Monday, November 15, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (ষোলো পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (ষোলো পর্ব)
  স্বপ্নাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন তার নন্দায়। স্বপ্না কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে থাকলো।শ্বশুরবাড়ির কোন ঘটনায় সে বাড়ির কাউকে জানালো না।দু থেকে তিনদিন যাওয়ার পর তার সেজদি ভারতী কিছুটা হলেও ঘটনার আঁচ পায়।অমরেশবাবু মেয়ের এই জামাই ছাড়া আসা আর মনমরা হয়ে থাকা দেখে  তিনি তার সেজো মেয়ে ভারতী ওরফে ভানুকে ডেকে বললেন,
--- আমার কাছে স্বপ্না যখন কিছু স্বীকার করছে না তুমি ওকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করো ওর শ্বশুরবাড়িতে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা।
--- হ্যাঁ বাবু আমি জানতে চাওয়ায় আমার কাছে সব স্বীকার করেছে।ওর শ্বাশুড়ী ওকে পছন্দ করেন না।তপনকে ওর কাছে দেখলেই শ্বাশুড়ির মাথা গরম হয়ে ওঠে।কিন্তু তপন পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে ওর মাকে তিনি যদি তার স্বভাবের পরিবর্তন না করেন তাহলে স্বপ্নার প্রতি যে মানসিক অত্যাচার তিনি করছেন সবকিছুই সে বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেবে।
--- বাড়ির কেউ কিছু এখনো জানে না?
--- না,এখনো পর্যন্ত কোন কথা অন্য কেউ জানে না।
--- আসলে কি জানো মা,ভদ্রমহিলা খুব অল্প বয়সে যখন বিধবা হয়েছেন তখন ছেলের বয়স ছ'মাস আর মেয়ের বয়স পাঁচ বছর।সংসারে ঝিয়ের মত পরিশ্রম করে ভাসুর,দেওরের চোখ রাঙ্গানি সহ্য করেও কোনদিন হয়ত তাদের মনই পাননি।তার ভিতরের চাপা যে কষ্ট রয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ কোনদিনও হয়নি তার ছেলেমেয়ের স্বার্থে।তিনি তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খুললে যদি তাকে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়।বাংলায় একটা প্রবাদ আছে জানো তো ?"ঝিকে মেরে বৌকে শাসন।"আমার মনেহচ্ছে উনার ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা কাজ করছে।উনি কোনদিনও উনার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেননি।আর তার ফলেই আমার মেয়েটার উপর অন্যায় অত্যাচার করে উনার ভিতরের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন।যতই উনি মুখে বলুন না কেন ভাসুর,দেওরের সংসারে কোনদিন কোন কষ্ট উনি পাননি।সেটা উনার মহানুভবতা।উনি চাননা উনার শ্বশুরবাড়ির কারো বিরুদ্ধে কোন কথা কাউকে বলে তাদের চোখে শ্বশুরবাড়ির লোকদের ছোট করতে।উনাকে সময় দিলেই আস্তে আস্তে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।এই মুহূর্তে স্বপ্নার যেটা প্রয়োজন তাকে এ কথাগুলি বুঝিয়ে বলা।ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে আমি বুঝেছি উনি যথেষ্ঠ বুদ্ধিমতী।সময় উনাকে সঠিক পথে চালনা করবে।দেখো কটাদিনের মধ্যেই তপনকে উনিই পাঠাবেন স্বপ্নাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে।
 ঘটলোই তাই।দিন পনেরর মধ্যে তপন এসে স্বপ্নাকে নিয়ে গেলো মা পাঠিয়েছেন বলে।
 অমরেশবাবু এতটাই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন।তিনি তার অন্তর দৃষ্টি দিয়ে মানুষের সাথে কথা বলে তার ভিতরটাও দেখতে পেতেন।এরপরে স্বপ্নার সংসারে টুকটাক অশান্তি থাকলেও বড় ধরনের কোন অশান্তি আর হয়নি।ভদ্রমহিলার মধ্যে এক আমুল পরিবর্তন এসেছিল।পরবর্তীকালে তপন নিজে বড় বাড়ি করলেও তার মা তার সাথে সেই মুহূর্তে আসেননি।কারণ ভাসুরপত্নী মারা যাওয়ার কারণে আর ওই শরিকের বাড়ি ছেড়ে একে একে সকলে বাড়ি করে চলে যাওয়ার ফলে ভাসুর ঠাকুর তার একা হয়ে পড়েন।তিনি চলে গেলে কে তাকে দেখবে এই অজুহাতে তিনি ছেলে এবং তার বউয়ের কাছে আসেন না।পরবর্তীতে জ্যাঠা মারা যাওয়ার পরে তপন তার মাকে জোর করে নিজের কাছে নিয়ে আসে।এরপর যে কটাদিন তিনি বেঁচে ছিলেন তপন সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তার সেবা করেছেন। একথা সত্যি স্বপ্না তাকে তিনবেলা ঠিকমত খাবার সামনে দিলেও সেই পুরনো কথাগুলো ভুলে গিয়ে কোনদিনও তার শ্বাশুড়ির কাছে ফ্রী হতে পারেনি।
 একবার অমরেশবাবুর সহকর্মী বন্ধু নারায়ণ স্যান্যালের ছেলেকে অপহরণ করে এক দুষ্ট চক্র।স্বভাবতই বার অ্যাসোসিযেশনের সকলেই খুব ভয় পেয়ে যান তাদের সন্তানদের নিয়ে।নারায়ণবাবু একটা কেসে জয়লাভ করেছিলেন।সেই কেসে এক কুখ্যাত ডাকাতকে তিনি যাবতজীবন জেল দিয়েছিলেন আইনি মারফৎ।এর জের হিসাবে ওর ডাকাত দলের যারা বাইরে ছিলো তারা উনার ছেলেকে অপহরণ করিয়েছিল।এই কেসে সর্বতভাবে নারায়ণবাবুকে সাহায্য করেছিলেন অমরেশবাবু।প্রথম অবস্থায় কেন এই অপহরণ বুঝতেই বেশ কয়েকটা দিন কেটে যায়।পড়ে তারা বুঝতে পারেন ওই ডাকাতকে জেলে দেওয়ার কারণে তাদের রাগের বহিঃপ্রকাশ এটি।ডাকাতদের টার্গেট ছিল এর পরেই অমরেশবাবুর ছেলেকে অপহরণ।যা জানা যায় অনেক পড়ে।উকিলবারে রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রত্যেকেই এই অপহরণের ব্যাপারে বক্তৃতা দেয়।যা পেপারে বেরোয়।রাতের অন্ধকারে উকিল বারের দেওয়ালে নানান ধরনের পোষ্টার পড়তে শুরু করে।ভয় পেয়ে যান অমরেশবাবু এবং তার অপর উকিল বন্ধুরা।তার ছেলে তখন গ্রামের বাড়িতে তার মায়ের কাছে থাকে।তিনি গ্রামের বাড়ি গিয়ে বাড়ির সবাইকে ঘটনার পুঙ্খানপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে সতর্ক করে দেন।
 যেদিন তিনি গ্রামের বাড়িতে যান খোকন তাঁর সাথে দেখা করতে আসে।( খোকন চাকরি পাওয়ার পর তার নিজের বাড়িতেই অধিকাংশ দিন থাকতো কারণ ওখান থেকে তার অফিস করতে সুবিধা হত)সেই রাতে খোকন অমরেশবাবুর বাড়িতেই থেকে যায়।আর অদ্ভুত ব্যাপার সেই রাতেই বাড়িতে ডাকাত পরে।উদ্দেশ্য হয়ত ছিল অমরেশবাবুর ছেলেকে অপহরণ। এসেছিলো তারা চোর হয়ে।কিন্তু বাড়ির লোক জেগে যাওয়ায় তারা দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢোকে।বাড়ির বাগানের মেহগনি কাঠ কেটে দরজা বানানো।শাবল,কুঠার দিয়ে যখন তারা দরজা ভাঙতে চেষ্টা করছে খোকন তখন ঠাকুরঘরের বেরা কেটে অমরেশবাবুর ছেলেকে কোলে নিয়ে অন্ধকারে গ্রামের মেঠো পথ ধরে অন্য এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।আর ঘরের বাকি মানুষেরা যে যেখানে পারে লুকিয়ে যায়।ডাকাতরা যারা এসেছিলো তাদের কেউই এ বাড়ির কোনকিছু সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না। কাঠের মই বেয়ে দুতলায় উঠতে হোত।কিন্তু বাইরে থেকে দেখে বোঝা যেত না এটা কাঠের দোতলা বাড়ি।অমরেশবাবু সহ বাড়ির সকলেই মই বা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যান।কিন্তু সেই মইটাকে সরানোর জন্য নিচুতে তো একজনকে থাকতে হবে।তানাহলে ডাকাতরা বুঝে ফেলবে উপরে লোক আছে।নিচুতে থেকে যান শান্তিলতাদেবী।
 হুড়মুড় করে পাঁচ সাতজনের একটা দল ঘরে ঢুকে সমস্ত ঘরে কি এবং কাকে খুঁজতে থাকে তা একমাত্র তারাই জানে।কোথাও খুঁজে না পেয়ে তারা বারবার শান্তিদেবীর কাছে হিন্দিতে জানতে চায় সকলে কোথায়।শান্তিদেবী তাদের জানান আজ তিনি একাই আছেন বাড়িতে।সকলে এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছে।আর এই বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যই অমরেশবাবু আজ বাড়িতে এসেছেন।ডাকাতরা নিজেরাই জানিয়েছিল সন্ধ্যার ট্রেনে অমরেশবাবু যে বাড়িতে এসেছেন তা তারা জানে।আর এদিকে উপরের কাঠের পাটাতনের ফাঁক দিয়ে সকলে দেখে চলেছে ডাকাত এবং বাড়ির মালকিনের হিন্দিতে কথোপকথন।
 ডাকাতরা ঘরে ঢুকে একজন মহিলাকে দেখে তারা কিন্তু কোনরকম দুর্ব্যবহার তার সাথে করেনি।উপরন্তু তাকে মাইজি বলে সম্মোধন করেছে।শান্তিদেবীর কাছে জল চেয়ে খেয়েছে।ঘরের ভিতর অনেক ডাব পারা ছিলো তারা সেগুলি খাবে কিনা জানতে চেয়েছে।শান্তিদেবী তাদের কাটারি/দা বের করে দিয়ে কেটে খেতে বলেছেন।চলে যাওয়ার সময় হাত জোড় করে শান্তিদেবীকে নমস্কার জানিয়েছে।
 এহেন অদ্ভুত ডাকাতের সম্মুখীন অন্য কেউ কোনদিন হয়েছে কিনা জানা নেই।তবে নামেই তারা ডাকাত।তারা কিন্তু কোন জিনিষ না নিয়েই সেদিন চলে যায়।অপহরণ বা খুন কোনটা করতে এসেছিলো জানা যায়নি।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment