অরুণাভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে শুরু করেন,
-- আমার একটি ছেলে আছে। এই মাসেই সে বাড়ি ফিরবে পড়াশুনা শেষ করে। আমার দুই ছেলেমেয়ে। আমাদের ইচ্ছা ছিল অসিতকে ডাক্তারী পড়াবো। ও কিছুতেই ডাক্তারী পড়তে রাজি হল না। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করছে এখন। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। এত কথা তোকে বলার কারণ হল - আমার ছেলেটা খুব একগুঁয়ে,জেদী। তুই আমাদের এখানে আছিস ও কিছুতেই এটা ভালোভাবে মেনে নিতে পারছে না।
-- কিন্তু কেন? আমি তো কোন ক্ষতি করছি না।
-- সেতো আমি জানি।আর ক্ষতির কথা কী বলছিস মা? তুই আমার যে উপকার করছিস এই ঋণ আমি সারাজীবন ধরেও শোধ করতে পারবো না।
-- এভাবে বোলো না বাবা। আমি সব হারিয়ে তোমাদের পেয়েছি।এইভাবে তোমার দেখা যদি আমি না পেতাম কোথায় হারিয়ে যেতাম কে জানে?
শ্রাবণী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আবারও বলে,
-- তুমি ভেবো না বাবা। তোমার ছেলে আমার সাথে দুর্ব্যবহার করলে আমি কিছু মনে করবো না। আর আমার তো যাওয়ার কোনো জায়গায়ও নেই। তোমার আর মায়ের ভালোবাসাটাই মনে রাখবো, তোমার ছেলের দুর্ব্যবহার আমাকে কোন কষ্ট দিতে পারবে না।
-- তুই আমার সব চিন্তা দূর করে দিলি মা। আমার ছেলেটা এমনিতে খুব ভালো রে মা কিন্তু খুব একগুঁয়ে। ও যেটা বিশ্বাস করে তার থেকে ওকে বের করা খুব মুশকিল। যতক্ষণ না ও নিজে উপলব্ধি করছে কোনটা ভুল কোনটা ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত ওর চিন্তাধারা নিয়েই ও জীদ করতে থাকে।
-- তুমি চিন্তা কোরো না বাবা আমাকে নিয়ে। জীবনে এত দুঃখ পেয়েছি এখন আর কোন দুঃখ,কোন কষ্ট আমাকে আর সেভাবে আঘাত করতে পারে না।
ছেলে অসিতের সম্পর্কে কথাগুলো কুহুকে বলতে পেরে অরুণাভ নিজে খুব হালকা বোধ করছেন। কারণ তিনি নিশ্চিত অসিত তার এমন ধরণের ছেলে সে এসেই মেয়েটির উপর চড়াও হবে।
একদিন সকালে সকলে বসে চা খাচ্ছেন। এখন অঞ্জলী বেশ স্বাভাবিক। শুধু শ্রাবণীই যে কুহু এটাই তার বদ্ধমূল ধারণা। এই ছাড়া তার আর কোন সমস্যায় নেই। এখন আর কোন ওষুধও খেতে হয় না। শ্রাবণী ও অরুণাভর সাথে তিনি ডাক্তারের কাছে গেছিলেন। তার নির্দেশেই ওষুধ এখন সব বন্ধ। চা খেতে খেতে কলিং বেল বেজে ওঠায় শ্রাবণী উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে একজন স্মার্ট,সুপুরুষ দরজার কাছে দাঁড়ানো।হাতে তার এক বিশাল ট্রলি আর কাঁধে এক বিশাল ব্যাগ। পরনে তার ফেডেড জিন্স আর হলুদ রংয়ের এক গেঞ্জি। মাথা ভর্তি চুল, চোখদু'টি যেন কথা বলে যুগল ভ্রুর নিচে দামী ফ্রেমের চশমা। তার গায়ের রং এতটাই সুন্দর যে মানুষটিকে দেখে শ্রাবণীর মনেহচ্ছে যেন শীত প্রধান দেশে বসবাসকারী কেউ। কিন্তু তাকে দেখে শ্রাবণীর এক সেকেন্ডও লাগেনি সে কে বুঝতে। ঘরে তার ছবি বাঁধানো আছে আর তার মায়ের মুখটি কেটে যেন বসিয়ে দিয়েছে। দরজা খুলে একটু পাশে সরে গিয়ে দাঁড়ায় শ্রাবণী। অসিত ট্রলিটা বাইরে রেখে কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
-- ব্যাগটা নিয়ে এসো।
শ্রাবণী কথাটা শুনে প্রথমে প্রচণ্ড অবাক হয়ে যায়।কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে বাইরে বেরিয়ে ট্রলিটা ঘরে টেনে আনে। অসিত ঢুকেই মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-- কেমন আছো তুমি এখন?
