Sunday, March 19, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৪১ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৪১ পর্ব)

 দশটার সময় ডাক্তার আসার কথা থাকলেও তিনি আসেন প্রায় একঘন্টা দেরিতে। অসিত বাইরেই অপেক্ষা করে। একজন অসুস্থ্য মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে বিব্রত করার ইচ্ছা অসিতেরও মন সায় দেয়নি। কারণ সে ভালোভাবেই জানে শ্রাবণী তাকে দেখলে মোটেই খুশি হবে না। কিন্তু এখানে না এসেও তার উপায় নেই। বাবা সারারাত কাল জেগে কাটিয়েছেন। সব থেকে বড় কথা নার্সিংহোমের বেডে তার ভালোবাসার মানুষটি। বাড়িতে থেকে কিংবা অফিসে গিয়ে তার একটুও মন বসবে না কোন কাজে। নাইবা গেলো সে সামনে শ্রাবণীর।নার্সিংহোমের বাইরে বসে থেকেও তার মনেহচ্ছে সে শ্রাবণীর অনেক কাছেই আছে।
 ডাক্তার শ্রাবণীর বাড়ির লোকের সাথে কথা বলে তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ডিসচার্জ করে দিলেন। তারপর অসিত ভিতরে ঢুকলো। শ্রাবণী বেড থেকে নামতে গেলে অসিত তাকে ধরে নামায়। শ্রাবণী এক্ষেত্রে তাকে আজ আর কিছু বলে না। গাড়ির কাছ পর্যন্ত ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে দিয়ে বলে,
-- তুমি পিছনেই বসো। সামনে বসলে সিটবেল্ট বাঁধলে হাতে ব্যথা লাগতে পারে।
 শ্রাবণী কোন কথা না বলে গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসলো। দরজা লাগিয়ে পিছন ঘুরে অসিত শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে পুণরায় বলে,
-- পিছন দিকে হেলান দিয়ে বসো আর হাতটা বুকের উপর চেপে রাখো। তাহলে যদি যারকিং হয় ব্যথা পাবে না।
 শ্রাবণী বাধ্য মেয়ের মত তাইই করে কিন্তু চুপচাপ। অসিতও আর কোন কথা না বলে গাড়ি চালিয়ে সোজা বাড়ির গেটের কাছে।নিজে নেমে এসে দরজা খুলে দিয়ে শ্রাবণীকে ধরে নামিয়ে দেয়। শ্রাবণী নেমে অসিতকে বলে,
-- ধন্যবাদ দিলে আপনাকে ছোট করা হবে। কাল থেকে আমার জন্য আপনি অনেক পরিশ্রম করেছেন। সারারাত ঘুম হয়নি। আবার সকালে অফিস কামাই করে আমাকে আনতে গেছেন। টাকার কথা আমি বলবো না। কারণ ওটা দেওয়ার আমার কোন ক্ষমতা নেই আর কয়েক বছর ধরে তো শুধু দু'হাত পেতে নিয়েই যাচ্ছি। আমার ঋণের বোঝা দিনকে দিন শুধু বেড়েই চলেছে।
-- নাও - অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হল। এবার ভিতরে ঢোকো।
 অসিতের পিছন পিছন শ্রাবণীও এগিয়ে গেলো। অরুণাভ, অঞ্জলী, লতিকামাসী সকলে ছুটে এসে নানান প্রশ্ন শুরু করলো শ্রাবণীকে। অসিত প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে আসলো ওষুধ কিনে। বাবা,মায়ের সামনে অসিত শ্রাবণীকে ওষুধ খাওয়ার নিয়মাবলী বুঝিয়ে দিয়ে উপরে উঠে গেলো। সেই গতকাল থেকে শ্রাবণীর শাড়িই পরা। নার্স বলে দিয়েছেন হাত খুব একটা বেশি নাড়াচাড়া না করতে। তাই বুক খোলা জামা পরতে হবে যতদিন প্লাস্টার করা থাকবে। অঞ্জলী এটা জানতে পেরে ছেলেকে বললেন,
-- কুহু তোর হাউজকোট আছে তো?
-- হ্যাঁ মা আছে কিন্তু সেগুলো তো আমি জয়েন করার সময় ওখানে নিয়ে গেছিলাম।
 অঞ্জলী ছেলেকে ডেকে তার একটা হাফহাতা শার্ট দিতে বললেন। কারণ অরুণাভর শার্ট অঞ্জলীর গায়ে আটবে না। বিকেলে গিয়ে কয়েকটা হাউসকোট কিনে আনার জন্যও ছেলেকে বললেন। নিজেই তাকে ওয়াসরুমে নিয়ে গিয়ে কাপড় ছাড়িয়ে অসিতের শার্টটা একটা হাত ঢুকিয়ে অপর হাতের উপর থেকে দিয়ে কোনরকমে বোতাম লাগিয়ে নিয়ে এসে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে বললেন,
-- আজ থেকে তোকে আর নিচুতে খেতে নামতে হবে না। তোর খাবার উপরেই দিয়ে আসবো।
-- মা, আমার হাতে ব্যথা। পা ঠিক আছে। আমি নিচুতে এসেই খাবো।
-- পাকামো করিস না। যা বলছি তাই শোন। এখন চল তোকে উপরে দিয়ে আসি।
-- আমি একাই যেতে পারবো মা। এত ভেবো না।
 শ্রাবণীর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে রেখেছে। অজানা, অচেনা একটি পরিবার থেকে এত ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যে না থাকলে হয় না। একসময় নিজেকে খুব হতভাগী বলে মনেহত শ্রাবণীর। কিন্তু ঈশ্বর একদিক থেকে ভাঙেন তো আর একটা দিক ঠিক গড়ে তোলেন। হয়ত এই পরিবারটার সাথে তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় লিখেছিলেন বলেই তার নিজের পরিবারটা কিভাবে তছনছ হয়ে গেলো। শ্রাবণী নিচের থেকে খেয়ে তখনকার মত ওষুধ খেয়ে উপরে উঠে আসে অঞ্জলীর সাথে। শ্রাবণীকে ঘুমাতে বলে তার দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে অসিতের ঘরে ঢুকে দেখেন সে স্নান সেরে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি ছেলেকে আর ডাকলেন না। ভাবলেন অতুর উপর দিয়ে কাল থেকে অনেক ঝড় গেছে। থাক কিছুক্ষণ ঘুমাক পরে নাহয় ডেকে খাওয়াবেন। অরুণাভর শরীরটাও রাত জাগার ফলে খারাপ হয়েছে। তিনিও শুয়ে আছেন। শ্রাবণী ফিরে বাবার সাথে তার ঘরেই দেখা করে এসেছে। 
 বিকেল নাগাদ শ্রাবণীর ঘুম ভাঙলো। সে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে পড়লো হাসপাতালে একটা মেল করতে হবে। তানাহলে নতুন চাকরি নিয়ে টানাটানি বেঁধে যাবে। সে এক হাতে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা যখন বের করছে ঠিক সেই মুহূর্তে অসিত তার ঘরে ঢোকে -
-- না জিজ্ঞাসা করেই আসতে বাধ্য হলাম। এখন এটা দিয়ে কী করবে? সরো আমি দেখছি। 
 শ্রাবণী সরে দাঁড়িয়ে বললো,
-- হাসপাতালে একটা মেল করতে হবে। কাল থেকে তো জয়েন করার কথা ছিলো। এই মুহূর্তে তো যেতে পারছি না।
-- ঠিক আছে। আমাকে বলো আমি করে দিচ্ছি। না তুমি ভেবো না তোমার কাছ থেকে পজেটিভ কোন কথা পাওয়ার আশায় আমি এগুলো করছি। তুমি যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে বাবা,মায়ের টেনশন কমবে। এই অবস্থায় আমার মূল উদ্দেশ্যই এইটা।
 শ্রাবণী লক্ষ্য করে অসিত বারবার তার পরনের জামাটার দিকে তাকাচ্ছে। সেটা দেখতে পেয়ে শ্রাবণী বলে,
-- কী দেখছেন বারবার জামাটার দিকে তাকিয়ে?
 অসিত হেসে দেয়।
-- দেখছি আর ভাবছি - আসলে মানুষ বিপদে পড়লে কত অসহায় হয়ে পড়ে। আমার জামাটা তুমি পরে আছো বাধ্য হয়ে। 
-- সে তো নিশ্চয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
-- না, বেশিক্ষণ পরে থাকতে হবে না। আমি সন্ধ্যায় বেরিয়েই তোমার হাউজকোট কিনে নিয়ে আসবো।
 
  অসিত শ্রাবণীর হাসপাতালে মেল করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

ক্রমশ 

  

No comments:

Post a Comment