Wednesday, March 15, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৩৭ পর্ব)

পরদিন অসিত অফিস চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী ব্রেকফাস্ট টেবিলে মাকে বললো,
-- মা, আমি একটু বেরোব
-- কোথায় যাবি?
-- কাজটা সেরে এসে বলবো।
-- একাই যাবি? নাকি আমরা কেউ সাথে যাবো?
-- মা,তোমার কুহু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। সে এখন চাকরি করে। একাই যাবো মা।
-- তাহলে ড্রাইভারকে বলে দিই গাড়ি নিয়ে যা
 --  না,না গাড়ি লাগবে না। আমি বাসেই চলে যাবো।
 অঞ্জলীর অনেক জোরাজুরিতেও শ্রাবণী গাড়ি নেয় না।কারণ তার মনের মধ্যে অন্য কোন প্লান ছিলো। 
প্রথমেই সে বাস ধরে আসলো তাদের পুরনো ভাড়াবাড়িতে। অবশ্য বাড়িতে যাওয়ার আগে সে বাবার জন্য একটা ধুতি আর একটা ফতুয়া কিনে নিলো। বাবা সব সময়ের জন্য ফতুয়া পরতেন। ভেবেছিল বাবার সাথে একবার শেষ দেখা করে আসবে। হাতে কিছু টাকাও দিয়ে আসবে। কিন্তু যে বাড়িতে ওরা থাকতো সে ঘরে এসে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। পাশের ভাড়াটিয়ার কাছে জানতে পারে 'এই ঘরে একজন বয়স্ক লোক থাকতেন শুনেছি তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ছিলো। কিন্তু বছর খানেক আগে তিনি মারা গেছেন। ঘরের ভিতরেই মরে পরে ছিলেন। দুদিন পর দুর্গন্ধে অন্য ভাড়াটিয়ারা পুলিশে খবর দেয়। শুনেছি ভদ্রলেকের স্ত্রী মারা গেলে তার মেয়ে পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করে ওইদিনই অন্য একটি ছেলের সাথে চলে যায় বাড়ি আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে এই ঘরটি তালাবন্ধ থাকে। যেহেতু তিনি ঘরের মধ্যে মরে পড়ে ছিলেন সেইহেতু কেউ ভাড়া নিতে সাহস পায় না' 
  শ্রাবণীর চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। সামনে থাকা মহিলা যাতে দেখতে না পান তারাতারি সে পিছন ফিরে চোখের জল মুছে নিলো। হাতে ধরা বাবার জন্য আনা তার রোজগারের টাকায় কেনা ধুতি,ফতুয়ার প্যাকেটটা নিতেই ভুলে যাচ্ছিল। ভদ্রমহিলা ডেকে তাকে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিলে সে ওখান থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে হাঁটতে শুরু করে বাস ধরবার জন্য। একজন বৃদ্ধকে রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখে তার হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-- আপনি এটা রাখুন। 
 চোখের জল মুছে দ্রুত পায়ে বাসে উঠে পড়ে। হাতে সময় খুব কম। কাল বাদে পরশুই চলে যেতে হবে কর্মস্থলে। মনটা মোটেই ভালো নেই আজ। কিন্তু তবুও বাস থেকে নেমে শ্রাবণী এগিয়ে চললো অঞ্জলীর সাথে আসা সেই শপিংমলে। সেখানে ঢুকে নিজের পছন্দ মত বাবা,মা এমনকি অসিতের জন্যও কিছু কেনাকাটা করলো। এসব করতে তার প্রায় তিনটে বেজে গেছিলো। অঞ্জলী দু'বার ফোন করেছেন। দু'বারই সে বলেছে তাদের খেয়ে নিতে আসতে দেরি হবে। অরুণাভ খেয়ে নিলেও অঞ্জলী না খেয়েই বসে ছিলেন। বেশ কয়েকটি প্যাকেট নিয়ে শ্রাবণী যখন বাড়ি ঢোকে তখন প্রায় পৌনে চারটে। মা না খেয়ে আছেন শুনেই সে কোনরকমে ফ্রেস হয়েই খেতে বসে যায়।
-- কতবার তোমাকে বললাম খেয়ে নিতে আর তুমি না খেয়েই বসে আছো?
-- কিভাবে খেয়ে নিই বলতো। সেই ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়েছিস। আমি তো জানি তুই বাইরে কিছুই খাবি না। খিদে তো তোর পেয়েছে। আর আমি ঘরে থেকে খেয়ে নেবো? 
 শ্রাবণীর মনটা এমনিতেই খারাপ ছিল। মায়ের এই কথা শুনে তার চোখের থেকে আনন্দে জল পড়তে লাগলো।
-- বোকা মেয়ে! একথা শুনে কেউ কাঁদে?
 শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
-- আমি ভাগ্য করে তোমার মত মা পেয়েছি।
-- আমিও কী কম ভাগ্য করেছি। ভাগ্যে না থাকলে তোর মত মেয়ে পেতাম?

 খাওয়া দাওয়ার পরেই শ্রাবণী তার কিনে আনা জিনিসগুলো বের করে বাবা,মা,লতিকামাসী, মালী, কাজের মেয়েটি সকলের হাতে হাতে জিনিসগুলি ধরিয়ে দিতে থাকে।
-- তুই এ কী করেছিস? মাইনের টাকা সব খরচ করে এসেছিস?
 মাইনের টাকা দিয়ে আমি আর কী করবো মা? তোমরাই তো ছ'মাসের হোস্টেল খরচ,খাওয়া খরচ সব দিয়ে এসেছো। আমার জীবনের প্রথম রোজগার। তোমাদের সকলকে কিছু দিতে না পারলে আমার ভালো লাগবে? তোমাদের পছন্দ হয়েছে কিনা বলো?
 -- খুব খুব পছন্দ হয়েছে। পছন্দের থেকেও ভালো লেগেছে তুই নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে এসব করেছিস বলে। আসলে কী জানিস মা বাবা,মায়ের যতই থাকুক না কেন সন্তান যদি হাতে করে কিছু এনে দেয় সেটাই বেশি আনন্দ দেয়।
 কথাগুলো বলে অরুণাভ চশমাটা খুলে চোখ মোছেন।
-- এ কী বাবা? তুমি কাদঁছো কেন?
-- আনন্দে মা আনন্দে! আচ্ছা একটা কথা বলি বাড়ির সকলের জন্যই তো কিছু না কিছু এনেছিস? অসিতের জন্য কিছু আনিসনি?
 সোফায় রাখা প্যাকেটটা এনে বাবার হাতে দিয়ে শ্রাবণী বললো,
-- এই তো এনেছি তো - দেখো তো পছন্দ হবে কিনা?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ তুই এনেছিস তা আবার ওর পছন্দ হবে না ?
 নিজের কথা বলার ধরণে নিজেই লজ্জা পেলেন বোধহয়! তাই কথাটা ঘুরিয়ে বললেন,
-- কী অঞ্জু তোমার ছেলের পছন্দ হবে তো?
-- হ্যাঁ পছন্দ হবে। আর ওকে এই রংটা মানাবেও ভালো।
-- মা, তুমি এটা রেখে দাও। তুমি হাতে করে দিও।
-- সে কী? কিনে আনলি তুই আর দেবো আমি? না, না তুইই দিস। এখন তো আর অতু তোর সাথে আগের মত ঝগড়া করে না। তুই হাতে করে দিলে বরং ও বেশি খুশি হবে।
 অঞ্জলীর কথা শুনে শ্রাবণী আর অরুণাভ দু'জন দু'জনের দিকে তাকিয়ে পড়লেন। অঞ্জলীর এই কথাতে অরুণাভ যেন আরও কিছুটা সিওর হলেন। অঞ্জলীর সব মনে পড়ে গেছে।তবে এখনো পুরোটা সিওর তিনি হতে পারেননি।

  শ্রাবণী এবার উপরে চলে যাচ্ছে দেখে অঞ্জলী তাকে ডেকে বললেন,
-- ওরে অতুর প্যাকেটটা উপরে নিয়ে যা। আবার কখন নিচুতে আসবি তার তো ঠিক নেই।
-- মা আমি একটু পরেই আবার আসছি। এখানেই দিয়ে দেবো।
-- না, তুই উপরেই দিস ওকে। এই নে -
 প্যাকেটটা শ্রাবণীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। এবারেও অরুণাভ কিছুটা হোঁচট খেলেন। তিনি যেন একটু একটু করে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছেন। যতক্ষণ না অঞ্জলী নিজে মুখে বলছে শ্রাবণী ও খোকার বিয়ের কথা ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজের থেকে কিছুই বলবেন না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
 
 সন্ধ্যায় অফিস থেকে অসিত ফিরে আসলে সকলে বসে একসাথে চা খান। অঞ্জলী ও শ্রাবণী অবেলায় খাওয়ার জন্য কোন টিফিন করেন না। অসিত ও তার বাবা সামান্য টিফিন করেন। তখন অঞ্জলী অসিতের কাছে গল্প শুরু করেন শ্রাবণী বাড়ির সকলের জন্য কতকিছু কিনে এনেছে। বের করে দেখানও তার ও অরুণাভের জিনিস। অসিতের খুব রাগ হয়। বাড়ির সকলের জন্য কিনতে পেরেছে আর আমার জন্য কিছুই আনেনি। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। অদ্ভুতভাবে অঞ্জলীও ছেলেকে বলেন না যে তার জন্যও টিশার্ট কিনে এনেছে কুহু।

ক্রমশ 

No comments:

Post a Comment