শ্রাবণী অঞ্জলীর ঘর থেকে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসলো। সদ্য মা হারা মেয়েটি বিধাতার লিখনে এমন এক পরিবারে এসে একজন মা পেলো যে মা কিনা তার একমাত্র মেয়ের শোকে অর্ধ উন্মাদ। আর বাবা বলে যাকে ডাকলো তিনি একজন মাটির মানুষ বলা ভালো ঈশ্বর জন্মের পর থেকে তাকে পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত করলেও ঠিক একজন দেবতুল্য পিতা তারজন্য ঠিক করেই রেখেছিলেন।
-- কুহুকে তোর মা ছোটবেলায় গান গেয়ে ঘুম পারাতো আজ এর উল্টোটা করলি কী করে? কতদিন পর অঞ্জলী আজ ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমালো। মাত্র কয়েক ঘন্টায় তুই আমাদের বড় আপন করে নিলি রে মা!
-- আমাকে উনি মানে মা বললেন 'আয় তোকে ছেলেবেলার মত ঘুম পাড়াই।' তখন আমি বললাম, 'না মা, এখন আমি বড় হয়েছি আমিই তোমাকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াবো।' উনিও রাজি হয়ে গেলেন।
-- তোর গানের গলাটা ভীষণ মিষ্টি। জানিস মা, তোর মা ও কিন্তু গান শেখেনি কিন্তু কী সুন্দর গান করতো একসময়। আচ্ছা কুহু -
ডাকটা দিয়েই অরুণাভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
-- তোর আসল নামটা বলতো ? আমরা নিজেরা যখন কথা বলবো তখন তো ওই নামটা ধরেই তোকে ডাকতে পারবো।
--- ওই নামটা আমি ভুলে যেতে চাই বাবা। আমি তোমাদের কাছে তোমাদের কুহু হয়েই থাকতে চাই। তোমরা আমাকে কুহু বলেই ডেকো।
আনন্দে অরুণাভর চোখে জল এসে গেলো।
---- হ্যাঁ যা বলছিলাম তোর নিজের মা কতদিন হল চলে গেছেন?
শ্রাবণী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-- আজ এগারোদিন। কালীঘাটে মায়ের কাজ করে শুন্য ঘরে আর ফিরতে ইচ্ছা করছিলো না। তাই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তোমার গাড়ির সাথে যদি আমার ধাক্কা না লাগতো তাহলে আজই হয়ত কোন অন্ধকার গলিতে আমার ঠাঁই হত।
-- এসব বলতে নেই মা। তোর সব কথা শুনবো। আমারও তোকে অনেক কথা বলার আছে। তুই গিয়ে তোর মায়ের পাশে শুয়ে পড়। আমিও আমার ঘরে যাই। অঞ্জলী যখন ওখানে ঘুমিয়ে পড়েছে আর ওকে ডেকে তুলে নিয়ে যাবো না আমাদের ঘরে। তুই আজ অসাধ্য সাধন করেছিস। কত কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়েও ওকে কতদিন যে আজকের মত অকাতরে ঘুমাতে দেখিনি। অসাধ্য সাধন করলি মা! যা - অনেক রাত হয়েছে এবার শুয়ে পর।
শ্রাবণী পুণরায় ফিরে এলো ওই ঘরটিতে। দোতলার দশ বাই বারো ফুটের ঘরের একপাশে একটি ব্যালকনি। ঘরের ভিতর অ্যাটাচ ওয়াশ রুম। ঘরের দক্ষিণ দেওয়ালে কুহুর নানান বয়সের ছবি দামী ফ্রেমে বাঁধানো। ডবল বেডের একটি খাট, একটি ডবল ডোরের দামী কোম্পানির আলমারি, এককোণে পড়ার টেবিল চেয়ার। সেই দেওয়ালেই রয়েছে একটি বড় বুকশেলফ। দেখলে মনেহয় এই ঘরটি যে মানুষটির জন্য তৈরি তার এখানে নিত্য ঘোরাঘুরি। নাইট ল্যাম্পের আলোয় পা টিপে টিপে ঘরের ভিতর ঢুকে খুব আস্তে করে সে তার এখনকার মায়ের পাশে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসে না। এই দুর্দিনে নিলয়ের কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে। না চেনে তার বাড়ি ,না মুখস্ত তার ফোন নম্বর। মায়ের কষ্ট, মায়ের সারাজীবনের দুঃখের কথা মনে পড়লেই বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সারাজীবন দুঃখ,যন্ত্রণা ভোগ করে বিনা চিকিৎসায় নীরবে চলে গেলেন। কিন্তু কোন অভিযোগ শ্রাবণীর বিধাতার প্রতি নেই। কারণ একদিক ভাঙলেও আর একদিন গড়ে দেওয়ার মত তিনি এই পরিবারটিকে তার জীবনে এনে দাঁড় করিয়েছেন।এখনো যে সে
বেঁচে আছে তা বোধকরি ঈশ্বরেরই আশীর্বাদ।
শ্রাবণী মনেমনে ভাবে মানুষ তার ভাগ্য নিয়েই জন্মায়। জন্মের পরে ভাগ্যের সেই ছবিটাকে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী পরিশ্রমের মাধ্যমে কেউ সুন্দর রূপ দিতে পারে আর কারও বা শত পরিশ্রমও বৃথা যায়। আর এখানে সে যে দুর্ভাগ্য নিয়েই জন্মেছে - পরিশ্রমের ফল মিঠা হবে কী করে? বিধাতা সবকিছুই আগে থাকতে ঠিক করে রাখেন যে।
দু'একবার যে বাবার কথা মনে পড়ছে না তা মোটেই নয়। অসুস্থ্য,বৃদ্ধ মানুষটি একাএকা কী খাবেন,কিভাবে থাকবেন এসব ভাবলেই বাবার জন্যও মাঝে মাঝে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবছে মা ছাড়া বাড়িতে বাবার অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেতেই হয়ত এই মানুষটার সাথে তার পরিচয় হয়েছে। বাবার স্নেহ,বাবার ভালোবাসা যা কোনদিন সে পায়নি মাত্র কয়েক ঘন্টায় এই মানুষটা সেই কষ্টের উপর অনেকটাই প্রলেপ দিয়ে দিয়েছেন। না, অতীতকে ভুলতেই হবে তাকে। তবে চেষ্টাও করে যেতে হবে যদি নিলয়ের একটা খবর সে পায়। নিলয়ের কথা মন থেকে কিছুতেই সে ভুলে যেতে পারছে না। সেদিনের সেই রাতের ঘটনার পর কোনভাবেই আর নিলয়ের সাথে সে যোগাযোগ করতে পারেনি। নিলয়ের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলি কিছুতেই যে সে ভুলতে পারছে না। ফোনটা বাবা জোর করে নিয়ে নেওয়ার ফলেই তার নিলয়ের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে ভাবলেই বাবার প্রতি আরও রাগ বেড়ে যাচ্ছে।
বহু বছর বাদে অঞ্জলী গতকাল রাতে একটা শান্তির ঘুম দিয়েছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার পাশে তার কুহু ঘুমাচ্ছে। এটা দেখে এক অনাবিল শান্তিতে তার মন ভরে গেলো। তিনি খুব সন্তর্পনে কুহুর কপালে একটা স্নেহের চুম্বন এঁকে দিয়ে যাতে তার ঘুমের ব্যঘ্যাত না হয় ঠিক সেইভাবে খাট থেকে নেমে নিজেদের ঘরে গিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকলেন। সারাটা রাত শ্রাবণী ঘুমাতে না পারলেও ভোরের দিকে সে ঘুমিয়ে পরে। আর অরুণাভও অনেকদিন পর তার অঞ্জলীকে ওষুধ ছাড়া ঘুমাতে দেখে নিজের ঘরে অঘোরে ঘুমিয়ে চলেছেন।
সেই আগের মত অঞ্জলী ভোরেই স্নান সেরে পরিপাটি করে শাড়ি পরে কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ পরে চুল আঁচড়ে একটা হাত খোঁপা করে প্রথমেই গিয়ে ঢুকলো রান্নাঘরে। তখন সেখানে বহু পুরনো রান্নার দিদি লতিকা উপস্থিত হয়ে গেছে। তাকে সেই মুহূর্তে খুঁটিনাটি কাজের দায়িত্ব দিয়ে একটু পরে নিজেই এসে রান্না করবেন বলে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েন।
এদিকে শ্রাবণী ঘুম থেকে জেগে পাশে তার মাকে দেখতে না পেয়ে নিচুতে নেমে পাগলের মত এঘর ওঘর খুঁজতে খুঁজতে অরুণাভর ঘরে গিয়ে ঢুকে তাকে ঘুমাতে দেখে ডেকে তুলে জানায় ,
-- মাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
অরুণাভ ধড়মড় করে উঠে প্রথমেই যান মেইন গেটের কাছে। নাহ্ সেখানে তো তালা দেওয়া। তাহলে অঞ্জলী গেলো কোথায়?
ক্রমশ
বিশেষ দ্রষ্টব্য - গল্পটি আপনাদের ভালো লাগলে লাইক,কমেন্টস করে গঠনমূলক সমালোচনা করলে এবং আপনারা কিভাবে গল্পটিকে পড়তে চাইছেন জানালে আমি লেখায় আরও উৎসাহ পাবো। 🙏🙏
No comments:
Post a Comment