রাতে খাবার টেবিলেও অসিত চুপচাপ। শ্রাবণী আসার পর একবার মাত্র উপরে নিজের ঘরে গেছিলো ফ্রেস হতে।তারপর আর ওঠেনি। অসিত নিচে থেকে চা,টিফিন করে এসে কান খাড়া করে রেখেছিল যদি শ্রাবণী উপরে আসে তাহলে ওর সাথে সামনাসামনি পুণরায় কথা বলবে। কিন্তু শ্রাবণী হয়ত অসিতকে এড়িয়ে যেতে, ইচ্ছা করেই আর উপরে ওঠেনি। খাবার টেবিলেও অঞ্জলী পুণরায় ছেলের বিয়ের প্রসঙ্গ তোলেন।
-- জানিস কুহু, আমি অসিতকে সেদিন বলছিলাম এবার একটা বিয়ে করতে।
-- আহ্ মা আবার সেই এককথা
কথাটা বলেই সে শ্রাবণীর দিকে তাকালো। শ্রাবণী কোন উত্তর দিলো না দেখে অঞ্জলী আবার বললেন,
-- কি রে কুহু তুই কী বলিস?
-- ভালোই তো হয় মা। বেশ জমিয়ে আনন্দ করা যাবে।
অসিত করমর করে দাঁতে দাঁত দিয়ে মনে মনেই শ্রাবণীর উপর রাগ দেখাতে লাগলো। অসিত রেগে গিয়ে বললো,
-- বিয়ে দিতে হলে তোমরা তোমাদের কুহুর বিয়ে দাও। জমিয়ে আনন্দ করতে পারবে।
এবার অরুণাভ বললেন,
-- আহা রাগ করছিস কেন? আমরা তোদের দু'জনের বিয়ে এক তারিখেই দেবো।
অসিতের বুকটা ধরাস করে উঠলো। 'বাবা এরূপ বললেন কেন? বাবা কী তার মনের খবর টের পেয়ে গেলেন।' অরুণাভ একটু টেরিয়ে ছেলের মুখটা দেখলেন। কয়েকদিন ধরেই তিনিও লক্ষ্য করছেন ছেলের মধ্যে উদাস হওয়া ভাবটি। অতীতের কথা মনে করে নিজের জীবন দিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছেন সুন্দরী, নম্ন, ভদ্র মেয়েটি মনেহচ্ছে তার ছেলের মনটা জিতে নিয়েছে। কিন্তু সিওর হতে পারছেন না। আজ সুযোগ বুঝে তিনি একটি তীর ছেড়ে দিলেন। কিন্তু একথাও তিনি জানেন যতদিন না অঞ্জলী বাস্তবটাকে মেনে নিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত চুপচাপ থাকতে হবে। অরুণাভও মাঝে মাঝে ভাবেন ডাক্তারের কথাটাই হয়ত ঠিক। অঞ্জলীর সবই মনে পড়েছে। তিনি ইচ্ছাকৃতই কাউকে কিছুই বলছেন না। সেদিন ডাক্তারবাবু অঞ্জলীর সাথে কথা বলার পর আলাদাভাবে অরুণাভকে ডেকে বলেছিলেন,
-- বুঝলেন মিস্টার দাশগুপ্ত, আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা বলছে আপনার মিসেসের সব কিছুই মনে পড়ে গেছে। আর বাস্তবটাকে তিনি মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু উনি সেটা স্বীকার করছেন না।
-- কেন বলুন তো?
-- প্রশ্নটা এখানেই। কেন স্বীকার করছেন না? হয়ত উনি ভাবছেন এটা আপনারা সবাই জানতে পারলে যে মেয়েটিকে আপনাদের মেয়ে ভেবে উনি আগলে রেখেছেন মেয়েটি হয়ত চলে যাবে কোথাও। এটা মনেহয় হারানোর ভয়! উনি একবার হারিয়েছেন আর হারাতে চান না। তাই হয়ত কাউকে কিছুই বলছেন না।
অসিত আগেই খেয়ে উপরে চলে গেলো। শ্রাবণী অনেক রাত অবধি বাবা,মায়ের সাথে গল্প করে ইচ্ছাকৃতভাবেই দেরি করে উপরে গেলো যাতে অসিত ঘুমিয়ে পড়ে। ঘরে ঢুকেই যখন দরজাটা দিতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে অসিত এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
-- ভিতরে আসতে পারি?
-- আপনি না মাঝে মাঝে এমন ভান করেন যেন বাড়িটা আমার
-- এই বাড়িটা তো তোমারও। কবে কী বলেছি সেটা মনে রেখে নিজের অধিকারটা ছেড়ে দিও না।
-- এই বাড়ির প্রতি আমার অধিকার? আপনাদের দয়ায় আজ আমি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। আপনাদের প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
-- এবার তো অন্তত ঘরে ঢুকি। আমার জন্য এইটুকু অধিকার দিলে আমিও তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।
শ্রাবণী একটু পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অসিত ঘরে ঢুকে চেয়ারটায় বসতে বসতে বললো,
-- দিদি চলে যাওয়ার পর বাড়িটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেছিলো। মা টুকটাক কাজ করতেন ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ সময় হয় নিজের ঘরে শুয়ে থাকতেন নয়ত এই ঘরটাতে এসে আপনমনে দিদির সাথে কথা বলতেন। সে এক অসহনীয় দিন গেছে আমাদের উপর থেকে। কিন্তু তুমি আসার পর থেকেই বাড়ির পরিবেশটা পুরো বদলে গেলো। আস্তে আস্তে আবার ঠিক সেই আগের মত হয়ে গেলো।
-- তাই বুঝি আপনি সব সময় আমার সাথে ঝগড়া করতেন?
অসিত একথা শুনে হেসে দিলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
-- তখন ঝগড়া করতাম।কই এখন তো একটুও ঝগড়া করি না। এখন তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি।
কথাটা বলেই সরাসরি শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে পূর্বের বলা কথাটার জের টেনে বললো,
-- আচ্ছা এই যে আমি এতবার করে তোমায় ভালোবাসি কথাটা বলি এই কথাটা শুনেও তোমার আমার প্রতি কোন ফিলিংস আসে না।
-- আমি এসব ভালোবাসা টাসা বিশ্বাস করি না। আমার জীবনের উপর থেকে যে ঝড় বয়ে গেছে তা নিয়েই একটা উপন্যাস লেখা যায়। সারাজীবন এক ছাদের তলায় থেকেও মানুষের প্রতি মানুষের কোন ভালোবাসা জন্মায় না। জৈবিক চাহিদার কারণে মানুষ মানুষের কাছে আছে, সন্তান জন্ম দেয় কিন্তু তবুও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় না। বেঁচে থাকা এবং বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলা। আর এটাই হল সংসার।
-- জীবন সম্পর্কে তোমার ধারণা এতটা খারাপ? তুমি যেটুকু দেখেছো সে টুকুই সব নয়। এর বাইরেও কিছু আছে। আমি আমার বাবা,মাকে দেখে বুঝেছি জীবনে ভালো থাকতে গেলে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর ভালোবাসার কোন বিকল্প নেই। আমার মায়ের অসুস্থতার সময়ে আমার বাবা যা করেছেন একজন পুরুষ হয়ে তা তোমার ধারণার বাইরে।
-- আচ্ছা আমরা এসব আলোচনা করছি কেন? অনেক রাত হল আপনি এবার আসুন।
-- তাড়িয়ে দিচ্ছ?
-- ছি ছি আপনাদের বাড়ি। এটা দিদির ঘর। আমি কিভাবে আপনাকে তাড়াতে পারি? অনেক রাত হয়েছে তাই শুতে যেতে বললাম।
-- আমার প্রশ্নের কোন উত্তর পাবো না?
-- সব প্রশ্নেরই তো উত্তর দিয়েছি। আর যে টার উত্তর দিতে পারিনি তার উত্তর আমার কাছে নেই।
--- তোমার উত্তরের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবো। আর আমি জানি যেদিন তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে সেটা পজেটিভই হবে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment