দরজার বাইরেই অসিত বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো। মনেমনে ভাবতে লাগলো এটা সে কী করে বসলো? কেন করলো? মেয়েটার প্রতি তো তার কোন দুর্বলতা নেই। মেয়েটা নিঃসন্দেহে সুন্দরী। কিন্তু ওকে তো ওর একটুও পছন্দ নয়! কেন এই সাময়িক দুর্বলতা কাজ করলো ওর প্রতি? ওকে দেখার আগের থেকেই ওর প্রতি একটা বিদ্বেষ,রাগ কাজ করে। তবে আজ এটা কী করলো ও? কেন করলো? হাজারো প্রশ্ন নিজের মনের মাঝে উদ্রেক হচ্ছে। তবে কি মেয়েটার প্রতি কোন দুর্বলতা গ্রো করেছে? না, কিছুতেই না। এটা হতেই পারে না।
কতক্ষণ যে অসিত ঐভাবে দাঁড়িয়ে ছিল নিজেই জানে না। সম্বিৎ ফিরলো সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে। দেখলো মেয়েটি উঠে আসছে। অসিত খুব তাড়াতাড়ি তার ঘরে চলে গেলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে অসিত শ্রাবণীর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
-- ভিতরে আসতে পারি?
-- আপনার বাড়ি ,এই বাড়ির যেকোন জায়গায় আপনি বিনা অনুমতিতে ঢুকতে পারেন।
অসিত তা সত্বেও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে শ্রাবণী বলে উঠলো,
-- আসুন
অসিত ভিতরে ঢুকে শ্রাবণীর পড়ার টেবিলটার একটু দূর থেকেই বলল,
-- সরি
শ্রাবণী অতি স্বাভাবিক ভাবে বলে,
-- কিসের জন্য? আপনার বাড়ি আর আমি এখানে আশ্রিতা। আপনার যা খুশি তাই করতে পারেন। আপনার বাবার দয়ায় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।যদি কোনদিন সেই সুযোগ আসে একদিন না একদিন এই বাড়ি থেকে নিশ্চয় আমি চলে যাবো।এসব সরি টরি বলবেন না।
-- তোমার খুব দেমাক! আমার মনে হয়েছে আমি অন্যায় করেছি তাই ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম। বিশাল এক বক্তৃতা দিয়ে দিলে।
কথাটা বলে অসিত আর ঘরে দাঁড়ালো না। শ্রাবণী আর পড়ায় মন বসাতে না পেরে নিচে নেমে গেলো। সেদিন রাতে শ্রাবণী সারাটা রাত নিলয়ের জন্য কেঁদেছে। যে সময়ে তার পাশে নিলয়কে সব চেয়ে বেশি দরকার ছিলো ঠিক সেই সময়েই মানুষটি হারিয়ে গেলো।
এই ঘটনার পর অসিতের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।সে আর যখন তখন শ্রাবণীর উপর চড়াও হয় না। এক বাড়িতে থাকতে গেলে, এক টেবিলে খেতে গেলে দেখা সাক্ষাৎ তো হবেই। কথাবার্তা মোটেই হয় না বললেই চলে। মা,বাবা শ্রাবণীকে কুহু বলেই ডাকেন। বাড়ির পরিচারিকারা তাকে দিদি,দিদিমণি যার যা খুশি বলে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অসিত কোন কথা বলতে গেলে ভাসুর, মামা শ্বশুরের মত শূন্যে কথা ছুঁড়ে দিতে হয়।তাই এক রবিবার দুপুরে মা,বাবা যখন তাদের ঘরে ঘুমাচ্ছেন অসিত শ্রাবণীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো শ্রাবণী তার পড়ার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে সম্ভবত টেবিলটা গুচাচ্ছে। সে বাইরে দাঁড়িয়ে সেই একইভাবে ভিতরে ঢোকার অনুমতি চাইলো। শ্রাবণীও তাকে 'আসুন' বলে চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে খাটের উপর বসলো। অসিত ঘরে ঢুকে প্রথমে একটু ইতস্তত করে চেয়ারটাতে বসে বললো,
-- আসলে কিছু কথা বলার ছিলো
-- আমি কবে এ বাড়ি থেকে যাবো এটাই জানতে চান তো ?
-- আচ্ছা তুমি কী ভালো কথা মনে আনতে পারো না? হ্যাঁ আমি মানছি আমি তোমার সাথে এক সময় খুব খারাপ ব্যবহার করেছি। কিন্তু এখন তো আমি কিছু তোমায় বলি না।
-- ওটাই আমার অসুবিধা হচ্ছে। কেন বলছেন না?
-- মানে?
-- আর কিছুদিন সহ্য করুন। ট্রেনিংটা শেষ করে নিশ্চয় একটা চাকরি পেয়ে যাবো। তখন এখান থেকে চলে যাবো।
-- তুমি তো প্রচণ্ড স্বার্থপর! মা,বাবার কথা একবারও ভাবলে না? তাদের ছেড়ে চলে যাবো কথাটা বললে কী করে?
--- আপনার বাবা,মা আপনার কথামত তাদের জন্য শুধু আপনি ভাববেন। আমার ভাবা উচিত নয়। সেটাও আপনার কথামত --
অসিত চুপ করে আছে দেখে শ্রাবণী তাকে আবারও বললো,
-- বলুন আপনি কী বলতে এসেছেন?
-- বলার মুডটাই তো নষ্ট করে দিলে
-- আমি খুব অবাক হচ্ছি আপনি মাঝে মাঝেই আমার ঘরে আসছেন কখনো সরি আবার কখনো বা কিছু বলতে। আপনার যা কিছু বলার আছে বাবাকে সরি আপনার বাবাকে বলবেন। আপনাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছি,ভালোমন্দ খাচ্ছি, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি - তাই আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
-- তুমি এত কথা কেন বলো? আমি আমার পূর্বের সব ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছি।
-- হঠাৎ কী হল আপনার? খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছেন তবে আমি কোন গ্যাংয়ের হয়ে কাজ করছি না।
-- উফ্ এত ধারালো কেন তোমার কথাগুলো? ক্ষমা চাইলাম তো
-- ছি ছি আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন বলুন তো? যাক গে - কী জানতে এসেছেন বলুন।
অসিত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-- আসলে তেমন কোন বিশেষ কথা নয়। মা,বাবা তোমায় কুহু অর্থাৎ আমার দিদির নামেই ডাকেন। তারা তোমার আসল নামটাও কোনদিন জানতে চাননি। আমি তোমার আসল নামটা জানতে চাই
-- কেন বলুন তো ? থানায় ডাইরি করবেন?
-- তুমি বড্ড ঝগড়ুটে। ভালো কথা বলতেই জানো না
-- হঠাৎ আপনার আমার আসল নামটা দরকার হয়ে পড়লো কেন? কী করবেন আমার আসল নামটা জেনে সেটাই জানতে চাইছি।
-- তেমন কিছু করবো না।একই বাড়িতে থাকি। কখনো তো প্রয়োজন হতেই পারে তোমাকে ডাকার। বাবা,মায়ের মত আমি তো আর কুহু বলে ডাকতে পারবো না। আবার দিদি বলেও ডাকতে পারবো না। কারণ তুমি আমার থেকে অনেক ছোট।
-- আপনার বাবা এখন আমার আসল নামটা জানেন।আমার কলেজ সার্টিফিকেটগুলো এখন তার কাছেই।
-- সেই থেকে তুমি আপনার বাবা,আপনার বাবা করছো কেন?
-- তাহলে কী তাদের নাম ধরে বলবো?
-- কেন নাম ধরে বলবে? বাবা,মা বলবে -
-- সে কী? এটা তো আপনিই আমায় নিষেধ করেছেন।
--- হ্যাঁ করেছিলাম কিন্তু এখন শুনতে আর ভালো লাগছে না।
-- কেন ভালো লাগছে না?
-- উফ্ তোমার সাথে তর্কে কেউ পেরে উঠবে না।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment