অঞ্জলী ও অরুণাভ দু'জনেই ড্রয়িংরুমে ছিলেন। শ্রাবণী ঢোকার সাথে সাথেই অঞ্জলী বলে উঠলেন,
-- কি রে আজই প্লাস্টার খুলে দিলো?
-- ডাক্তারবাবু এক্সরে প্লেট দেখে বললেন,'সব ঠিক আছে। আগামীদিন আর কষ্ট করে আসার দরকার নেই আজই খুলে দিই।'
-- এখনো কতদিন এইভাবে গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে হাত?
-- মাঝে মাঝে মাত্র কয়েকটা দিন মা। তুমি অত ভেবো নাতো। সব ঠিক আছে। মা,আজ আমি স্নান করতে পারবো। কতদিন ভালোভাবে স্নান করিনি। যাই স্নান করে ফ্রেস হয়ে আসি।
শ্রাবণী উপরে উঠে গেলো।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment