কোঠাবাড়ির স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো।যুগযুগ ধরে ওইভাবেই ওই একই জায়গায় ইটের স্তূপ পড়ে রইলো।সাপ,ব্যাঙের উপদ্রপের ভয়ে বাড়ির কেউই আর ওদিকটা যেত না।
একবার বাড়ির বছর মাইনের অপর একটি ছেলে নাম গোপাল নারকেল তেল ভাঙ্গানোর জন্য শুকনো নারকেল নিয়ে (নারকেল ছুলে নাকেলের টুকরোগুলোকে ছোটছোট করে কেটে রোদে শুকিয়ে মেশিনে দিয়ে তেল করা হত) ভাঙাতে গেলো।কিন্তু সে আর ফিরে এলো না চারিদিকে লোক পাঠানো হল।কিন্তু তাকে কেউ খুঁজে পেলো না।সকলেই বুঝতে পারলো গোপাল ফিরবে না বলেই ফেরেনি।সে ওগুলি চুরি করার উদ্দেশ্য নিয়েই বেরিয়েছিল।কিন্তু দিন সাতেক পরে ঠিক সন্ধ্যার দিকে গোপালের বাবা তাকে সাথে নিয়ে রায় চৌধুরী বাড়িতে হাজির।
একবার গোপালের বাবা রামকৃষ্ণ মজুমদার জমি সংক্রান্ত একটি মামলায় মারত্মকভাবে ফেঁসে যান।অমরেশবাবু ছিলেন আসামী পক্ষের উকিল।জেল ছিল নিশ্চিত।কিন্তু অনেক চেষ্টায় তিনি রামকৃষ্ণকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন।আর তারপর থেকেই এই গরীব মানুষটা অমরেশবাবুকে দেবতা জ্ঞানে মান্য করতো।গোপাল সেদিন সমস্ত জিনিসপত্র বিক্রি করে মামার বাড়িতে গা ঢাকা দিয়েছিল।মামাবাড়ির লোকেরাও জানতো না যে সে এই কুকৃত্তী করেছে।যখন রায় চৌধুরী বাড়ি থেকে গোপালদের বাড়িতে তাকে খোঁজার জন্য লোক পাঠানো হয়েছিলো তারা তখনই সবকিছু জানতে পেরেছিল।আর তারপরই তার খোঁজ মেলে তার মামাবাড়িতে।গোপালকে তার বাবা মেরে প্রায় আধমরা করে ভ্যানে বসিয়ে অমরেশবাবুর সামনে হাজির করে।অমরেশবাবু গোপালের ওই অবস্থা দেখে রামকৃষ্ণকে চরম ভর্ৎসনা করে সেই মুহূর্তে গ্রামের ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ্য করার চেষ্টায় ব্রতী হন।সেখানে উপস্থিত সকলেই অবাক!যে ছেলেটি তার বাড়ি থেকে জিনিস চুরি করে চম্পট দিয়েছিল তাকে হাতের কাছে পেয়ে তাকে শাস্তি দেওয়ার থেকে সুস্থ্য করে তোলার জন্য বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।এই হলেন অমরেশবাবু।
গোপাল তার বাবার সাথে নিজেদের বাড়িতে চলে যায়।কারণ অমরেশবাবুর ইচ্ছা থাকলেও তার স্ত্রী এবং মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি তাকে রাখতে সাহস আর পান কি করে?
অমরেশবাবু যখন থেকে রোজগার করতে শুরু করেছেন ঠিক তখন থেকেই তিনি তার শ্বশুরবাড়ির গ্রাম,এবং নিজ গ্রামের অজস্র অসহায় গরীব মানুষদের সাহায্য করেছেন যা অনেক ক্ষেত্রেই তার নিজ পরিবারও জানতে পারেনি।শুধু কেউ বিপদে পড়লে বিনা টাকায় কেস লড়াই নয় পারিবারিক সাহায্যের হাতও বাড়িতে দিতেন।তার মৃত্যুর পর সেই সব ছেলেমেয়েদের বাবা,মায়েরা হয়ত কেউ দাঁড়িয়েছে তাই মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে বা অর্থ সাহায্যের প্রয়োজনে তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন তখন তাদের মুখ থেকে বাড়ির সদস্যরা জানতে পেরেছেন।
বাড়িতে প্রচুর সবজি,ফলমূলের চাষ হত।অনেক সময় গ্রামের গরীব মানুষগুলি চেয়ে নেওয়ার পরও চুরি করেছে।তাকে সেসব কথা জানালে তিনি বলতেন,
--- যা তাদের দেওয়া হয়েছে হয়ত তাতে তাদের প্রয়োজন মেটেনি।তাই আমাদের বাগান থেকে বা মাঠ থেকে কিছু জিনিষ তুলে নিয়েছে।তোমরা এটাকে চুরি বলছো কেন?ওরা তো গরীব মানুষ।আমাদের অনেক আছে।সামান্য পরিমাণ কেউ নিয়ে নিলে আমাদের তেমন কোন ক্ষতি হবে না।অথচ ওরা আনন্দিত মনে ওগুলি খেতে পারবে।তাই ওদের কিছু বোলো না।
এহেন মানুষটা যদি একবার রেগে যেতেন তাহলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতেন। নটি মেয়ে এবং সকলের শেষে একটি মাত্র ছেলে। ছ'নম্বর মেয়েটির নাম ছিল রণিতা।অমরেশবাবু কোন গালিগালাজ পছন্দ করতেন না কোনদিনও।একবার তার দুই মেয়ে মিলে চরম ঝামেলা করতে শুরু করে নিজেদের জামাকাপড় নিয়ে।হঠাৎ রণিতা তার দিদি ইরাকে বলে বসে,
--- শয়তান একটা
অমরেশবাবুর কানে যেতেই তিনি।চেম্বার ছেড়ে ঘরে ঢুকে রণিতাকে বলেন,
--- বাজে কথা বললি কেন? দিদির কাছে ক্ষমা চেয়ে নে।
--- ও আমাকে আগে বলেছে।তারপর আমি বলেছি।
--- আমি ওকে বলতে শুনিনি।তোকে বলতে শুনেছি।ক্ষমা তোকে চাইতেই হবে।
--- ওতো আমার বড়।বেশি চালাক ।তোমার কানে যাতে না যায় সেই জন্যই ও আস্তে বলেছে।আমি তো ছোট।ওর মত অত বুদ্ধি আমার নেই।আমি বুঝতে পারিনি তোমার কানে গেলে তুমি চেম্বার ছেড়ে ঘরে আসবে।
মেয়ের যুক্তি এবং বুদ্ধির কাছে হেরে গেলেও জোর করে তাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়াতে পারেননি।কারণ রিনিতার কথাকে সমর্থন জানিয়েছিল তার আর এক দিদি।রিনিতা তাই দেখে বলেছিলো,
--- তুমি তো উকিল মানুষ সাক্ষী ছাড়া কোনকিছু বিশ্বাস করোনা ওই তো আমার পক্ষে দাদা সাক্ষী দিলো।
(একদিদিকে কেন তারা দাদা বলতো এবার সেটাই বলছি)
পরপর অনেকগুলি মেয়ে হওয়ার ফলে ভাই বা দাদা না থাকাতে ভাইফোঁটার দিনে তাদের মন খুব খারাপ থাকতো।একবার রিনিতা ভাইফোঁটার দিনে খুব কান্নাকাটি করার সময় দিদি মালতী তাকে বলেছিলো,
--- ভাই নেই বলে এত কান্নাকাটির কি আছে আমি তো তোর বড় দিদি।আজ থেকে আমায় তুই দাদা ডাকবি।আর আগামীবার ভাইফোঁটার দিনে আমায় ফোঁটা দিবি।
সেই থেকে ছোটরা সকলেই মালতীকে দাদা বলেই ডাকতো।তারপর যতদিন না তাদের ভাই হয়েছে তারা ভাইফোঁটার দিনে মালতীকেই ফোঁটা দিতো।এবং এই ব্যাপারটিকে অমরেশবাবু ভীষণভাবে সমর্থন করতেন।এই দিনে তিনি তার বোনের বাড়ি ফোঁটা আনতে গেলেও বাড়িতে ভাইফোঁটার আয়োজন করেই বেরোতেন।
খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ নিখুদ মানুষ।বাজারের সেরা জিনিসটিই তিনি কিনে আনতেন।কিন্তু নিজের এবং বাড়ির অন্য সকলের পোশাকআশাক নিয়ে তার কোন হেলদোল ছিলো না।একমাত্র পুজোর সময় পরিচিত দর্জিকে বাড়িতেই তলব করতেন।গোটা একটা ছিট-কাপড়ের থান নিজেই পছন্দ করে কিনে নিয়ে আসতেন।মেয়েরা সব উঠোনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তো।দর্জি তার বিশাল লম্বা খাতায় সকলের জামার মাপ নিয়ে লিখে নিয়ে যেতেন। জামা তৈরি হয়ে গেলে দর্জি নিজেই এসে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেতেন।পুজোর সময় সকলে একই ধাঁচের একই কাপড়ের জামা পরে ঠাকুর দেখে বেড়াতো।মাঝেমধ্যে প্রতিবেশীরা টোন করতেও ছাড়তো না।তারা অমরেশবাবুর মেয়েদের ওই একই কাপড়ের জামা পরিহিত দেখে হাসাহাসি করে বলতো,
--- রায় চৌধুরী বাড়ির ইউনিফর্ম।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে তাঁর মেয়েরা তাঁর পছন্দ করা ওই একই কাপড়ের জামা পড়তে বেশ গর্ববোধ করতো।আবার পুজো প্যান্ডেলে একজন আর একজনকে খুঁজে না পেলে গর্বের সাথে অন্যদের কাছে জানতে চাইত
--- আমার মত এই একই জামা পড়া কাউকে দেখেছেন?
পোশাকআশাকের প্রতি তাঁর যেমন কোন আগ্রহ ছিলো না ঠিক তদ্রুপ তাঁর মেয়েদেরও কোন আগ্রহ ছিলো না।প্রতিটা বোনের মধ্যে আন্তরিকতা,ভালোবাসা ছিলো ভীষণভাবে এবং যা একই ভাবে আজও তা সমানভাবে বিধ্যমান।সাজগোজ তিনি একদমই পছন্দ করতেন না।বিশেষত তার অপছন্দের তালিকায় ছিল লিপস্টিক পরা। তাঁর সমস্ত মেয়েরা সব সময় তার পছন্দ অপছন্দের ভীষণভাবে মূল্য দিত।প্রতিটা মেয়ের কাছেই ছিলো তাদের বাবুর কথায় শেষ কথা।মেয়েরা তাদের বাবুর কথাকে বেদবাক্য এ সম্মান জানাতো।মাকে তারা ভয় পেলেও
তাদের কাছে তাদের বাবুই ছিলেন বেস্ট ফ্রেন্ড।সকলের মনের কথা বলার একজন খুব কাছের বন্ধু।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment