Thursday, March 30, 2023

একদিন ভালোবাসবে।(৫১ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে ( ৫১ পর্ব)

  তিয়াসারা গ্যাংটকে পৌঁছে ভুলেই গেলো সৌম্যর কথা। প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত সে নিলয়ের ভালোবাসায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। আর ওদিকে সৌম্য প্রতিটা মুহূর্ত তিয়াসার ফোনের অপেক্ষা করেছে। অঙ্কুরিত না হওয়া প্রথম ভালোবাসাকে মনে করে যে আজও কোন মেয়েকে নিজের করে নিতে পারেনি। সেই সৌম্য যখন বিবাহিত তিয়াসাকে ট্রেনের কামরায় একাএকা দেখলো তখন তার বুকের ভিতর কে যেন সশব্দে হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই আওয়াজ সৌম্য নিজে ছাড়া তিয়াসার কাছেও পৌঁছায়নি। এ যন্ত্রণার শব্দ অন্য কারও কাছে কখনোই পৌঁছায় না। সামনাসামনি বসে থাকা দু'টি মানুষ একজন ভাবছে তার সদ্য বিয়ে হওয়া স্বামীর ভালোবাসার কথা আর অপরজন হারানোর যন্ত্রণার দগদগে ঘায়ের কারণে বুকে অসীম বেদনা নিয়ে মুখে হাসি রেখে তারই সাথে কথা বলে চলেছে। এটাই জীবন! 
  যে ভালোবাসার কথা পরস্পর কেউ কখনো প্রকাশ করেনি, যে ভালোবাসার কথা অপরজন ভালোবাসে কিনা তাও জানার চেষ্টা কখনোই কেউ করেনি - সেই ভালোবাসাকে সৌম্য আজও মনের মধ্যে একাকীই লালন করে চলেছে। সুপুরুষ, বড় ব্যবসায়ীর একমাত্র সন্তান - অর্থ,গাড়ি,বাড়ি,বৈভব কোনকিছুতেই কমতি ছিলো না আজও নেই। চাইলেই যে কোন সুন্দরী মেয়ের বাবা তার মেয়েকে সৌম্যর হাতে তুলে দিতে রাজি হতেন। কিন্তু না - সৌম্য তার ভালোবাসার প্রতি এতটাই বিশ্বাস রেখেছিল যে সে ভেবেছিল গোলাকার এই পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই একদিন না একদিন সে তার ভালোবাসাকে ফিরে পাবে। 
   যখন তিয়াসারা ভাড়া বাড়িতে থাকতো তখন একই কলেজে সৌম্য ও তিয়াসা পড়তো। পরবর্তীতে একটু গ্রামের দিকে তিয়াসার বাবা অনিল দাস সামান্য জমি কিনে বাড়ি করে চলে আসেন। কিন্তু সৌম্যর সাথে সেরূপ কোন সম্পর্ক গড়ে না ওঠায় তিয়াসা সেই বাড়ির কথা কোনদিনও সৌম্যকে জানায়নি। সৌম্য জানতো ওদের পুরনো বাড়ির ঠিকানা। খোঁজও করেছিলো পরবর্তীতে। কিন্তু নতুন বাড়ির ঠিকানা মেলেনি। প্রথম প্রেম তার হারিয়ে গেলেও তার ভালোবাসার প্রতি এতটাই বিশ্বাস ছিলো সে ভেবেই নিয়েছিল আজ হোক বা কাল তিয়াসা তার হবেই।
    মানুষ ভাবে এক আর তার জীবনে ঘটে আর এক! এক জীবনে মানুষের সব আশা পূর্ণতা পায় না। তাই হয়ত জন্মান্তর কথাটা সকলে বলে থাকে। ছেলেবেলা থেকেই সৌম্য পড়াশুনায় তুখোড়,অর্থ সম্পদের মধ্যে মানুষ, সুন্দর চেহারা। কোনকিছুতেই তার কোন কমতি ছিল না। যে কোন কিছু চাইলেই সে পেয়েছে। তাই সে ধরেও নিয়েছিলো তিয়াসা হারিয়ে গেলেও একদিন না একদিন ঠিক তাকে সে খুঁজে পাবে। হায়রে মানুষের মন! 
 হঠাৎ করে একটা অপরিচিত মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে এসে সেই মুহূর্তে তাকে প্রাণে বাঁচালেও তার শারীরিক অবস্থার কারণে সৌম্যর স্নেহময়ী মা এতদিন তাকে আগলে রেখে বাবার ইচ্ছাতেই তাকে গ্যাংটকের হাইওয়ের কাছাকাছি বাকথাং জলপ্রপাতের খুব কাছেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা একটি ছোট প্রাইমারি স্কুলে পাঠিয়ে দেন। যা চলে কিছু সহৃদয় মানুষের সহয়তায়। এখানে একটা মোটা অংকের টাকা দান করেন সৌম্যর বাবা বিমানবাবু। পাহাড়ের পাদদেশেই কাঠের তৈরি বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ঘর। দু'জন শিক্ষক এখানে থেকেই এদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। এদের মধ্যে যোগ হল দীপিকা। পূর্বের দু'জনই মহিলা। দীপিকার মতই তাদেরও জীবনকাহিনী। থাকা,খাওয়া আর সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তবে আগে যে দু'জন আছেন তাদের একজনের বয়স দীপিকার মত হলেও অন্যজন মধ্য বয়সী। তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ জীবনে এখানে এসেই একটু সুখের মুখ দেখেছেন। তার নিজ বাড়ি ছিল সিকিম। তিনি তার বাড়ি বিক্রি করে স্বামীর জমানো টাকায় এখানে এসে ছোটছোট বাচ্চাগুলোর জন্য প্রথমে তৈরি করেছিলেন একটি ছোট্ট বেড়ার ঘর। সেখানে তিনি ওদের প্রাইভেট পড়াতেন। একজন পশ্চিমবঙ্গবাসী বড় ব্যবসায়ী পর্যটকের নজরে আসে মেনকার এই কার্যকলাপ। তিনিই উদ্যোগী হয়ে মেনকার পাশে থেকে কাজটিকে একটু একটু করে বড় করে তুলেছেন। তার আগ্রহেই আরও কিছু মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন সেখানে প্রায় তিরিশ জনের মত ছাত্রছাত্রী। 
  অপর যে জন সেখানে শিক্ষকতা করেন তার বয়স দীপিকার মতই। অল্প বয়সে জুই ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল তার প্রেমিকের সাথে। টাকার বিনিময়ে তার প্রেমিক তাকে নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করে দিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেদিনই সে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। সামনে যে ট্রেনটা সে পেয়েছিল তাতেই চড়ে বসেছিল। সেই ট্রেনে যাত্রী হিসাবে এমন একজনকে সে পেয়েছিল যে তাকে পৌঁছে দিয়েছিল এখানে। 

  দীপিকাকে বিমানবাবু তার ছেলেকে দিয়ে এখানেই পাঠিয়ে দেন। কারণ এমন বয়সের একটি মেয়েকে তিনি কিছুতেই বাড়িতে রাখতে রাজি নন। সৌম্য দীপিকাকে বাকথ্যানে পৌঁছে দিয়ে তারপরে বেশ কয়েকদিন সে হোটেলে অপেক্ষা করে তিয়াসা নিশ্চয় তার স্বামীর সাথে একবার হলেও দেখা করতে আসবে। সৌম্য তার কার্ডটা তিয়াসাকে দিলেও তার ফোন নম্বরটা তাড়াহুড়োয় নিতে ভুলে যায়। সুতরাং যোগাযোগের রাস্তা পুরোটাই বন্ধ।

  পুনশ্চ 

সৌম্য কী সারাজীবন তিয়াসাকে ভালোবেসেই কাটিয়ে দেবে? তিয়াসা কি নিলয়ের ভালোবাসা সারাটাজীবন ধরে রাখতে পারবে? তিয়াসার সুখী জীবন আর সৌম্যর ব্যর্থ জীবন! এটাই কী ওদের ভবিতব্য?
  এই সব প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে পড়তেই হবে এর পরবর্তী পর্বগুলি। গল্পের মোড় শুরু এখান থেকেই --।

ক্রমশ
  
   

Wednesday, March 29, 2023

সংসার নীতি (moms)

সংসার নীতি

  'মনে যাই থাকুক মুখে ভারি মিষ্টি' - কথাটা বলেই অঞ্জনা মুখটা একটু ভেংচি কাটলেন।
-- আর কী চাই দিদি আমরা তো আর ছেলের বউয়ের কাছ থেকে এর বেশি আশা করতেও পারি না। আজকালকার মেয়েরা কী আর সংসারের যাবতীয় কাজ করে শ্বশুর,শ্বাশুড়ীর যত্নআত্তি করে? করে না দিদি । তারা ঘর বার সমানতালে পা মেলায়। এটা তো তোমাকে স্বীকার করতেই হবে তোমার ছেলের বউ আমার ছেলের বউ অপেক্ষা অনেক ভালো। সে তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।আমার ছেলের বউ সপ্তাহে চারদিন থাকে বাপেরবাড়ি আর তিনদিন আমার বাড়ি। রান্না কিংবা কোন কাজই করে না বললেই চলে। সংসারে শান্তি বজায় রাখতে আর এখনো শরীর চলছে বলেই আমিও কিছু বলি না। আর আমার ছেলেটাও তো তোমার ছেলের মত নয়। সে বউ যা বলবে তাইই বিশ্বাস করে।
-- কী যে বলো না তুমি দিদি? ওই মুখের মিষ্টতাই ! স্কুল থেকে এসেই ঘরে দরজা বন্ধ করে দু'ঘন্টা বিশ্রাম। তখন তাকে ডাকলেই তার মুখ হাড়ি হয়ে যায়।
-- কিন্তু আমরা তো জানি তোমার বউ সকালে রান্না করে রেখে স্কুল যায়, আবার রাতে ফিরেও রান্নাবান্না করে।
-- ওই আর কী? যখন তিনি ঘুমান তখন চায়ের জন্য গলা শুকিয়ে গেলেও তাকে ডাকা যাবে না। তিনি যখন উঠবেন সেই সময় চা করবেন।
-- তা এককাপ চা তো তুমিও করে খেতে পারো।
 সমবয়সী প্রতিবেশী রুবির কথা শুনে অঞ্জনা পুণরায় মুখ ব্যাকান।
 অঞ্জনা এবং রুবির পাশাপাশি বাস প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। দুজনে খুব ভালো বন্ধুও বটে! দুজনের দুটি ছেলে। তারাও প্রায় সমবয়সী। ছেলেবেলার থেকেই দু'জনের এক সাথেই বেড়ে ওঠা। অঞ্জনার ছেলে ধীর, স্থীর ,সাংসারিক জ্ঞানবুদ্ধি প্রবল। মায়ের পছন্দ করা চাকুরীজীবী মেয়েকে বিয়ে করেছে। কিন্তু বিয়ের আগে সে মেয়ের সাথে কথা বলে নিয়েছিলো তার মায়ের সাথে কখনোই দুর্ব্যবহার করা যাবে না। ভালোমন্দ মিশিয়ে প্রত্যেকটা মানুষ। মায়ের মধ্যে যেমন মন্দ দিক আছে ঠিক তেমনই অনেক ভালো দিক আছে। মায়ের ভালো দিকগুলি তাকে বললে মা খুশি হবেন কিন্তু খারাপ দিকগুলি যদি তাকে বলা হয় তাতে ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। তাই সেক্ষেত্রে সেগুলি যদি আমাকে বলা হয় তাহলে আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো মাকে। তাতে ঝামেলা হবে না আর হলেও তা আমার আর মায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সেক্ষেত্রে তিনি পরবর্তীতে নিজেকে সংশোধন করেও নিতে পারবেন।
  শুভদীপের স্ত্রী যথেষ্ঠ বুদ্ধিমতী। সে এসবের ভিতর না গিয়ে একজন দায়িত্বশীল পুত্রবধূর মত রান্নাটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। কারণ এর থেকে অনেক ঝামেলায় এড়ানো যায় সংসারে। মুখে মিষ্টতা দিয়েই সে শ্বাশুড়ীকে বশ করে ফেলে। মাইনে পেয়ে শ্বাশুড়ীর হাত খরচের জন্য কিছু টাকা তার হাতে গুঁজে দেয়। মনে মনে এতে তিনি ভীষণ খুশি হন। কখনোই শ্বাশুড়ীর নামে স্বামী কিংবা পাড়া প্রতিবেশীর কাছে নিন্দা করে না। উল্টে প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়। আর অঞ্জনার এগুলিই কানে আসে। তাই তিনিও আস্তে আস্তে বউয়ের নামে নিন্দা করার স্বভাবটা অনেকটাই কমিয়ে ফেলেন। কারণ তিনি পাড়ায় যেখানেই যান শোনেন তার বৌমা তার নামে সর্বত্র প্রশংসা করে বেরিয়েছে। নিজের প্রশংসা শুনতে কে না ভালোবাসে?
   সংসারটা হচ্ছে একটা বড় রাজনীতির জায়গা। দেশ চালনার মত এখানেও রাজার নীতি চলে। নিজের বুদ্ধি,বিবেক দিয়ে সংসারের নীতি চালাতে পারলে সংসারে কোনোই অশান্তি থাকে না। সে ক্ষেত্রে একটু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়।

Monday, March 27, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫০ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৫০ পর্ব)

  রাত তখন গভীর। হঠাৎ অসিতের ঘুম ভেঙে যায়। অসিত তখনও শ্রাবণীর কোলের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে। তাকিয়ে দেখে শ্রাবণী সেই একইভাবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। অসিতের নিজের উপর নিজেরই রাগ হল। 'ইসস মেয়েটাও তো সুস্থ্য নয়। এতটা জীদ করা তার উচিত হয়নি। শ্রাবণী ওর এই অসুস্থতার জন্য সম্পূর্ণ আবদার মেনে নিয়েছে। কতটা ভালো বাসলে মানুষ এটা করতে পারে?' অসিত শ্রাবণীর কোলের উপর থেকে উঠে পড়ে। শ্রাবণী জেগে গিয়েই অসিতের কপালে হাত দিয়ে দেখতে যায় আর ঠিক তখনই অসিত শ্রাবণীর হাতটা তার কপালের উপর চেপে ধরে বলে,
-- এত চিন্তা তোমার আমাকে নিয়ে কেন আমি বুঝি না ভাবো? না আমার আর জ্বর আসেনি। আসবেও না আর। এবার তুমি নিজের বিছানায় গিয়ে শোও।
 শ্রাবণী উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হঠাৎ করেই পড়ে যেতে যায়। বসা অবস্থাতেই অসিত ওকে ধরে ফেলে। শ্রাবণী অসিতের বুকের উপর গিয়ে পড়ে। অসিত ওকে দু'হাতে ঝাপটে ধরে খাটের উপর শুয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণী উঠতে গেলে অসিত বলে,
-- একবার মুখে বলো না ভালোবাসো আমায়!
 শ্রাবণী ওর দিকে তাকিয়ে আছে গভীর দৃষ্টিতে। অসিত ওকে আরও জোড়ে বুকের সাথে চেপে ধরে। হঠাৎ শ্রাবণীকে বুকের উপর থেকে নিচুতে নামিয়ে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দেয়। শ্রাবণী ওকে বাঁধা দেয় না। শ্রাবণীর বুকের ভিতর তখন তোলপাল করছে। তার শরীর মন তখন অন্যকিছু চাইছে। অসিত পাগলের মত শ্রাবণীর ঠোঁটদুটি নিয়ে তখন খেলছে। শ্রাবণীও অসিতের শরীরের পরিবর্তনের স্পর্শ নিজের শরীরে টের পাচ্ছে। বেশ কয়েক মিনিট পর অসিত বলে,
-- আমাকে একটুও আদর করতে তোমার ইচ্ছা করছে না? তুমি কি পাথর?
 শ্রাবণীর দৃষ্টি তখন আরও গভীর হয়। সে অসিতের গভীর দৃষ্টির সাথে নিজের দৃষ্টি মিলিয়ে হঠাৎ করেই অসিতের বুকের উপর ছোট্ট একটা চুমু করে বলে,
-- এত কিছু বোঝেন আর এটা বোঝেন না আপনার উপরে আমার যতই রাগ থাকুক না কেন যতবার আমায় কাছে টেনেছেন কোনোবার আমি বাঁধা দিইনি কেন? মুখে যাই বলি না কেন এই কাছে টানা,এই ভালোবাসা কিংবা আদর করা যদি আমার ভালো না লাগতো আমি কি এটা এলাও করতাম? 
 অসিত এ কথা শুনে নিজের দু'হাত শ্রাবণীর গলার নিচে থেকে দিয়ে ওকে উচু করে টেনে নিজের ঠোঁটের কাছে ওর ঠোঁট নিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণী দু'হাতে ওর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু করে। অসিত তখন ওর চোখ,নাক, কপাল,গলা সমস্ত জায়গায় চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়।
-- পাগলী একটা! ভালোবাসো এত অথচ মুখে বলতে পারোনি। আমায় শুধু কষ্টই দিয়েছো। আজ ঠিক যেভাবে আমায় তুমি জড়িয়ে আছো আর আমিও তোমায় জড়িয়ে আছি এইভাবেই আমরা সারাজীবন দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে রাখবো।
-- কিন্তু বাকি রাতটুকু তো একটু ঘুমাতে হবে। এখন ছাড়লে হত না।
 অসিত পুণরায় ওকে মুখের সর্বত্র পাগলের মত চুমু করতে করতে বলে,
-- একদম ছাড়তে ইচ্ছা করছে না তোমায়। কোনদিন যদি এই রাত আর ভোর না হত তাহলেই ভালো হতো।
 -- বুঝলাম। এবার তো ছাড়ুন।
-- ছাড়ুন নয় ছাড়ো বলো।-
শ্রাবণী হাসতে হাসতে বলে,
-- হু ছাড়ো। এতক্ষণ পরে মনে পড়লো আমার তো হাতে ব্যথা ছিল। কিন্তু --
-- ম্যাজিকের মত ভ্যানিশ হয়ে গেছে আমায় জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে।
-- সত্যিই পাগল একটা!
 অসিত হাসতে হাসতে ওকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু শ্রাবণীরও কি অসিতের বাহুবন্ধন ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে? না, মোটেই না। তবুও সে উঠতে চেষ্টা করতেই অসিত পুণরায় তাকে বুকের উপর চেপে ধরে বলে,
-- আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একবার বলো 'ভালোবাসো আমায়।'
-- এর পরেও -
-- হ্যাঁ একদম এর পরেও - । আমি তো অনেকবার বলেছি তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু শুনতে কেমন লাগে সেটা তো জানি না। তাই একবার শুনতে চাইছি -।
 শ্রাবণী অসিতের চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি অনেক আগে থেকেই । কিন্তু নিজেই বুঝতে পারিনি। বুঝলাম নিজে অসুস্থ্য হওয়ার পর। প্রতিদিন রাতে ঘরে গিয়ে একটা অপেক্ষা কখন আপনি আসবেন, আমার সাথে কথা বলবেন, আপনার ভালোবাসার কথা আমায় জানাবেন।
-- আবার আপনি ?
-- সরি,সরি 
-- সত্যি বলছো?
--- সত্যি,সত্যি,সত্যি। এক একটা সেকেন্ড,মিনিট আমার কাছে ঘণ্টার পর ঘন্টা মনে হত। তখনই বুঝতে পেরেছি ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। গতকাল রাতে যখন তুমি আমার ঘরে এলে না খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। চোখের থেকে জল পড়ে গেছিলো অভিমানে নিজের অজান্তেই। সারাটা রাত ঘুমাইনি। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি তোমার দরজা বন্ধ। তুমি তো শুধু আমার মুখের কথাই শুনতে। মনের কথা বুঝতে না -
-- না,বললে কী করে বুঝবো পাগলী?
-- অনেক হয়েছে। এবার ছাড়ো। কিন্তু যতদিন মা নিজের থেকে কিছু না বলছেন আমি কিন্তু বাবা,মায়ের সামনে আপনিই বলবো। 
-- আবার কবে বাড়ি যাবে তুমি ? এবার তো আরও বেশি কষ্ট হবে আমার।
-- না, রোজ ফোনে কথা বলবো। আর কষ্টের কথা বলছো? ওটা বুঝি তোমার একার হবে? আমার হবে না?
 শ্রাবণী অসিতের কপালে একটা গাঢ় চুম্বন করে বলে,
-- রাত শেষ হতে চললো। এবার শুয়ে পরও। সকাল আটটায় ওষুধ আছে।
 অসিত শ্রাবণীকে ছেড়ে দিলো। শ্রাবণী উঠে তার খাটের উপর গিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যে দু'জনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

ক্রমশ 
 

    

একদিন ভালোবাসবে (৪৯ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৪৯ পর্ব)

    অনেকটা সময় ওরা গাড়ির মধ্যে বসে থাকে। মাঝে একবার শ্রাবণী গাড়ি থেকে নেমে বিস্কুটের প্যাকেট কিনে আনে। অসিত ওইভাবেই অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ঘাড়ে ব্যথা করতে লাগলে মাথাটা এপাশ ওপাশ করছে দেখতে পেয়ে শ্রাবণী আস্তে করে ধরে ওর মাথাটা নিজের কাঁধের উপর রাখে। রক্তবর্ণ চোখ তুলে শ্রাবণীর দিকে যখন ও তাকায় অসিতের চোখ থেকে দুফোঁটা জ্বরের ফলে জল গড়িয়ে পড়ে। শ্রাবণী হাত দিয়ে মুছিয়ে দেয়। ঘাম হতে শুরু করলে জামার বোতাম খুলে নিজের ওড়না দিয়ে ঘাম মুছতে শুরু করে। অসিতের শরীরের সমস্ত লোমকূপ তখন দাঁড়িয়ে যায়। সে এক দৃষ্টে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে থাকে। শ্রাবণী ওর দিকে না তাকিয়েই সেটা বুঝতে পেরে বলে,
-- ওভাবে আমার দিকে তাকাবেন না।
 অসিত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এনে বলে,
-- এর পরেও বলবে তুমি আমায় ভালোবাসো না?
-- আপনি অসুস্থ্য, এখন বেশি কথা বলবেন না।
 অসিত দু'হাত দিয়ে শ্রাবণীকে বুকের সাথে চেপে ধরে নিজের মাথাটা শ্রাবণীর মাথার উপর রেখে বলে,
-- বুকে কান পেতে শোনো ওখানে একটি নামই বারবার ধ্বনিত হচ্ছে সে শ্রাবণী শুধু শ্রাবণী।
 শ্রাবণী আজ অসিতকে কোন বাঁধা দেয় না। নিজেকেই যেন সে আজ অসিতের কাছে সমর্পণ করেছে। যতক্ষণ অসিত তাকে বুকে জড়িয়ে থাকে শ্রাবণী কোন বাঁধা না দিয়েই পরম নিশ্চিন্তে অসিতের বুকে মাথা দিয়ে থাকে।

  অসিত একটু ধাতস্থ হলে শ্রাবণী ওকে জোর করে দুটো বিস্কুট আর জল খাওয়ায়। অসিত তখন বলে,
-- এখন ঠিক আছি আমি। এবার রওনা হই।
-- রওনা হবো ঠিকই কিন্তু একটু এগিয়ে হোটেল পাওয়া যাবে এখনকার লোকেরা বললো। আমরা আজ কোন একটা হোটেলে থাকবো। কাল আমার নাইট ডিউটি। তাই তার আগে পৌঁছলেই হবে। আমি আজ আপনাকে একা ছাড়বো না।
-- আমি তো তোমার কেউ না, আমায় নিয়ে তুমি কেন এত ভাবছো?
-- এসব কথার উত্তর আমার কাছে এখন নেই। সময় মত সব কথার উত্তর দেবো। এখন আপনি সুস্থ বোধ করলে স্টিয়ারিংটা ধরুন।
-- সে যাচ্ছি কিন্তু আমার সাথে তুমি হোটেলে কিভাবে থাকবে একঘরে? তাহলে আলাদা দুটো রুম নেবো।
-- তাহলে আমার হোস্টেলে গেলেই বা কী অসুবিধা হত?
আপনি না সত্যিই বেশি কথা বলেন।
  অসিত দুর্বল বোধ করলেও কিছুটা এগিয়ে মিনিট কুড়ির মধ্যেই মোটামুটি থাকার মত একটা হোটেল পেয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে দোতলায় একটা রুম ভাড়া করে রূমের ভিতরে গিয়ে ঢুকলো দু'জনে। রিসেপশনেই কথা বলে নিয়েছিল দুটো সিঙ্গেল খাট যাতে থাকে। কিন্তু সমস্যা হল অসিতের তো কোন জামাকাপড় নেই। ওই অবস্থাতেই অসিতকে একটা খাটে জোর করে শ্রাবণী শুইয়ে দিয়ে কাজ আছে বলে সন্ধ্যার দিকে একটু বাইরে বেরোয়। ওখানে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে আশেপাশে কোন মেডিসিন দোকান নেই। হোটেলের লোকের সহয়তায় একজনকে কিছু টাকা দিয়ে সে অসিতের জন্য ওষুধ আনতে পাঠায়। এ জ্বর এন্টিবায়োটিক না খেলে যে কমবে না এটা সে বুঝতে পারে। তাই পুণরায় জ্বর আসার আগেই তাকে ওষুধ দিতে হবে। ওষুধ নিয়ে রুটি,সবজি কিনে যখন সে তালা খুলে হোটেলের রুমে এসে পৌঁছায় তখন অসিত ঘুমিয়ে। সে তার একটা নাইটি নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে অসিত উঠে পরেছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর নেই। জোর করে তাকে দুটো রুটি খাইয়ে ওষুধ দেয়। তারপর সে বলে,
-- যদি কিছু মনে না করেন আমার টিশার্ট আর ট্রাউজার পরতে পারেন।
অসিত হেসে দিয়ে বলে,
-- উপায় কী? সেটাই দাও। টেনেটুনে ঢোকাই গায়ে। এই জামাপ্যান্ট পরে থাকতে আর ভালো লাগছে না। বাড়িতে একটা ফোন করে জানিয়ে দিই।
-- আমি বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি আপনি কাল ফিরবেন।
-- বাহ্! দায়িত্ব,কর্তব্য সম্পর্কে তোমাকে কেউ হারাতে পারবে না।
 শ্রাবণীর দেওয়া টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে অসিত যখন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো শ্রাবণী তখন হেসেই খুন। তা দেখে অসিত বলে উঠলো,
-- বেশ প্রতিশোধ নিলে কিন্তু! একদিন আমার শার্ট পরতে হয়েছিল বলে আজ দেখো ভগবান এমন একটা কান্ড করলেন তোমার জিনিস আমায় পরতে হল। একেই বলে কপাল!
অসিত একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে।
শ্রাবণী অসিতের বালিশটা ঠিক করে দিয়ে বলে,
-- এবার আপনি শুয়ে পড়ুন। কাল আমরা দুপুরে এখান থেকে খেয়ে তবে বেরোব।
-- কিন্তু এখন তো কিছুক্ষণ আমরা গল্প করতেই পারি।
-- না,পারি না। আপনার শরীর খারাপ আপনি এখনি ঘুমাবেন।
-- দশ মিনিট। এখানে আমার কাছে এসে বসো।
-- আমি তো এখান থেকেই আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি ।আপনি বলুন আমি শুনছি।
-- না,এখানে এসো। এই তো একটু আগে আমার বুকের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে ছিলে; তখন তো এত জীদ করোনি। তুমি কী জানো?ওই কয়েকটা মিনিটের জন্যই আমার আর জ্বর আসেনি। ওটাই আমার জ্বরের এন্টিবায়োটিক!
-- ওহ্ এত কথা কেন বলেন? আপনি এখন ঘুমাবেন কিনা বলুন।
-- ঘুমাবো। একবার এসে আমার কাছে দু'মিনিটের জন্য বসো।
 শ্রাবণী আর কথা না বাড়িয়ে অসিতের খাটের উপর গিয়ে বসে। অসিত তখন ঠিক ছেলেমানুষের মত শ্রাবণীর কোলে শুয়ে পড়ে বলে,
-- গাড়ির ভিতর যখন তোমার কোলের উপর শুতে বলেছিলে খুব ইচ্ছা করছিলো শুতে।কিন্তু এই ছ'ফুট হাইটের মানুষটা কিভাবে ওই ছোট্ট জায়গাটার উপর শোবে বল? তাই এখন শুয়ে পড়লাম।
-- আচ্ছা ঠিক আছে। এটাও মেনে নিলাম। এবার তো ঘুমাবেন?
অসিত শ্রাবণীর একটা হাত নিয়ে নিজের মাথার উপর দিয়ে বললো,
-- মাথায় হাত বুলিয়ে দাও আমি এখুনি ঘুমিয়ে পড়বো।
 -- আপনি পুরো একটা বাচ্চা! আচ্ছা তাই হবে। আপনি যেটা বলবেন আমি সেটাই করছি। তবে প্লিজ আর কথা বলবেন না। এবার ঘুমান।
-- ভাগ্যিস আমার জ্বর হয়েছিলো। তাই তো আজ আমি এভাবে তোমায় অনেকক্ষণ কাছে পেলাম।
-- কাছে পাওয়ার এই পলিসিটা আপনার মোটেই ভালো না। তবে এবার কলকাতা ফিরে গিয়ে ডাক্তার দেখাবেন। ব্লাড টেষ্ট করতে হবে। খুব কম সময়ের মধ্যে এই 
দু'দুবার জ্বর আসা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।
-- তুমি এইভাবে পাশে থাকলে আমি তোমার সব কথা শুনবো সারাজীবন।
-- সারাজীবনের কথা থাক। আপাতত এখনকার মত শুনে একটু ঘুমান। আর একটাও কথা বললে আমি কিন্তু মাথা কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে নিজের বিছানায় চলে যাবো।
-- না,না, ঠিক আছে। আর কথা বলছি না। ঘুমিয়ে
 পড়ছি এবার।
অসিত চোখ বন্ধ করে আর শ্রাবণী দেওয়ালে পিঠটা হেলান দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগে।

ক্রমশ

Sunday, March 26, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৪৮ পর্ব)

অসিত তার ঘরে রেডি হচ্ছে শ্রাবণীকে নিয়ে বেরোবে বলে আর শ্রাবণী তার ঘরে রেডি হতে হতে কান খাড়া করে রেখেছে অসিতের পায়ের শব্দ শুনবার জন্য। কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে তার সে নিজেই বুঝতে পারে না। গতকাল থেকে অসিত কেন এত চুপচাপ হয়ে গেলো শ্রাবণী কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তবে অসিতের এই চুপ থাকাটাও শ্রাবণীর মোটেই ভালো লাগছে না। 

  অসিত রেডি হয়ে নিজের ঘরে অপেক্ষা করতে থাকে। আর শ্রাবণী নিশ্চিত অসিত ব্যাগ নেওয়ার জন্য তার ঘরে ঢুকবেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন অসিত আসে না তখন শ্রাবণী এক হাতেই ব্যাগটা নিয়ে  সিঁড়ির কাছে আসতেই অসিত পিছন দিক থেকে ব্যাগটা ধরে বলে,
-- ছাড়ো আমি নিচ্ছি।
-- আমি নিজেই নিতে পারবো। এ হাতে তো আর ব্যথা নেই।
-- সেটা আমিও জানি। এটা নিয়েই তুমি নামতে পারবে। এমন কী ট্রেন কিংবা বাস জার্নিও করতে পারবে। একাই তো যেতে চেয়েছিলে। নেহাত বাবা,মায়ের কথা ফেলতে পারোনি তাই আমার সাথে যেতে বাধ্য হচ্ছ। 
-- আপনার কোন অসুবিধা থাকলে তো তখনই বলতে পারতেন। আপনিই তো বললেন 'কোন  অসুবিধা নেই।'
-- হ্যাঁ আমি জানি আমার সাথে যেতে তোমার ভালো লাগবে না। কিন্তু এই অবস্থায় বাড়ির লোকও তোমায় একা ছাড়তে পারবে না। অগত্যা আর কয়েক ঘন্টা এই খারাপ মানুষটাকে একটু সহ্য করো।
   শ্রাবণী অসিতের এই ধরনের ভারী কথায় অভ্যস্ত নয়। তাই সে অসিতের দিকে তাকিয়ে পড়লো। অসিতের চোখ,মুখের চেহারা তার স্বাভাবিক লাগলো না। সে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো,
-- আপনার কি শরীর খারাপ? 
-- কই না তো?
-- কিন্তু আপনার চোখ,মুখ তো স্বাভাবিক লাগছে না।
-- আমার ভালোমন্দ তোমার কিছু নজরে পড়ে?
 শ্রাবণী সে কথার উত্তর না দিয়ে নামতে থাকে।
   ওরা নিচুতে নেমে আসে। অসিত শুধু চেঁচিয়ে বলে,
-- মা,বাবা আমরা বেরোচ্ছি।
 শ্রাবণী বাবা,মাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পরে। অসিত আজও শ্রাবণীর সিটবেল্ট বেঁধে দেয়। 
 অঞ্জলী ,অরুণাভ ওদের টা টা করে ঘরে এসে বসেন। অসিত একমনে গাড়ি চালিয়ে চলেছে। আজ একটা কথাও সে বলছে না। অসিতের এই নীরবতা শ্রাবণীর একদম ভালো লাগছে না। সে চাইছে অসিত ওর সাথে কথা বলুক। নিজেও কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না যে অসিতকে কিছু সে বলবে। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর শ্রাবণী আর না পেরে বললো,
-- আপনার কি শরীর খারাপ? আপনি এত চুপচাপ কেন আজ?
-- আমি বেশি কথা বলি বলে তুমি বোর হও। তাই চুপ আছি। কেন আমার এই চুপ থাকাটাও তোমার পছন্দ হচ্ছে না? মোদ্দা কথা আমার কোনকিছুই তোমার পছন্দ হয় না। আমি কথা বললেও দোষ আবার কথা না বললেও দোষ।
--- কিন্তু আমার মনেহচ্ছে আপনার শরীর খারাপ। আরে সমস্যাটা তো বলবেন।
-- কোন সমস্যা নেই। আমার কথা বলতে আজ ইচ্ছা করছে না।
 শ্রাবণী কোন উত্তর দেয় না সে কথার। কিন্তু সে লক্ষ্য করে অসিত এই সামান্য কথাগুলো বলে বেশ হাপাচ্ছে। বেশ কয়েকবার বোতল খুলে জলও খেলো। শ্রাবণী বুঝতে পারছে অসিতের শরীর ভালো নেই। এইভাবে আরও বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর ওরা একটা জনবহুল রাস্তায় ঢোকে। আর ঠিক তখনই শ্রাবণী বলে,
-- গাড়িটা একটু থামাবেন?
খুব ক্ষীণস্বরে অসিত বলে,
-- কেন?
-- একটু দরকার আছে।
 অসিত গাড়িটা একটু সাইড করে শ্রাবণীর বেল্টটা খুলে দেয়। শ্রাবণী অসিতের কপালে হাত দিয়ে দেখে তার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
-- একি! আপনার গায়ে এত জ্বর। আর বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে আপনি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন?
-- এখানে যদি তোমার কোন কাজ না থাকে তাহলে গাড়িটা পুণরায় স্টার্ট দিই। আর ঘণ্টা দু'য়েক পরেই আমরা পৌঁছে যাবো। তানাহলে খুব বিপদে পড়ে যাবো।
-- না, এখন আর গাড়ি চলবে না। জ্বরের ওষুধ আছে সাথে? 
-- সকালেই খেয়েছি একটা। হ্যাঁ আরও সাথে আছে।নিয়ে এসেছি। কিন্তু প্লিজ গাড়িটা স্টার্ট করতে দাও।
-- না, গাড়ি এখন চলবে না। আপনি গাড়ির মধ্যেই বসুন। আমি আসছি।
 শ্রাবণী গাড়ি থেকে নেমে গেলো। কিন্তু আশেপাশে কোথাও মোটামুটি থাকা যায় একটা রাত এমন কোন হোটেলের সন্ধান না পেয়ে পুণরায় গাড়ির কাছে ফিরে এসে দেখে অসিত স্টিয়ারিংয়ে উপর হাত রেখে সেখানেই মাথা দিয়ে আছে। তখন তার জ্বর আরো বেশি। কিন্তু এই অবস্থায় শ্রাবণী কী করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না। ওখানেই লোকজনের কাছে শোনে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে হোটেল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এখন যা অসিতের শারীরিক অবস্থা তাতে সে কী করেই বা স্টিয়ারিং ধরবে?
 -- আপনার ওষুধ কোথায়? ওষুধটা নিয়ে নেমে আসুন
-- কী হবে এখানে নেমে?
-- এখন অন্তত আমার কথা শুনুন।
 অসিত ওষুধ হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে। শ্রাবণী পিছনের দিকে উঠে গিয়ে একদম গাড়ির জানলার কাছে গিয়ে বসে বলে,
-- এবার উঠে আসুন।ওষুধটা খেয়ে কষ্ট হলেও আমার কোলে মাথা দিয়ে একটু সময় শুয়ে থাকুন পা ভাঁজ করে। জানি এভাবে শুতে আপনার কষ্ট হবে কিন্তু কিছু করার নেই তো।
-- তুমি যে আমার জন্য এটা ভেবেছো এটাই আমার জন্য অনেক। আমি বসেই থাকবো হেলান দিয়ে। এইটুকুন সিটে আমি শুতেই পারবো না।
-- তবে তাই করুন। উঠে আসুন ভিতরে।
 অসিত গাড়ির মধ্যে গিয়ে ওষুধটা খেয়ে সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে থাকে। শ্রাবণী তখন কিছুটা এগিয়ে যায় অসিতের দিকে। অসিত চোখ মেলে সেটা দেখতে পেয়ে বলে,
-- ভেবো না। এক্ষুণি জ্বর রেমিশন হয়ে যাবে। তুমি এই খারাপ মানুষটাকে নিয়ে এত ভাবছোই বা কেন?
-- আপনি খুব অন্যায় করেছেন এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে।
-- আরও কিছুটা সময় তোমার সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। তাই কাউকে কিছুই বলিনি। ওখানে গিয়ে বাবা,মাকে ফোন করলেও আমার সাথে তো কথা বলবে না। আমার তো খারাপ লাগে এতে। জানি তাতে তোমার কিছুই যায় আসে না। রাত থেকেই জ্বরটা এসেছে। 
 
 এবার শ্রাবণী বুঝতে পারে কেন গতকাল রাতে অসিত ঘুমানোর আগে তার কাছে আসেনি।

ক্রমশ 



Friday, March 24, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৪৭ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৪৭ পর্ব)

   এর ঠিক দিন তিনেক পরে শ্রাবণী তার কর্মস্থলে চলে যাবে ঠিক হল। আগেরদিন রাতে অরুণাভ জানালেন অসিত গাড়ি নিয়ে গিয়ে তাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসবে। তাই রবিবার করে তিনি দিন ঠিক করেছেন। শুনেই শ্রাবণী বললো,
-- বাবা,কোন দরকার নেই। আমি একাই চলে যেতে পারবো।
 সঙ্গে সঙ্গে অঞ্জলী বলে উঠলেন,
-- পাগলের মত কথা বলিস না। একা কী করে ব্যাগ নিয়ে যাবি। এখনো তো হাতটা গলায় ঝুলছে। একদম কথা বলবি না। অসিতই তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। 
  অসিত চুপচাপ বাবা,মা আর শ্রাবণীর কথা শুনে যাচ্ছে। আর যে যখন কথা বলছে তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। অরুণাভ অসিতকে বললেন,
-- কী রে তুই কোন কথা বলছিস না কেন? তোর কোন অসুবিধা নেই তো?
-- না,না আমার আবার কিসের অসুবিধা? রবিবার তো সেদিন।
 শ্রাবণী মনেমনে বলে, 'আবার কাল বেশ কয়েক ঘণ্টা চলবে বকবকানি।'
 খাওয়াদাওয়ার শেষে অঞ্জলী গিয়ে শ্রাবণীর ছোট্ট ব্যাগটা গুছিয়ে দিয়ে বললেন,
-- কোন রকম অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবি। শরীরের যত্ন নিবি। আর যে ভিটামিনটা দিয়েছেন রোজ নিয়ম করে খাবি।
-- এত কেন চিন্তা করো তুমি? একদম চিন্তা করবে না। এখন তো অনেকদিন আসতে পারবো না তুমি আর বাবা ওখানে ঘুরতে যেও। আমরা একসাথে ঘুরবো।
-- শুধু আমি আর তোর বাবা কেন? আমরা গেলে অসিতও যাবে। ঘুরতে হলে চারজনেই ঘুরবো।
 শ্রাবণী সে কথার কোন উত্তর দিলো না। শ্রাবণী বুঝতেই পারছে মা ঘর থেকে বেরোনোর সাথে সাথে অসিত এসে ঘরে ঢুকবে। অঞ্জলী চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও অসিত শ্রাবণীর ঘরে আসে না দেখে শ্রাবণী ভিতরে ভিতরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করছে। ও যেন মনেমনে চাইছে অসিত আসুক আবার ওর ভালোবাসার কথা বলে পাগলামী করুক। একজন সুঠাম,সুন্দর পুরুষের মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনতে বেশ লাগে রোজ। কিন্তু অসিতকে তো শ্রাবণী ভালো বাসে না। তবে কেন রোজ ওর মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনতে ওর ভালো লাগে। তবে কি অসিতকে ভালোবেসে ফেলেছে? কী সব উল্টোপাল্টা ভাবছে! আসেনি বাঁচা গেছে আজ বকবকানির হাত থেকে। কেনই বা ভাবছে ওর কথা? শ্রাবণী দরজার ছিটকনিটা দিতে গিয়েও দরজাটা খুলেই রাখে। তবে কি সত্যিই সে চাইছে অসিত তার ঘরে আসুক তার সাথে বসে গল্প করুক। কিন্তু কেন? মনটা এত আনচান করছে কেন? এই ক'দিনে কি এটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে নাকি অন্য কিছু? 

  শ্রাবণী লাইট অফ করে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুতেই ওর ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করতে থাকে। কেন মনের মধ্যে এরূপ তোলপাল করছে। কেন মন চাইছে অসিত এ ঘরে আসুক। নাহ্ ঘুম হবে না। ভেজানো দরজা খুলে বাইরে আসে। অসিতের দরজার কাছে এসে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তারমানে অসিত ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। কিন্তু কেন এত কষ্ট হচ্ছে বুকের মধ্যে? কার প্রতি এত অভিমানে কষ্টে চোখে জল এসে গেল? নিজেকে নিজের কাছে এত অচেনা লাগছে কেন?

  সারাটা রাত না ঘুমানোর ফলে খুব ভোরে উঠে পড়লো শ্রাবণী। তখন বাড়ির কেউই ওঠেনি। অসিতের দরজা তখনও ভিতর থেকেই বন্ধ। অত ভোরেই শ্রাবণী স্নান করে ঠাকুর ঘরে যায়। আজ মালী বাগানে আসার আগেই শ্রাবণী বাগান থেকে সব ফুল তুলে এনেছে। পুজো দিতে দিতেই নিজের মনে গুনগুন করে গান করে শ্রাবণী। অসিত ঘুম থেকে উঠে শ্রাবণীর দরজা খোলা দেখে ভাবে সে নিচুতে। কিন্তু নিচেই গিয়ে তাকে দেখতে পায় না। মা ,বাবা সবাই উঠে গেছেন তখন ঘুম থেকে। অঞ্জলী অসিতকে জিজ্ঞাসা করেন,
-- শ্রাবণী উঠেছে?
-- দরজা তো খোলা দেখলাম মা। কিন্তু সে কোথায় আমি জানি না।
-- কোথায় গেলো? দেখ তো বাগানে গেলো কিনা? মাঝে মাঝে তো আমাকে ফুল তুলে এনে দেয় পুজো করতে।
 ওদের কথার মাঝেই ঠাকুরঘর থেকে শঙ্খ'র আওয়াজ ভেসে আসে। তখন সকলেই বুঝতে পারে শ্রাবণী আজ পুজো করছে। সকলে তাকিয়ে দেখে ভিজে চুল ছেড়ে দিয়ে পুজো করে শ্রাবণী নিচেই নামছে। সকলের চোখ তার দিকে। সে নেমেই প্রথমে পুজোর ফুল বাবার কপালে ছোঁয়ালো। তারপর মাকে দিয়েই আবার সিঁড়ির দিকে রওনা দিয়েছে দেখে অঞ্জলী বললেন,
-- ওরে কুহু পুজোর ফুল অসিতের মাথায় ছোঁয়ালি না?
 একথা শুনে শ্রাবণী পড়লো মহা ফ্যাসাদে। সে পুজোর থালা নিয়ে এসে অসিতের সামনে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে ফুলটা তার মাথায় ছুঁইয়ে প্রসাদ হাতে দিলো। শ্রাবণী মনে ভেবেছিল নিশ্চয় অসিত কিছু তাকে বলবে। কিন্তু সে কিছুই বললো না উপরন্তু চোখ নিচের দিকে রেখে আশীর্বাদী ফুলের ছোঁয়া নিলো দেখে শ্রাবণী বেশ অবাক হল। গতকাল রাত থেকেই অসিতের এই পরিবর্তনে শ্রাবণী বেশ অবাকই হয়েছে। অথচ এই মানুষটাই যখন তার কাছে থাকে, তার সাথে কথা বলে সে মোটেই পছন্দ করে না। কিন্তু কাল রাত থেকে অসিতের এই পরিবর্তনও তার মোটেই ভালো লাগছে না। শ্রাবণী মনেমনে ভাবে কী অদ্ভুত মানুষের মন! অনেক সময় তার নিজের মন কী চায় তা সে নিজেই বুঝতে পারে না। কিন্তু যে মানুষটাকে সে পছন্দই করে না তার এরূপ ব্যবহারে কেন তার এতটা খারাপ লাগছে? তবে কি সে অসিতকে ---।

ক্রমশ 

Thursday, March 23, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৪৬ পর্ব)

প্রতিদিনই রাতে খাওয়ার পর অসিত শ্রাবণীর ঘরে ঢুকে ঠিক এভাবেই কিছুটা সময় কাটায়। শ্রাবণীও নিজের অজান্তেই যেন এই সময়টার অপেক্ষা করতে থাকে। অসিতের এই বকবকানিতে তার কান ঝালাপালা হলেও কোথাও যেন একটা ভালোলাগাও কাজ করে। আস্তে আস্তে নানান বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হতে থাকে। অনেক সময় মতের বিরোধ আবার কখনো মতের মিল। রবিবারের দিনগুলিতে শ্রাবণী খুব কম সময়ই উপরে থাকে। দু'জনে নিচুতেই বাবা,মায়ের সামনে টুকটাক কথা বলে এখন। অরুণাভ এবং অঞ্জলী  ওরা এক জায়গায় হলেই নানান কাজের অছিলায় অন্য কোথাও চলে যান এটা অসিত বেশ খেয়াল করেছে।
   দেখতে দেখতে শ্রাবণীর প্লাস্টার খোলার সময় হয়ে আসলো। কিন্তু তার আগেরদিন যেতে হবে এক্সরে করতে। অরুণাভ অসিতকে জানিয়ে দিলেন সে যাতে শ্রাবণীকে নিয়ে যায়। শ্রাবণী মাকে বলল,
-- মা, তুমি আর আমি যাই চলো। আমরা ট্যাক্সি করে চলে যাবো।
-- কেন রে অসিত গেলেই তো ভালো হবে। তুই বরং ওর সাথেই চলে যা।
 অগত্যা শ্রাবণী অসিতের সাথেই বেরোলো। গাড়ি বের করে সে শ্রাবণীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। শ্রাবণী এসে গাড়ির পিছন দিকে বসতে গেলে অসিত তাকে বলে,
-- ম্যাডাম,আজ সামনে আসুন। আপনি পিছনের সিটে বসলে আমি তো আপনার গাড়ির ড্রাইভার হয়ে যাবো।
 কথাটা বলেই হাসতে থাকে। 
 শ্রাবণী বেশ ঝাঁঝালো সুরে বলে,
-- তাহলে সেদিন কেন পিছনে বসতে বললেন? আর আজই বা কেন আপনার মনেহল আমি পিছনের সিটে বসলে গাড়ির মালিক হয়ে যাবো?
-- তোমার সারাজীবনের ড্রাইভার হতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার হতে চাই না। সেদিন তোমার কাঁচা প্লাস্টার ছিলো। সিটবেল্ট বাঁধলে ব্যথা লাগতে পারতো। আর আজ সে ভয় নেই। এই একটু সময় নাহয় দম বন্ধ করেই আমার পাশে বসে গেলে। আমার তো ভালো লাগবে।
 মিটিমিটি হাসতে থাকে অসিত। শ্রাবণী আর কথা না বাড়িয়ে সামনের সিটে গিয়ে বসে। অসিত ঝুঁকে পড়ে শ্রাবণীর সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলে,
-- আমার এটুকুই লাভ। এই যে বেল্ট বাঁধার অজুহাতে তোমার একটু হলেও তো কাছে এলাম।
 আবারও অসিতের হাসি। শ্রাবণী চোখ বন্ধ করে বসে আছে দেখে অসিত যেন একটু বেশিই সময় লাগাচ্ছে বেল্টটা বাঁধতে। সেটা বুঝতে পেরে শ্রাবণী বলে ওঠে,
-- এতক্ষণ কী করছেন আপনি? একটা বেল্ট বাঁধতে কতক্ষণ সময় লাগে?
-- ঠিক ততক্ষণ সময় লাগবে যতক্ষণ না তুমি চোখ খুলে আমার দিকে তাকাবে।
-- যত্তসব!
 বলেই অসিতের দিকে তাকিয়ে দেখে অসিত একদম তার বুকের কাছে একদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
  অসিতের সে দৃষ্টি দেখে এই প্রথম শ্রাবণীর বুকের ভিতর ধক করে কেঁপে উঠলো। আচমকা অসিত শ্রাবণীর ঠোঁট দুটোতে হালকা একটা পরশ দিয়ে বললো,
-- পারলাম না নিজেকে সামলাতে। চেষ্টা করেছি আজ এতদিন ধরে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করতে। কিন্তু আজ এত কাছে তোমায় পেয়ে আর পারিনি। প্লিজ কিছু মনে কোরো না।
 অসিতের আজকের এই মুহুর্তের পরশ শ্রাবণীর মনেও এক তৃপ্তি এনে দেয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও সে অসিতের প্রতি রাগ,অভিমান ভুলে যায়। কিন্তু হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে নিলয়ের মুখটা ভেসে ওঠে। ততক্ষণে অসিত গাড়ি চালাতে শুরু করেছে।
 এক্সরে করে সব ঠিক আছে দেখে ডক্টর শ্রাবণীর প্লাস্টার খুলে দেন। ফেরার পথে গাড়ি চালাতে চালাতে অসিত বলে,
-- তোমার প্লাস্টার খুলে দিয়েছেন আর সব ঠিক আছে এটা খুব আনন্দের খবর। কিন্তু আমার মনটা অন্য দিক থেকে ভীষণ খারাপও লাগছে।
-- ওঃ আমার হাতটা ঠিক হয়ে গেছে বলে আপনার খারাপ লাগছে?
-- আমার কথাগুলির সব বাঁকা মানে করো কেন? আমার এই কথাটার মানে তোমার মনে এটাই আসলো?
-- তাছাড়া আবার কী?
-- আসলে প্লাস্টার খোলা হয়ে গেছে এবার তো তুমি এখন থেকে চলে যাবে। খুব খারাপ লাগছে আমার। 
আচ্ছা তোমার কী একটুও খারাপ লাগছে না?
-- আনন্দ হচ্ছে! রোজ রাতে আর আমার বকবকানি শুনতে হবে না মনে করে।
 এবার শ্রাবণী মুচকি হাসছে দেখে অসিত বলে,
-- কাছে থাকতে তো বুঝলে না; দেখো এবার গিয়ে কাজ ছাড়া যখনই থাকবে আমার কথা তোমার মনে পড়বেই।
-- আপনার এত কনফিডেন্ট আসে কোথা দিয়ে? এ জিনিস কখনোই হবে না
-- হবে হবে হতেই হবে। আমার ভালোবাসার মধ্যে কোন খাদ নেই। জীবনে তুমি ছাড়া অন্য কারও প্রেমে আগে পড়িনি। জানি না আগে তুমি কারও প্রেমে পড়েছ কিনা। তাহলে বুঝতে প্রেমে পড়লে কী হয়! 
 কথাটা শুনেই শ্রাবণী একটু উদাস হয়ে গেলো। নিলয়ের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়তে লাগলো। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে দেখতে পেয়ে অসিত হাসতে হাসতে বললো,
-- নির্ঘাত পুরনো কারও কথা মনে পড়ে গেছে।
 শ্রাবণী যেহেতু অন্যমনস্ক ছিলো অসিতের কথাটা ভালোভাবে না শুনেই মুখ থেকে ওর 'হু' কথাটা বেরিয়ে আসলো। আর সেটা শুনেই অসিত আরও জোরে জোরেই হাসতে লাগলো। শ্রাবণী ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
-- পাগলের মত হাসছেন কেন?
 অসিত সুর করে এক লাইন গেয়ে উঠলো,'যখন কেউ আমাকে পাগল বলে -'।
-- কী হল বললেন না হাসছেন কেন?
অসিত হাসতে হাসতেই উত্তর দিলো,
-- না কিছু না। 
 গাড়ি থেকে নেমে শ্রাবণী আর কোন কথা না বলে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। অসিত গাড়িটা গ্যারেজ করে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে।

  অঞ্জলী ও অরুণাভ দু'জনেই ড্রয়িংরুমে ছিলেন। শ্রাবণী ঢোকার সাথে সাথেই অঞ্জলী বলে উঠলেন,
-- কি রে আজই প্লাস্টার খুলে দিলো?
-- ডাক্তারবাবু এক্সরে প্লেট দেখে বললেন,'সব ঠিক আছে। আগামীদিন আর কষ্ট করে আসার দরকার নেই আজই খুলে দিই।'
-- এখনো কতদিন এইভাবে গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে হাত?
-- মাঝে মাঝে মাত্র কয়েকটা দিন মা। তুমি অত ভেবো নাতো। সব ঠিক আছে। মা,আজ আমি স্নান করতে পারবো। কতদিন ভালোভাবে স্নান করিনি। যাই স্নান করে ফ্রেস হয়ে আসি।
 শ্রাবণী উপরে উঠে গেলো।

ক্রমশ 

Wednesday, March 22, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৪৫ পর্ব)

দুপুরে খাবার টেবিলেও আয়োজন ছিল যথেষ্ঠ। আজ অঞ্জলী অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশিই হাসিখুশি। তিনি জোর করে করে তার কুহুকে খাওয়ান। অসিত অফিস থেকে এসেই ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে চলে যায়। তখন শ্রাবণী নিচুতে। কিছুক্ষণ পরে ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে এসে সামান্য টিফিন করে। শ্রাবণী আর মা আজ বেশ খোশ মেজাজে আছেন দেখে ওর ও খুব ভালো লাগে। নিজে আর ওদের ভিতর না ঢুকে সে আস্তে আস্তে বাবার ঘরে চলে যায়। অরুণাভ তখন এক ফাইল খুলে ব্যবসার কাগজ দেখছিলেন। অসিত এসেছে দেখে তিনি বললেন,
-- তোকে যা বলেছিলাম সেটা কী এনেছিস?
 অসিত সলজ্জ হেসে মাথা নাড়ালো।
-- আচ্ছা বাবা, আমার যতদূর মনেহচ্ছে মায়ের সব কিছু মনে পড়ে গেছে। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলছেন না কেন?
-- তোকে বলিনি ডাক্তারবাবুর একটা কথা। তিনিও কিন্তু মনে করেন তোর মায়ের সবকিছু মনেপড়ে গেছে। কিন্তু তিনি কাউকে কিছুই বলছেন না। আজকে যেভাবে তোর মা শ্রাবণীর জন্মদিনটা পালন করলেন আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার আলমারিতে শ্রাবণীর একটা ফাইল আছে। তোর মা কোনদিনও আমার ব্যবসার কাগজপত্রে হাত দেন না। কিন্তু এখন মনেহচ্ছে তিনি ওই ফাইল দেখেছেন। তবে মেয়েটিকে তোর মা বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন। অবশ্য আমিও ওকে ভীষণ ভালোবাসি। ওর জন্যই তো তোর মা সুস্থ হল।
-- কিন্তু বাবা, মা পুরোটা স্বীকার করছেন না কেন?
-- শ্রাবণীকে হারানোর ভয়ে। করবে খুব শীগ্রই স্বীকার করবে।
-- কীভাবে?
-- এই যে তোমার কল্যাণে!
 মিটিমিটি হাসতে থাকেন অরুণাভ
-- বুঝলাম না 
-- বুঝলে না ? যখনই আমি শ্রাবণীর বিয়ের কথা তোর মাকে বলবো ঠিক তখনই সে তাকে বাড়িতেই আটকে রাখতে চাইবে। সে তোর বিয়ের কথা বলছে কেন বুঝতে পারছিস তুই?
-- না বুঝতে পারছি না -
-- হয়ত তোর মুখ থেকেই শুনতে চাইছিলো। কিন্তু আমরা নিজেরা একথা বলবো না। তোর মায়ের মুখ থেকে যখন একথা বেরোবে তখনই আমি ফিল্ডে নামবো।
-- কিন্তু বাবা ও তো আমাকে পছন্দই করে না 
-- তুই একটা গা*ধা। যা তুই এখন আমাকে কাজ করতে দে।

  রাতে খাবার টেবিলে পায়েসের বাটি দেখে অসিত বললো,
-- আজ হঠাৎ পায়েস কেন মা?
-- ওই কুহুর নামে একটু পুজো দিলাম
-- এতকাল তো দেখেছি মিষ্টি,ফল দিয়েই পুজো দিতে। পায়েস দিতে তো কোনদিন তোমায় দেখিনি
 -- আমার ইচ্ছা করলো তাই আর কী!
 অসিত ইচ্ছা করে আর কোন কথা বাড়ালো না। খেতে বসে কয়েকবার শ্রাবণীর দিকে তাকালো ঠিকই কিন্তু কথা কিছু বললো না। ওর সাথে কথা বলতে গেলেই ঝামেলা হয়। জন্মদিনে অসিত শ্রাবণীর সাথে আর ঝামেলা করতে চাইলো না।
  শ্রাবণী খেয়ে উপরে তার ঘরে ঢুকলে অসিত কিছু পরেই শ্রাবণীর ঘরে গিয়ে ঢোকে। প্রথমেই বলে,
-- ওষুধ খেয়েছো? দুপুরে ওষুধগুলো খেয়েছিলে?
শ্রাবণী খুব আস্তে উত্তর দেয় 
-- দুপুরের গুলো খেয়েছিলাম। এখনকার টা খাবো। কিন্তু একটা কথা বলুন তো -
শ্রাবণীর কথা শেষ হয় না অসিত একটা আঙ্গুল তার ঠোঁটের উপর রেখে বলে,
-- উহু আজ একদম ঝগড়া নয়। তারপর মুখটা শ্রাবণীর একদম মুখের কাছে এনে বলে,
-- শুভ জন্মদিন।
  একটা প্যাকেট শ্রাবণীর হাতে দিয়ে বলল,
-- এটা তোমার জন্য। এর ভিতর একটা লাল কাঞ্জিভরম আছে। অবশ্য দোকান থেকেই বললো ওটা কাঞ্জিভরম। আশাকরি তোমার পছন্দ হবে। তুমি এটা নিলে আমি খুব খুশি হবো।
-- আপনি কী করে জানলেন আজ আমার জন্মদিন?
-- বাবা অফিসে ফোন করেছিলেন। আর শাড়িটাও বাবা কিনে আনতে বলেছিলেন। সুতরাং তুমি না নিলে এটা আমার সাথে বাবাও কষ্ট পাবেন।
-- আপনি কী মানুষ বলুন তো? শেষ পর্যন্ত আপনার মনের কথাগুলো বাবাকেউ জানিয়েছেন?
-- আজ্ঞে না ,আমি বাবাকে কিছুই বলিনি। অত বোকা আমি নই। বাবা তার বুদ্ধি দিয়ে ছেলের মনের কথা বুঝেছেন। সবাই তো আর মনের ভিতর দেখতে পায় না।
 -- জীবনে ভালোভাবে চলতে গেলে সকলের মনের খবর নেওয়া যায় না। যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু জানাই বুদ্ধিমানের কাজ।
-- আচ্ছা আজ তোমার জন্মদিনে একটা সত্যি কথা বলো তো? আমার প্রতি কি তোমার বিন্দুমাত্র কোন অনুভূতি নেই?
-- কে বললো নেই? ঘুরতে গিয়ে আপনি অসুস্থ্য হলে আমি কি আপনার জন্য কিছু করিনি? এটা যদি অনুভূতি না থাকতো তাহলে কি করতাম?
-- সেতো আমরা রাস্তাঘাটে অসুস্থ্য মানুষ দেখলেও করে থাকি। আমি সে অনুভূতির কথা বলিনি। আমি জানতে চাইছি --
-- না, আপনি যে অনুভূতির কথা জানতে চাইছেন সে অনুভূতি আপনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র নেই। কোনদিন হওয়ার কোন চান্সও নেই। তবে হ্যাঁ আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা বোধ আছে। আর আমার এই সময়ে আপনি যা করেছেন সে ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না।
-- সব উত্তর ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। সময় সব কিছুর উত্তর দেবে। এ নিয়ে আজকে অন্তত কোন তর্ক আমি তোমার সাথে করবো না। দাঁড়াও তোমার ওষুধগুলো দিই।
-- আমি নিয়ে নিতে পারবো।
-- সেতো জানি।
 কথা বলতে বলতেই অসিত ওষুধগুলো স্টিপ থেকে খুলে শ্রাবণীর হাতে দিয়ে জলের বোতলের মুখটা খুলে হাতে ধরিয়ে দিল। শ্রাবণী ওষুধ খাওয়ার সাথে সাথে আবার বোতলটা হাতে নিয়ে মুখ লাগিয়ে খাটের উপর মাথার বালিশের কাছে রেখে দিয়ে বললো,
-- এবার শুয়ে পরও। যতদিন না তোমার প্লাস্টার খোলা হচ্ছে তুমি দরজাটা ভেজিয়েই রেখো। মা কিন্তু আজ সকালে উঠেই তোমাকে দেখতে এসেছিলেন। তোমায় ঘুমাতে দেখে আমার সাথে কথা বলে নিচুতে নেমেছেন।
এটা চলতেই থাকবে যতদিন না তুমি সুস্থ হও।
শ্রাবণী একটু অন্যমনস্ক ভাবেই বললো,
-- মা,বাবা দু'জনেই আমায় খুব ভালোবাসেন।
 অসিত ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে বললো,
-- কবে যে তুমি আমার ভালোবাসাটা বুঝবে ঈশ্বর জানেন।
-- আপনি কথাই কথাই এই কথাটা আমায় শোনাবেন নাতো
-- শোনায় কী আর সাধে?  মনের কষ্টে বেরিয়ে আসে।
 অসিতের হাসি হাসি মুখ দেখে শ্রাবণী একটু রেগেই বললো,
-- এখন হয়েছে আর এক জ্বালা! রোজ রাতে এই ওষুধ দেওয়ার নাম করে ওই একই কথার পুনরাবৃত্তি। ভালো লাগে না রোজ রোজ এক কথা শুনতে।
-- আমারও কী আর রোজ রোজ একই কথা বলতে ভালো লাগে?
 অসিত হাসতে থাকে। শ্রাবণী তখন দরজার দিকে আঙ্গুলটা দিয়ে বললো,
-- এবার আপনি আসুন। আমি ঘুমাই। 
-- আর একবার শুভ জন্মদিন।
 শ্রাবণী 'থ্যাংকস'বলে শোয়ার জন্য বালিশের দিকে এগিয়ে গেলো। অসিত লাইট অফ করে দরজা ভেজিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।

ক্রমশ 

একদিন ভালোবাসবে (৪৪ পর্ব )

 একদিন ভালোবাসবে (৪৪ পর্ব)

   অসিত খেয়ে অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর অঞ্জলী শ্রাবণীকে ডেকে বললেন,
-- কুহু আজ একটু তাড়াতাড়ি স্নান করে নিবি। তোর জন্য আমি ঘরেই একটু পুজো দেবো। 
-- কিসের পুজো মা? ওমা,আমি তো স্নান করতে পারবো না। প্লাস্টারে জল লেগে যাবে তো -
-- তাই তো । তাহলে চল আমি নিজেই তোর মাথা ধুইয়ে গা স্পঞ্জ করে দিই 
-- বললে নাতো কিসের পুজো করবে?
-- সেদিন তোর ওই অবস্থায় যখন বাপ,ছেলে মিলে আমায় না নিয়ে চলে গেলো তখন আমি আর কী করবো? বসে বসে ঠাকুরকে ডেকে যাচ্ছিলাম। ওই সেই কারণেই তোর নামে একটু পুজো দেবো।
-- বাবাকে দেখছি না। বাবা কী বেড়িয়েছেন?
-- হ্যাঁ বললো কী কাজ আছে। চা,বিস্কুট খেয়েই বেরিয়ে গেছেন।

   শ্রাবণী উপরে উঠতে গেলে অঞ্জলী তাকে বললেন,
-- তুই গিয়ে উপরেই থাক। আমিই উপরে আসছি। বারবার তোকে উঠানামা করতে হবে না। 
-- মা, তোমাকে তো আগেই বলেছি আমার হাতে ব্যথার জন্য সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে অসুবিধা হবে না।
-- সে যাই হোক। তুই যা আমি আসছি।
  শ্রাবণী উপরে গিয়ে ভাবতে থাকে নিজের মায়ের সাথে এই নতুন মায়ের কোন পার্থক্য নেই। একদম মায়ের মত ওকে আগলে রেখেছেন। বাবাও ঠিক তাই। নিজের বাবার কাছ থেকে কোনদিন কোন আদর,ভালোবাসা পাইনি কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় সে শুন্য স্থান এই বাবা'ই পূরণ করে দিয়েছেন। কিন্তু এতকিছু স্বর্তেও অসিতের পূর্ব ব্যবহারই শুধু নয় কেন যে সে অসিতকে একদম পছন্দ করতে পারে না নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি আজও। 
  অঞ্জলী উপরে গিয়ে শ্রাবণীর মাথা ধুইয়ে গা স্পঞ্জ করে, চুল আঁচড়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু করে বলেন,
-- লক্ষী মা আমার।খুব ভালো থাকিস জীবনে। 
-- কী ব্যাপার বলো তো মা? আজ কী কোন বিশেষ দিন?
-- হ্যাঁ বিশেষ দিন তো অবশ্যই। আজ তোর নামে আমি পুজো দিলাম। 
 কথাটা বলে তিনি আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে নিচে নেমে গেলেন। শ্রাবণীও সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিচুতে গিয়ে দেখে মেঝেতে আসন পাতিয়ে ধান-দূর্বা, প্রদীপ জ্বালিয়ে অঞ্জলী ওর জন্য অপেক্ষা করছেন। খুব খটকা লাগে ওর। তবে কি উনি সবকিছু জেনে গেছেন? কিন্তু কী করে জানবেন? একমাত্র বাবা ছাড়া তো কেউ জানে না যে আজ তার জন্মদিন। কলেজ থেকে সার্টিফিকেট আনতে গিয়েই বাবা জেনেছেন। তবে মায়ের আজ এই আয়োজন দেখে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে মা পুরোটাই জেনে গেছেন। তাহলে মা তো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন। উনি বাস্তবতাটা মেনে নিয়েছেন। তবে উনি কাউকে কিছু বলছেন না কেন? 
 অঞ্জলী শ্রাবণীকে দেখতে পেয়ে বললেন,
-- আয় এই আসনটাই বোস। পুজোর জন্য একটু পায়েস করেছি। তোর উদ্দেশ্যে পুজো। ঠাকুরকে নিবেদন করে নিয়ে এসেছি। আয় তো তোর মুখে একটু দিই।
 শ্রাবণী পায়েস দেখে চোখের জল সংবরণ করতে পারে না। তার চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। নিজের জন্মদিনে মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। অঞ্জলী ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন,
-- গৃহ দেবতা আমার কথা শুনেছেন। তাই পুজোটা দিলাম। এই আশীর্বাদটাও সেই জন্যই।
 বাটি থেকে পায়েস তুলে তিনবার শ্রাবণীর মুখে দিলেন।শ্রাবণী মাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতে গেলে উনি বলেন,
-- দাঁড়া তোর বাবা এসে গেছেন। উনাকে ডেকে আনি। আমি একাই আশীর্বাদ করবো কেন? উনি যখন এসেই গেছেন আশীর্বাদটা করে নিন।
 সকালে অরুণাভ বেরিয়ে শ্রাবণীর জন্মদিন উপলক্ষে একটা কাপড় কিনে এনেছেন। কিন্তু কিভাবে দেবেন সেটাই বুঝতে পারছিলেন না। অঞ্জলী তাকে আশীর্বাদের জন্য ডাকলে তিনি একটি সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু আজকের এই আয়োজনে অরুণাভ নিজেও বিভ্রান্ত!
-- কী বলো অঞ্জু? খালি হাতে কিভাবে আশীর্বাদ করি। এই কাপড়টা দিয়ে আশীর্বাদ করি আমার মাকে।
  অঞ্জলী হেসে দিয়ে বললেন,
-- হ্যাঁ ঠিকই তো! আমিও তো খালি হাতে আশীর্বাদ করলাম। তুমি আশীর্বাদ করতে শুরু করে দাও আমি আসছি।
 অঞ্জলী চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী বাবাকে বলে,
-- কী হচ্ছে বাবা এগুলো? আজ ছাব্বিশে জুন আমার জন্মদিন তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না। মা কী করে জানলেন?
-- আমারও সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমার মনেহচ্ছে অঞ্জু পুরো সুস্থ শুধু হয়নি আমার আলমারির ভিতর তোর সব কাগজপত্র ও দেখেছে। তাই এইভাবেই তোর জন্মদিন পালন করলো। 
-- কিন্তু মা সে কথাটা কাউকে কিছু বলছে না কেন?
-- হয়ত ভয়ে 
-- কিসের ভয়?
-- তোকে হারানোর ভয়। মা সুস্থ হয়ে গেছেন এটা জানতে পারলে তুই যদি এখান থেকে চিরদিনের মত চলে যাস সেই ভয়ে।
 ওদের কথার মাঝে অঞ্জলী একটা সোনার চেন যা কুহুর পাঁচ বছরের জন্মদিনে তাকে দেওয়া হয়েছিল তিনি সেটি নিয়ে এসে শ্রাবণীর গলায় পরাতে পরাতে বললেন,
-- মায়ের আশীর্বাদ। সারাজীবন এটা গলায় রাখবি।
 শ্রাবণী অবাক হয়ে বললো,
-- মা এত দামী একটা চেন দেওয়ার কী দরকার ছিলো বলো তো?
-- আমার কাছে অসিত আর তুই হচ্ছিস সব থেকে দামী। এইসব কিছু আমার কাছে তুচ্ছ! তোরা দু'জনে সুস্থ থাক,ভালো থাক ব্যাস আর কিছু আমার চায় না।
 অরুণাভ আর শ্রাবণী দু'জনে অঞ্জলীর দিকে তাকিয়ে থাকেন কিন্তু কেউ কোন কথারই উত্তর করেন না। অঞ্জলী যখন ঘরে চেন আনতে গেছিলেন তখন খুব আস্তে অরুণাভ শ্রাবণীকে 'শুভ জন্মদিন' - বলে উইশ করেন। শ্রাবণী ছলছল চোখে বাবাকে প্রণাম করে।

  ক্রমশ -

Tuesday, March 21, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৪৩ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৪৩ পর্ব)

  রাতের খাবার খেয়ে শ্রাবণী যখন উপরে উঠে অসিত তখন তার ঘরে।শ্রাবণী ঘরে ঢুকেছে বুঝতে পেরেই অসিত শ্রাবণীর ঘরে গিয়ে দেখে ওষুধের স্ট্রিপ দাঁতে চেপে সে ট্যাবলেট বের করার চেষ্টা করছে। সঙ্গে সঙ্গে সে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-- সবটাতেই এত পাকামো কেন করো? ডাকলেই তো পারতে আমাকে। দাও দেখি আমি খুলে দিচ্ছি।
  শ্রাবণী ওষুধটা খোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেখে অসিত ওর মুখ থেকে ওটা টেনে নিয়ে ওষুধটা বের করে হাতে দিয়ে বলে,
-- কী ধাতুতে তুমি গড়া আমার জানা নেই। আরে বাবা! আমি মানুষটা তোমার কাছে খুব খারাপ আমি জানি। কিন্তু এখন তো তুমি অসুস্থ্য। বাড়িতে যখন আছি এটুকু সাহায্য তো করতেই পারি তোমাকে।
-- আপনি কাল থেকে আমার জন্য অনেক করেছেন। দয়া করে এসব করতে এসে আমাকে আর বিব্রত করবেন না।
-- তুমি দেখতে যত সুন্দর তোমার মুখের কথাগুলো ঠিক ততটাই খারাপ। কই আমার সাথে ছাড়া আর কারও সাথে তো এরকম ভাবে কথা বলো না।
-- এসব কথার উত্তর দিতে গেলে আবার সেই পুরোনো কথা টেনে আনতে হবে। 
-- তোমায় একটা অনুরোধ করি। যতদিন তোমার প্লাস্টার না খুলছে ততদিন আমি বাড়ি থাকাকালীন সময়ে তোমার এই ছোটখাটো কাজগুলি আমায় করতে দিও।
-- কিন্তু কেন? এগুলো আমি নিজেই করে নিতে পারবো। আপনাকে করে দিতে হবে না।
-- তুমি করে নিতে পারবে সেটা আমিও জানি। মনে কর এটা আমার তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা -
-- বুঝলাম না , আমার প্রতি আপনার কিসের কৃতজ্ঞতা? আপনি যদি মনে করেন এসব করে আমার কাছাকাছি আসতে পারবেন তাহলে বলবো - আপনার এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল 
-- আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল! বাবার কথা বলবো না কারণ তিনি তোমাকে মেয়ের জায়গাটাই দিয়েছেন। আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ তার কারণ হচ্ছে আমার মায়ের সুস্থতা। আমরা কলকাতা শহরের অনেক বড় বড় ডাক্তার মাকে দেখয়েছিলাম। ভেলোর, চেন্নাই কোথাও বাদ দিইনি। কিন্তু মাকে সুস্থ করতে পারিনি। আমরা তাকে সুস্থ করার আশা ছেড়েও দিয়েছিলাম। এখন মনেহয় তোমার আমাদের বাড়িতে আসা ঈশ্বরের আশীর্বাদ। হয়ত তাকে সুস্থ করতে তোমাকে কোন পরিশ্রম করতে হয়নি কিন্তু তোমার উপস্থিতিই আমার মাকে আগের মত করে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।
-- বাব্বা! অনেক কিছু ভেবেছেন তো?
-- আসলে এই যে তুমি সব সময় এই বাড়ির প্রতি তোমার কৃতজ্ঞতা জানাও এটা শুনতে আমার একদম ভালো লাগে না। এইটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তোমার প্রতি আমাদেরও যে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সেটা মাথায় আসলো। কোনদিন কোন ব্যাপার নিয়ে আমি এত মাথা ঘামায়নি। ছোটবেলার থেকে মাকে খুব কম সময়ই কাছে পেয়েছি। প্রথম দিকে তো সবই ঠিক ছিল। কিন্তু দিদির মৃত্যুর পর সবকিছুই বদলে গেলো। পড়াশুনার জন্য অধিকাংশ সময় বাইরে কাটিয়েছি। বাড়িতে ফিরে সেই আগের মত মাকে কখনোই পাইনি। কিন্তু তুমি এসে এই বদলে যাওয়া বাড়িটাকে ঠিক আগের মত করে দিয়েছো। মানে তোমার উপস্থিতিই সবকিছু ঠিক করে দিয়েছে। হ্যাঁ প্রথম দিকে তোমার সাথে আমি খুব দুর্ব্যবহার করেছি। বলতে একটুও বাঁধা নেই আস্তে আস্তে তোমায় আমি ভালোও বেসে ফেলেছি। আমার মনে যা মুখেও আমি তাই প্রকাশ করি। আমি মনের কথা চেপে রাখতে পারি না সকলের মত।
-- আজ কেন বলছেন এসব কথা? আমার এগুলো শুনে কী হবে?
-- না, এ কথাগুলো শুনে তোমার কিছু হবে না সেটা আমিও জানি। কিন্তু এই কারণেই বলা তোমার অজান্তেই তুমি আমাদের অনেক উপকার করেছো। তাই কথায় কথায় ওই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটা বন্ধ করো। ভালো লাগে না শুনতে আর। তোমার এই অসুস্থতার সময়ে তোমার জন্য কিছু করতে পারলে অন্তত কিছুটা ঋণ তো শোধ হবে। 
 শ্রাবণী সে কথার কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। তাই সে চুপ করেই থাকলো। অসিত আবারও বললো,
-- কথা বলতে বলতে অনেকটা রাত হয়ে গেলো। এবার ঘুমিয়ে পরও। তবে দরজাটা বন্ধ কোরো না। না,না ভয় নেই। আমি অতটা অমানুষ নই। আসলে তোমার এই অবস্থায় কখন কী দরকার পড়ে তাই বললাম। আর আমি যতদূর জানি এই ওষুধগুলোর মধ্যে তোমার ঘুমের ওষুধও আছে। স্বভাবতই সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হবে। মা তো উঠেই উপরে চলে আসবেন তোমার খবর নিতে। ডাকলে তোমার ঘুমের ব্যাঘাত হবে আর তুমি না উঠলে মায়ের টেনশন হবে। তাই বলছি দরজাটা খোলা থাক। 
 অসিত 'শুভ রাত্রি' জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। শ্রাবণী আজ এক অন্য অসিতকে দেখতে পেলো।
 
  সকালে সত্যিই শ্রাবণীর ঘুম ভাঙতে দেরি হল। অসিত ঠিকই বলেছিল ভোরবেলা উঠেই অঞ্জলী উপরে শ্রাবণীর ঘরে ঢুকে দেখলেন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তিনি তাকে না ডেকেই ছেলের ঘরে গিয়ে দেখলেন সে উঠে পরেছে। অঞ্জলী জানতে চাইলেন,
-- আজ অফিস বেরোবি তো?
-- হ্যাঁ মা। এখন একদম কামাই করতে পারবো না। গতকাল অনেক বুঝিয়ে ছুটি ম্যানেজ করেছি। 
-- না,না আমি তোকে অফিসে যেতে বারণ করেছি না। বলছি কী মেয়েটার শরীর তো খারাপ তুই আর ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করিস না। 
 অসিত অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
-- এখন তো আমি ওকে আর কিছু বলি না। কিন্তু তুমি একথা কেন বলছো?
-- না,এমনিই বললাম। তুই তো খুব কাটকাট কথা বলিস তাই বললাম আর কী!
 অসিত অবাক হয় মায়ের এই কথায়। ও এখনো ধন্ধে রয়েছে মায়ের পুরনো কথা সব মনেপড়ে গেছে কিনা। কিন্তু যতদিন না মা নিজের মুখ থেকে কিছু বলছেন ততদিন পর্যন্ত ওকে আর বাবাকে চুপ থাকতেই হবে।

 গতকাল রাত থেকেই শ্রাবণীর বারবার মনে পড়ছিল আজ তার জন্মদিন। কয়েক বছর ধরে এই দিনটার কথা সে ভুলেই বসে ছিল। মা কিছু না করলেও একবাটি পায়েস করে তাকে দিতেন। আর আসনে বসিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে আশীর্বাদ - ব্যাস এটুকুই ছিলো শ্রাবণীর জন্মদিন পালন। কিছুক্ষণ পুরনো কথা মনে করে নিজের চোখ দু'টি মুছে সে নিচুতে নেমে গিয়ে দেখলো অসিত অফিসের যাবে বলে রেডি হয়ে টেবিলে খেতে বসেছে। শ্রাবণী নামার সাথে সাথে অঞ্জলী লতিকাকে তার চা ও ব্রেকফাস্ট দিতে বললেন। শুনেই শ্রাবণী বললো,
-- মা,আগে চা টা খাই একটু পরে ব্রেকফাস্ট করছি।
 অসিত খেতে খেতে মুখটা তুলে বললো,
-- ওষুধটা খেতে তাহলে দেরি হয়ে যাবে। চায়ের সাথে অন্তত একটা পাউরুটির পিস খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নাও। বলেই পকেট থেকে সকালের তিনটি ওষুধ বের করে টেবিলের উপর রাখলো। সেই মুহূর্তে অঞ্জলী ওখানে না থাকায় শ্রাবণী খুব আস্তে আস্তে বললো,
-- এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
 অসিত হেসে পড়ে উত্তর দিলো,
-- হলে হচ্ছে আমার কিছু করার নেই।
 শ্রাবণী রাগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সেই মুহূর্তে সেখানে অঞ্জলী চলে আসেন চা ,পাউরুটি টোস্ট,ডিম কলা নিয়ে। শ্রাবণী চুপ করে যায়। অসিতের দিকে তাকিয়ে দেখে সে মুচকি মুচকি হাসছে।এটা দেখে শ্রাবণীর রাগে সর্বশরীর জ্বলে যাচ্ছে তখন।

ক্রমশ 
    

Sunday, March 19, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৪২ পর্ব)

লতিকামাসী উপরে শ্রাবণীর চা দিয়ে গেলেও চা টা শেষ করেই শ্রাবণী নিচুতে নেমে যায়। নামার আগে অসিতের ঘর অন্ধকার দেখে কৌতূহল বশত অসিতের ঘরে পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখে সে ঘরে নেই। শ্রাবণী নিজেও বুঝতে পারছে না অসিতকে কেন আগের মত আর অসহ্য ওর লাগছে না। নিজেকেই নিজে বোঝায় হয়ত মানুষটা তার এই অ্যাক্সিডেন্টে এতটা দৌড়ঝাঁপ করেছে বলেই কৃতজ্ঞতা বশত তার এমন হচ্ছে। সে নিচুতে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে দেখে অঞ্জলী অরুণাভকে বললেন,
-- দেখো মেয়ের কান্ড! আমি তাকে উপরে চা পাঠিয়ে দিলাম আর সে কাপ হাতে নিচেই নেমে আসলো।
  দুজনেই বসে ছিলেন ডাইনিং রুমে। তাকে দেখে অরুণাভ খুব খুশি হলেন এবং মেয়েকে হাত ধরে নিজের কাছে বসিয়ে বললেন,
-- এখন কেমন আছিস মা? এখনো কি ব্যথা করছে?
-- না,না বাবা এখন আর ব্যথা নেই। এখন আমি ভালো আছি। কিন্তু মা যদি একদম আমায় উপরে বসিয়ে রাখেন তাহলে অসুস্থ্য হয়ে পড়বো।
-- ওমনি মায়ের দোষ না? খামোখা কী একটা কান্ড করে বসলি বলতো?
  অঞ্জলী কথাটা বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- সেই কখন অসিত বেরিয়েছে এখনো আসে না কেন বলো তো?
-- আরে ওর কাজ হয়ে গেলেই আসবে। সব বিষয়ে এত চিন্তা কেন করো বলতে পারো?
-- চিন্তা কী আর করি সাধে? এই দেখো না কুহু কী একটা ঘটিয়ে বসলো!
-- ঠিক আছে,ঠিক আছে। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। কিন্তু মা তোকে তো হাসপাতালে একটু জানাতে হবে তো?
-- হ্যাঁ বাবা মেল করে দিয়েছি।
-- যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো। নতুন তার উপর সরকারি চাকরি। ভাবছিলাম এটা নিয়ে খুব।
  ওরা ওখানে বসেই গল্পগুজব করছিলেন। মাঝে মধ্যে অঞ্জলী উঠে রান্নাঘরে টিফিনের তদারকিতে যাচ্ছিলেন। কারণ তার মাথায় রয়েছে কুহু অনেক তাড়াতাড়ি লাঞ্চ করেছে। ওর খিদে পেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বাদে বেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খোলেন অঞ্জলী। অসিত তার হাতে একটা খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে বলে,
-- মা গরম গরম কচুরি আর ছোলার ডাল আছে। এখন এটাই সবাই খাবো।
-- যাহ তুই খাবার নিয়ে আসবি জানতে পারলে লতিকাকে আর টিফিন বানাতে বলতাম না। 
 কথাটা বলেই তিনি খাবারের প্যাকেট হাতে রান্নাঘরে ছুটলেন লতিকাকে টিফিন যাতে না করে সেটা বলতে । একটু পরেই তিনি প্লেটে খাবার সাজিয়ে টেবিলে এনে রাখলেন।
-- কুহু তোর তো খিদে পেয়ে গেছে মা। আয় খেয়ে নে।
 অসিতও হাত ধুয়ে এসে বসলো। সবাই মিলে একসাথে খেতে লাগলেন। খেতে খেতেই অসিত বললো,
-- মা, ওই প্যাকেটে তুমি যা কিনে আনতে বলেছিলে তা এনেছি। দেখো পছন্দ হয় কিনা।
-- আমি তো আর পরবো না। কুহুর জিনিস ওর পছন্দ হলেই হল।
 অসিত শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-- সেইই! তবে এখন যা অবস্থা তাতে পছন্দ না হলেও পরবে। দিব্যি তো আমার জামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওটা পছন্দ না করেই যখন পরতে পারছে এগুলোও পছন্দ না হলেও পরবে।
 শ্রাবণী অসিতের দিকে তাকিয়ে পড়লো। দু'জনে চোখাচোখি হওয়াতে শ্রাবণী চোখ নামিয়ে নিয়ে খাবারে মন দিল। খাওয়া শেষে অঞ্জলী প্যাকেট দুটি খুলে বসলেন। অসিত চারটে হাউজকোট কিনে এনেছে সেগুলো একটা প্যাকেটে। এক একটা বের করছেন অরুণাভ আর তার কুহুকে দেখিয়ে আবার ভাঁজ করে রাখছেন। অন্য প্যাকেটটা খুলে দেখেন তার ভিতর খুব সুন্দর এবং দামী একটা চুড়িদার। দেখে ছেলেকে বললেন,
-- ওরে তুই এখন এটা কিনে আনলি ওতো এই হাত নিয়ে পরতে পারবে না।
 অরুণাভ কথাটা শুনতে পেয়েই বলে উঠলেন,
-- চমৎকার হয়েছে তো চুড়িদারটা। আমার খোকার পছন্দ আছে। দেখ কুহু কী সুন্দর জামা পছন্দ করে কিনে এনেছে তোর জন্য। 
 অঞ্জলীর দিকে মুখ করে বললেন,
-- এখন পরতে পারবে না তাতে কী হয়েছে? প্লাস্টার খুললে তারপর পরবে।
 অসিতের যেন গা দিয়ে ঘাম ছাড়লো। যাক বাবা এ যাত্রাও বাঁচিয়ে দিলেন। এবার অসিত সিওর হল বাবা তার মনের খবর পুরোটাই জেনে গেছেন। সে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো। অরুণাভ চোখের ইশারায় তাকে বুঝিয়ে দিলেন তিনি তার পাশে আছেন। এদিকে যাকে নিয়ে এত কথা সে কিন্তু চুপ। এবার অঞ্জলী বললেন,
-- কি রে কুহু তুই চুপচাপ কেন? তোর পছন্দ হয়েছে এগুলো?
 শ্রাবণী মাথা নাড়িয়ে 'হ্যাঁ' জানিয়ে বলে,
-- এতগুলো কেনার কোন দরকার ছিল না। দুটো আনলেই হয়ে যেত।
 অঞ্জলী বললেন,
-- এতগুলো কোথায়? তোকে তো প্লাস্টার না খোলা পর্যন্ত এগুলোই পরতে হবে। ঠিকই আছে। এ কটার দরকার আছে। আমার অতু বুঝেই এনেছে। যা তুই ওই ড্রেসটা ছেড়ে এই একটা পরে নে।
-- এখনি?
অরুণাভ বললেন,
-- আরে যেটা পরা আছে সেটা এখন খোলার কী দরকার। কাল পরবে।
 অসিতও বলে উঠলো,
-- এখন আর পরতে হবে না। নারাচারিতে ব্যথা লাগতে পারে। যেমন আছে তেমনই থাক।
 শ্রাবণীর সাথে আবার চোখাচোখি হওয়াতে অসিত একটু মুচকি হাসি দিলো। শ্রাবণীর আগের মত গা জ্বলে না উঠলেও অসিতের এই দুষ্টুমি হাসি তাকে বুঝিয়ে দিলো 'আমার পরা জামা এখনো অনেকক্ষণ তোমায় ধারণ করে রাখতে হবে।'
 টিফিন করেও অসিত আজ আর উপরে ওঠেনি। ওখানে বসে চারজনে গল্প করতে করতে সাড়ে ন'টা বাজিয়ে দিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অঞ্জলী বলে উঠলেন,
-- আরে অনেক রাত হল তো! অসিত যা উপরে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে আয়। আসার থেকে তো উপরেও উঠিসনি -। ফ্রেস হয়ে নিচুতে আয়। কুহুর তো ওষুধ খাওয়ার সময় হল।
 মায়ের কথা শুনে কুহু বললো,
-- মা, একটু আগে টিফিন করেছি। এখুনি কিন্তু খেতে পারবো না।
 শুনেই অসিত তিড়িং করে উঠলো,
-- খেতে পারবো না মানে কী? ওষুধটাতো ঠিক সময়ে খেতে হবে।
 নিজের কথা বলার ধরণে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-- না, আমি বলছিলাম যে ওষুধটা ঠিক সময়ে খেতে হলে খাবারটাও তো ঠিক সময়েই খেতে হবে।
 ছেলের অস্বস্তি কারণ বাবা সহজেই ধরতে পারলেন। তিনিও বললেন,
-- তুই যেটুকু পারবি সেটুকুই খেয়ে ওষুধগুলো খেয়ে নে। তারপর খিদে পেলে নাহয় আর একবার খেয়ে নিবি।
 বাবার কথা শুনে অসিত বাচ্চাদের মত হেসে দিয়ে বললো,
-- হ্যাঁ তাই তো। বাচ্চারা তো বারবার খায়।
 অসিততের কথা শুনে শ্রাবণীর রাগে এবার শরীর জ্বলে উঠলো। কিন্তু সে কোন কথা না বলে দাঁতে দাঁত চেপে চুপচাপই বসে থাকলো।


ক্রমশ 


 
 

একদিন ভালোবাসবে (৪১ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৪১ পর্ব)

 দশটার সময় ডাক্তার আসার কথা থাকলেও তিনি আসেন প্রায় একঘন্টা দেরিতে। অসিত বাইরেই অপেক্ষা করে। একজন অসুস্থ্য মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে বিব্রত করার ইচ্ছা অসিতেরও মন সায় দেয়নি। কারণ সে ভালোভাবেই জানে শ্রাবণী তাকে দেখলে মোটেই খুশি হবে না। কিন্তু এখানে না এসেও তার উপায় নেই। বাবা সারারাত কাল জেগে কাটিয়েছেন। সব থেকে বড় কথা নার্সিংহোমের বেডে তার ভালোবাসার মানুষটি। বাড়িতে থেকে কিংবা অফিসে গিয়ে তার একটুও মন বসবে না কোন কাজে। নাইবা গেলো সে সামনে শ্রাবণীর।নার্সিংহোমের বাইরে বসে থেকেও তার মনেহচ্ছে সে শ্রাবণীর অনেক কাছেই আছে।
 ডাক্তার শ্রাবণীর বাড়ির লোকের সাথে কথা বলে তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ডিসচার্জ করে দিলেন। তারপর অসিত ভিতরে ঢুকলো। শ্রাবণী বেড থেকে নামতে গেলে অসিত তাকে ধরে নামায়। শ্রাবণী এক্ষেত্রে তাকে আজ আর কিছু বলে না। গাড়ির কাছ পর্যন্ত ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে দিয়ে বলে,
-- তুমি পিছনেই বসো। সামনে বসলে সিটবেল্ট বাঁধলে হাতে ব্যথা লাগতে পারে।
 শ্রাবণী কোন কথা না বলে গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসলো। দরজা লাগিয়ে পিছন ঘুরে অসিত শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে পুণরায় বলে,
-- পিছন দিকে হেলান দিয়ে বসো আর হাতটা বুকের উপর চেপে রাখো। তাহলে যদি যারকিং হয় ব্যথা পাবে না।
 শ্রাবণী বাধ্য মেয়ের মত তাইই করে কিন্তু চুপচাপ। অসিতও আর কোন কথা না বলে গাড়ি চালিয়ে সোজা বাড়ির গেটের কাছে।নিজে নেমে এসে দরজা খুলে দিয়ে শ্রাবণীকে ধরে নামিয়ে দেয়। শ্রাবণী নেমে অসিতকে বলে,
-- ধন্যবাদ দিলে আপনাকে ছোট করা হবে। কাল থেকে আমার জন্য আপনি অনেক পরিশ্রম করেছেন। সারারাত ঘুম হয়নি। আবার সকালে অফিস কামাই করে আমাকে আনতে গেছেন। টাকার কথা আমি বলবো না। কারণ ওটা দেওয়ার আমার কোন ক্ষমতা নেই আর কয়েক বছর ধরে তো শুধু দু'হাত পেতে নিয়েই যাচ্ছি। আমার ঋণের বোঝা দিনকে দিন শুধু বেড়েই চলেছে।
-- নাও - অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হল। এবার ভিতরে ঢোকো।
 অসিতের পিছন পিছন শ্রাবণীও এগিয়ে গেলো। অরুণাভ, অঞ্জলী, লতিকামাসী সকলে ছুটে এসে নানান প্রশ্ন শুরু করলো শ্রাবণীকে। অসিত প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে আসলো ওষুধ কিনে। বাবা,মায়ের সামনে অসিত শ্রাবণীকে ওষুধ খাওয়ার নিয়মাবলী বুঝিয়ে দিয়ে উপরে উঠে গেলো। সেই গতকাল থেকে শ্রাবণীর শাড়িই পরা। নার্স বলে দিয়েছেন হাত খুব একটা বেশি নাড়াচাড়া না করতে। তাই বুক খোলা জামা পরতে হবে যতদিন প্লাস্টার করা থাকবে। অঞ্জলী এটা জানতে পেরে ছেলেকে বললেন,
-- কুহু তোর হাউজকোট আছে তো?
-- হ্যাঁ মা আছে কিন্তু সেগুলো তো আমি জয়েন করার সময় ওখানে নিয়ে গেছিলাম।
 অঞ্জলী ছেলেকে ডেকে তার একটা হাফহাতা শার্ট দিতে বললেন। কারণ অরুণাভর শার্ট অঞ্জলীর গায়ে আটবে না। বিকেলে গিয়ে কয়েকটা হাউসকোট কিনে আনার জন্যও ছেলেকে বললেন। নিজেই তাকে ওয়াসরুমে নিয়ে গিয়ে কাপড় ছাড়িয়ে অসিতের শার্টটা একটা হাত ঢুকিয়ে অপর হাতের উপর থেকে দিয়ে কোনরকমে বোতাম লাগিয়ে নিয়ে এসে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে বললেন,
-- আজ থেকে তোকে আর নিচুতে খেতে নামতে হবে না। তোর খাবার উপরেই দিয়ে আসবো।
-- মা, আমার হাতে ব্যথা। পা ঠিক আছে। আমি নিচুতে এসেই খাবো।
-- পাকামো করিস না। যা বলছি তাই শোন। এখন চল তোকে উপরে দিয়ে আসি।
-- আমি একাই যেতে পারবো মা। এত ভেবো না।
 শ্রাবণীর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে রেখেছে। অজানা, অচেনা একটি পরিবার থেকে এত ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যে না থাকলে হয় না। একসময় নিজেকে খুব হতভাগী বলে মনেহত শ্রাবণীর। কিন্তু ঈশ্বর একদিক থেকে ভাঙেন তো আর একটা দিক ঠিক গড়ে তোলেন। হয়ত এই পরিবারটার সাথে তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় লিখেছিলেন বলেই তার নিজের পরিবারটা কিভাবে তছনছ হয়ে গেলো। শ্রাবণী নিচের থেকে খেয়ে তখনকার মত ওষুধ খেয়ে উপরে উঠে আসে অঞ্জলীর সাথে। শ্রাবণীকে ঘুমাতে বলে তার দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে অসিতের ঘরে ঢুকে দেখেন সে স্নান সেরে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি ছেলেকে আর ডাকলেন না। ভাবলেন অতুর উপর দিয়ে কাল থেকে অনেক ঝড় গেছে। থাক কিছুক্ষণ ঘুমাক পরে নাহয় ডেকে খাওয়াবেন। অরুণাভর শরীরটাও রাত জাগার ফলে খারাপ হয়েছে। তিনিও শুয়ে আছেন। শ্রাবণী ফিরে বাবার সাথে তার ঘরেই দেখা করে এসেছে। 
 বিকেল নাগাদ শ্রাবণীর ঘুম ভাঙলো। সে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে পড়লো হাসপাতালে একটা মেল করতে হবে। তানাহলে নতুন চাকরি নিয়ে টানাটানি বেঁধে যাবে। সে এক হাতে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা যখন বের করছে ঠিক সেই মুহূর্তে অসিত তার ঘরে ঢোকে -
-- না জিজ্ঞাসা করেই আসতে বাধ্য হলাম। এখন এটা দিয়ে কী করবে? সরো আমি দেখছি। 
 শ্রাবণী সরে দাঁড়িয়ে বললো,
-- হাসপাতালে একটা মেল করতে হবে। কাল থেকে তো জয়েন করার কথা ছিলো। এই মুহূর্তে তো যেতে পারছি না।
-- ঠিক আছে। আমাকে বলো আমি করে দিচ্ছি। না তুমি ভেবো না তোমার কাছ থেকে পজেটিভ কোন কথা পাওয়ার আশায় আমি এগুলো করছি। তুমি যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে বাবা,মায়ের টেনশন কমবে। এই অবস্থায় আমার মূল উদ্দেশ্যই এইটা।
 শ্রাবণী লক্ষ্য করে অসিত বারবার তার পরনের জামাটার দিকে তাকাচ্ছে। সেটা দেখতে পেয়ে শ্রাবণী বলে,
-- কী দেখছেন বারবার জামাটার দিকে তাকিয়ে?
 অসিত হেসে দেয়।
-- দেখছি আর ভাবছি - আসলে মানুষ বিপদে পড়লে কত অসহায় হয়ে পড়ে। আমার জামাটা তুমি পরে আছো বাধ্য হয়ে। 
-- সে তো নিশ্চয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
-- না, বেশিক্ষণ পরে থাকতে হবে না। আমি সন্ধ্যায় বেরিয়েই তোমার হাউজকোট কিনে নিয়ে আসবো।
 
  অসিত শ্রাবণীর হাসপাতালে মেল করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

ক্রমশ 

  

Saturday, March 18, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৪০ পর্ব)

আগে বলো তুমি কেন আমার সাথে এরকম ব্যবহার করো?
-- সত্যিটা জানলে আপনার ভালো লাগবে না।
-- কী সত্যি? ভালো না লাগলেও শুনতে চাই। বলো কী সেই সত্যি?
-- কিছু মানুষ আছে যারা অপ্রিয় সত্যিটা নিতে পারে না।আর আপনি ঠিক সেই দলের।
 অসিতের এবার রাগ হতে থাকে। কিসের এত দেমাক এই মেয়েটার? তবুও নিজের রাগকে সংবরণ করে যতটা পোলাইটলি বলা যায় সেইভাবেই বলে,
--- এত ভনিতা না করে সত্যিটা বলো। আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না।
-- আপনার ভিতর দুটি স্বর্তা কাজ করে। প্রতিটা মানুষেরই দুটি  স্বর্তা থাকে। কিন্তু একটিকে মানুষ লুকিয়ে রাখতে জানে। আপনি সেটা পারেন না। যে মানুষটার প্রতি আপনার রাগ হয় আপনি তার সামনেই সেটা উগড়ে দেন। একবারও ভাবেন না অপরদিকের মানুষটি তাতে কত কষ্ট পায়, আঘাত পায়। আবার অপর  স্বর্তাটি সম্পূর্ণ একটি অন্য মানুষ। প্রত্যেকটা মানুষেরই রাগ,অভিমান, দুঃখ,কষ্ট,ভালোবাসা থাকে। কিন্তু সব সময় সেটাকে টেনে বাইরে আনা ঠিক নয়।
-- তোমার কথার মানে দাঁড়াচ্ছে মানুষের কোন কিছুই মানুষ তার মন থেকে বাইরে বের করে আনবে না। নিজে গুমরে গুমরে মরবে। সে রাগ হোক কিংবা ভালোবাসা।
-- দেখুন এত তত্ত্ব কথা আমি বুঝি না। তবে এই ধরণের মানুষকে আমি একদম পছন্দ করি না।
-- মোদ্দা কথা তুমি আমায় পছন্দ করো না। কী তাই তো? তবুও বেহায়ার মত বলবো আমি তোমায় ভালোবাসি। আর আমার এই ভালোবাসার মধ্যে কোন খাদ নেই। আমি তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবো। বাকিটা সময় বলবে।
 শ্রাবণী কোন কথার উত্তর দেওয়ার আগেই অরুণাভ,অঞ্জলী এসে গেলেন। ওদের কথা আর শেষ হল না। হোটেলে খেয়ে বাড়িতে ফিরতে প্রায় রাত সাড়ে দশটা বেজে গেলো। শ্রাবণীর কথাগুলো শোনার পর থেকেই অসিত গুম মেরে থাকলো। কথা প্রয়োজন না হলে বাড়ি ফেরবার পূর্ব পর্যন্ত সে বলেনি। গাড়িতে উঠবার সময় বললো,
--- বাবা,তুমি সামনে বসো।
 অরুণাভও বুঝলেন দু'জনের মধ্যে মান-অভিমানের পালা চলছে। তাই তিনিও কোন কথা না বলে চুপচাপ গিয়ে ছেলের পাশে বসে পড়লেন।
 বাড়িতে এসে অরুণাভ ও অঞ্জলী নিজেদের ঘরে ঢুকে গেলেন। অসিত গাড়ি গ্যারেজ করে নিজের ঘরে চলে গেলো কোনদিকে না তাকিয়ে। শ্রাবণী বাবা,মাকে ওষুধ দিয়ে যখন উপরে উঠতে গেলো সে কাপড়ের কোণায় বেঁধে সিঁড়িতে দরাম করে পড়ে গেলো। হাতে ছিল তার জলের বোতল সেটা শব্দ করে গড়াতে গড়াতে ঘরের মেঝেতে এসে থামলো। শব্দ পেয়ে সকলে ছুটে এসে দেখে শ্রাবণী পড়ে আছে সিঁড়িতে। অসিত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উপরেই দাঁড়িয়ে।এমনিতেই তার মন ছিলো খারাপ, ছিলো সে একটু অন্যমনস্কও।অরুণাভ চেষ্টা করলেন শ্রাবণীকে তোলার। কিন্তু তিনি পারলেন না। শ্রাবণী তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। উপরে ছেলেকে দাঁড়ানো দেখে অঞ্জলী বললেন,
-- ওখানে দাঁড়িয়ে হাদার মত কী দেখছিস? ওকে এসে তোল।
অসিত এসে শ্রাবণীকে তুলতে গেলে প্রথমে সে বাঁধা দিলো। কিন্তু অঞ্জলীর কথায় চুপ হয়ে গেলো। শ্রাবণী যন্ত্রণায় ছটফট করছে দেখে অসিত বললো,
-- মা ওকে তোমাদের ঘরে নিয়ে যাই। আমার মনেহচ্ছে ওর কনুইয়ের হাড় ভেঙ্গে গেছে। হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে।সবাই তাকিয়ে দেখেন শ্রাবণীর কনুইয়ের হাড় ভেঙ্গে রীতিমত ঝুলছে। শ্রাবণীকে দু'হাতে তুলে নিয়ে অসিত মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে বললো,
-- আমি রেডি হয়ে আসছি। এক্ষুণি নিয়ে হাসপাতাল যেতে হবে। বাবা,রেডি হয়ে নাও।
 অঞ্জলী শুনে বললেন,
-- আমিও সাথে যাবো।
 শ্রাবণী তখন দাঁতে দাঁত দিয়ে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করছে। চোখ থেকে সমানে জল পড়ে যাচ্ছে।অঞ্জলী তার মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছেন। মা যেতে চাইছেন শুনে অসিত বলে,
-- না,এত রাতে তোমার গিয়ে আর কাজ নেই। আমি আর বাবা যাচ্ছি।
 কয়েক মিনিটের মধ্যেই অসিত পুণরায় নিচুতে নেমে এলো। বাপ,ছেলে দু'জনে মিলে শ্রাবণীকে নার্সিংহোম নিয়ে গেলেন। অসিত শ্রাবণীকে ধরতে গেলে সে বললো
-- আমি হেঁটেই যেতে পারবো। ধরতে হবে না।
 যন্ত্রণায় চোখ,মুখ শ্রাবণীর তখন কালো হয়ে গেছে। অসিত শ্রাবণীর কথার কোন পাত্তা না দিয়ে তাকে ধরেই গাড়িতে তুললো। গাড়িতে বসিয়ে নিজে সরে আসার সময় আস্তে করে বললো,
-- রাগটা পরে দেখাবে। আগে প্লাস্টারটা করে আসি।
    তাকে বসিয়ে বাবাকে বসার কথা বলেই নিজে এসে ড্রাইভিং সিটে বসেই গাড়ি ছেড়ে দিলো। অঞ্জলীর বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাকে কেউ নিতে রাজি হল না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে গেট থেকেই ঘরে ফিরে গেলেন। নার্সিংহোম পৌঁছেই দৌড়াদৌড়ি,ছুটাছুটি সবই অসিত। অরুণাভ শ্রাবণীকে নিয়ে বসে থাকলেন। যদিও অসিতরা ভেবেছিল তারা শ্রাবণীকে নিয়েই ফিরবে কিন্তু ডক্টরবাবুরা সেদিন কিছুতেই ছাড়লেন না। প্লাস্টার করিয়ে রাতটা নার্সিংহোমেই রেখে দিলেন। ভোররাতের দিকে বাবা আর ছেলে বাড়িতে ফিরলেন। সকাল আটটার মধ্যেই আবার অসিত বেরিয়ে গেলো শ্রাবণীকে আনতে। সারাটা রাত জাগার ফলে অরুণাভ তখনো ঘুম থেকে উঠতে পারেননি। 
   হাসপাতাল পৌঁছে অসিত জানতে পারে দশটার সময় ডাক্তার এসে দেখে প্রেসক্রাইব করে তবে ছাড়বেন। অগত্যা অসিত বাইরেই অপেক্ষা করতে লাগলো। পেষ্ট,ব্রাশ কিনে সিস্টারের হাতে দিয়ে দিলো। শ্রাবণী জানতে চাইলো,
-- কে এসেছেন আমায় নিতে?
 সিস্টার একটু মজা করেই উত্তর দিলেন হেসে,
-- একজন হ্যান্ডসাম।
 শ্রাবণীর বুঝতে একটুও অসুবিধা হল না তাকে কে নিতে এসেছে। সিস্টার অসিতকে ভিতরে যাওয়ার পারমিশন দিলেও অসিত ইচ্ছা করেই ভিতরে ঢোকে না। ফর্মালিটিগুলো সেরে বাইরেই অপেক্ষা করতে থাকে।

ক্রমশ 

Friday, March 17, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৩৯ পর্ব)

পরদিন সকালে অসিত চা খেতে নিচুতে নামলে অঞ্জলী বললেন,
-- হ্যাঁরে অতু, আজ কি তোকে অফিসে যেতেই হবে?
-- কেন মা ?
-- কালই তো কুহু চলে যাবে। তাই ভাবছিলাম আজ সবাই মিলে একটু ঘোরাঘুরি করে হোটেলে খেয়ে ফিরবো। 
-- হ্যাঁ মা, আজকে আমাকে যেতেই হবে। তোমরা ঘুরতে যাও না সবাই।
  অসিতের আজ অফিসে না গেলেই নয়। ইচ্ছা তো করছে আগামীকাল শ্রাবণী চলে যাবে তার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। কিন্তু উপায় নেই।
-- তাহলে ঘোরাটা বাদ থাক। তুই ফিরে আসার পর সবাই মিলে চল বাইরে খেয়ে আসি।
-- হ্যাঁ এটা হলে আমার অসুবিধা হবে না।
-- তাহলে একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরোস। বাড়িতে এসে ফ্রেস হয়ে সবাই মিলে যাবো।
   অসিত টিশার্টটা অফিসে পরে যাবে বলে বের করে রেখেছিল। কিন্তু বাইরে যখন খেতে যাবে তখন পরবে মনে করে আর সেটা পরে না। অফিস থেকে সে বিকেলের মধ্যেই চলে আসে। শ্রাবণীকে ডেকে অঞ্জলী একটা ভাগলপুরী সিল্কের শাড়ি দিয়ে বলেন,
-- তুই আজকে এটা পরবি আর এটা আমার ব্লাউজ। দেখতো গায়ে দিয়ে। আমার একসময় তোর মতই স্বাস্থ্য ছিল। আশাকরি তোর হয়ে যাবে। এখন থেকে মাঝে মধ্যে একটু শাড়ি পরার অভ্যাস করতে হবে। কিছু ব্লাউজ বানিয়ে নিবি।
-- মা, আমি তো শাড়ি পরে হাঁটতেই পারি না। হাসপাতালে অনেক উঁচু করে শাড়ি পরি। সবাই হাসাহাসি করে তা দেখে।
-- আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।
 অঞ্জলী শাড়ি,ব্লাউজ,সায়া দিয়ে মেয়েকে বললেন,
-- যা রেডি হয়ে নে। আজ আর কেউ টিফিন করবো না।অসিতও চা খেয়ে উপরে চলে গেছে। সেও বললো 'কিছু খাবে না' -।
 শ্রাবণী মায়ের দেওয়া জিনিসগুলি নিয়ে উপরে চলে গেলো। যখন সে প্রস্তুত হয়ে নিচুতে এলো অন্য তিনজন তার দিকেই তাকিয়ে। অঞ্জলী বললেন,
-- শাড়ি পরে তোকে পুরো লক্ষী প্রতিমার মত লাগছে।
-- কী যে বলো না মা
-- তোর মা ঠিক কথাই বলেছেন রে কুহু। সত্যিই তোকে দেখতে লক্ষী প্রতিমার মতই লাগছে।
 কথাটা বলেই তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখেন সে একদৃষ্টিতে শ্রাবণীর দিকেই তাকিয়ে আছে। বাবার কথা তার কানেও গেলো না। অরুণাভ ছেলের কাঁধটা ধরে বললেন,
-- চল এবার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো
 সম্বিৎ ফিরে অসিত গাড়ির চাবিটা নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। ওর মনেহল বাবা সবটাই যেন টের পেয়ে গেছেন। অঞ্জলী ও অরুণাভ গাড়ির পিছন সিটে বসে পড়লেন। শ্রাবণীও পিছনে উঠতে গেলো। কিন্তু অরুণাভ ওকে বললেন,
-- ওরে মা তুই সামনে বোস। পিছনে গাদাগাদি করে যাওয়ার কোন মানে হয় না। 
-- না আমি সামনে বসবো না বাবা। তুমি এসে সামনে বসো! আমি আর মা পিছনে বসছি।
-- এই বুড়ো ছেলেটাকে আবার নামাবি? ঠিক আছে এখন বোস আসবার সময় আমি সামনেই বসবো।
  কিন্তু শ্রাবণী সামনে বসার পর অসিত যখন তাকে সিট বেল্টটা বাঁধতে বললো শ্রাবণী পড়লো অস্বস্তিতে। প্রথমে সে বেলটটাকে অনেক টেনেও সামনে আনতে পারলো না। অসিত তাকে সাহায্য করলো। তারপর সেতো সেটা লাগাতেই পারে না। পিছন থেকে অরুণাভ বিষয়টা লক্ষ্য করে বললেন
-- অসিত গাড়িটা একটু সাইড করে বেল্টটা ঠিক করে লাগিয়ে দে।
 বাবার বলতে দেরি হল তো অসিতের গাড়ি সাইড করতে এক সেকেন্ডও সময় লাগলো না। নিজের সিটবেল্টটা খুলে শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে আসলো। প্রথমেই সে শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলো। শ্রাবণী মুখটা সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরিয়ে নিলো। শ্রাবণীর সিটবেল্টটা লাগিয়ে নিজেরটা ঠিক করে আবার গাড়িতে স্টার্ট দিলো।
 অসিত মনেমনে বেশ খুশিই হল। যাক বাবা ব্যাপারটা বুঝেই এটা ম্যানেজ করলেন বোধহয়।  অসিত গাড়ি চালাতে চালাতে বারবার আড়চোখে শ্রাবণীকে দেখছে। অসিতের এই আড়চোখে দেখাটাই শ্রাবনীকে অস্বস্তিতে ফেলছে বারবার। নানানভাবে অসিতকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও সে বারবার হেরে যাচ্ছে। আর এখন তো বাবাও মনেহচ্ছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। তাই ছেলের হয়ে কিছু কাজ তিনিও করছেন। কিন্তু শ্রাবণী কিছুতেই অসিতকে মেনে নিতে পারছে না।
   গাড়ি এসে একটি বড় হোটেলের সামনে থামলো। কিন্তু আবার সেই সমস্যা। টানাটানি করেও শ্রাবণী বেল্ট খুলতে অপারগ হয়। অসিত এবারও ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি নিয়ে শ্রাবণীর গা ঘেঁষে বেল্ট খুলে দিয়ে খুব আস্তে করে বলে,
-- এবার তো এগুলো শিখে নিতে হবে আস্তে আস্তে।
-- এগুলো আমার জীবনে কোন কাজে আসবে না। তাই শিখেও কোন লাভ নেই।
-- কে বললো কাজে আসবে না? সব কাজে আসবে। 
 শ্রাবণী কোন উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলো বাবা,মাকে jঅনুসরণ করে।
 অসিত গাড়ি পার্ক করে সকলের সাথে গিয়ে বসলো। অরুণাভ এবং অঞ্জলী তখন দু'জনেই বেসিনের কাছে হাত ধুতে গেছেন। এই ফাঁকে অসিত শ্রাবণীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
-- তোমায় আজ খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। আচ্ছা আমি যে তোমার দেওয়া টিশার্টটা পরেছি কেমন লাগছে বললে না তো?
-- আচ্ছা আপনি এত কথা আমার সাথে কেন বলেন? আর আপনার এই কথাগুলোর উত্তর আমার দিতেও ইচ্ছা করে না।
 -- আগে বলো তুমি কেন আমার সাথে এরকম ব্যবহার করো?
-- সত্যিটা জানলে আপনার ভালো লাগবে না।
-- কী সত্যি? ভালো না লাগলেও শুনতে চাই। বলো কী সেই সত্যি?

ক্রমশ
    

Thursday, March 16, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৩৮ পর্ব)

শ্রাবণী তার ঘরে আর যায় না। সে নিচুতেই বাবা,মা আর লতিকামাসীর সাথে গল্প করে সময় কাটাচ্ছে। আগে পড়াশুনার জন্য অধিকাংশ সময় সে উপরেই থাকতো। কিন্তু এখন সে পাঠ চুকেছে। তাই যখন তখন উপরে ওঠারও তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আর সে ভালোভাবেই জানে উপরে গেলেই অসিতের মুখোমুখি তাকে হতে হবে। 

  আজ রাতে বাড়িতে বিশাল খাওয়ার আয়োজন। যেন ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে ; হোক না সে
 দু'একদিনের জন্য। অসিত খেতে বসেই বললো,
-- বাব্বা! এই একমাস বাড়িতে না থাকার জন্য একমাসের খাবার এক বেলাতেই খাইয়ে দেবে নাকি তোমাদের মেয়েকে?
-- কেন তোর হিংসা হচ্ছে নাকি?
অঞ্জলী হাসতে হাসতে বলেন।
-- না,না হিংসা হবে কেন? তোমাদের মেয়ের অনারে আমার কপালেও ভালো খাবার জুটলো।
 অরুণাভ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- এটা তুই ঠিক বললি না খোকা। তোর মা কিন্তু রান্নার ব্যাপারে কখনো কঞ্জুসি করে না। যে যা পছন্দ করে তোর মা কিন্তু রোজই তাই কিছু না কিছু করার চেষ্টা করে। লতিকা রান্না করে বেশিরভাগটাই ঠিকই কিন্তু তোর মা কিন্তু রান্নাঘরেই থাকে।
-- বাবা ,মায়ের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তুমি সেই আগের মতই ফোঁস করে ওঠো।
 অরুণাভ হাসতে হাসতে বললেন,
-- সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? একেই বলে দাম্পত্য। শিখে রাখ তোরও ভবিষ্যতে কাজে আসবে।
 অসিত আড়চোখে শ্রাবণীর দিকে একটু তাকালো। অরুণাভর তা চোখ এড়ালো না। কিন্তু শ্রাবণী চুপচাপ।


 রাতে খাওয়ার পর শ্রাবণী যখন উপরে ওঠে তখন অনেকটাই রাত হয়ে গেছে। শ্রাবণী ভালোভাবেই জানে সে উপরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অসিত তার কাছে আসবে। তার ধারণা যে ভুল না সে তার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রমাণ পেলো। আজ শ্রাবণী ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেনি। কারণটা হল অসিত এই ঘরে আসলে ওর জিনিসটা ওকে দিতে হবে।
-- ভিতরে আসতে পারি?
 অসিতের কথা শুনে শ্রাবণী আজ আর বাঁকাভাবে উত্তর না দিয়ে বললো,
-- হ্যাঁ আসুন।
-- কী সৌভাগ্য আমার! আজ সূর্য্য কোন দিক থেকে উঠেছে ভাবতে হচ্ছে।
 অসিত ঢোকার সাথে সাথেই শ্রাবণী বললো,
--- না,আসলে আপনার সাথে আমার একটু দরকার আছে।
-- তোমার দরকার? তাও আবার আমার কাছে? কিন্তু তার আগে আমার একটা কথার উত্তর দাও তো?
-- বলুন কী জানতে চান?
-- এই যে তুমি মাইনে পেয়ে বাড়ির প্রতিটা লোকের জন্য কিছু না কিছু কিনে এনেছো। তোমার কি একবারও মনে হয়নি আমিও এই বাড়ির সদস্য। আমার জন্যও কিছু আনতে কি তোমার মন সায় দেয়নি? এত অপরাধ করে ফেলেছি আমি?
-- আর কিছু?
-- হ্যাঁ বলছি - আমি নাহয় খুব খারাপ মানুষ! কিন্তু তুমি তো খুব ভালো মেয়ে --
-- কে বললো আপনাকে এ কথা?
-- কে আবার বলবে? আমি তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। 
-- কী দেখতে পাচ্ছেন?
-- সে থাক কী দেখতে পাচ্ছি তা বলে কোন লাভ নেই। কিন্তু তুমি কী করে পারলে আমার জন্য কিছু না এনে?
-- কী করে ভাবলেন আমি এত অকৃতজ্ঞ? আপনার বাবার দয়ায় আজ এখানে পৌঁছেছি --
-- আবার শুরু হল। ভেবেছিলাম আজ মনেহয় শুধু ভালো ভালো কথাই বলবে। আচ্ছা আমায় বলো তো তোমার এই 'দয়া,আশ্রিতা' - এই কথাগুলো আমি কী করলে তুমি বন্ধ করবে?
-- আমাকে অকৃতজ্ঞ হতে বলছেন?
-- বারবার এই কথাগুলো বললেই কী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়? শুধু তো এই কথাগুলো আমাকেই বলো।কই বাবা,মাকে তো কখনো বলতে শুনিনি।
-- আপনার সাথে দয়া করে বাবা,মার তুলনা টেনে আনবেন না।
-- তারমানে বাবা,মা খুব ভালো আর আমি তোমার কাছে খুব খারাপ?
-- সে কথা আমি তো বলিনি। আপনাকে খারাপ কখন বললাম? বাবা,মা আমাকে প্রথম থেকে যেভাবে বুকে টেনে নিয়েছেন আর আপনি প্রথম থেকেই আমার এই বাড়িতে থাকা নিয়ে বিরোধিতা করে গেছেন।
-- বাবা,মা প্রথমেই বুকে টেনে নিয়েছেন -
 ঠোঁটের কোণায় একটু মুচকি হাসি রেখে অসিত শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- কিন্তু আমি তো প্রথম দিকে না হলেও তারপর অনেকবার বুকে টানতে চেয়েছি। তুমিই তো ধরা দিতে চাও না।
 শ্রাবণী অসিতের কথা শুনে একটু থমকে গেলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্যাকেটটা  অসিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-- না, আমি এতটা খারাপ নই। আমি আপনার জন্যও কিছু এনেছি। তবে আমি হয়ত আপনার মত অত দামী জিনিস কিনতে পারিনি আমার ক্ষমতা অনুযায়ী এনেছি। পছন্দ হলে পরবেন।
-- আর পছন্দ না হলে ?
-- কাউকে দিয়ে দেবেন।
-- তুমি যতটা খারাপ আমাকে ভাবো ততটা খারাপ আমি নই। আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি আমার জন্য কিছু কিনে এনেছো। সকলের কথা জেনে আমার জন্য কিছু আনোনি দেখে প্রথমে রাগ হয়েছিল। কিন্তু পরে সেই রাগ কষ্ট আর অভিমানে পরিণত হয়েছিল। আর জানো তো অভিমান হয় সেই মানুষটার প্রতি যার প্রতি থাকে ভালোবাসা। 
 অসিত প্যাকেট খুলে টিশার্টটা দেখে বলে,
-- তোমার পছন্দ আছে! আগের জামাটাও আমার খুব পছন্দ হয়েছে। অফিসের সবাই বলেছে জামাটা নাকি আমায় খুব মানিয়েছে। 
 তারপর বাচ্চাদের মত বলে,
-- আমি কালই এটা পরবো। আচ্ছা শ্রাবণী আমি যদি তোমায় কিছু গিফট করি তুমি নেবে তো?
-- আবার তো সেই পুরোনো কথাই বলতে হয় আমার এই নতুন জীবনে যা কিছু পেয়েছি তা তো সবই আপনাদেরই দান। নতুন করে আমায় আর কিছু গিফট করতে হবে না।
-- যদি তাই বলো সে জীবনে আমার কোন দান নেই। ওগুলো সবই বাবা,মা দিয়েছেন তোমায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে শুধু আমার কথা বলছি।
-- না, আমি আর কিছু চাই না কারও কাছ থেকে। মা এখন ভালো আছেন। আমিও এখান থেকে চলে গেছি। আপনিও আমাকে দিনরাত দেখার থেকে মুক্তি পেয়েছেন -- তাই
 অসিত একটু জোরেই বলে উঠলো,
-- তুমি কিছুতেই আমায় ক্ষমা করতে পাচ্ছো না এখনো? ভুলতে পারছো না আমার বলা কথাগুলো? কিন্তু আমি জানি একদিন তুমি আমায় ঠিক চিনতে পারবে। বুঝতে পারবে আমার ভালোবাসা। 
একটু চুপ থেকে পুণরায় বলে,
অনেক রাত হল এবার শুয়ে পরও। আমি যাই। আর হ্যাঁ
 প্যাকেটটা দেখিয়ে বললো,
-- এটার জন্য থ্যাংকস -

ক্রমশ 

   

Wednesday, March 15, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৩৭ পর্ব)

পরদিন অসিত অফিস চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী ব্রেকফাস্ট টেবিলে মাকে বললো,
-- মা, আমি একটু বেরোব
-- কোথায় যাবি?
-- কাজটা সেরে এসে বলবো।
-- একাই যাবি? নাকি আমরা কেউ সাথে যাবো?
-- মা,তোমার কুহু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। সে এখন চাকরি করে। একাই যাবো মা।
-- তাহলে ড্রাইভারকে বলে দিই গাড়ি নিয়ে যা
 --  না,না গাড়ি লাগবে না। আমি বাসেই চলে যাবো।
 অঞ্জলীর অনেক জোরাজুরিতেও শ্রাবণী গাড়ি নেয় না।কারণ তার মনের মধ্যে অন্য কোন প্লান ছিলো। 
প্রথমেই সে বাস ধরে আসলো তাদের পুরনো ভাড়াবাড়িতে। অবশ্য বাড়িতে যাওয়ার আগে সে বাবার জন্য একটা ধুতি আর একটা ফতুয়া কিনে নিলো। বাবা সব সময়ের জন্য ফতুয়া পরতেন। ভেবেছিল বাবার সাথে একবার শেষ দেখা করে আসবে। হাতে কিছু টাকাও দিয়ে আসবে। কিন্তু যে বাড়িতে ওরা থাকতো সে ঘরে এসে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। পাশের ভাড়াটিয়ার কাছে জানতে পারে 'এই ঘরে একজন বয়স্ক লোক থাকতেন শুনেছি তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ছিলো। কিন্তু বছর খানেক আগে তিনি মারা গেছেন। ঘরের ভিতরেই মরে পরে ছিলেন। দুদিন পর দুর্গন্ধে অন্য ভাড়াটিয়ারা পুলিশে খবর দেয়। শুনেছি ভদ্রলেকের স্ত্রী মারা গেলে তার মেয়ে পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করে ওইদিনই অন্য একটি ছেলের সাথে চলে যায় বাড়ি আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে এই ঘরটি তালাবন্ধ থাকে। যেহেতু তিনি ঘরের মধ্যে মরে পড়ে ছিলেন সেইহেতু কেউ ভাড়া নিতে সাহস পায় না' 
  শ্রাবণীর চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। সামনে থাকা মহিলা যাতে দেখতে না পান তারাতারি সে পিছন ফিরে চোখের জল মুছে নিলো। হাতে ধরা বাবার জন্য আনা তার রোজগারের টাকায় কেনা ধুতি,ফতুয়ার প্যাকেটটা নিতেই ভুলে যাচ্ছিল। ভদ্রমহিলা ডেকে তাকে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিলে সে ওখান থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে হাঁটতে শুরু করে বাস ধরবার জন্য। একজন বৃদ্ধকে রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখে তার হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-- আপনি এটা রাখুন। 
 চোখের জল মুছে দ্রুত পায়ে বাসে উঠে পড়ে। হাতে সময় খুব কম। কাল বাদে পরশুই চলে যেতে হবে কর্মস্থলে। মনটা মোটেই ভালো নেই আজ। কিন্তু তবুও বাস থেকে নেমে শ্রাবণী এগিয়ে চললো অঞ্জলীর সাথে আসা সেই শপিংমলে। সেখানে ঢুকে নিজের পছন্দ মত বাবা,মা এমনকি অসিতের জন্যও কিছু কেনাকাটা করলো। এসব করতে তার প্রায় তিনটে বেজে গেছিলো। অঞ্জলী দু'বার ফোন করেছেন। দু'বারই সে বলেছে তাদের খেয়ে নিতে আসতে দেরি হবে। অরুণাভ খেয়ে নিলেও অঞ্জলী না খেয়েই বসে ছিলেন। বেশ কয়েকটি প্যাকেট নিয়ে শ্রাবণী যখন বাড়ি ঢোকে তখন প্রায় পৌনে চারটে। মা না খেয়ে আছেন শুনেই সে কোনরকমে ফ্রেস হয়েই খেতে বসে যায়।
-- কতবার তোমাকে বললাম খেয়ে নিতে আর তুমি না খেয়েই বসে আছো?
-- কিভাবে খেয়ে নিই বলতো। সেই ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়েছিস। আমি তো জানি তুই বাইরে কিছুই খাবি না। খিদে তো তোর পেয়েছে। আর আমি ঘরে থেকে খেয়ে নেবো? 
 শ্রাবণীর মনটা এমনিতেই খারাপ ছিল। মায়ের এই কথা শুনে তার চোখের থেকে আনন্দে জল পড়তে লাগলো।
-- বোকা মেয়ে! একথা শুনে কেউ কাঁদে?
 শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
-- আমি ভাগ্য করে তোমার মত মা পেয়েছি।
-- আমিও কী কম ভাগ্য করেছি। ভাগ্যে না থাকলে তোর মত মেয়ে পেতাম?

 খাওয়া দাওয়ার পরেই শ্রাবণী তার কিনে আনা জিনিসগুলো বের করে বাবা,মা,লতিকামাসী, মালী, কাজের মেয়েটি সকলের হাতে হাতে জিনিসগুলি ধরিয়ে দিতে থাকে।
-- তুই এ কী করেছিস? মাইনের টাকা সব খরচ করে এসেছিস?
 মাইনের টাকা দিয়ে আমি আর কী করবো মা? তোমরাই তো ছ'মাসের হোস্টেল খরচ,খাওয়া খরচ সব দিয়ে এসেছো। আমার জীবনের প্রথম রোজগার। তোমাদের সকলকে কিছু দিতে না পারলে আমার ভালো লাগবে? তোমাদের পছন্দ হয়েছে কিনা বলো?
 -- খুব খুব পছন্দ হয়েছে। পছন্দের থেকেও ভালো লেগেছে তুই নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে এসব করেছিস বলে। আসলে কী জানিস মা বাবা,মায়ের যতই থাকুক না কেন সন্তান যদি হাতে করে কিছু এনে দেয় সেটাই বেশি আনন্দ দেয়।
 কথাগুলো বলে অরুণাভ চশমাটা খুলে চোখ মোছেন।
-- এ কী বাবা? তুমি কাদঁছো কেন?
-- আনন্দে মা আনন্দে! আচ্ছা একটা কথা বলি বাড়ির সকলের জন্যই তো কিছু না কিছু এনেছিস? অসিতের জন্য কিছু আনিসনি?
 সোফায় রাখা প্যাকেটটা এনে বাবার হাতে দিয়ে শ্রাবণী বললো,
-- এই তো এনেছি তো - দেখো তো পছন্দ হবে কিনা?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ তুই এনেছিস তা আবার ওর পছন্দ হবে না ?
 নিজের কথা বলার ধরণে নিজেই লজ্জা পেলেন বোধহয়! তাই কথাটা ঘুরিয়ে বললেন,
-- কী অঞ্জু তোমার ছেলের পছন্দ হবে তো?
-- হ্যাঁ পছন্দ হবে। আর ওকে এই রংটা মানাবেও ভালো।
-- মা, তুমি এটা রেখে দাও। তুমি হাতে করে দিও।
-- সে কী? কিনে আনলি তুই আর দেবো আমি? না, না তুইই দিস। এখন তো আর অতু তোর সাথে আগের মত ঝগড়া করে না। তুই হাতে করে দিলে বরং ও বেশি খুশি হবে।
 অঞ্জলীর কথা শুনে শ্রাবণী আর অরুণাভ দু'জন দু'জনের দিকে তাকিয়ে পড়লেন। অঞ্জলীর এই কথাতে অরুণাভ যেন আরও কিছুটা সিওর হলেন। অঞ্জলীর সব মনে পড়ে গেছে।তবে এখনো পুরোটা সিওর তিনি হতে পারেননি।

  শ্রাবণী এবার উপরে চলে যাচ্ছে দেখে অঞ্জলী তাকে ডেকে বললেন,
-- ওরে অতুর প্যাকেটটা উপরে নিয়ে যা। আবার কখন নিচুতে আসবি তার তো ঠিক নেই।
-- মা আমি একটু পরেই আবার আসছি। এখানেই দিয়ে দেবো।
-- না, তুই উপরেই দিস ওকে। এই নে -
 প্যাকেটটা শ্রাবণীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। এবারেও অরুণাভ কিছুটা হোঁচট খেলেন। তিনি যেন একটু একটু করে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছেন। যতক্ষণ না অঞ্জলী নিজে মুখে বলছে শ্রাবণী ও খোকার বিয়ের কথা ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজের থেকে কিছুই বলবেন না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
 
 সন্ধ্যায় অফিস থেকে অসিত ফিরে আসলে সকলে বসে একসাথে চা খান। অঞ্জলী ও শ্রাবণী অবেলায় খাওয়ার জন্য কোন টিফিন করেন না। অসিত ও তার বাবা সামান্য টিফিন করেন। তখন অঞ্জলী অসিতের কাছে গল্প শুরু করেন শ্রাবণী বাড়ির সকলের জন্য কতকিছু কিনে এনেছে। বের করে দেখানও তার ও অরুণাভের জিনিস। অসিতের খুব রাগ হয়। বাড়ির সকলের জন্য কিনতে পেরেছে আর আমার জন্য কিছুই আনেনি। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। অদ্ভুতভাবে অঞ্জলীও ছেলেকে বলেন না যে তার জন্যও টিশার্ট কিনে এনেছে কুহু।

ক্রমশ 

Tuesday, March 14, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৩৬ পর্ব)

রাতে খাবার টেবিলেও অসিত চুপচাপ। শ্রাবণী আসার পর একবার মাত্র উপরে নিজের ঘরে গেছিলো ফ্রেস হতে।তারপর আর ওঠেনি। অসিত নিচে থেকে চা,টিফিন করে এসে কান খাড়া করে রেখেছিল যদি শ্রাবণী উপরে আসে তাহলে ওর সাথে সামনাসামনি পুণরায় কথা বলবে। কিন্তু শ্রাবণী হয়ত অসিতকে এড়িয়ে যেতে, ইচ্ছা করেই আর উপরে ওঠেনি। খাবার টেবিলেও অঞ্জলী পুণরায় ছেলের বিয়ের প্রসঙ্গ তোলেন।
-- জানিস কুহু, আমি অসিতকে সেদিন বলছিলাম এবার একটা বিয়ে করতে।
-- আহ্ মা আবার সেই এককথা
 কথাটা বলেই সে শ্রাবণীর দিকে তাকালো। শ্রাবণী কোন উত্তর দিলো না দেখে অঞ্জলী আবার বললেন,
-- কি রে কুহু তুই কী বলিস?
-- ভালোই তো হয় মা। বেশ জমিয়ে আনন্দ করা যাবে।
 অসিত করমর করে দাঁতে দাঁত দিয়ে মনে মনেই শ্রাবণীর উপর রাগ দেখাতে লাগলো। অসিত রেগে গিয়ে বললো,
-- বিয়ে দিতে হলে তোমরা তোমাদের কুহুর বিয়ে দাও। জমিয়ে আনন্দ করতে পারবে।
এবার অরুণাভ বললেন,
-- আহা রাগ করছিস কেন? আমরা তোদের দু'জনের বিয়ে এক তারিখেই দেবো।
 অসিতের বুকটা ধরাস করে উঠলো। 'বাবা এরূপ বললেন কেন? বাবা কী তার মনের খবর টের পেয়ে গেলেন।' অরুণাভ একটু টেরিয়ে ছেলের মুখটা দেখলেন। কয়েকদিন ধরেই তিনিও লক্ষ্য করছেন ছেলের মধ্যে উদাস হওয়া ভাবটি। অতীতের কথা মনে করে নিজের জীবন দিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছেন সুন্দরী, নম্ন, ভদ্র মেয়েটি মনেহচ্ছে তার ছেলের মনটা জিতে নিয়েছে। কিন্তু সিওর হতে পারছেন না। আজ সুযোগ বুঝে তিনি একটি তীর ছেড়ে দিলেন। কিন্তু একথাও তিনি জানেন যতদিন না অঞ্জলী বাস্তবটাকে মেনে নিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত চুপচাপ থাকতে হবে। অরুণাভও মাঝে মাঝে ভাবেন ডাক্তারের কথাটাই হয়ত ঠিক। অঞ্জলীর সবই মনে পড়েছে। তিনি ইচ্ছাকৃতই কাউকে কিছুই বলছেন না। সেদিন ডাক্তারবাবু অঞ্জলীর সাথে কথা বলার পর আলাদাভাবে অরুণাভকে ডেকে বলেছিলেন,
-- বুঝলেন মিস্টার দাশগুপ্ত, আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা বলছে আপনার মিসেসের সব কিছুই মনে পড়ে গেছে। আর বাস্তবটাকে তিনি মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু উনি সেটা স্বীকার করছেন না।
-- কেন বলুন তো?
-- প্রশ্নটা এখানেই। কেন স্বীকার করছেন না? হয়ত উনি ভাবছেন এটা আপনারা সবাই জানতে পারলে যে মেয়েটিকে আপনাদের মেয়ে ভেবে উনি আগলে রেখেছেন মেয়েটি হয়ত চলে যাবে কোথাও। এটা মনেহয় হারানোর ভয়! উনি একবার হারিয়েছেন আর হারাতে চান না। তাই হয়ত কাউকে কিছুই বলছেন না।

  অসিত আগেই খেয়ে উপরে চলে গেলো। শ্রাবণী অনেক রাত অবধি বাবা,মায়ের সাথে গল্প করে ইচ্ছাকৃতভাবেই দেরি করে উপরে গেলো যাতে অসিত ঘুমিয়ে পড়ে। ঘরে ঢুকেই যখন দরজাটা দিতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে অসিত এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
-- ভিতরে আসতে পারি?
-- আপনি না মাঝে মাঝে এমন ভান করেন যেন বাড়িটা আমার 
-- এই বাড়িটা তো তোমারও। কবে কী বলেছি সেটা মনে রেখে নিজের অধিকারটা ছেড়ে দিও না।
-- এই বাড়ির প্রতি আমার অধিকার? আপনাদের দয়ায় আজ আমি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। আপনাদের প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
-- এবার তো অন্তত ঘরে ঢুকি। আমার জন্য এইটুকু অধিকার দিলে আমিও তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।
 শ্রাবণী একটু পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অসিত ঘরে ঢুকে চেয়ারটায় বসতে বসতে বললো,
-- দিদি চলে যাওয়ার পর বাড়িটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেছিলো। মা টুকটাক কাজ করতেন ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ সময় হয় নিজের ঘরে শুয়ে থাকতেন নয়ত এই ঘরটাতে এসে আপনমনে দিদির সাথে কথা বলতেন। সে এক অসহনীয় দিন গেছে আমাদের উপর থেকে। কিন্তু তুমি আসার পর থেকেই বাড়ির পরিবেশটা পুরো বদলে গেলো। আস্তে আস্তে আবার ঠিক সেই আগের মত হয়ে গেলো।
-- তাই বুঝি আপনি সব সময় আমার সাথে ঝগড়া করতেন?
 অসিত একথা শুনে হেসে দিলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
-- তখন ঝগড়া করতাম।কই এখন তো একটুও ঝগড়া করি না। এখন তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি।
কথাটা বলেই সরাসরি শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে পূর্বের বলা কথাটার জের টেনে বললো,
-- আচ্ছা এই যে আমি এতবার করে তোমায় ভালোবাসি কথাটা বলি এই কথাটা শুনেও তোমার আমার প্রতি কোন ফিলিংস আসে না।
 -- আমি এসব ভালোবাসা টাসা বিশ্বাস করি না। আমার জীবনের উপর থেকে যে ঝড় বয়ে গেছে তা নিয়েই একটা উপন্যাস লেখা যায়। সারাজীবন এক ছাদের তলায় থেকেও মানুষের প্রতি মানুষের কোন ভালোবাসা জন্মায় না। জৈবিক চাহিদার কারণে মানুষ মানুষের কাছে আছে, সন্তান জন্ম দেয় কিন্তু তবুও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় না। বেঁচে থাকা এবং বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলা। আর এটাই হল সংসার।
-- জীবন সম্পর্কে তোমার ধারণা এতটা খারাপ? তুমি যেটুকু দেখেছো সে টুকুই সব নয়। এর বাইরেও কিছু আছে। আমি আমার বাবা,মাকে দেখে বুঝেছি জীবনে ভালো থাকতে গেলে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর ভালোবাসার কোন বিকল্প নেই। আমার মায়ের অসুস্থতার সময়ে আমার বাবা যা করেছেন একজন পুরুষ হয়ে তা তোমার ধারণার বাইরে।
-- আচ্ছা আমরা এসব আলোচনা করছি কেন? অনেক রাত হল আপনি এবার আসুন।
-- তাড়িয়ে দিচ্ছ?
-- ছি ছি আপনাদের বাড়ি। এটা দিদির ঘর। আমি কিভাবে আপনাকে তাড়াতে পারি? অনেক রাত হয়েছে তাই শুতে যেতে বললাম।
-- আমার প্রশ্নের কোন উত্তর পাবো না?
-- সব প্রশ্নেরই তো উত্তর দিয়েছি। আর যে টার উত্তর দিতে পারিনি তার উত্তর আমার কাছে নেই।
--- তোমার উত্তরের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবো। আর আমি জানি যেদিন তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে সেটা পজেটিভই হবে।

ক্রমশ

Monday, March 13, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৩৫ পর্ব )

অপর প্রান্ত থেকেও ' হ্যালো ' বলে শুরু করেই শ্রাবণী বলে,
-- আমি শ্রাবণী বলছি - মা, বাবা কেমন আছেন?
-- ভালো আছেন। শুধু বাবা,মায়ের খবরটাই জানতে চাইলে আমি কেমন আছি জানার কোন ইচ্ছে নেই তোমার?
-- না, আসলে কাল রাতে আপনার এতগুলো মিসড কল দেখে ভাবলাম ওদের কিছু হয়েছে কিনা। আচ্ছা ঠিক আছে রাখি -
-- না,রাখবে না - আমি কথা বলবো -
-- বলুন কী বলতে চান।
 শ্রাবণী মনেমনে ভাবে লোকটা পূর্বে যত খারাপ ব্যবহার করেছে তার দ্বিগুণ সে ফেরৎ পেয়েছে তার কাছ থেকে। শত হোক তার বাবা,মায়ের জন্যই আজ সে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আর এটাও সত্যি অসিত তাকে এখন ভালোবাসে। সে বাসে না সেটা অন্য কথা। কিন্তু এত দুর থেকে আর দুর্ব্যবহার করা ঠিক হবে না।
-- কাল এতবার ফোন করলাম ধরলে না কেন?
-- নাইট ডিউটি ছিল আই সি ইউ তে। ফোন এখানে অ্যালাউ না।
-- আমাকে নিয়ে তুমি কিছু ভাবলে?
-- কী ব্যাপারে বলুন তো?
-- বুঝেও না বোঝার ভান কোরো না। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। তুমি জানো আমি তোমায় ভালোবাসি। এইভাবে আমাকে আর কষ্ট দিও না।
-- আসলে কী বলুন তো? এটা আমি কোনদিনও ভুলতে পারবো না আমি আপনাদের আশ্রিতা। আমি জানি এই কথাটা আপনাকে আমি বহুবার বলেছি। আপনার বাবা,মা কবে যে আমার বাবা,মায়ের জায়গাটা নিয়ে ফেলেছেন সেটা বলতে পারবো না। প্রথম প্রথম বাবার কথামত তাদের বাবা,মা ডাকতাম। আর এখন আমি তাদের নিজের বাবা , মা'ই মনে করি। সব চেয়ে বড় কথা যেটা সেটা হল ভালোবাসাটা দুই পক্ষ থেকে আসে। আমি মানছি আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু তারমানে এই নয় আমাকেও আপনাকে ভালোবাসতে হবে। আমি আপনাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ! আমার ভালোবাসা আপনাদের সকলের প্রতিই আছে।কিন্তু আপনি যে ভালোবাসার কথা বলছেন সেটা নয়। আর এটা সম্ভব হবেও না কোনদিন।
  অসিত শ্রাবণীর এই ধীর,স্থিরভাবে কথাগুলো শুনে কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।সত্যিই তো জোর করে সব কিছু পাওয়া গেলেও ভালোবাসা পাওয়া যায় না। অসিতকে চুপ করে থাকতে দেখে শ্রাবণী বলে,
-- আপনার কথা মনেহয় শেষ হয়ে গেছে।এবার রাখি?
-- কবে আসবে তুমি বাড়ি?
-- বলতে পাচ্ছি না। দেখি কবে ছুটি পাই। 
 শ্রাবণী ফোন কেটে দেয়। কথাগুলো বলতে পেরে শ্রাবণীর বুকটা অনেকটাই হালকা হয়। সে ভালোভাবেই জানে ভালোবাসা হারানোর ব্যথা। নিলয়কে সে এখনো ভুলতে পারেনি। কিন্তু কিছু করার নেই। অসিত তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে জেনেও সে কিছুতেই অসিতকে নিলয়ের জায়গা দিতে পারবে না। নিলয়ের সাথে কোন যোগাযোগ না থাকলে কী হবে আজও সে নিলয়কেই ভালোবাসে। আর যে মা তাকে নিজের মেয়ে বলে মেনে নিয়ে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছেন অসিতের কথা মেনে নিয়ে মাকে পুণরায় অসুস্থ্য করতে পারবে না। বাবার দুর্ব্যবহারের জন্য সে বাবাকে পর্যন্ত ত্যাগ করেছে। আর যতই কৃতজ্ঞতা থাকুক না কেন অসিতের ওই দুর্ব্যবহার ভুলে সে অসিতকে ভালোবাসতে পারবে না।

শ্রাবণী ফোনটা কেটে দেওয়ার পর অসিত অনেকক্ষণ চুপ করে খাটের উপর বসে থাকে। আর মনেমনে বলতে থাকে - " ভালো তো তোমার আমাকে বাসতেই হবে। সে আজ হোক বা কাল। আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে এভাবে কুঁড়িতেই শেষ হতে দেবো না। তুমি যদি জেদী হও আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ জীবনে তুমি শুধু আমার।"

  অসিত তখন অফিসে। বিকেলের দিকে পিঠে ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে বাবা,মাকে না জানিয়ে শ্রাবণী হঠাৎ বাড়ি এসে উপস্থিত হয়। হঠাৎ করে শ্রাবণীকে দেখে আনন্দে অঞ্জলী আর অরুণাভ আত্মহারা! তখন বাড়িতে কাজের লোক বলতে শুধু লতিকা। অন্যান্যরা তখন সব যে যার বাড়িতে। শ্রাবণীকে পেয়ে সকলে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। শ্রাবণী সকলকে জড়িয়ে ধরে ধরে আদর করছে। তারা সকলে এতটাই গল্পগুজবে মেতে আছে মেইন দরজা দিতেই ভুলে গেছে। সকলে মিলে চা,জল খাবার খেতে খেতে যখন গল্প করছে ঠিক সেই সময়ে অসিত এসে ঢোকে।
-- মা,কতদিন বলেছি মেইন দরজাটা দিয়ে রাখবে দিনকাল ভালো না --
কথা শেষ হয় না ভিতরে এসে দেখে শ্রাবণী সকলের মধ্যমনি হয়ে গল্প জুড়েছে। শ্রাবণীকে দেখেই অসিতের বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-- কখন এলে ?
 অসিত কখনোই কারও সামনে শ্রাবণীর সাথে দুর্ব্যবহার ছাড়া কোন কথা সাধারণত বলেনি। আজ হঠাৎ করেই সকলের মধ্যে তাকে দেখেই মুখ ফস্কে তার কথা বেরিয়ে গেলো। শ্রাবণী উত্তর দেওয়ার আগেই অঞ্জলী বললেন,
-- এই তো একটু আগেই এসেছে। কাউকে কিছুই না জানিয়ে একা একা অত দূর থেকে চলে এসেছে। তবে ওর এই হঠাৎ আসাটা আমরা সবাই এনজয় করছি খুব। অসিত শুধু মায়ের কথাগুলি শুনলো কোন উত্তর দিলো না। উপরে ওঠার আগে একবার আড়চোখে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।
  কিছুক্ষণ পরেই ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে এলো চা,জলখাবার খেতে। শ্রাবণী তখন রান্নাঘরে লতিকামাসীর সাথে গল্প জুড়েছে। অঞ্জলীও রান্নাঘরে। শুধু অরুণাভ একা চুপচাপ বসে ফোন ঘেঁটে চলেছেন। ছেলে আসার সাথে সাথেই তিনি হাক দিলেন,
-- কই গো অসিত এসছে ওর চা দাও।
রান্নাঘর থেকেই অঞ্জলী উত্তর দিলেন,
-- আসছিইই 
 অঞ্জলীর সাথে শ্রাবণী নিজেই চা টিফিন নিয়ে এসে অসিতের সামনে রেখে আবার রান্নাঘরের দিকে যেতে উদ্যত হলে অরুণাভ বললেন
-- কোথায় চললি ? এখানে বোস।সবাই মিলে একটু সময় কাটাই। আজ মনটা বেশ ফুরফুরে আছে। মেয়েটা কতদিন পরে বাড়ি এসেছে। আমার তো আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে।
 অসিত ভাবে বাবা,মা শ্রাবণীকে কত ভালোবাসেন। একদম দিদির জায়গাটায় বসিয়েছেন। সত্যিই যদি মায়ের কোনদিনও সবকিছু মনে না পড়ে তাহলে তো মায়ের কাছে অসিত, কুহু ওরফে শ্রাবণী দুই ভাইবোন। তাহলে তো অসিতের ভালোবাসা কোনদিনও পূর্ণতা পাবে না। অসিতের বারবার মনেহয় মায়ের দিদির কথা সব মনে পড়ে গেছে। কিন্তু যেকোন কারণেই হোক মা ইচ্ছাকৃত সে কথাটা কাউকেই বলেন না। 
 অঞ্জলী, শ্রাবণী দু'জনেই এসে বসে। অসিত সেখানে শুধুই শ্রোতা আর বাকি সবাই বক্তা। অসিতের একটাই কাজ মাঝে মাঝে আড়চোখে শ্রাবণীকে দেখা।

ক্রমশ


  



  

একদিন ভালোবাসবে (৩৪ পর্ব)

প্রায় মাসখানেক হতে চললো শ্রাবণী বাড়ি থেকে গেছে। রোজই বাবা,মায়ের সাথে তার কথা হয়। কিন্তু এই এক মাসের মধ্যে সে একবারের জন্যও অসিতকে ফোন করেনি। অসিতের প্রতি মুহূর্তে মনে পড়লেও, প্রতি ক্ষণে শ্রাবণীর ফোনের অপেক্ষা করলেও নিজে ফোন করার সাহস পায়নি। রোজই রাতে খাবার টেবিলে বাবা,মা শ্রাবণীর কোন না কোন আলোচনা করবেনই। আর এটাই জন্যই সে সারাটাদিন মুখিয়ে থাকে। কিন্তু শ্রাবণীকে নিয়ে তাদের কোন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে না। শুধু চুপচাপ খেয়ে যায়। কিছুদিন ধরেই অঞ্জলী লক্ষ্য করছেন অসিত খাবার আগের মত খায় না,কথা কম বলে। ডিনার টেবিলেও চুপচাপ। একদিন খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলেন
-- হ্যাঁরে অতু কিছুদিন ধরেই তোকে একটু অন্যমনস্ক লাগছে। খাওয়াদাওয়াও ঠিকমত করছিস না; কী হয়েছে তোর?
-- কই কিছু হয়নি তো!ঠিকই তো আছি। খাচ্ছি তো।
-- না,বাবা আমার ঠিক সুবিধা মনেহচ্ছে না।
অসিত একটু মুচকি হেসে বলে,
-- মায়েরা সন্তানদের ক্ষেত্রে একটু বেশিই দেখে।
-- আচ্ছা ঠিক আছে। একটা কথা বলি শোন চাকরি তো অনেকদিন হল।এবার তোর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখি।
 অসিত খেতে খেতে প্রচণ্ড বিশুম খেলো। মা জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-- বিয়ের কথা শুনেই বিশুম খেলি?
 অরুণাভ মা,ছেলের কথা চুপচাপ শুনছিলেন। তিনি এবার হেসে পড়ে অঞ্জলীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- মেয়ে খোঁজার আগে তোমার ছেলের কাছে জানতে চাও সে মেয়ে পছন্দ করে রেখেছে কিনা?
 অসিত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- সে রকম হলে আমি নিজেই তোমাদের বলবো। এখনো সে সময় আসেনি। আচ্ছা আমার খাওয়া হয়ে গেছে আমি এবার উঠছি।
 অসিত যেন পালিয়ে গেলো। অঞ্জলীকে একটু গম্ভীর দেখে অরুণাভ বললেন,
-- কী গো তুমি আবার কী ভাবছো?
-- না তেমন কিছু না। কুহু অনেকদিন হল বাড়ি আসে না। কয়েকদিনের জন্য যদি ছুটি পেতো মেয়েটা। আজ রাতে ওকে বলবো।
 -- বলে দেখো যদি আসতে পারে।

  এই একমাসে শ্রাবণী রোজ ডিউটি করেছে। অন্যের সুবিধার জন্য তার ডিউটিও করেছে একটাই কারণে সে মাইনে পেয়ে একবার এখানে আসতে চায়। কলকাতায় এসে শপিং করে সকলকে কিছু দিতে চায়। রাতে অঞ্জলী তাকে বলার সাথে সাথেই সে বলে ওঠে,
-- হ্যাঁ মা আমি এই মাসে যাবো বাড়িতে। কয়েকদিন থাকবো তোমার কাছে। কতদিন দেখি না তোমাদের।
 অঞ্জলী ভীষণ খুশি হয়ে ফোন রেখেই পাশেই শুয়ে থাকা অরুণাভকে বলেন,
-- এই শুনছো কুহু বললো এই মাসেই ও নাকি বাড়ি আসবে।
-- কবে আসবে কিছু বললো?
-- না, তা তো জানতে চাইনি।
-- জানতে পারলে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।
-- কাল আমায় একটু মনে করিয়ে দিও।আজ আর ফোন করবো না। ওর আজ নাইট ডিউটি। তাও আবার আই সি ইউ তে।কাল জিজ্ঞাসা করবো।

  অসিত খেয়ে উপরে উঠে গিয়ে নিজের ব্যালকনিতে বসে শ্রাবণীর কথা ভাবতে থাকে। এক সময় শ্রাবণীর সাথে খুব দুর্ব্যবহার করেছে মনে পড়লেই নিজের প্রতি নিজের প্রচণ্ড রাগ হয়। কিন্তু এটাও ঠিক সে যে অনুতপ্ত সে কথাও তো বারবার তাকে জানিয়েছে।'সরি' বলেছে কতবার। হয় মেয়েটার মন বলে কিছু নেই নয়তো ওর মনে চাপা কোন কষ্ট আছে। যা ও কারো সাথেই ভাগ করতে চায় না। বারমুডার পকেট থেকে ফোনটা বের করে কন্টাকসে গিয়ে শ্রাবণীর নামটা এনে অনেকক্ষণ দোলাচলে কাটিয়ে ফোন করে। রিং হয়ে যায় শ্রাবণী ফোন ধরে না। প্রথম বারে এই ফোন না ধরাটা অসিতের খুব আত্মসম্মানে লাগে। পরে তার জীদ চেপে যায় ফোন করতেই লাগে। কিন্তু প্রতিবারই সে বিফল হয়। কষ্ট,অভিমান আর আবেগে একান্তে দু'হাতে মুখ ঢেকে সে কাঁদতে থাকে।

  এদিকে শ্রাবণীর সেদিন প্রথম আই সি ইউ এর ডিউটি। ক্রিটিকাল সব রোগীদের মাঝে সব সময়ের জন্য তদারকিতে ব্যস্ত। এখানে প্রথম ডিউটি বলে সে আজ একটু ভয়ে ভয়েই আছে। আই সি ইউ তে ফোন সব সময়ের জন্যই সাইলেন্ট মুডে রাখতে হয়। শ্রাবণীর ফোন আসা বলতে এখনকার বাবা মা আর এখানে এসে দু'একজন  বন্ধু বান্ধব যা হয়েছে। আর আজ সে ফোনটা মেট্রন ম্যামের ড্রয়ারে সাইলেন্ট করে রেখে এসেছে। আই সি ইউ এর ডিউটিতে এক সেকেন্ডও বসার উপায় নেই। প্রথম দিন এখানে ডিউটি করতে এসেই সে বুঝতে পেরেছে। কেউ নাকের নল খুলে ফেলছে, কেউ যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। এক এক জন এক এক রকম সমস্যার সৃষ্টি করে। সমানে বেড টু বেড ঘুরে বেড়াতে হয়। রাতের খাবার টুকুও খেলো গোগ্লাসে। এখানে কর্তব্যে বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেওয়া মানে একটা মানুষের জীবন শেষ হয়ে যাওয়া।
  ফোন সে আর সারারাত হাতেই নেয়নি। ভোরে ডিউটি শেষে যখন সে হোস্টেলে ফিরবে তখন ফোনটা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পরে।
  আর এদিকে সারাটা রাত অসিত একের পর এক ফোন করেই চলেছে। সারা রাত না ঘুমিয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরে। সকালে আর উঠতেই পারে না। অঞ্জলী এসে দেখেন ছেলে অকাতরে ঘুমাচ্ছে। আবার জ্বর হল কিনা ভেবে কপালে হাত দিয়ে দেখে নেন। কিন্তু অসিত এতটাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো যে মায়ের হাতের স্পর্শ টুকুও সে টের পায়নি। অঞ্জলী আর অসিতকে না ডেকে নিচুতে চলে যান। তিনি বুঝতে পারেন অসিত আজ আর অফিসে যাবে না।
  এদিকে হোস্টেলে ফিরে স্নান,খাওয়া সেরে শ্রাবণীর এক কলিগকে ফোন করা জরুরী হয়ে পড়ে। কারণ এই কলিগের সাথেই সে ডিউটি পরিবর্তন করে কলকাতা আসবে ঠিক করেছে। ফোন করতে গিয়ে দেখে অসিতের ষোলোখানা মিসড কল। শ্রাবণী মনে ভাবে মা,বাবার নিশ্চয় শরীর খারাপ করেছে সেটা জানাতেই অসিত তাকে এতবার ফোন করেছে। অসিতের নম্বরটা অসিত নিজেই ফোনে সেভ করে দিয়েছিল সেটা শ্রাবণী জানে। শ্রাবণী এটাও জানে এই ফোনটা বাবা নয় অসিতই কিনে এনেছিল। তাই তার এই ফোন নিতে এত আপত্তি ছিল। কিন্তু বাবার কথা সে ফেলতে পারেনি। তাই ফোনটা নিতে বাধ্য হয়েছিল।
  অসিত এতটাই গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল শ্রাবণীর ফাস্ট রিংয়ে তার ঘুম ভাঙ্গেনি। দ্বিতীয়বার ফোন করতেই অসিত ঘুমের ভিতর ফোনটা রিসিভ করে ' হ্যালো 'বলে।

ক্রমশ 

Sunday, March 12, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৩৩ পর্ব)

সৌম্যর বাবা,মায়ের সাথে রাতে খেতে বসে দীপিকা কোন কথা বলে না।চুপচাপ সামান্য খাবার নিয়ে মুখে দিতেই হঠাৎ মুখ চেপে ওয়াসরুমে ঢুকে যায়। সৌম্য এবং তার বাবা ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও সৌম্যর মা বুঝতে পারেন মেয়েটি প্রেগন্যান্ট। তখন তার মাথায় হাত! সৌম্যর থেকে বয়সে অনেক ছোট হলেও হিজিবিজি চিন্তায় মা ছেলেকেই সন্দেহ করে বসেন। ওয়াসরুম থেকে দীপিকা বেরোলে তিনি তাকে বলেন,
-- তোমাকে এসব কিছু খেতে হবে না।ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসো। আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি। বাপ,ছেলে দু'জনের কেউই মাথামুন্ডু কিছু না বুঝে চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলেন।
 সকলের খাওয়া শেষে সৌম্যর মা বিপাশা একগ্লাস দুধ নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলেন দীপিকা চোখ বন্ধ করে আছে আর তার চোখ থেকে সমানে জল পড়ে যাচ্ছে। পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-- এবার আমায় সব খুলে বলো। তার আগে তুমি এই দুধটুকু খেয়ে নাও।
 দীপিকা গ্লাসটা হাতে ধরে সামান্য দুধ খেয়ে বললো,
-- আর খাবো না।বমি হয়ে যাবে।
 আবার বিপাশা সস্নেহে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
-- এ সময় অনেকের বমি হয়
-- আপনি কী করে বুঝলেন?
-- আমিও তো একজন মা। বুঝবো না ? এবার আমাকে আস্তে আস্তে সব বলো। আগে বলো তোমার নামটা কী?
-- দীপিকা।দীপিকা মুখার্জী। আমার বাবা একজন উকিল। আমার এক দাদা আছে। সে চাকরি নিয়ে বর্তমানে দেশের বাইরে। হঠাৎ করেই চাকরি পেয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে।আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিলো। তাকে আমি ভালবাসতাম। যেহেতু বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাই মেলামেশায় আমাদের কোন বাঁধা ছিল না। এইভাবেই আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ি। কিন্তু আমি যাকে ভালোবাসি সেই ছেলেটি অর্থাৎ সুজয় এই বাচ্চা আমায় রাখতে দেবে না। এখনো বিয়ের বেশ কয়েকমাস বাকি। এই বাচ্চা রাখলে নাকি তার পরিবার সকলের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। 
-- বোঝো কান্ড! ছেলেটি কী করে?
-- ইঞ্জিনিয়ার। সবে চাকরি পেয়েছে। বাবা,মাকে আমি একথা বলতে পারিনি। কারণ আমি ভালোবাসি বলেই বাবা,মা বিয়েতে মত দিয়েছিলেন। এখন কী করে একথা তাদের জানাবো?
-- তাহলে কী করবে এখন?
-- আমি যদি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকি আমার সন্তানও বাঁচবে। আর আমি ম*রে গেলে সে তো আমার সাথেই চলে যাবে। তাই গাড়ির সামনে ম*রতেই গেছিলাম। আমি বেঁচে থাকলে আমার সন্তানও বেঁচে থাকবে। কারণ সারা জীবন ধরে এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না যে আমি আমার সন্তানকে মে*রে ফেলেছি। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি।
-- কিন্তু এখন কী করবে?
-- জানিনা। আপনারা যদি আমায় একটু আশ্রয় দেন বাচ্চাটা হওয়া পর্যন্ত তারপর আমি অন্য কোথাও চলে যাবো।
-- কোথায় যাবে ? কার কাছে যেতে চাও? কতদূর পড়াশুনা করেছো?
-- কোথায় যাবো জানি না। তবে আমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি।
-- ঠিক আছে। আমি দেখছি। সৌম্যর বাবাকে বলে তার অফিসে তোমার কোন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। তবে একটা কথা দাও আমাকে আর কখনো তুমি ম*রে যাওয়ার কথা মনেও আনবে না।
 দীপিকা বিপাশাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। তিনি গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-- চলো তুমি কোথায় শোবে দেখিয়ে দিই। একটা কথা সব সময় জেনো পৃথিবীতে যার কেউ নেই তার ভগবান আছেন। আর তার ইশারা ছাড়া কোন কাজ ঘটে না। তোমার সন্তান পৃথিবীতে আসবে। তার কারণ কী জানো? এইজন্যই আমার সৌম্যর সাথে তোমার দেখা হয়েছে। নিজের ছেলে বলে বলছি না আজকের যুগে এরূপ ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।কিন্তু তবুও মুহূর্তের জন্য হলেও তুমি খেতে বসে ওয়াসরুমে ঢুকলে আমার মনের মাঝে এক সন্দেহের দানা বেঁধেছিলো।

 সৌম্যর মায়ের চেষ্টায় দীপিকা তাদের অফিসের এক দায়িত্ব পেলো। কিন্তু কাজ করবে বাড়িতেই ল্যাপটপে। এটাও সৌম্যর মায়ের ইচ্ছানুসারে। কোন কাজ না করে মেয়েটা বাড়িতে খামোখা বসে থাকলে উল্টোপাল্টা চিন্তায় তার সন্তানের ক্ষতি হবে মনেকরে তিনিই এই উপায় ঠিক করেন। একথা সত্যি দীপিকার মত একটি মেয়ে নয় এরূপ অনেককেই বসিয়ে খাওয়ানোর মত ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু দীপিকার মন ভালো রাখতে এই ব্যবস্থা। কিছু মাসোহারারও ব্যবস্থা করলেন।তবে দীপিকা কখনোই সেটা নিতো না।তিনি দীপিকা যে ঘরটাতে থাকে সেই ঘরের একটি আলমারিতে রেখে দিতেন প্রতি মাসে।

 বিপাশা তাকে বহুবার বলেছেন তার বাড়ির ঠিকানা দেওয়ার কথা।তারা নিজেরা গিয়ে কথা বলবেন দীপিকাকে যেতে হবে না। কিন্তু দীপিকা রাজি হয়নি। সৌম্যর সাথে দীপিকার দেখা হয় না বললেই চলে। দীপিকা সব সময় তার নির্দিষ্ট ঘরটিতেই তার কাজ নিয়ে থাকে। সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে কোনদিন দেখা হয় আবার কোনদিন বা দেখা হয় না। কিন্তু কথা কখনোই হয় না। তার খাবারদাবার ,ডাক্তার দেখানো সবই বিপাশার আন্ডারে। সৌম্যর বাবা এই অযাচিত ঘটনায় মোটেই খুশি নন। কিন্তু দীপিকার এই অবস্থায় তিনি মুখেও কিছু বলছেন না। তবে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মেয়েটির জন্য অন্য কোথাও সে যাতে কিছু করতে পারে। যদিও তিনি তার সৌম্যকে চেনেন তবুও তার মনের ভিতরে একটা ভয় কাজ করে। তাই দীপিকার জন্য কলকাতার বাইরে ভালো কোন বন্দোবস্ত করতে পারেন কিনা তারজন্য তিনি অবিরত চেষ্টার কসুর করছেন না।তবে সবই বিপাশা,সৌম্যর অগোচরে। তিনি ভালোভাবেই জানেন তার গিন্নী বাচ্চা ডেলিভারির পর একটু বড় না হলে তাকে কিছুতেই ছাড়বেন না।

  দেখতে দেখতে দীপিকার ডেলিভারির সময় চলে আসলো। একদিন অনেক রাতে সৌম্য মায়ের সাথে নিজেই ড্রাইভ করে তাকে নিয়ে নির্দিষ্ট নার্সিংহোমে ভর্তি করলো। একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো দীপিকা। হাসপাতালের রেকর্ড বুকে পিতার জায়গায় সে সুজয়ের নামটাই রাখলো। কিন্তু ঠিকানা দিলো সৌম্যদের বাড়ির।

 বিপাশার একমাত্র সন্তান সৌম্য। কিন্তু সে কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না। তাই দীপিকার এই সন্তানকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতে শুরু করলেন।কিন্তু সৌম্যর বাবা বিমান এর মধ্যেই কলকাতার বাইরে দীপিকার জন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করে ফেললেন মোটা অঙ্কের এক ডোনেশনের মাধ্যমে। এখন মাঝে মধ্যে দিশার ইনজেকশন এবং নানান কারণে শরীর খারাপের জন্য সৌম্যকে যেতে হয় তার সাথে। কারণ বিপাশা পায়ে চোট পেয়ে বেশ কিছুদিন কাহিল হয়ে আছেন। ওই ঘরের মধ্যেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যেটুকু চলতে পারেন তাই চলছেন।

 দেখতে দেখতে বেশ কয়েকমাস কেটে গেলো। প্রসাদ এনে দিশার মুখে ভাতও হল। এবার বিমান তার মনের কথাটা বিপাশাকে জানালে তিনি বললেন,
-- তোমার যা ক্ষমতা তাতে মেয়েটিকে তার বাচ্চা সমেত এখানে রাখতে কোন অসুবিধা হত না। কিন্তু তুমি মুখে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারি মেয়েটির এখানে থাকা তোমার মোটেই পছন্দ নয়। তুমি যেমন এই পর্যন্ত ওর সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছো আমিও তোমার সিদ্বান্তকে মেনে নেবো। তবে এত ছোট বাচ্চা নিয়ে দীপিকা ওই পাহাড়ে গিয়ে একাএকা হিমসিম খাবে। তাই বলি কী বাচ্চাটা আর একটু বড় হোক। তখন নাহয় ওকে সেখানে পাঠিয়ে দিও। তুমি সেইভাবেই ওখানে কথা বলে নাও।
 বিমান তার গিন্নীর কথামত তাদের কাছে আরও কিছুটা সময় চেয়ে নিলেন। তবে একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন যে বিপাশা মেয়েটিকে অন্যত্র পাঠাতে আপত্তি করবেন না।

ক্রমশ