দুপুরে খাবার টেবিলেও আয়োজন ছিল যথেষ্ঠ। আজ অঞ্জলী অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশিই হাসিখুশি। তিনি জোর করে করে তার কুহুকে খাওয়ান। অসিত অফিস থেকে এসেই ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে চলে যায়। তখন শ্রাবণী নিচুতে। কিছুক্ষণ পরে ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে এসে সামান্য টিফিন করে। শ্রাবণী আর মা আজ বেশ খোশ মেজাজে আছেন দেখে ওর ও খুব ভালো লাগে। নিজে আর ওদের ভিতর না ঢুকে সে আস্তে আস্তে বাবার ঘরে চলে যায়। অরুণাভ তখন এক ফাইল খুলে ব্যবসার কাগজ দেখছিলেন। অসিত এসেছে দেখে তিনি বললেন,
-- তোকে যা বলেছিলাম সেটা কী এনেছিস?
অসিত সলজ্জ হেসে মাথা নাড়ালো।
-- আচ্ছা বাবা, আমার যতদূর মনেহচ্ছে মায়ের সব কিছু মনে পড়ে গেছে। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলছেন না কেন?
-- তোকে বলিনি ডাক্তারবাবুর একটা কথা। তিনিও কিন্তু মনে করেন তোর মায়ের সবকিছু মনেপড়ে গেছে। কিন্তু তিনি কাউকে কিছুই বলছেন না। আজকে যেভাবে তোর মা শ্রাবণীর জন্মদিনটা পালন করলেন আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার আলমারিতে শ্রাবণীর একটা ফাইল আছে। তোর মা কোনদিনও আমার ব্যবসার কাগজপত্রে হাত দেন না। কিন্তু এখন মনেহচ্ছে তিনি ওই ফাইল দেখেছেন। তবে মেয়েটিকে তোর মা বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন। অবশ্য আমিও ওকে ভীষণ ভালোবাসি। ওর জন্যই তো তোর মা সুস্থ হল।
-- কিন্তু বাবা, মা পুরোটা স্বীকার করছেন না কেন?
-- শ্রাবণীকে হারানোর ভয়ে। করবে খুব শীগ্রই স্বীকার করবে।
-- কীভাবে?
-- এই যে তোমার কল্যাণে!
মিটিমিটি হাসতে থাকেন অরুণাভ
-- বুঝলাম না
-- বুঝলে না ? যখনই আমি শ্রাবণীর বিয়ের কথা তোর মাকে বলবো ঠিক তখনই সে তাকে বাড়িতেই আটকে রাখতে চাইবে। সে তোর বিয়ের কথা বলছে কেন বুঝতে পারছিস তুই?
-- না বুঝতে পারছি না -
-- হয়ত তোর মুখ থেকেই শুনতে চাইছিলো। কিন্তু আমরা নিজেরা একথা বলবো না। তোর মায়ের মুখ থেকে যখন একথা বেরোবে তখনই আমি ফিল্ডে নামবো।
-- কিন্তু বাবা ও তো আমাকে পছন্দই করে না
-- তুই একটা গা*ধা। যা তুই এখন আমাকে কাজ করতে দে।
রাতে খাবার টেবিলে পায়েসের বাটি দেখে অসিত বললো,
-- আজ হঠাৎ পায়েস কেন মা?
-- ওই কুহুর নামে একটু পুজো দিলাম
-- এতকাল তো দেখেছি মিষ্টি,ফল দিয়েই পুজো দিতে। পায়েস দিতে তো কোনদিন তোমায় দেখিনি
-- আমার ইচ্ছা করলো তাই আর কী!
অসিত ইচ্ছা করে আর কোন কথা বাড়ালো না। খেতে বসে কয়েকবার শ্রাবণীর দিকে তাকালো ঠিকই কিন্তু কথা কিছু বললো না। ওর সাথে কথা বলতে গেলেই ঝামেলা হয়। জন্মদিনে অসিত শ্রাবণীর সাথে আর ঝামেলা করতে চাইলো না।
শ্রাবণী খেয়ে উপরে তার ঘরে ঢুকলে অসিত কিছু পরেই শ্রাবণীর ঘরে গিয়ে ঢোকে। প্রথমেই বলে,
-- ওষুধ খেয়েছো? দুপুরে ওষুধগুলো খেয়েছিলে?
শ্রাবণী খুব আস্তে উত্তর দেয়
-- দুপুরের গুলো খেয়েছিলাম। এখনকার টা খাবো। কিন্তু একটা কথা বলুন তো -
শ্রাবণীর কথা শেষ হয় না অসিত একটা আঙ্গুল তার ঠোঁটের উপর রেখে বলে,
-- উহু আজ একদম ঝগড়া নয়। তারপর মুখটা শ্রাবণীর একদম মুখের কাছে এনে বলে,
-- শুভ জন্মদিন।
একটা প্যাকেট শ্রাবণীর হাতে দিয়ে বলল,
-- এটা তোমার জন্য। এর ভিতর একটা লাল কাঞ্জিভরম আছে। অবশ্য দোকান থেকেই বললো ওটা কাঞ্জিভরম। আশাকরি তোমার পছন্দ হবে। তুমি এটা নিলে আমি খুব খুশি হবো।
-- আপনি কী করে জানলেন আজ আমার জন্মদিন?
-- বাবা অফিসে ফোন করেছিলেন। আর শাড়িটাও বাবা কিনে আনতে বলেছিলেন। সুতরাং তুমি না নিলে এটা আমার সাথে বাবাও কষ্ট পাবেন।
-- আপনি কী মানুষ বলুন তো? শেষ পর্যন্ত আপনার মনের কথাগুলো বাবাকেউ জানিয়েছেন?
-- আজ্ঞে না ,আমি বাবাকে কিছুই বলিনি। অত বোকা আমি নই। বাবা তার বুদ্ধি দিয়ে ছেলের মনের কথা বুঝেছেন। সবাই তো আর মনের ভিতর দেখতে পায় না।
-- জীবনে ভালোভাবে চলতে গেলে সকলের মনের খবর নেওয়া যায় না। যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু জানাই বুদ্ধিমানের কাজ।
-- আচ্ছা আজ তোমার জন্মদিনে একটা সত্যি কথা বলো তো? আমার প্রতি কি তোমার বিন্দুমাত্র কোন অনুভূতি নেই?
-- কে বললো নেই? ঘুরতে গিয়ে আপনি অসুস্থ্য হলে আমি কি আপনার জন্য কিছু করিনি? এটা যদি অনুভূতি না থাকতো তাহলে কি করতাম?
-- সেতো আমরা রাস্তাঘাটে অসুস্থ্য মানুষ দেখলেও করে থাকি। আমি সে অনুভূতির কথা বলিনি। আমি জানতে চাইছি --
-- না, আপনি যে অনুভূতির কথা জানতে চাইছেন সে অনুভূতি আপনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র নেই। কোনদিন হওয়ার কোন চান্সও নেই। তবে হ্যাঁ আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা বোধ আছে। আর আমার এই সময়ে আপনি যা করেছেন সে ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না।
-- সব উত্তর ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। সময় সব কিছুর উত্তর দেবে। এ নিয়ে আজকে অন্তত কোন তর্ক আমি তোমার সাথে করবো না। দাঁড়াও তোমার ওষুধগুলো দিই।
-- আমি নিয়ে নিতে পারবো।
-- সেতো জানি।
কথা বলতে বলতেই অসিত ওষুধগুলো স্টিপ থেকে খুলে শ্রাবণীর হাতে দিয়ে জলের বোতলের মুখটা খুলে হাতে ধরিয়ে দিল। শ্রাবণী ওষুধ খাওয়ার সাথে সাথে আবার বোতলটা হাতে নিয়ে মুখ লাগিয়ে খাটের উপর মাথার বালিশের কাছে রেখে দিয়ে বললো,
-- এবার শুয়ে পরও। যতদিন না তোমার প্লাস্টার খোলা হচ্ছে তুমি দরজাটা ভেজিয়েই রেখো। মা কিন্তু আজ সকালে উঠেই তোমাকে দেখতে এসেছিলেন। তোমায় ঘুমাতে দেখে আমার সাথে কথা বলে নিচুতে নেমেছেন।
এটা চলতেই থাকবে যতদিন না তুমি সুস্থ হও।
শ্রাবণী একটু অন্যমনস্ক ভাবেই বললো,
-- মা,বাবা দু'জনেই আমায় খুব ভালোবাসেন।
অসিত ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে বললো,
-- কবে যে তুমি আমার ভালোবাসাটা বুঝবে ঈশ্বর জানেন।
-- আপনি কথাই কথাই এই কথাটা আমায় শোনাবেন নাতো
-- শোনায় কী আর সাধে? মনের কষ্টে বেরিয়ে আসে।
অসিতের হাসি হাসি মুখ দেখে শ্রাবণী একটু রেগেই বললো,
-- এখন হয়েছে আর এক জ্বালা! রোজ রাতে এই ওষুধ দেওয়ার নাম করে ওই একই কথার পুনরাবৃত্তি। ভালো লাগে না রোজ রোজ এক কথা শুনতে।
-- আমারও কী আর রোজ রোজ একই কথা বলতে ভালো লাগে?
অসিত হাসতে থাকে। শ্রাবণী তখন দরজার দিকে আঙ্গুলটা দিয়ে বললো,
-- এবার আপনি আসুন। আমি ঘুমাই।
-- আর একবার শুভ জন্মদিন।
শ্রাবণী 'থ্যাংকস'বলে শোয়ার জন্য বালিশের দিকে এগিয়ে গেলো। অসিত লাইট অফ করে দরজা ভেজিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment