জীবনের প্রতি বাঁকে (সতের পর্ব)
তখনকার দিনে ন'টি মেয়ে এবং একটি মাত্র ছেলে।শিক্ষা এবং সাংসারিক কাজকর্মে প্রতিটা মেয়েই দক্ষ।অবশ্য এদের মধ্যে ফাঁকিবাজ যে ছিলনা তা কিন্তু নয়।কেউ কেউ এমন ছিল যে এক বোনের কাজ অন্য বোনের ঘাড়ে মিষ্টি কথায় চাপিয়ে দিত।তবে স্কুল এবং পড়াশুনা এগুলো কেউ করতো স্বইচ্ছায় আবার কেউ করতো মায়ের ভয়ে।শাসন যা করার তা করতেন শান্তিদেবী।অমরেশবাবু সারাটা জীবন তার প্রতিটা মেয়েকে শুধু আদর আর ভালোবাসা দিয়ে গেছেন।'মা'আর 'তুমি'বলেই তিনি তার প্রতিটা মেয়ের সাথে কথা বলতেন।প্রতিটা মেয়ের আবদার ছিল তাদের বাবুর কাছেই।
তার সপ্তম মেয়েটি তন্দ্রা ওরফে খুকু ছিল খুব সরল,সাদা।এই মেয়েটির উপর তার অন্য মেয়েরা তাদের নিজেদের কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতো।খুকুকে অমরেশবাবু ডাকতেন খুকুমা বলে।পরবর্তীতে অমরেশবাবুর সমস্ত নাতি নাতনীরাও তাকে ওই নামেই ডাকতো।মনটা ছিল তার শিশুর মত সরল।কেউ কোন কুকথা বললেও সে বুঝেও না বোঝার ভান করতো।বলতো,
--- কি লাভ অন্যের সাথে ঝগড়া করে।কতদিনই বা বাঁচবো?এড়িয়ে গেলেই তো আর ঝগড়া হবে না।
কেউ হয়ত তখন বলেছে,
--- তাই বলে ওর ওই নোংরা কথাগুলির জবাব দিবি না?
--- ওর ওই কথাগুলির জবাব দিতে গেলে আমাকেও ওই নোংরা ভাষাতেই বলতে হবে।তাহলে ওর আর আমার মধ্যে পার্থক্য কোথায় থাকবে?
এই ছিলো অমরেশবাবুর খুকুমা।বাড়ির প্রত্যেকের মুখের কথা বেরোনোর আগেই তার সে কাজ সে নিজ হাতে করে দিত।কোন অভিযোগ, কারো বিরুদ্ধে কোন নালিশ তার কোনদিনও ছিল না।অমরেশবাবু একটা কথা প্রায়ই বলতেন কেউ কখনো কোন গালিগালাজ করে 'অমুকের বাচ্চা'যদি বলে কোনদিনও সেই কথাটা তাকে ফিরিয়ে বলবে না।তাকে ভাই বলে সম্মধন করবে।তারমানে তুমি তাকে সেটাই বললে যা সে তোমায় বলেছে।অথচ কথাটা তুমি সরাসরি বললে না।আর তার এই নীতিটা একমাত্র তাঁর খুকুমা ই মেনে চলতেন।অমরেশবাবুর সমস্ত মেয়েরা পড়াশুনা করলেও তাঁর খুকুমা কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরতে পারেনি।আসলে সংসার আর সকলের যত্ন নিয়ে সে এতটাই মাথা ঘামাত যে পড়াশুনার প্রতি তার কোন টান ই সে অনুভব করতো না।বাড়ির সকলেই চেষ্টা করেছিল কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারেনি।
দিদি,বোন,ভাই সকলেই ছিল তার প্রাণ।সকলের প্রতি তার ছিল এক অসীম দরদ। কার কখন কি দরকার, কার কি অসুবিধা মুখে তাকে কিছু বলতে হত না।সে যেন এক অলৌকিক ক্ষমতাবলে সবকিছু বুঝে যেত।পরিবারের সকল সদস্যের সাথে তার যেন এক অলিখিত চুক্তি ছিলো সকলের সবকিছু মুস্কিল আসানের।
নিরীহ,অতি শান্ত সাত চড়ে কথা না বলা মানুষটির জীবনেও প্রেম এসেছিলো।এক অনুষ্ঠান বাড়িতে দেখা হওয়া কোন একটি মানুষের সাথে।চলত তার সাথে লুকিয়ে চিঠি আদানপ্রদান।বাড়ির কেউই কিছুই কোনদিন জানতে পারেনি।
বাড়ির সকলে খুকুর বিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলে দেখতে শুরু করলে সে এসব কথা জানায় সকলের ছোটবোনকে।তার ছোটবোন ছন্দা তার সেজদিকে একথা জানায়।এই সেজদি তাদের বাবুর বর্তমান এবং অবর্তমানে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।ভাই এবং বোনদের লেখাপড়া শিখিয়ে বোনদের এক এক করে বিয়ে দিতে থাকে।তার জীবনটা ঠিক যেন মালা সিংহা অভিনীত কবিতা সিনেমার মত।নিজের কোন ভালোলাগা,ইচ্ছা নেই।ভাইবোনেরাই তার জীবনের সব।তাদের আবদার,তাদের শখ সবকিছুই এই সেজদি মেটায়।অমরেশবাবুর বয়স হয়ে যাওয়ার পর তাঁর রোজগার যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন থেকেই ভারতী নিজের ইচ্ছায় পুরো সংসারের সমস্ত দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
অধিকাংশ সংসারে দেখা যায় কোন সদস্য যদি সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে তখন সেই পরিবারের বাবা, মায়েরাও কিছুটা হলে স্বার্থপর হয়ে পড়েন।একটা জীবনের বিনিময়ে অন্য জীবনগুলো যদি একটু সুখ,স্বচ্ছন্দ পায়- তারা সেদিকেই দৃষ্টিপাত করে মূল মানুষটির জীবনের কথা না ভেবে।মা না হয়েও কিভাবে সংসারে সকলের মা হয়ে উঠা যায় ভারতী তার পুরো জীবন দিয়ে রায় চৌধুরী পরিবারে তা বুঝিয়ে দিয়েছে।ছোট বোনেরা,ভাই যেমন তার সন্তানসম আবার তাদের ছেলেমেয়েরাও তার ছেলেমেয়ে।
খুকুমার সাথে কথা বলে সেই ছেলেটিকে ডেকে আনে তাদের সেজদি।ছেলেটি আসে ঠিকই কিন্তু বিয়ে করতে অস্বীকার করে।কি অদ্ভুত!একটা মেয়ের সাথে আট থেকে দশ বছরের সম্পর্ক।অথচ যখন মেয়েটির বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হল তখন ছেলেটি জানালো,
--- আমি ওকে বন্ধু মনে করতাম।ভালোবাসি কোনদিন তো বলিনি।এরকম বন্ধু আমার অনেক আছে।
নিরীহ,শান্ত স্বভাবের খুকু এরপর আর কোন কথা তার সাথে বলেনা।সে সোজা উঠে ঘরে চলে যায়।এরপর মাস ছয়েকের মধ্যে স্বল্প শিক্ষিত খুকুর জন্য তার উপযুক্ত পাত্র খুঁজে বের করে ভারতী তার বিয়ে দেয়।
খুকুর শ্বশুরবাড়িটি শরিকের বাড়ি হলে কি হবে প্রচুর জমিজমা,পুকুর মিলিয়ে সে বিশাল ব্যাপার।কিন্তু যেহেতু খুকু বেশি লেখাপড়া জানতো না তাই তাকে ঠিক সেরূপ পাত্রের হাতেই সমর্পণ করা হয়েছে।ছোটখাট একটা চাকরি করে।কিন্তু অসম্ভব ভালোবাসে তার স্ত্রী তন্দ্রাকে।বাপ,মা মরা সমরকে কে কবে গুছিয়ে খেতে দিয়েছে তা সে মনেই করতে পারেনা।বিয়ের পর খুকুর যত্ন,ভালোবাসায় সমর এক নূতন জীবন খুঁজে পায়।পরস্পর যেন পরস্পরকে চোখে হারায়।ছুটির দিনগুলোতে দুজনে এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়।
এভাবে দু'বছর কাটার পর তাদের সংসারে নূতন এক অতিথি আসে।সংসারে লক্ষীর আগমনে সংসারে শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে।মেয়েকে নিয়ে দুজনেই নূতন নুতন স্বপ্ন দেখতে থাকে।কিন্তু খুকু, সমরের জীবনে এসুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়না।মেয়ের বয়স তখন এক বছর এক মাস।এতটুকু ছোট বাচ্চাকে নিয়ে খুকু আত্মীয়ের বিয়েবাড়িতে যাবে না বলে বাপের বাড়িতে আসে তার মেয়েটিকে ছোট বোনের কাছে রেখে বিয়েবাড়িতে যাবে বলে।
মেয়ের খাবারদাবার সবকিছু ছোট বোনকে বুঝিয়ে দিয়ে সে স্নানে ঢোকে।অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও যখন সে বাথরুম থেকে বেরোচ্ছে না তখন বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করে তার ছোট বোন ছন্দা দৌড়ে গিয়ে পাড়ার ক্লাবে জানায়। সেজদি তখন অফিসে।ক্লাবে তখন খুকুর ভাই ও এক বোনপো ছিল। এ খবর শুনেই তারা ছুটে আসে সঙ্গে পাড়ার অনেক ছেলেরা।বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে খুকুকে বের করা হয়।ডাক্তার ডাকা হলে তিনি জানান 'ব্রেন স্ট্রোক'।তবুও তাকে হাসপাতাল নেওয়া হয়।
তেরো মাসে খুকু তার জীবনের সমস্ত শখ,আহ্বলাদ বিসর্জন দিয়ে একমাত্র মেয়ের কথা না ভেবে বিধাতার এক অমোঘ লিখনে সকলকে ছেড়ে পরপারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো।ছোটবোন ছন্দা তখন দিদির মেয়েকে বুকে আঁকড়ে ধরলো।তখনো খুকুকে শ্মশানে নেওয়া হয়নি।খুকুর মেয়ে খিদেয় তীব্র চিৎকারে বাড়ি মাথায় করছে।ছন্দা নিজের চোখ মুছে তার দিদির বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।দিদিকে হারিয়ে সেই মুহূর্তে ছন্দা একটু কাঁদতেও পারেনি।ছন্দার মাতৃত্বের কাছে সেদিন দিদিকে হারানোর শোকটা মৃয়মাণ হয়ে পড়েছিলো।
( পরবর্তী পর্বে জানাবো এই বাচ্চাটা কার কাছে মানুষ হয়েছে।)
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment