জীবনের প্রতি বাঁকে (কুড়ি পর্ব)
অমরেশবাবুর ছোট মেয়েটি ছেলেবেলা থেকেই একটু বিজ্ঞ টাইপের।পড়াশুনায় সে তুখোড়।ছোটবেলা থেকে সংসারের কাজকর্মেও তার জুড়ি মেলা ভার।ন্যায়,নীতি বোধ তার টনটনে।সত্যি কথা মুখের উপর বলে দিতে এক সেকেন্ডও দেরি করেনা।কেউ বলে ঠোঁট কাটা,কেউ বলে মুখরা।আর অমরেশবাবু স্বয়ং বলেন, "বিষ"।এবং এই বিষ নামেই মাঝে মধ্যে তিনি ডাকতেন।
--- বিষের মত ঝাঁঝ ওর কথায়।সত্যি কথা অনেক সময় যে বলা যায় না এটা ওকে বুঝাতেই পারলাম না কোনদিন।
পৃথিবীতে যারা সৎপথে চলে,সত্যি কথা বলে তাদের শত্রু সংখ্যা সব সময়ের জন্যই একটু বেশি হয়।উদাহরণ স্বরূপ একটি কথা বলি।একজন খুব সেজেগুজে এসে জানতে চাইলো,
--- এই আমায় কেমন লাগছে দেখতে?
তাকে খুশি করতে সকলেই এক বাক্যে বলে উঠবে,
--- ওহ্ দারুন লাগছে।
কিন্তু অমরেশবাবুর ছোটমেয়ে ছন্দা মিথ্যা কথা বলে কাউকে খুশি করতে পারে না।তার চোখে ভালো লাগলে ভালো বলবে আবার খারাপ লাগলে খারাপ বলবে।আর এই কারণেই অনেকেই তাকে ঠিক পছন্দ করেনা।কিন্তু যারা পছন্দ করে তারা তাদের সবটুকু দিয়েই তাকে ভালোবাসে।প্রতিবছর ক্লাসে প্রথম হয়ে ওঠে সেই ছোট্টবেলা থেকেই।অঙ্ক ছিল তার প্রিয় বিষয়।ক্লাসের অনেকেই ছিল অঙ্কে কাচা।তাই স্বইচ্ছায় সে টিফিন আওয়ারে সেইসব ক্লাসমেটদের নিয়ে অঙ্ক করতে বসতো।পড়াশুনার দিক থেকে যারা একটু দুর্বল তাদের বিষয়গুলি বুঝিয়ে দেওয়া,পরীক্ষার সময় নানানভাবে তাদের সাহায্য করা এগুলোতেই ছিল ছন্দার আনন্দ।ছন্দা সব সময় পড়াশুনা নিয়েই থাকতে ভালবাসত।পুজোর সময় সন্ধ্যায় ঠাকুর দেখতে বের হবে পড়ার সময় নষ্ট - তাই সে সারা দুপুর বসে সন্ধ্যার পড়াটা করে নিত।মাঝে মধ্যে বিকেলবেলায় বাড়ি থেকে অনেকটা দূরত্বে মাঠে খেলতে যেত।
শুধুমাত্র একটি পুত্র সন্তানের আশায় পরপর অনেকগুলি মেয়ে হতে থাকলে মেয়েগুলোকে এক একজনকে এক এক অদ্ভুত নামে ডাকা হত। আন্না (আর চাইনা),সমাপ্তি, ক্ষ্যান্ত, ( বন্ধ),ইতি, চাইনা (চায়না নয় কিন্তু) এরূপ আরো কত কি!
প্রতিবারই সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় শান্তিদেবী ছাড়াও বাড়ির সকলেই আশা করতেন এবারেরটা নিশ্চয়ই ছেলে হবে।কিন্তু আঁতুড়ঘরে শিশুর ক্রন্দন শুনে সকলে অধীর আগ্রহে যখন বুড়ি পিসিমার (ধাত্রী মা) কাছে জানতে চাইত বোন না ভাই?প্রতিবারই তারা নিরাশ হত আর সকলের চোখ থেকে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়তো।ছন্দার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।যে ব্লেডে নাড়ি কাটা হবে সেটি না পুড়িয়েই বুড়ি পিসিমার হাতে চলে আসে।অমরেশবাবুর বকা খেয়ে তারপর আবার সেই ব্লেড নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে ফুটিয়ে নিয়ে আসা হয়।পরপর মেয়ে হওয়ায় সকলে অসন্তুষ্ট হলেও অমরেশবাবু কিন্তু কখনোই এই কারণে মন খারাপ করতেন না।তিনি বলতেন,
--- মেয়েরা হচ্ছে ঘরের লক্ষী।মা লক্ষী সবসময়ই আমার মেয়েদের রূপ ধরে আমার ঘরে বিরাজিত।এর ফলে আমার সংসারে কত উন্নতি হচ্ছে দিনকে দিন।আমি কিন্তু খুশি।
কিন্তু তিনি খুশি হলে হবে কি?তার মা এবং তার স্ত্রী শান্তিদেবী তো খুশি নন।তারা তো বংশের প্রদীপ চান।
কোথার থেকে ধরে আনলেন এক নামকরা জ্যোতিষীকে।তিনি শান্তিদেবীর হাত দেখে বললেন,
--- এবারের সন্তান তোমার ছেলে হবে।তবে ভবিতসতে তার অগাধ সম্পত্তি থাকলেও সে যে তা ভোগ করতে পারবে এমন কোন গ্যারান্টি আমি কিন্তু দিতে পারছি না।শুধু এই একটাই বাড়ি নয়,তার বেশ কয়েকটি বাড়িও হবে।সম্পত্তি,টাকা পয়সার কারণে তার শত্রু সংখ্যাও কিন্তু কম থাকবে না।
বোঝো ঠেলা!যে সন্তান পৃথিবীতে এখনো ভূমিষ্টই হলনা তার পুরো জীবনের ঘটনা জানিয়ে গেলেন তার মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে।অমরেশবাবু গেলেন ক্ষেপে।জ্যোতিষী বা তার মাকে তো আর ভৎসনা করতে পারেন না ;কিন্তু রাগে গজগজ করতে লাগলেন।কারণ জ্যোতিষী,হাত দেখা,ভবিৎসত বলে দেওয়া এসব তিনি মোটেই বিশ্বাস করতেন না।তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন মানুষই তার ভবিতসত কারিগর।পরিশ্রম করলে তার ফল মিঠা হবেই।জীবনে কিছু অর্জন করতে গেলে লক্ষ্যটাকে ঠিক রেখে পথ যতই কণ্টকাকীর্ণ হোকনা কেন সামনে এগিয়ে চলতেই হবে।তখন নিজে এসে সফলতা জীবনে ধরা দেবে।তাই তিনি জ্যোতিষীর বলে যাওয়া কথা নিয়ে মা এবং শান্তিদেবীকে চিন্তা করতে নিষেধ করেন।
ছন্দার জন্মের পড়ে মাত্র দেড় বছর বাদে সত্যিই রায় চৌধুরী বংশের বংশধর আসে কার্তিকের মত চেহারা নিয়ে।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যে মেয়েটি মাত্র দেড় বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছে যে মাকে ছাড়া,মায়ের বুকের দুধ ছাড়া যার এক মুহুর্ত চলে না সে কিন্তু একটু একটু করে বঞ্চিত হতে লাগলো।দুজনে দুপাশ থেকে মায়ের দুধ খেত।কিন্তু অদ্ভুতভাবে দু'মাসের মধ্যে শান্তিদেবীর বা পাশের ব্রেস্টে এক মস্তবড় ফোঁড়া হয়।রঙ্গিনীবালাদেবী তার বৌমাকে বলেন,
--- ফোঁড়া হওয়া দুধটা কিন্তু তুমি ছেলেকে খাওয়াবে না।ওটা তুমি আহ্লাদীকে খাওয়াবে।( ছেলে প্রণয়ের জন্মের পর রঙ্গিনীবালাদেবী ছন্দাকে আদর করে আহ্লাদী বলে ডাকতেন।তার বক্তব্য ছিল আহ্লাদীই রায় চৌধুরী পরিবারে বংশের প্রদীপকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছে।তাই তিনি সকলের চাইতে আহ্লাদী বা ছন্দাকেই একটু বেশি ভালবাসতেন।)কিন্তু কখনোই হারানো মানিককে বঞ্চিত করে নয়।( প্রণয়ের ডাক নাম ছিল হারা।তার কারণ পাঁচ বছর বয়সে এ বাড়ির একটি ছেলের মৃত্যু হয়েছিল যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি)
রায় চৌধুরী বাড়িতে মুখে ভাত উঠে যাওয়ার কারণে গোবিন্দ মন্দির থেকে একটু পায়েস এনে প্রণয়ের মুখেভাত করা হয়।পড়ে জাকজমক করে পাঁচ বছরের জন্মদিন পালন করা হয়।এই জন্মদিনে শহর এবং গ্রাম মিলিয়ে কয়েকশ লোক নিমন্ত্রিত ছিলেন।
হারার বয়স তিন বছর।ছন্দার বয়স সাড়ে চার বছর।রাখা হল হারার জন্য একজন শিক্ষক।কিন্তু ছন্দার কথা কেউ ভাবলো না।রোজ শিক্ষক সুশান্ত পাল হারাকে পড়াতে আসেন ভাই পড়ে আর হা করে বসে চেয়ে থাকে ছন্দা।তার পড়তে খুব ইচ্ছা করে কিন্তু অতটুকু মেয়ে কাকে বলবে? কি বলবে?ভাইকে স্যারের পড়ানো শুনতে শুনতেই তার অ, আ, ক,খ মুখস্ত হয়ে গেলো।সাহসে ভর করে একদিন স্যারকে জানালো যে সে ভায়ের পড়া মুখস্ত বলতে পারে।স্যার তাকে সুযোগ দিলেন।মেয়েটির প্রচণ্ড মেরিট দেখে তিনি সেদিনই বাড়ির লোককে জানালেন ছন্দাকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার কথা। বড় দিদিরা তখন তাকে সুশান্ত স্যারের কাছেই পড়ার জন্য ঠিক করে।তখন এসব ব্যাপারে তাদের বাবু বা মা খুব একটা মাথা ঘামাতেন না।বড় মেয়েদের উপরই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন।কিন্তু অভিজ্ঞ শিক্ষক কয়েক মাসের মধ্যেই বুঝে গেলেন এ মেয়েকে যদি সরাসরি ক্লাস টু তে ভর্তি করা হয় সেখানেও সে তরতরিয়ে এগিয়ে যাবে।ঠিক হল ছেলেকে ক্লাস ওয়ানে এবং মেয়েকে ক্লাস টু তে ভর্তি করানো হবে।কিন্তু ছন্দা নিজেই বেঁকে বসলো।সে কিছুতেই ক্লাস টু তে ভর্তি হবে না।তার কারণটাও কিন্তু সে ব্যাখ্যা করে সকলে বুঝিয়ে বলছে।সবাই কেন সেটা বুঝতে পারছে না ;সেটাই ছন্দা বুঝতে পারছে না।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment