Wednesday, November 17, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (আঠারো পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (আঠারো পর্ব)
  অমরেশবাবুর খুকুমা মাত্র সাইত্রিশ বছর বয়সে সব লেনাদেনা চুকিয়ে চিরদিনের মত চলে গেলো ঠিকই কিন্তু রেখে গেলো নাড়ি কাটা ধন।ছোটবোন ছন্দার মেয়ের বয়স তখন সাড়ে তিন বছর।তার স্বামী তাকে জানালো,
--- খুকুদির মেয়েটিকে আমরাই দত্তক নিয়ে নেবো।তুমি বাড়ির সকলের সাথে কথা বলো।কারণ ওর বাবা তো একা মানুষ।সে তো ওকে মানুষ করতে পারবে না।তাছাড়া তার বয়স কম।কবে আবার বিয়ে করবে তার কোন ঠিক নেই।আমরাই ওকে মানুষ করবো।মনে করবো আমাদের দুটো মেয়ে।
 সতেরোটা দিন দুধের শিশু তার মাকে হারানোর পর ছন্দার কাছে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।এদিকে স্বপ্নার বিয়ের আট বছর বাদেও কোন সন্তান হয় না।অনেক ডাক্তার,অপারেশন করার পরেও নিঃসন্তান অবস্থায় তাদের দিনাতিপাত।তার শ্বাশুড়ী বাইরের কোন শিশুকে দত্তক নিতে দেবেন না।আর তাছাড়া তখনকার দিনে দত্তক ব্যাপারটা সকলে তেমন জানতেন না আবার অনেকে জানলেও পছন্দ করতেন না।কিন্তু খুকুর মেয়েটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য স্বপ্নার শ্বাশুড়ী তাকে এবং তার ছেলেকে বলেন।তার কথা অনুযায়ী 
--- আমরা তো এই মেয়েটিকে দত্তক নিতেই পারি।এর বাপ,মা জন্ম-ঠিকুজি আমরা সব জানি।ছন্দার তো একটি মেয়ে আছে।তোমরা গিয়ে ছন্দাকে আর বাড়ির সকলকে বুঝিয়ে বলো।মেয়েটিকে নিয়ে এসে তোমাদের শুন্য কোল পূরণ করো।
 স্বপ্না আর তার স্বামী এসে খুকুর মেয়েকে নিয়ে যায়।পড়ে সমরের কাছ থেকে তারা মেয়েকে আইনী মারফৎ দত্তক নিয়ে নেয়।খুকুর স্বামী কিন্তু ছ'মাসের মধ্যেই আবার বিয়ে করে। স্বপ্না ও তপন তাদের এই মেয়েকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ, মায়া-মমতা দিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করেছে।সব থেকে আশ্চর্য্য কিংবা ভালোলাগার বিষয় যেটি তা হল স্বপ্নার শ্বাশুড়ী একসময় স্বপ্নার সাথে যে দুর্ব্যবহার করেছিলেন সেই তিনিই খুকুর এই মেয়েটিকে নিজ নাতনীর মত ভালোবাসতেন।তার নিজের বিয়ের গয়না যা তিনি তার একমাত্র পুত্রবধূটিকেও দেননি তা তিনি এই নাতনীর বিয়ের জন্য স্বপ্নাকে দিয়েছিলেন।মানুষের কিছু ব্যবহার দেখে যে পুরো মানুষটিকে ভালো কিংবা মন্দ হিসাবে যে বিচার করা ঠিক নয় তা স্বপ্নার শ্বাশুড়ীকে দেখেই বোঝা যায়।একটা মানুষের ভিতরে ভালো মন্দ দুটি দিকই থাকে।পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানুষের মানসিক পরিস্থিতির উপর তার ব্যবহার নির্ভর করে।
 স্বপ্না মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজেরা পছন্দ করে উপযুক্ত ছেলের হাতেই সমর্পণ করে।বর্তমানে এক কন্যা সন্তানের জননী সে।ভালো মন্দ মিশিয়ে সে খুব সুখেই আছে।আর হ্যাঁ একটা সময়ে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো যে সে স্বপ্নার বোনের মেয়ে এবং তারা তাকে দত্তক নিয়েই মানুষ করেছে।এটা জানানো হয়েছিলো এই কারণেই যেহেতু সমস্ত আত্মীয়-বন্ধুরা সমস্ত বিষয়টি জানতেন যদি কখনো অন্যের মাধ্যমে তার কানে যায় এবং সে যদি এই বিষয়ে কোন রিয়াক্ট করে তাই মাধ্যমিক দেওয়ার পরেই তাকে জানানো সকলে শ্রেয় বলে মনে করে।
  রায় চৌধুরী পরিবারে সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে যখন সবেমাত্র অমরেশবাবুর মাত্র দুটি কন্যা মানে বড় ও মেজটির বিয়ে হয়েছে তারপরেই বিয়ে হয় চৌদ্দ বছর বয়সে তার অষ্টম কন্যাটির।বিশাখা তখন নবম শ্রেণীতে পড়ে।খেলাধুলায় ভীষণ ভালো।যেখানেই যায় পুরস্কার নিয়েই ফেরে তা সে যে কোন ধরনের খেলা হোকনা কেন।যেখানেই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কথা তার কানে আসে - নাওয়া,খাওয়া,ঘুম সব বাদ দিয়ে বাড়ির লোককে অধিকাংশ সময় না জানিয়েই ছুটে চলে যায় খেলতে।বাড়ির লোক খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গিয়ে দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনা নিয়ে যখন প্রতিটা সেকেন্ড,মিনিট কাটাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে হাতে পুরস্কার নিয়ে হাসতে হাসতে সে হাজির।তাকে বাড়ির সকলে অনেক বুঝিয়েও পারেনি যে কোথাও খেলতে গেলে অন্তত বাড়ির যে কাউকে একটু বলে যায় যেন সে।এই বলে না যাওয়ার মধ্যেই সে যেন এক বিশাল আনন্দ খুঁজে পেতো।খেলা পাগল এই মেয়েটিকে নিয়ে অমরেশবাবুর চিন্তার শেষ নেই।তখনকার দিনে গ্রাম বা মফরসল শহরগুলোতে এখনকার দিনের মত খেলাধুলার এতো সুযোগ সুবিধা,এবং এই খেলার সোর্স এ চাকরির এত সুযোগ সুবিধা ছিলনা।সেভাবে কোন কোচও তখন পাওয়া যেতনা।
পড়াশুনার প্রতিও তেমন আগ্রহ ছিলোনা।শুধু সারাটা।দিন ধরে খেলা আর খেলা বিশেষত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।আর এই কারণে সারাটাদিন বাইরে থেকে সন্ধ্যায় তার ঘরে ফেরাটা কারোই ভালো লাগতো না।মন্দ মানুষ সব দেশে সব কালেই থাকে।সম্মান এবং প্রাণের আশঙ্কায় মেয়েকে নিয়ে অমরেশবাবু খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন।এমতাবস্থায় বোনকে ঘরমুখো করতে মায়ের সাথে পরামর্শ করে হঠাৎ করেই তার বিয়ে ঠিক করে ফেলে সবাই।অমরেশবাবু শুনে তো থ।
--- এটা কিছুতেই হতে পরে না।একটা বাচ্চা মেয়ের বিয়ে আমি কিছুতেই দিতে দেবো না।ও যা করছে করুক।ওর দেখভাল করার জন্য আমি একজন লোক নিয়োগ করবো।ঘরমুখো করার জন্য এই বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আমি ওর জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারবো না।তোমাদের এই সিদ্ধান্তে আমার কোন মত নেই।
 বাড়িতে বিশাখার বিয়ে নিয়ে নিত্য অশান্তি।শেষমেষ অমরেশবাবু রেগেমেগে বললেন,
--- শোনো তোমরা যদি জোর করে ওর বিয়ে দাও আমি সত্যি বলছি ওকে নিয়ে অন্য কোথাও আমি চলে যাবো।কিছুতেই আমি এ বিয়ে হতে দেবো না।অবস্থা গুরুতর বুঝতে পেরে যে ঘটক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিলো সে ছেলের বাড়ি গিয়ে সবিস্তারে সবকিছু জানালো।একদিন দুপুরের দিকে প্রায় সাত আটজনের এক দল ছেলের বাড়ি থেকে এসে হাজির।এই মেয়েকেই তারা তাদের বাড়ির বউ করতে চায় বলে অমরেশবাবুর হাতদুটি ধরে অনুনয় বিনয় করতে লাগে।তারা কথা দেয় তারা বিশাখাকে বিয়ের পর পুনরায় পড়াবে।
 অমরেশবাবু সব শুনে বলেন,
--- নারী পুরুষের সম্পর্ক বোঝার মত যে মেয়ের জ্ঞান হয়নি তাকে বিয়ে দিলে কতটা সমস্যার মধ্যে আপনাদের পড়তে হতে পারে সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান আছে আপনাদের?
--- সকল বাবা,মায়ের কাছেই চিরকাল তার সন্তান ছোটই থাকে।বাবা,মায়েরা তাদের সন্তানদের ভাবেন তারা কিছুই জানে না,কিছুই বোঝে না।আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।শুধুমাত্র বিয়েটাই মত দিন।মেয়েটিকে আমাদের খুবই পছন্দ।খুবই লক্ষীমন্ত মেয়ে আপনার। এ মেয়ে যে সংসারে যাবে সে সংসার সুখ উপচে পড়বে।
--- আপনাদের সংসারে সুখ উপচে পড়ার জন্য আমি আমার কচি মেয়েটার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবো না।আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন।
 তারাও নাছোড়বান্দা।দুপুর থেকে বিকেল,বিকেল থেকে সন্ধ্যা তারপর রাত।তাদের উঠার কোন নামই নেই।শেষমেষ হাত জোড় করে অমরেশবাবু বললেন,
--- আপনারা আমায় একটু ভাবনার সময় দিন।কয়েকটা দিন পরে আমি আপনাদের আমার মতামত জানাচ্ছি।যদি আমার মতের পরিবর্তন হয় তাহলে কিন্তু আপনাদের আমাকে দেয় কথার মর্যাদা রাখতে হবে।আমার মেয়ের পড়াশুনা কিন্তু বন্ধ করা চলবে না।

ক্রমশঃ 
  
    

No comments:

Post a Comment