লতিকামাসী উপরে শ্রাবণীর চা দিয়ে গেলেও চা টা শেষ করেই শ্রাবণী নিচুতে নেমে যায়। নামার আগে অসিতের ঘর অন্ধকার দেখে কৌতূহল বশত অসিতের ঘরে পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখে সে ঘরে নেই। শ্রাবণী নিজেও বুঝতে পারছে না অসিতকে কেন আগের মত আর অসহ্য ওর লাগছে না। নিজেকেই নিজে বোঝায় হয়ত মানুষটা তার এই অ্যাক্সিডেন্টে এতটা দৌড়ঝাঁপ করেছে বলেই কৃতজ্ঞতা বশত তার এমন হচ্ছে। সে নিচুতে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে দেখে অঞ্জলী অরুণাভকে বললেন,
-- দেখো মেয়ের কান্ড! আমি তাকে উপরে চা পাঠিয়ে দিলাম আর সে কাপ হাতে নিচেই নেমে আসলো।
দুজনেই বসে ছিলেন ডাইনিং রুমে। তাকে দেখে অরুণাভ খুব খুশি হলেন এবং মেয়েকে হাত ধরে নিজের কাছে বসিয়ে বললেন,
-- এখন কেমন আছিস মা? এখনো কি ব্যথা করছে?
-- না,না বাবা এখন আর ব্যথা নেই। এখন আমি ভালো আছি। কিন্তু মা যদি একদম আমায় উপরে বসিয়ে রাখেন তাহলে অসুস্থ্য হয়ে পড়বো।
-- ওমনি মায়ের দোষ না? খামোখা কী একটা কান্ড করে বসলি বলতো?
অঞ্জলী কথাটা বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- সেই কখন অসিত বেরিয়েছে এখনো আসে না কেন বলো তো?
-- আরে ওর কাজ হয়ে গেলেই আসবে। সব বিষয়ে এত চিন্তা কেন করো বলতে পারো?
-- চিন্তা কী আর করি সাধে? এই দেখো না কুহু কী একটা ঘটিয়ে বসলো!
-- ঠিক আছে,ঠিক আছে। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। কিন্তু মা তোকে তো হাসপাতালে একটু জানাতে হবে তো?
-- হ্যাঁ বাবা মেল করে দিয়েছি।
-- যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো। নতুন তার উপর সরকারি চাকরি। ভাবছিলাম এটা নিয়ে খুব।
ওরা ওখানে বসেই গল্পগুজব করছিলেন। মাঝে মধ্যে অঞ্জলী উঠে রান্নাঘরে টিফিনের তদারকিতে যাচ্ছিলেন। কারণ তার মাথায় রয়েছে কুহু অনেক তাড়াতাড়ি লাঞ্চ করেছে। ওর খিদে পেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বাদে বেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খোলেন অঞ্জলী। অসিত তার হাতে একটা খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে বলে,
-- মা গরম গরম কচুরি আর ছোলার ডাল আছে। এখন এটাই সবাই খাবো।
-- যাহ তুই খাবার নিয়ে আসবি জানতে পারলে লতিকাকে আর টিফিন বানাতে বলতাম না।
কথাটা বলেই তিনি খাবারের প্যাকেট হাতে রান্নাঘরে ছুটলেন লতিকাকে টিফিন যাতে না করে সেটা বলতে । একটু পরেই তিনি প্লেটে খাবার সাজিয়ে টেবিলে এনে রাখলেন।
-- কুহু তোর তো খিদে পেয়ে গেছে মা। আয় খেয়ে নে।
অসিতও হাত ধুয়ে এসে বসলো। সবাই মিলে একসাথে খেতে লাগলেন। খেতে খেতেই অসিত বললো,
-- মা, ওই প্যাকেটে তুমি যা কিনে আনতে বলেছিলে তা এনেছি। দেখো পছন্দ হয় কিনা।
-- আমি তো আর পরবো না। কুহুর জিনিস ওর পছন্দ হলেই হল।
অসিত শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-- সেইই! তবে এখন যা অবস্থা তাতে পছন্দ না হলেও পরবে। দিব্যি তো আমার জামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওটা পছন্দ না করেই যখন পরতে পারছে এগুলোও পছন্দ না হলেও পরবে।
শ্রাবণী অসিতের দিকে তাকিয়ে পড়লো। দু'জনে চোখাচোখি হওয়াতে শ্রাবণী চোখ নামিয়ে নিয়ে খাবারে মন দিল। খাওয়া শেষে অঞ্জলী প্যাকেট দুটি খুলে বসলেন। অসিত চারটে হাউজকোট কিনে এনেছে সেগুলো একটা প্যাকেটে। এক একটা বের করছেন অরুণাভ আর তার কুহুকে দেখিয়ে আবার ভাঁজ করে রাখছেন। অন্য প্যাকেটটা খুলে দেখেন তার ভিতর খুব সুন্দর এবং দামী একটা চুড়িদার। দেখে ছেলেকে বললেন,
-- ওরে তুই এখন এটা কিনে আনলি ওতো এই হাত নিয়ে পরতে পারবে না।
অরুণাভ কথাটা শুনতে পেয়েই বলে উঠলেন,
-- চমৎকার হয়েছে তো চুড়িদারটা। আমার খোকার পছন্দ আছে। দেখ কুহু কী সুন্দর জামা পছন্দ করে কিনে এনেছে তোর জন্য।
অঞ্জলীর দিকে মুখ করে বললেন,
-- এখন পরতে পারবে না তাতে কী হয়েছে? প্লাস্টার খুললে তারপর পরবে।
অসিতের যেন গা দিয়ে ঘাম ছাড়লো। যাক বাবা এ যাত্রাও বাঁচিয়ে দিলেন। এবার অসিত সিওর হল বাবা তার মনের খবর পুরোটাই জেনে গেছেন। সে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো। অরুণাভ চোখের ইশারায় তাকে বুঝিয়ে দিলেন তিনি তার পাশে আছেন। এদিকে যাকে নিয়ে এত কথা সে কিন্তু চুপ। এবার অঞ্জলী বললেন,
-- কি রে কুহু তুই চুপচাপ কেন? তোর পছন্দ হয়েছে এগুলো?
শ্রাবণী মাথা নাড়িয়ে 'হ্যাঁ' জানিয়ে বলে,
-- এতগুলো কেনার কোন দরকার ছিল না। দুটো আনলেই হয়ে যেত।
অঞ্জলী বললেন,
-- এতগুলো কোথায়? তোকে তো প্লাস্টার না খোলা পর্যন্ত এগুলোই পরতে হবে। ঠিকই আছে। এ কটার দরকার আছে। আমার অতু বুঝেই এনেছে। যা তুই ওই ড্রেসটা ছেড়ে এই একটা পরে নে।
-- এখনি?
অরুণাভ বললেন,
-- আরে যেটা পরা আছে সেটা এখন খোলার কী দরকার। কাল পরবে।
অসিতও বলে উঠলো,
-- এখন আর পরতে হবে না। নারাচারিতে ব্যথা লাগতে পারে। যেমন আছে তেমনই থাক।
শ্রাবণীর সাথে আবার চোখাচোখি হওয়াতে অসিত একটু মুচকি হাসি দিলো। শ্রাবণীর আগের মত গা জ্বলে না উঠলেও অসিতের এই দুষ্টুমি হাসি তাকে বুঝিয়ে দিলো 'আমার পরা জামা এখনো অনেকক্ষণ তোমায় ধারণ করে রাখতে হবে।'
টিফিন করেও অসিত আজ আর উপরে ওঠেনি। ওখানে বসে চারজনে গল্প করতে করতে সাড়ে ন'টা বাজিয়ে দিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অঞ্জলী বলে উঠলেন,
-- আরে অনেক রাত হল তো! অসিত যা উপরে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে আয়। আসার থেকে তো উপরেও উঠিসনি -। ফ্রেস হয়ে নিচুতে আয়। কুহুর তো ওষুধ খাওয়ার সময় হল।
মায়ের কথা শুনে কুহু বললো,
-- মা, একটু আগে টিফিন করেছি। এখুনি কিন্তু খেতে পারবো না।
শুনেই অসিত তিড়িং করে উঠলো,
-- খেতে পারবো না মানে কী? ওষুধটাতো ঠিক সময়ে খেতে হবে।
নিজের কথা বলার ধরণে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-- না, আমি বলছিলাম যে ওষুধটা ঠিক সময়ে খেতে হলে খাবারটাও তো ঠিক সময়েই খেতে হবে।
ছেলের অস্বস্তি কারণ বাবা সহজেই ধরতে পারলেন। তিনিও বললেন,
-- তুই যেটুকু পারবি সেটুকুই খেয়ে ওষুধগুলো খেয়ে নে। তারপর খিদে পেলে নাহয় আর একবার খেয়ে নিবি।
বাবার কথা শুনে অসিত বাচ্চাদের মত হেসে দিয়ে বললো,
-- হ্যাঁ তাই তো। বাচ্চারা তো বারবার খায়।
অসিততের কথা শুনে শ্রাবণীর রাগে এবার শরীর জ্বলে উঠলো। কিন্তু সে কোন কথা না বলে দাঁতে দাঁত চেপে চুপচাপই বসে থাকলো।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment