একদিন ভালোবাসবে (১৮ পর্ব)
অঞ্জলীকে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে সকলে যখন খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন হঠাৎ করেই বহু বছর বাদে অঞ্জলীর গানের আওয়াজ পাওয়া গেলো। বাড়ির সকলে ছুটে গেলো তিনতলায় ঠাকুরঘরের দিকে। যেখানে অঞ্জলী আজ বেশ কয়েক বছর আর ঢোকেন না। লতিকার এ বাড়ির দায়িত্ব রান্নাবান্নার আর নিত্য পুজো দেওয়ার। অঞ্জলী যে একদম কিছু রান্না করেন না তা একদমই নয়। তিনি তার কুহুর পছন্দ মত খাবার কিছু না কিছু নিত্য রান্না করেন। সেটা অরুণাভ এবং অসিত খেতো। যেহেতু অসিত এখন বাইরে আছে পড়াশুনার জন্য তাই অরুণাভকেই বেশির ভাগটা খেতে হয়। কিন্তু কুহুর জন্য তিনি প্লেটে সাজিয়ে তার ঘরে নিয়ে যান। ছবির সামনে অনেক সাধ্য সাধনার পর যখন তিনি ওই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন তখন অরুণাভ কিংবা বাড়ির কাজের লোকরা যে দেখতে পেতো কেউ ফেলে দিতো কেউবা খেয়ে নিতো। এমনটাই বাড়ির সকলের প্রতি নির্দেশ দেওয়া থাকতো।
কিন্তু শ্রাবণী আসার পর রোজই একটু একটু করে অঞ্জলীর ভিতরে স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে থাকে। অঞ্জলী যত ধীরে ধীরে তার কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে - ঠিক সেভাবেই ধীরে ধীরে অঞ্জলী ও অরুণাভর অন্তরে শ্রাবণী কুহু হিসাবেই জায়গা করে নিতে থাকে। বাড়িতে মাঝে মধ্যেই হাসি,ঠাট্টা, গল্প গুজবের সাথে সাথে সকাল, সন্ধ্যা ঠাকুরঘরে শাঁখের আওয়াজ,উলুধ্বনি , ভক্তিগীতি সবই যেন একটু একটু করে ফিরে আসতে থাকে।
রোজ রাতে ব্যাঙ্গালোর থেকে অসিতের সাথে যখন অরুণাভর কথা হয় তখন তাদের মধ্যে অধিকাংশ সময়ই কুহুকে নিয়েই ঝামেলা বাঁধে। মায়ের শারীরিক উন্নতি হচ্ছে জানতে পেরেও শ্রাবণীর সম্মন্ধে তার ধারণা সেই পূর্বের মতোই রয়েছে। অসিত রোজই রাতে তার বাবাকে বোঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে শ্রাবণী কোন বড় গ্যাংয়ের হয়ে কাজ করছে। যেহেতু তাদের পারিবারিক এই বিশাল ব্যবসা,টাকাপয়সা,সোনাদানা রয়েছে এগুলির কারণেই তারা শ্রাবনীকে নানান ধরণের ট্রেনিং দিয়েই পাঠিয়েছে। সুযোগ পেলেই বড়সড় দাও মেরে পালাবে। অসিতের ভয় শুধু মাকে কোনভাবে ভুলিয়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে অপহরণ না করায়। তাই রোজ রাতে সে তার বাবাকে সতর্ক করতে ভোলে না
-- কোন অবস্থাতেই মেয়েটির সাথে মা যেন বাইরে না যান।তোমরা তো তার আসল নামটি পর্যন্ত জানতে চাওনি। কোথায়,কোন বাড়িতে সে তার মায়ের সাথে ভাড়া থাকতো তাও তোমরা জানতে চাওনি। কোন অঘটন ঘটলে কোন পথই খোলা রাখোনি একটা ডাইরি করে মেয়েটির খোঁজ করার।
অরুণাভ এখন আর ছেলের এসব কথার কোন জবাব করেন না। কারণ তিনি ভালোভাবেই জানেন "যে চিটেই ধান নেই তা ঝেড়ে কোন লাভ নেই।"
সকলেই ঠাকুরঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গান শুনতে শুনতে অঞ্জলীর পুজো দেওয়া দেখছে। কেউই তার ভিতর কোন অস্বাভাবিকতা দেখতে পাচ্ছে না। গান শেষ হলে অরুণাভ চোখের ইশারায় সকলকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন অরুণাভ আর শ্রাবণী। পুজো শেষে বাইরে আসতে গিয়ে ওদের দেখে অতি স্বাভাবিক ভাবেই বলে ওঠেন,
--- তোমাদের দেখে মনেহচ্ছে তোমরা কেউই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হওনি। তোমরা ফ্রেস হয়ে নাও আমি ব্রেকফাস্ট তৈরি করছি।
কথা বলতে বলতেই তিনি ঠাকুরের পায়ের ফুল এনে প্রথমে শ্রাবণীর মাথায় গালি পরে অরুণাভর মাথায় গলায় ছুঁইয়ে দিলেন।
গরম গরম লুচি আর আলুরদম। বহুদিন পর অরুণাভ তার অঞ্জলীর হাতের কুহু ও তার নিজের পছন্দের খাবার পেয়ে নিজেও খুব তৃপ্তি ভরে খেলেন।
-- তোকে আর একটা লুচি দিই কুহু।
শ্রাবণী মাথা নাড়িয়ে 'না'বলাতেও তিনি জোর করে আর একটি লুচি তার প্লেটে তুলে দিয়ে বললেন,
-- দুপুরে কী খাবি বল --
-- তুমি যা রান্না করবে সেটাই ভালোবেসে খাবো।
অঞ্জলী তার মেয়ের কথা শুনে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- দেখো আমাদের কুহু কত বড় হয়ে গেছে। আগে কেমন বায়না করতো 'এটা খাবো, ওটা খাবো না' আর এখন লক্ষী মেয়ের মত কথা বলছে ।
বলেই তিনি হাসতে লাগলেন। অপরপারের দু'জনেই চুপ ।
দিন গড়িয়ে যেতে থাকে আর অঞ্জলীর পরিবর্তন হতে থাকে। কিন্তু তিনি শ্রাবণীকে তার কুহুই মনে করেন। শ্রাবণী আর তার কুহুর মুখের কোন মিল নেই জেনেও এটাই তার বিশ্বাস বয়স বাড়াতে তার কুহুর মুখের আদল পরিবর্তন হয়েছে। তার এই বিশ্বাসে অরুণাভ কিংবা শ্রাবণী কোন আঘাতই করেননি কখনো।
অরুণাভ একদিন সুযোগ পেয়ে শ্রাবণীর কাছে তার জীবনের কথা জানতে চান। নিলয় এবং বাবার কথা বাদে সব কথাই সে অরুণাভকে জানায়। তাকে এও বলে সে বিএসসি পরীক্ষা দিয়েছে রেজাল্ট বের হলেও সে তা আনতে যায়নি। কথাটা শুনেই অরুণাভ তাকে বলেন,
-- চল কলেজে গিয়ে আমরা রেজাল্টটা নিয়ে আসি। আর তারপর তুই কী পড়তে চাস আমায় বল আমি তোকে পড়িয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করাবো।
কথাটা শুনে শ্রাবণীর আনন্দে চোখে জল এসে যায়। তবুও সে বলে,
-- কী লাভ আর পড়াশুনা করে?
-- কী বলছিস তুই? নিজের পায়ে দাঁড়াবি । জীবনটা গড়ে নিতে হবে তো? আমি তোকে আমার মেয়ের জায়গা দিয়েছি। সেই ভাবেই তোকে আমি মানুষ করবো। শুধু মায়ের দেখভাল করাই তো তোর কাজ নয়। নিজের জীবনটা গড়ে নেওয়াও তোর কাজের মধ্যেই পরে।
-- আমি চেষ্টা করবো বাবা সব ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে সব শুরু করতে।
-- চেষ্টা নয় মা চেষ্টা নয় তোকে পড়াশুনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। তারপর এক রাজপুত্র দেখে তোর বিয়ে দেবো।
শ্রাবণী চুপ করে আছে দেখে তিনি বললেন,
-- চল তবে কাল পরশুর মধ্যেই আমরা তোর কলেজে যাই।তবে একটা কথা তোকে বারবার বলবো বলবো করেও বলা হয়ে উঠছে না।
-- কী কথা?
অরুণাভ কিছু সময় চুপ করে থেকে বলতে শুরু করেন -
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment