তিয়াসারা গ্যাংটকে পৌঁছে ভুলেই গেলো সৌম্যর কথা। প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত সে নিলয়ের ভালোবাসায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। আর ওদিকে সৌম্য প্রতিটা মুহূর্ত তিয়াসার ফোনের অপেক্ষা করেছে। অঙ্কুরিত না হওয়া প্রথম ভালোবাসাকে মনে করে যে আজও কোন মেয়েকে নিজের করে নিতে পারেনি। সেই সৌম্য যখন বিবাহিত তিয়াসাকে ট্রেনের কামরায় একাএকা দেখলো তখন তার বুকের ভিতর কে যেন সশব্দে হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই আওয়াজ সৌম্য নিজে ছাড়া তিয়াসার কাছেও পৌঁছায়নি। এ যন্ত্রণার শব্দ অন্য কারও কাছে কখনোই পৌঁছায় না। সামনাসামনি বসে থাকা দু'টি মানুষ একজন ভাবছে তার সদ্য বিয়ে হওয়া স্বামীর ভালোবাসার কথা আর অপরজন হারানোর যন্ত্রণার দগদগে ঘায়ের কারণে বুকে অসীম বেদনা নিয়ে মুখে হাসি রেখে তারই সাথে কথা বলে চলেছে। এটাই জীবন!
যে ভালোবাসার কথা পরস্পর কেউ কখনো প্রকাশ করেনি, যে ভালোবাসার কথা অপরজন ভালোবাসে কিনা তাও জানার চেষ্টা কখনোই কেউ করেনি - সেই ভালোবাসাকে সৌম্য আজও মনের মধ্যে একাকীই লালন করে চলেছে। সুপুরুষ, বড় ব্যবসায়ীর একমাত্র সন্তান - অর্থ,গাড়ি,বাড়ি,বৈভব কোনকিছুতেই কমতি ছিলো না আজও নেই। চাইলেই যে কোন সুন্দরী মেয়ের বাবা তার মেয়েকে সৌম্যর হাতে তুলে দিতে রাজি হতেন। কিন্তু না - সৌম্য তার ভালোবাসার প্রতি এতটাই বিশ্বাস রেখেছিল যে সে ভেবেছিল গোলাকার এই পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই একদিন না একদিন সে তার ভালোবাসাকে ফিরে পাবে।
যখন তিয়াসারা ভাড়া বাড়িতে থাকতো তখন একই কলেজে সৌম্য ও তিয়াসা পড়তো। পরবর্তীতে একটু গ্রামের দিকে তিয়াসার বাবা অনিল দাস সামান্য জমি কিনে বাড়ি করে চলে আসেন। কিন্তু সৌম্যর সাথে সেরূপ কোন সম্পর্ক গড়ে না ওঠায় তিয়াসা সেই বাড়ির কথা কোনদিনও সৌম্যকে জানায়নি। সৌম্য জানতো ওদের পুরনো বাড়ির ঠিকানা। খোঁজও করেছিলো পরবর্তীতে। কিন্তু নতুন বাড়ির ঠিকানা মেলেনি। প্রথম প্রেম তার হারিয়ে গেলেও তার ভালোবাসার প্রতি এতটাই বিশ্বাস ছিলো সে ভেবেই নিয়েছিল আজ হোক বা কাল তিয়াসা তার হবেই।
মানুষ ভাবে এক আর তার জীবনে ঘটে আর এক! এক জীবনে মানুষের সব আশা পূর্ণতা পায় না। তাই হয়ত জন্মান্তর কথাটা সকলে বলে থাকে। ছেলেবেলা থেকেই সৌম্য পড়াশুনায় তুখোড়,অর্থ সম্পদের মধ্যে মানুষ, সুন্দর চেহারা। কোনকিছুতেই তার কোন কমতি ছিল না। যে কোন কিছু চাইলেই সে পেয়েছে। তাই সে ধরেও নিয়েছিলো তিয়াসা হারিয়ে গেলেও একদিন না একদিন ঠিক তাকে সে খুঁজে পাবে। হায়রে মানুষের মন!
হঠাৎ করে একটা অপরিচিত মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে এসে সেই মুহূর্তে তাকে প্রাণে বাঁচালেও তার শারীরিক অবস্থার কারণে সৌম্যর স্নেহময়ী মা এতদিন তাকে আগলে রেখে বাবার ইচ্ছাতেই তাকে গ্যাংটকের হাইওয়ের কাছাকাছি বাকথাং জলপ্রপাতের খুব কাছেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা একটি ছোট প্রাইমারি স্কুলে পাঠিয়ে দেন। যা চলে কিছু সহৃদয় মানুষের সহয়তায়। এখানে একটা মোটা অংকের টাকা দান করেন সৌম্যর বাবা বিমানবাবু। পাহাড়ের পাদদেশেই কাঠের তৈরি বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ঘর। দু'জন শিক্ষক এখানে থেকেই এদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। এদের মধ্যে যোগ হল দীপিকা। পূর্বের দু'জনই মহিলা। দীপিকার মতই তাদেরও জীবনকাহিনী। থাকা,খাওয়া আর সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তবে আগে যে দু'জন আছেন তাদের একজনের বয়স দীপিকার মত হলেও অন্যজন মধ্য বয়সী। তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ জীবনে এখানে এসেই একটু সুখের মুখ দেখেছেন। তার নিজ বাড়ি ছিল সিকিম। তিনি তার বাড়ি বিক্রি করে স্বামীর জমানো টাকায় এখানে এসে ছোটছোট বাচ্চাগুলোর জন্য প্রথমে তৈরি করেছিলেন একটি ছোট্ট বেড়ার ঘর। সেখানে তিনি ওদের প্রাইভেট পড়াতেন। একজন পশ্চিমবঙ্গবাসী বড় ব্যবসায়ী পর্যটকের নজরে আসে মেনকার এই কার্যকলাপ। তিনিই উদ্যোগী হয়ে মেনকার পাশে থেকে কাজটিকে একটু একটু করে বড় করে তুলেছেন। তার আগ্রহেই আরও কিছু মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন সেখানে প্রায় তিরিশ জনের মত ছাত্রছাত্রী।
অপর যে জন সেখানে শিক্ষকতা করেন তার বয়স দীপিকার মতই। অল্প বয়সে জুই ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল তার প্রেমিকের সাথে। টাকার বিনিময়ে তার প্রেমিক তাকে নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করে দিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেদিনই সে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। সামনে যে ট্রেনটা সে পেয়েছিল তাতেই চড়ে বসেছিল। সেই ট্রেনে যাত্রী হিসাবে এমন একজনকে সে পেয়েছিল যে তাকে পৌঁছে দিয়েছিল এখানে।
দীপিকাকে বিমানবাবু তার ছেলেকে দিয়ে এখানেই পাঠিয়ে দেন। কারণ এমন বয়সের একটি মেয়েকে তিনি কিছুতেই বাড়িতে রাখতে রাজি নন। সৌম্য দীপিকাকে বাকথ্যানে পৌঁছে দিয়ে তারপরে বেশ কয়েকদিন সে হোটেলে অপেক্ষা করে তিয়াসা নিশ্চয় তার স্বামীর সাথে একবার হলেও দেখা করতে আসবে। সৌম্য তার কার্ডটা তিয়াসাকে দিলেও তার ফোন নম্বরটা তাড়াহুড়োয় নিতে ভুলে যায়। সুতরাং যোগাযোগের রাস্তা পুরোটাই বন্ধ।
পুনশ্চ
সৌম্য কী সারাজীবন তিয়াসাকে ভালোবেসেই কাটিয়ে দেবে? তিয়াসা কি নিলয়ের ভালোবাসা সারাটাজীবন ধরে রাখতে পারবে? তিয়াসার সুখী জীবন আর সৌম্যর ব্যর্থ জীবন! এটাই কী ওদের ভবিতব্য?
এই সব প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে পড়তেই হবে এর পরবর্তী পর্বগুলি। গল্পের মোড় শুরু এখান থেকেই --।
ক্রমশ