খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই যে যার জায়গা মত শুয়ে পড়ে। কিন্তু সৌম্যর কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। সে বারবার অতীতে হারিয়ে যেতে থাকে। সেদিন ছিল তাদের কোম্পানির পে-ডেট। অফিসের সব কাজ মিটিয়ে ফিরতে একটু রাতই হয়েছিল। নিজেই ড্রাইভ করছিল। হঠাৎ ওর গাড়ির সামনে কোথা দিয়ে একটা মেয়ে এসে পড়ে। প্রচন্ডভাবে ব্রেক কষে রাগে গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটির দিকে তিরবেগে এগিয়ে যায়।
-- চোখে দেখতে পান না? এইভাবে গাড়ির সামনে হুমড়ি খেয়ে এসে পড়লেন কেন?
মেয়েটি নিরুত্তর। সৌম্য আরও ক্ষেপে গিয়ে বলে,
-- এত রাতে এই নির্জন রাস্তায় একা কী করছেন আপনি? আপনার সাথে আর কেউ নেই?
মেয়েটি খুব কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
-- এই নির্জন রাস্তায় এত রাতে তারাই আসে যাদের জীবনের উপর থেকে আশা,আকাঙ্খা,ভালোবাসা মুছে গেছে। বেঁচে থেকে যারা জীবন দহন সহ্য করতে চায় না।
-- তারমানে আপনি সুই*সাইড করতে এসেছিলেন? হা ভগবান তাও আবার আমার গাড়ির সামনে? নিজে তো মরে গিয়ে জীবন যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতেন আর আমায় সারাজীবনের জন্য জেলের ভিতর জীবন যন্ত্রণা ভোগ করার ব্যবস্থা করে যেতেন।
বাড়ি কোথায় ? চলুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
-- আমি বাড়ি যাবো না। এত কথা আপনি কেন বলছেন বলুন তো? আপনি আপনার মত চলে যান। আমি আমার পথ দেখে নেবো।
-- হ্যাঁ সেতো বাড়ির পথ নয় ওপারের পথ।
মেয়েটি কোন উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। সৌম্য দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললো,
-- দেখুন আত্ম*হ*ত্যা মহাপাপ। এই সুন্দর জীবনটা কেন এভাবে শেষ করবেন বলুন। ঠিক আছে আপনি বাড়ি যেতে চান না চলুন আমার সাথে আমার বাড়ি।
-- আপনার সাথে সেই থেকে কথা বলে বুঝতে পেরেছি আপনি মানুষটা ভালো।তাই আপনাকে অনুরোধ করবো আমার সমস্যার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিজের জীবনে বিপদ ডেকে আনবেন না।
-- এতই যদি বোঝেন তাহলে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়লেন কেন?
এখন তো জেনেবুঝে আপনাকে আমি মরতে দিতে পারি না। উঠুন গাড়িতে উঠুন।
বারবার মেয়েটির আপত্তি সর্তেও সৌম্য কোন কথা না শুনে বলতে গেলে জোর করেই মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে অত রাতে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে।
সারা রাত সৌম্য জেগেই কাটায়। শিলিগুড়ি স্টেশনে গাড়ি থেকে নামতে লাগেজ নিতে সৌম্য তিয়াসাকে সাহায্য করে। সাথে নিজেদের লাগেজ তো আছেই। সৌম্যরা স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে আর তিয়াসা নিলয়ের জন্য স্টেশনে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। সৌম্য অপেক্ষা করতে চেয়েছিল কিন্তু তিয়াসা বাচ্চাটির কষ্ট হবে মনে করে ওদের চলে যেতে বলে। যাওয়ার আগে ফোন নম্বর আর গ্যাংটকে কোন হোটেলে ওরা উঠছে সে এড্রেসটা দিয়ে যায়।বারবার করে বলে যায় যাতে ওর স্বামীর সাথে সৌম্যর পরিচয় করিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ এর মধ্যেই নিলয়ের ফোন
-- তুমি কোথায়? আমি এসে গেছি
তিয়াসা তার লোকেশন জানায়। ভিড় স্টেশনের ভিতর থেকে নিলয় ছুটতে ছুটতে আসে।
তিয়াসার কাছে এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথে তিয়াসা একগাল হেসে বলে ওঠে,
-- মানুষ বটে একখানা! ফুলশয্যার রাতে ওই কেস, হানিমুনে যেতে এই কেস। জানিনা সারাজীবন ধরে আমার কপালে কত কেস আছে।
-- আসল কেসটার কথাই তো বললে না?
-- আসল কেস?
-- আমার জীবনে ভালোবেসে কেস খাওয়া -
বলেই নিলয় হাসতে শুরু করে।
ওরা একটা গাড়ি বুক করে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওনা হল। পাহাড়ের ঢালু রাস্তা দিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিশাল খাদ দেখে মাঝে মাঝে দু'জনের মনেই একটা ভয়ের সঞ্চার হচ্ছিল। কিন্তু ওদের পাইলট এতই বকবক করছিল মাঝে মধ্যে ওরা যাত্রাপথের কথা ভুলে গিয়ে তার কথা শুনতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলো।
এইভাবেই ওরা এসে পৌঁছায় ঋষিখোলা। সুন্দর মনোরম পরিবেশে পাহাড়ের পাদদেশে কাঠের তৈরি একটি সুন্দর হোটেল। পাশেই কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলেছে ঋষিখোলা নদী। জানা নেই জায়গায় নামে নদীর নাম নাকি নদীর নামে জায়গার নাম। নদীর পাশ থেকে হেঁটে এসে হোটেলে পৌঁছাতে হয়। বড় বড় পাথরের চায় নদীর মধ্যে। কিছুটা জায়গা জুড়ে হাঁটু জল। কিন্তু একটু এগিয়ে গেলেই নদীর আসল রূপ চোখে পরে। যেমন গভীর ঠিক তেমনই খরস্রোতা। চারিপাশে পাহাড় আর পাহাড়।বড় বড় গাছের সমারোহ। নাম না জানা অজস্র ফুল ফুটে আছে চারিপাশে। দুপুরের খেয়েদেয়ে দু'জনে পায়ে হেঁটে নানান জায়গায় ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরে এসে নদীর পাশে একটা বড় পাথরের চায় এর উপর বসে থাকে।
সৌম্য সেদিন অত রাতে অপরিচিত একটি মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে আসলে স্বাভাবিকভাবেই বাবা,মা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েন। মেয়েটার পরিচয় জানতে চাইলে সৌম্য কিছুই বলতে পারে না। শুধু সে একটা কথাই বলে,
-- গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল আ*ত্ম* হ*ত্যা করার ইচ্ছা নিয়ে। বাড়ি যেতে চায়নি। অত রাতে রাস্তায় মেয়েটিকে ফেলে আসতে পারিনি তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। নামধামও জানতে চাইনি।
দীপিকার কাছে প্রশ্ন করেও তার বাবা,মা একই কথা জেনেছেন। কিছুতেই তার কাছ থেকে বাড়ির ঠিকানা এবং কী কারণে সে সুই*সা*ইড করতে চেয়েছিল কিছুতেই জানতে পারেননি।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment