সময় কথা বলে
"দরজা খুলতেই তাকে সামনে দেখে চমকে গেলাম।কোনদিন ভাবিনি ওর সাথে আবার আমার দেখা হবে।হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোথাও ওর সন্ধান পাইনি।রাজেশের পুরো পরিবারটাই যেন রাতারাতি উদাও হয়ে গেলো।"
--- এই পায়েল, এই এইদিকে আরে তোর পিছনে --
বন্ধু কামনার ডাকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো পায়েল।অবশ্য প্রথম অবস্থায় বুঝতে পারেনি পায়েল যে কামনা ওকে ডাকছে।একটা শপিংমলে হঠাৎ করেই ওদের দেখা প্রায় ছ'বছর বাদে।পায়েলের বিয়ের সময় শেষ দেখা দু'বন্ধুর।পায়েল তাকিয়ে দেখে কামনা।দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে।কেনাকাটা যে যেটুকু করেছিলো তাই নিয়েই দুজনে বেরিয়ে পরে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
কামনা কথায় কথায় পায়েলের কাছে জানতে চায়,
--- কিংশুকের কোন খবর জানিস?
অনেকদিন পর কিংশুকের নামটা শুনে পায়েল কিছুটা সময় চুপ করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে,
--- জানতাম না।তবে বছর তিনেক আগে একবার হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেছিলো আমার বাড়িতেই।ও অবশ্য না জেনেই এসেছিল আমার বাড়ি।
--- মানে?
--- হ্যাঁ এটাই সত্যি।নিজের প্রাণ বাঁচাতে পুলিশের তাড়া খেয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল পুলিশ ইন্সপেক্টর সোমেশ সেনের বাড়িতে।
--- কি বলছিস তুই এসব?
--- হ্যাঁরে।বছর তিনেক আগে হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে আমার কলিংবেলটা বেজে ওঠে।নির্জন জায়গা।মাসখানেক আগেই ওখানে সোমেশ বদলী হয়েছে।বদলীর চাকরী।আজ এখানে তো কাল সেখানে।তখনো সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারিনি।লোক চলাচলও খুব একটা নেই কোয়ার্টারের আশেপাশে।সবই দরিদ্র শ্রেণীর লোকের বাস।সবুজে ঘেরা পুরো জায়গা।তাই জায়গাটাও আমার খুব পছন্দ হয়ে যায়।তখন সন্ধ্যা হয়হয়।কাজের মেয়ে শাকিলা রাতের রান্না করে সবে বেরিয়েছে।অনেক দূরের পথ তার বাড়ি।রাস্তাতে তখন লাইট ছিলো না।তাই বিকেলে এসে রাতের রান্না করে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে যেত।শাকিলা বেরোনোর পর সবে দরজাটা দিয়ে পিছন ঘুরেছি ;সঙ্গে সঙ্গে বেলটা বেজে উঠলো।ভাবলাম শাকিলাই আবার ফিরে এসেছে।দরজা খুললাম।একজন আমায় ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।ভয়ে আমি তখন ঠকঠক করে কাঁপছি।আমার মুখের থেকে কোন শব্দ বেরোচ্ছে না।লোকটা আমার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিজের মুখ থেকে কালো কাপড়টা সরিয়ে দিলো।তাকিয়ে দেখি কিংশুক।কিংশুক আমায় বলল,
--- আমি বুঝতে পারিনি এটা তোমার বাড়ি।আসলে এক ভদ্রমহিলাকে এখান থেকে বেরোতে দেখলাম।ভাবলাম রাতটা যদি কাটাতে পারি এখানে তাই বেল বাজালাম।
কিংশুককে দেখে আর তার কথা শুনে তার বিপদের একটা গন্ধ পেলাম।তোমাকে কি পুলিশে তারা করেছে? তুমি জানো আমার স্বামী কি চাকরি করেন?
--- আমি কিছু জানিনা আর জানার কোন আগ্রহও নেই।আমাকে এখনো কিছুদিন বাঁচতে হবে।পুরো কাজ আমার শেষ হয়নি।তোমাকে বিপদের মধ্যে ফেলার আমার কোন উদ্দেশ্য ছিল না।আসলে আমি তো বুঝতেই পারিনি এটা তোমার বাড়ি।আমি এখনি চলে যাচ্ছি।
আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।বললাম কেন পুলিশ তোমায় খুঁজছে?উত্তর দিলো না।চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকলো।ইতিমধ্যে বাইরে সোমেশের গাড়ির আওয়াজ পেলাম।দৌড়ে গিয়ে পিছনের দরজা খুলে দিয়ে বললাম,
--- আমার স্বামী আসছেন।তিনি একজন ইন্সপেক্টর।তুমি এই দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাও।কোথাও লুকিয়ে থেকে পনের কুড়ি মিনিট বাদে গেট দিয়ে বেরিয়ে যেও।কিন্তু সেই অজানা কথাটা আজও জানা হলনা।কেন করেছিলে তুমি আমার সাথে এরূপ।
করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আমাকে অন্ধকারে রেখেই কিংশুক বেরিয়ে গেলো।
কামনা সবটুকু শুনে বললো,
--- বাকিটা তাহলে আমার কাছ থেকে শোন। কিংশুকের বোনের উপর শারীরিক নির্যাতন হওয়ায় হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়।কিন্তু বাঁচানো যায়নি।মৃত্যুর আগে কিংশুককে সে জানিয়ে যায় কারা একাজ করেছে।এক হেভিওয়েট নেতার ছেলে এর ভিতর থাকায় সব বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।কিংশুক তার মা আর ভাইকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।খুন করে তিন ধর্ষকের একজনকে।তারা কিংশুকের গ্রামের বাড়ি পৌঁছে রাতের অন্ধকারে জীবন্ত দগ্ধ করে তার মা ভাইকে।পুলিশ হন্যে হয়ে কিংশুককে খুঁজতে থাকে।বাকি দুজনেরও একই ব্যবস্থা করে কিংশুক।উপর মহল থেকে চাপ আসতে থাকে কিংশুককে জীবিত অথবা মৃত ধরার জন্য।
--- তুই এত কথা জানলি কি করে?
--- আমার সাথে কিংশুকের দেখা হয়েছিলো একবার কোর্ট চত্বরেই।সব কাজ শেষ করে ও নিজেই এসে ধরা দিয়েছিল।এখন জেলে আছে।আমি ওর পক্ষের উকিল ছিলাম।যাবতজীবন কারাদণ্ড হয়েছে।মাঝে মাঝে দেখা করতে যাই ওর সাথে।এখন ও সেই আগের কিংশুক।জীবন থেকে ওর সবকিছু হারিয়ে গেছে।হয়ত কিছুদিন আগেই ছাড়া পেয়ে যাবে।একটা নূতন জীবন ওকে দেওয়ার খুব ইচ্ছা আমার।জানিনা ও রাজি হবে কিনা।তবে আমি আশাবাদী। ও যা হারিয়েছে তা আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না কিন্তু ওর জীবনটা ভালোবাসায় ভরিয়ে নূতন পথের সন্ধান দিতে পারবো এ বিশ্বাস আমি রাখি।
No comments:
Post a Comment