-- আমার আবার কবে কী হল? আমি তো ভালোই আছি।
অরুণাভ তাকিয়ে দেখেন শ্রাবণী ট্রলিটা নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকছে। তিনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
-- তুই কেন এটা আনতে গেলি? এ বাড়িতে ব্যাগ আনার লোকের অভাব নেই।এটা তোর কাজ নয়।
অঞ্জলী ছেলের সাথে কথা বলছিলেন।তিনি ছুটে এসে শ্রাবণীর হাতটা ধরে বললেন,
-- এসব কষ্টের কাজ তোকে কেন করতে হবে?
-- মা, একটা ট্রলি সিমেন্টের উপর থেকে টানতে কারো কষ্ট হয় না।
শ্রাবণী ব্যাগটা টানতে টানতে বলে।
অসিত বাবা,মায়ের মেয়েটির প্রতি এত আদিখ্যেতা দেখে বলে উঠলো,
-- আমিই বলেছি ব্যাগটা আনতে ওকে। কেন কী হয়েছে তাতে?
অরুণাভ বেশ রাগের সাথে বলে উঠলেন,
-- কী হয়েছে তুমি বুঝতে পারছো না? তোমাকে তো সবই আমি ফোনে বলেছি।
অপ্রস্তুত হয়ে শ্রাবণী এই ঝামেলার মাঝে বলেই বসলো,
-- এগুলো কী হচ্ছে বাবা? ঘরের ছেলে সবে মাত্র ঘরে ঢুকেছে। কেন এটা নিয়ে কথা বলছো? বাড়ির কাজগুলো তো বাড়ির মানুষগুলোই করে।
অরুণাভ চুপ করে গেলেন। তিনিও ভেবে দেখলেন এতদিন পরে ছেলেটা ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই কুহুকে নিয়ে এসব কথা তার বলা উচিত হয়নি। এমনিতেই মেয়েটিকে না দেখেই অসিত তার সম্মন্ধে নানান ধরণের কথা তাকে বলেছে। আর বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই এই ধরণের কথাবার্তায় মেয়েটির প্রতি তার ধারণা আরও খারাপ হবে।
অসিত এই ব্যাপারগুলোর জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এসব দেখে শুনে তার মাথা আরও গরম হয়ে গেলো। সে রেগে বলে উঠলো,
-- আমি ভুল করে মনেহচ্ছে পরের বাড়ি ঢুকে পড়েছি। এ বাড়িতে আমার আর জায়গা নেই।
বলেই সে হনহনিয়ে উপরে তার ঘরের দিকে চলে গেলো।
অঞ্জলী তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- অতু এসব কী বললো? ও রাগ করলো কেন? কুহুর সাথে কোন কথাই তো বললো না?
শ্রাবণী অঞ্জলীর কথা শুনে হেসে পরে বললো,
-- মা, কতটা জার্নি করে দাদা এসেছে বলো তো। তাড়াতাড়ি করে তুমি দাদার জন্য তার পছন্দের খাবার করো। আর লতিকা মাসীকে বলো দাদার জন্য চা করে আনতে।
অঞ্জলী মেয়ের কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মত রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আর শ্রাবণী অরুণাভর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-- বাবা, তুমি এগুলো ওই মুহূর্তে কেন বলতে গেলে? তুমিই তো আমায় বললে উনি আমায় বিশ্বাস করেন না। আর তোমার কাছ থেকে এসব শুনে উনি তো আরো রেগে গেলেন।
-- হ্যাঁ রে মা সেটা তো আমি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার পর বুঝেছি। সত্যিই ঠিক করিনি ব্যাপারটা।
কিছুক্ষণ পরে লতিকা চা নিয়ে এসে শ্রাবণীকে বললো,
-- মা,তোমায় চা নিয়ে যেতে বললেন দাদার জন্য।
একথা শুনে শ্রাবণী ভয় পেয়ে গেলো। সে মনেমনে ভাবলো চা নিয়ে ওই রাগী মানুষটার কাছে সে যদি যায় তাহলে হয়ত এই চা তিনি না খেয়েই তার মুখেই ছুঁড়ে মারবেন। কিন্তু এখন উপায়? চা নিয়ে যেতে হবে শুনেই শ্রাবণীর মুখ শুকিয়ে চুন হয়ে গেলো।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment