দু'রাত একবেলা কাটিয়ে নিলয়, তিয়াসা বাড়ি ফিরে আসে। পরদিন থেকেই নিলয় অফিসে জয়েন করে। নিলয় ও তিয়াসার কথাবার্তা,খুনসুঁটি দেখে নিলয়ের মা'ও খুব খুশি। বিয়ের পরে প্রথমদিন অফিসে যাওয়ার আগে তিয়াসা নিজের হাতে নিলয়ের টিফিন করে দেয়। নিলয় স্নান করে এসে দেখে খাটের উপর তার জামাকাপড় রেডি যা সে অফিসে পরে যাবে। তিয়াসা তখন ঘরেই ছিল। নিলয় টাওয়াল পরে ঘরে ঢুকে তিয়াসাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। আচমকা নিলয়ের এই কাজে তিয়াসা হাসতে হাসতে তাকে বলে,
-- মশাই, তোমার যা অবস্থা তাতে মনেহচ্ছে অফিসে গিয়ে তুমি মন দিয়ে কাজ করতে পারবে না।
-- এক কাজ করো।আমার সাথে তুমিও অফিস চলো। আমার সামনে বসে থাকবে তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি কাজ করবো।
-- হ্যাঁ এখন সেটাই বাকি আছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচুতে আসো।
-- দূর আমার অফিস যেতে একদম ইচ্ছা করছে না। সারাটাদিন তোমার সাথে থাকতে ইচ্ছা করছে।
-- আমি আজ দু'দিন ধরে তোমায় দেখছি আর ভাবছি - যে মানুষটার ভিতর এত প্রেম, এত কাছে আসার তাগিদ সে ফুলশয্যার রাতে কিভাবে পারলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাতটাকে নষ্ট করতে।
-- এটা যে আমিও ভাবছি না তা কিন্তু নয়। তবে ভালো হয়েছে জানো। এরপর থেকে আমরা প্রতিটা রাতকেই ফুলশয্যার রাত বানাবো।
তিয়াসা নিলয়ের ভিজে চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-- পাগল একটা! তাড়াতাড়ি আসো। এরপর দেরি হয়ে যাবে অফিসে।
নিলয় চিৎকার করে বলল,
-- আজই কিন্তু আমি হানিমুনের টিকিট কেটে আনবো।
তিয়াসা যেতে যেতে বলল,
--- তোমার যা খুশী তাই করো। আমি বুঝতে পেরেছি কী পাগলের পাল্লায় আমি পড়েছি।
অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে নিলয়ের রাত ন'টা বেজে যায়। রোজ এই সময়েই ও ফেরে। তিয়াসা আজ রাতের সমস্ত রান্না নিজে করেছে। শ্বাশুড়ী মাকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয়নি। রান্না করতে করতে তিয়াসার হঠাৎ মনে পড়ে যায় ফুলশযার পরদিন নিলয় কার জন্য সারাটা দিন হাসপাতালে ছিল আজ জিজ্ঞাসা করবে। কী এমন গোপন কথা তার জীবনে আছে যার জন্য সে ফুলশয্যার রাতে ঐরকম ব্যবহার করেছিল? একটু একটু করে ওর ভিতরের সব কথাগুলো বের করে আনতে হবে। যদিও পুরনো কোন ঘটনা নিয়েই তিয়াসার মাথা ব্যথা নেই কিন্তু তবুও যে মানুষটার সাথে তাকে সারাটা জীবন কাটাতে হবে তার সম্মন্ধে তো কিছুটা হলেও তো জানতে হবে।
নিলয় বাড়িতে ঢোকা থেকে তিয়াসাকে বহুবার ইশারায় উপরে যেতে বলেছে। কিন্তু রান্নার মাঝখানে শ্বশুর,শ্বাশুড়ীর কাছ থেকে উপরে উঠে যেতে তার খুব লজ্জা লাগছিল। শেষমেশ বিফল মনোরথ নিয়ে নিলয় উপরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নিচেই নেমে আসে। রাতে খাবার টেবিলে নিলয়ের বাবা নিলয়কে বললেন,
-- তোরা কবে বাইরে ঘুরতে যাবি?
নিলয় একবার তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবাকে বললো,
-- দেখি আবার কবে ছুটি পাই। সবে তো ছুটি শেষ হল। যাবো যত তাড়াতাড়ি পারি।
-- আমার একটা কথা ছিলো তোদের সকলকে বলার। তোদের সকলের মতামতটা দরকার।
নীলিমা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- কী এমন কথা যে সকলের মতামত দরকার সে কাজে?
-- আমি বলছি কী নীলু , বৌমা তো এত লেখাপড়া শিখেছে। তা কি সবই ওই রান্নাঘরে হাতাখুন্তি নাড়ানোর মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে? তাছাড়া আমি বেয়াই মশাইকে কথা দিয়েছিলাম বৌমা যদি চাকরি করতে চায় আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না। আজকের যুগে সব মেয়েরাই চায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
নিলয় বাবার কথা শুনে তিয়াসার দিকে একটু তাকিয়ে নিয়ে তার মনের ভাবটা বোঝার চেষ্টা করে বললো,
-- টিয়া যদি চাকরি করতে চায় আমার কোন আপত্তি নেই। তবে এটা সম্পূর্ণভাবে ওর ডিসিশনের উপর নির্ভর করছে।
-- কী গো গিন্নী আর তোমার কী মত?
-- ভালোই তো। আপত্তির কোন কারণই দেখছি না। আজকের যুগে সংসারের চাহিদা মেটাতে গেলে স্বামী,স্ত্রীর দু'জনকেই রোজগারের জন্য বাইরে বেরোতে হয়। আর মেয়েরা হচ্ছে দশভূজা। দশ হাতে ঘর,বাইরের যাবতীয় কাজ তারা করতে পারে। তাই আমিও খুব খুশি হবো বৌমা যদি চাকরি করে।
সকলের সব কথা শুনে অজয় বললেন,
-- বেশ তাহলে তো কারো কোন আপত্তি নেই। তুমি কাল থেকেই চাকরির জন্য চেষ্টা করতে লাগবে। চাকরি করবো বললেই তো আর চাকরি পাওয়া যায় না। এখন থেকে লেগে থাকলে বয়স থাকতে থাকতে একটা কিছু অবশ্যই পেয়ে যাবে।
তিয়াসা শ্বাশুড়ীকে এখন কোন কাজই করতে দেয় না। সকলের খাওয়া হলে সে টেবিল পরিষ্কার করে বাকি খাবার ফ্রিজে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দেখে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে নিলয় দরজার উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। তিয়াসা দরজা বন্ধ করে নিলয়ের কোমরের উপর থেকে মুখটা বাড়িয়ে বলে,
-- খোকা, তুমি রাগ করেছো?
-- হ্যাঁ খুব রাগ করেছি।
-- এত অবুঝ কেন খোকা তুমি? ওই সময় কি আমি উপরে উঠতে পারি? বাবা,মা কী মনে করতেন বলো তো?
নিলয় পাশ ফিরে দুইহাতে তার বউকে জড়িয়ে বুকের উপর টেনে নিয়ে বললো,
-- এই হানিমুনের টিকিট কেটেছি। আমরা গ্যাংটক যাবো আগামী মাসে।
-- বাবা যখন বললেন তুমি তো কিছু বললে না?
-- যাবো তো হানিমুনে। তাই তোমাকে আগে জানাতে চেয়েছি। বাবা,মাকে কাল অফিস থেকে ফিরে এসে বলবো।
-- সত্যিই তুমি একটা পাগল!
নিলয় তিয়াসাকে আরও গভীরভাবে কাছে টানতে গেলে তিয়াসা তাকে বলে,
-- আজ তোমার কাছে কিছু জানতে চাইবো। বলবে?
-- বলো কী জানতে চাও? আমিও তোমাকে আমার অতীতের সব কথা জানাতে চাই। সকলের জীবনেই কিশোর বয়সে কিছু ঘটনা থাকে। আমারও ছিলো হয়ত তোমারও আছে। কিন্তু সত্যি বলছি আমি তোমার অতীতে যদি কিছু ঘটে থাকে তা জানতে চাই না। আমার কাছে বর্তমানই জীবন। অতীত আমরা ভুলতে পারি না ঠিকই কিন্তু অতীতের কোন ছাপ যদি বর্তমান জীবনের উপরে পরে তাহলে সব খানখান হয়ে যায়। বলো তুমি কী জানতে চাও?
-- তুমি আগে কাউকে ভালোবাসতে।
-- হ্যাঁ বাসতাম কলেজ লাইফে। শেষ পরীক্ষার দিনে মেয়েটিকে দু'টি ছেলে তুলে নিয়ে যায়। আমি আর আমার এক বন্ধু ঘটনাচক্রে ওরা যাওয়ার সময় বিষয়টা দেখে ফেলি। তারপর আমার অন্যান্য বন্ধুরা মিলে যখন তাকে উদ্ধার করে ওদের বাড়ির রাস্তা অবধি নিয়ে আসি ওর বাবা আমাকে ভুল বুঝে আমাকেই দোষারোপ করে মারধর করে আমার বিরুদ্ধে কেস দিয়ে দেন। পুলিশ আমায় অ্যারেস্টও করে। কিন্তু আমার অন্যান্য বন্ধুদের মুখ থেকে সব ঘটনা জানার পর সেদিনই আমার এক বন্ধুর বাবা আমাকে জামিনে মুক্ত করেন। সেই থেকে সেই কেস আজও চলছে। আর সেই ঘটনার পর মেয়েটির সাথে আমার আর দেখা হয়নি। বলতে একটুও বাঁধা নেই আমি মেয়েটিকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোন খোঁজ পাইনি। এটাই হচ্ছে আমার অতীতের কাহিনী।
-- এত কিছুই না! আমি তো ভাবলাম বিশাল কিছু ঘটনা। তুমি যা ফুলশয্যার রাতে খেল দেখালে আমি তো ভেবেছিলাম গেলো আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে।
তিয়াসা হাসতে লাগে। নিলয় তাকে বলে,
-- তোমাকে তো আমি বলেছি ওই রাতটা আমি তোমাকে প্রতিরাতে ফেরৎ দেবো।
বলেই তিয়াসাকে বুকের উপর থেকে নিজের বালিশে শুইয়ে দিয়ে তার ঠোটে দখল নেয়। তিয়াসা নিলয়ের মুখটা ঠেলে দিয়ে বলে,
-- দাঁড়াও দাঁড়াও আরও একটা কথা জানার আছে।
-- আজ আর কোন কথা না। বুঝতে পারছো না ওসব কথা বলার পরিস্থিতি আমার আর নেই।
তিয়াসা হাসতে লাগে আর তারপরেই
পুনরায় তারা মিশে যায় সেই আদিম খেলায়।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment