জীবনের প্রতি বাঁকে (পঁচিশ পর্ব)
প্রতিটা মানুষ তার জীবনে ভাবে এক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অন্যকিছু বিধাতা আগেই ঠিক করে রেখেছেন।স্বপ্ন ভঙ্গ আর ব্যর্থতা জীবন নামক উপন্যাসের একটা পার্ট।পৃথিবীতে খুব কম মানুষ পাওয়া যাবে যারা তাদের জীবনে যা ভেবেছে তাইই ঘটেছে বা তারা তাই পেয়েছে।জীবনে প্রতিটা মুহূর্তেই পথটা থাকে কন্টকাকীর্ণ।সেই কণ্টকাকীর্ণ পথে হাঁটতে সবাই পারে না।অধিকাংশই পিছলে যায়।জীবনে কোন কোন সময় আসে তখন একটা ভুল সিদ্ধান্তই পুরো জীবনের চালচিত্র পাল্টে দেয়।আবার অনেকের স্বপ্ন ভাঙ্গে পরিবার বা পার্টিকুলালি কোন একটা মানুষের ভবিৎসতের কথা ভেবে।অমরেশবাবুর অসুস্থ্যতা এবং অবর্তমানে তার পরিবারের কয়েকজন ঠিক এইভাবেই তাদের স্বপ্নের বলিদান দিয়েছে।
সেবার স্বরসতী পুজোর দিন স্যার, দিদিমনিরা ছাড়াও সেই বছরের পরীক্ষার্থীরা কয়েকদিন আগের থেকেই প্রচণ্ড ব্যস্ত।পুজোর দিনই খাওয়ানো হবে লুচি আর করাইশুটি দিয়ে বাঁধা কফির তরকারি।একটা ক্লাসরুমের মেঝে খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে তার উপরেই যার যার বাড়ি থেকে বটি নিয়ে গিয়ে কফি কাটা হত।সে এক আলাদা আনন্দ!এখনকার দিনের মত লোক দিয়ে নয় নিজেরা সবাই মিলে সব কাজ করা হত।আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা সেসব ভাবতেই পারবে না।কাটা বাঁধা কফির যেন ছোট এক পর্বত।এখন তো স্কুলের ছেলেমেয়েরা স্কুলে ঢুকলেই গেটে তালা পরে যায়।পুজোর খাওয়ার দিনেও তার ব্যতিক্রম নয়।কিন্তু সেই সময় আশেপাশের স্কুল থেকেও ছাত্রছাত্রীরা অন্য স্কুলে এসে খেয়ে যেত।সেসব এক আলাদা মজা!আজও চোখ বুজে সেসব মজার পরশ পাওয়া যায়।যাদের বাড়ি একটু দূরে থাকতো রাত হয়ে গেলে স্যারেরা তাদের সাথে করে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন।প্রত্যেক শিক্ষক তাদের প্রতিটা ছাত্রছাত্রীকে নিজ সন্তানের মত দেখতেন এবং ভালোবাসতেন।অপরদিকে ছাত্রছাত্রীরাও প্রতিটা শিক্ষক শিক্ষিকাকে অসীম ভক্তি,শ্রদ্ধা করতো।আর ভয় তো ছিল জমের মত।
ছন্দাও তার বাড়ি থেকে বটি নিয়ে বিকালেই হাজির।অনভিজ্ঞ হাতে কফি কাটতে কাটতে আগুল কেটে গেলো।হেড মাস্টার এবং কিছু শিক্ষক কিছুটা দূরেই চেয়ারে বসে ছিলেন।ছুটে এলেন তারা।কেউ বলে এ টি এস দিতে হবে কেউবা দৌড়ে গিয়ে টিচার্স রুম খুলে ডেটল তুলো এনে তার আঙ্গুলে চেপে ধরে বসে থাকেন।তখনকার শিক্ষকেরা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের সামান্য কিছু হলেও যে ব্যকুলতা তাঁদের মধ্যে দেখা যেত আজ আর তা খুঁজে পাওয়া যায় না।সকলের জীবন থেকে সেই দিনগুলি যেন খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেছে।সেদিন ছন্দাকে কৃষ্ণকান্ত পাল স্যার রিক্সা করে বাড়ি পৌঁছে দেন কারণ ছন্দার বাড়িটা একটু দূরেই ছিল।এই কৃষ্ণকান্ত স্যারকে স্কুলের সকলেই কেষ্ট স্যার বলে ডাকতো।লম্বা প্রায় সাড়ে ছ'ফুটের কাছে।কালো কুচকুচে চেহারা।সবসময় ধুতি পাঞ্জাবি,আর পায়জামা পাঞ্জাবী পড়তেন।জীবনে কোনদিনও তিনি প্যান্ট শার্ট পরেননি।
এই কাজগুলি সব পুজোর আগের দিন করা হত।পরদিন পুজো হত।তখন রাধুনী এসে রান্না করতো।ক্লাসরুমগুলির পিছনের দিকে একটা বিশাল বড় জায়গা ছিল ছন্দাদের স্কুলে।সেখানেই রান্না হত।এই কেষ্ট স্যার হাতে একটা বেত নিয়ে এই রান্নার জায়গায় অদূরেই এক চেয়ারের উপর বসে থাকতেন।কারণ দুটো মাটির বড় বড় উনুন জ্বালানো হত।কোন ছাত্রছাত্রী সেখানে গেলে হঠাৎ করে যদি কোন বিপদ হয় তাই স্যারের বেত নিয়ে সদা সতর্ক পাহারায় সেখানে বসে থাকা।
ছন্দা স্যারের কাছে গিয়ে এগিয়ে বলে,
--- স্যার আজকে আমরা ঠাকুরের সাথে সবাই ছবি তুলবো।
--- দেখি তোর হাতটা কেমন আছে?ব্যথা কমেছে?
--- ঠিক হয়ে গেছে স্যার।ব্যথা-ট্যথা কিছু নেই।আপনি শুধু একটু অনুমতি দিন আমরা ক্যামেরাম্যানকে বলে আসি।
---যা বলে আয়,তবে বিকেলের দিকে বলিস।পুজোর পরে খেতে খেতে বিকেল হয়ে যাবে।তখন সব্বাই ফ্রী থাকবে।
বেশ কয়েকজন মিলে সেখানকার নাম করা স্টুডিও আলোছায়াতে গিয়ে দেবাশীষ কাকুকে বলে আসলো ছবি তোলার কথা।এদিকে খাওয়ার জায়গায় রসগোল্লা দেওয়া নিয়ে ছন্দার সাথে পণ্ডিতস্যার মণিশঙ্কর চক্রবর্তীর (সংস্কৃত পড়াতেন তাই পণ্ডিত স্যার বলেই ডাকতো সবাই)সামান্য মনোমালিন্য হয়।ব্যাপারটা ছিল এরূপ - ছন্দা সবাইকে রসগোল্লা দিচ্ছিল কেউ একজন দুটোর বেশি রসগোল্লা চাওয়ায় ছন্দা যখন সেটা দিতে যায় পণ্ডিত স্যার তাকে কটূক্তি করেন।কারণ কথা ছিল সকলকে দুটোর বেশি দেওয়া যাবে না।
ছন্দা এতে ভীষণ অপমানিত বোধ করে এবং কাউকে কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে আসে।শেষ খাওয়ার ব্যাচে ছন্দাকে দেখতে না পেয়ে তাকে সবাই খুঁজতে শুরু করে।কেষ্ট স্যার ঘটনার কথা জেনে বুঝতে পারেন তার অভিমানী এই ছাত্রীটি রাগ করেই বাড়ি চলে গেছে।তিনি ও তার এক সহকর্মী তিমির কুমার দে দুজনে মিলে পারিজাত ও আসাদকে নিয়ে ছন্দাদের বাড়ি এসে উপস্থিত।এই মানুষগুলিও কিন্তু না খেয়েই ছিলেন।ছন্দাকে নিয়ে গিয়ে তারপর খান।এদিকে ক্যামেরাম্যান এসে ফিরে যায় দিনের আলো নেই বলে।তাকে বলে দেওয়া হয় পরদিন ভাসানের আগে ছবি তোলা হবে।
ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক শিক্ষিকার মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল তখনকার দিনে আজকের দিনে উভয় পক্ষই সেসব বুঝতে যেমন পারবেন না এমন কি ভাবতেও পারবে না।সেই ভালোবাসা,স্নেহ,শ্রদ্ধা সবই ছিল হৃদয় কেন্দ্রিক।অভিনয়ের কোন প্রয়োজন সেখানে হত না।
ছবি তুলতে দেবাশীষ কাকু এলেন।পণ্ডিত স্যার পুনরায় ব্যগরা দিলেন
--- মৃত ঠাকুরের ছবি তুলতে নেই।
আসলে সব যুগেই কিছু মানুষ তো এরূপ থাকেই।স্যারের কথা শুনে কেষ্ট স্যার বললেন,
--- কথায় কথায় তো শ্লোক বলেন।শ্লোক বলে বুঝিয়ে দেন মৃত ঠাকুরের ছবি তুলতে গীতায় কোথায় নিষেধ আছে?
স্যারদের মধ্যে হাসির রোল উঠলো।পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ালো পণ্ডিত স্যার নিজেও হাসতে শুরু করলেন।তারপর নির্বিঘ্নেই ছবি তোলা হল।
এই স্কুলেই অমরেশবাবু ছিলেন গার্জিয়ান তরফ থেকে একমাত্র মেম্বার।স্কুল কর্তৃপক্ষ কোন আইনী জটিলতার সম্মুখীন হলে সেটিও অমরেশবাবুই দেখতেন।তখনো স্কুলটি সরকারি হয়নি।কিন্তু তিনি একটি নিয়ম স্কুলে চালু করেছিলেন।যে ক্লাসে যে ফাষ্ট হবে সে বিনা বেতনে পড়বে।বলা বাহুল্য ছন্দা কোনদিনও বেতন দিয়ে পড়েনি।কারণ প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী সে প্রতিবার প্রতি ক্লাসেই প্রথম হয়ে উঠতো।
যেহেতু স্কুলটি কোএড ছিল ছেলেমেয়েরা একই সাথে ক্লাস করতো;ভাবলে অবাক হতে হয় এইসব ছেলেগুলো কোনদিন কোন মেয়ের সাথেই অভদ্রতা করেনি।তারা ক্লাসমেট হিসাবে যেভাবে মেয়েরা ছেলেদের এবং ছেলেরা মেয়েদের সাহায্য করতো আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এখনকার ছেলেমেয়েরা সেগুলি কল্পনাও করতে পারবে না।দু একটি ক্ষেত্রে যে কিছু ঘটেনি তা কিন্তু নয়।যেমন হাতের পাঁচটা আঙ্গুল সমান নয়।কিন্তু সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি সংখ্যায় এতটাই নগন্য সেগুলিকে হিসাবের বাইরেই রাখা যায়।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment