Sunday, November 21, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে(তেইশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (তেইশ পর্ব)
  অমরেশবাবুর ষষ্ঠ মেয়েটির জন্মের পর তাঁর একটি পুত্র সন্তান হয়েছিল।একবার গ্রামের এক কালী পুজোয় তাকে কোলে করে শান্তিদেবী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর কোল থেকেই হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে সে অন্য এক ভদ্রমহিলার কোলে 'মা' বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।সেই থেকে ওই ভদ্রমহিলা রায় চৌধুরী পরিবারে সব সন্তানদের মা হয়ে ওঠেন।সকলেই তাকে মা বলেই ডাকতো।গরীব ঘরের মানুষ ছিলেন মহিলা।বিপদে,আপদে যেকোন সময় রায় চৌধুরী বাড়িকে সে পাশে পেয়েছে।আবার রায় চৌধুরী পরিবারে যে কোন দুর্যোগের সময় তিনি ছুটে এসেছেন।পাশে থেকে নানান কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।(সেই সন্তানটি যে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় মারা গেছিল আমি আগেই তা উল্লেখ করেছি)
 গ্রামের এই কালী পুজোকে ঘিরে নানান কথা সেই সময় লোকের মুখে মুখে ঘুরতো।এই পুজো হত এবং আজও হয়ে চলেছে জৈষ্ঠ মাসের এক অমাবস্যায়।এই পুজোর নাম সদের গাছতলার পুজো।একমাস ধরে বাড়ি বাড়ি কুলো নিয়ে শাক উলুধ্বনি সহকারে চাল,ডাল,টাকা ভিক্ষা করে বেড়ানো হয়।কথিত আছে এই রায় চৌধুরী বাড়ির কোন এক পূর্বপুরুষ একসময় রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে আসছিলেন তখন তিনি দেখেছিলেন একজন বৃদ্ধা মলিন বস্ত্র পরে ওই রাস্তার উপর এমনভাবে শুয়ে আছেন যে যিনি আসছিলেন তাকে আসতে গেলে উনাকে টপকে আসতে হয়।তিনি ভদ্রমহিলাকে বলেন,
--- মা তুমি এইভাবে রাস্তার উপর পড়ে আছো কেন?
--- ছেলেমেয়েরা যে আমায় দেখে না বাবা।তাই যেখানে সেখানে পড়ে থাকি।
--- আমায় বল কোথায় থাকে তোমার ছেলেমেয়েরা।আমি ওদের বুঝিয়ে বলবো।
--- বলবো বাবা।
 সেদিনই রাতে ওই ভদ্রলোক স্বপ্নে দেখেন স্বয়ং মা কালী তাকে বলছেন তার থাকার আস্তানা করে দিতে।এবং তিনিই জানিয়ে দেন তাঁর পুজো কিভাবে হবে। জায়গাও ঠিক করা হয় মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েই।উপরে খড়ের ছাউনি এবং বাঁশের বেড়া দিয়ে মন্দির তৈরি করা হয়।তারপর মায়ের মূর্তি তৈরি করা হয়।এদিকে কুলো নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি খালি পায়ে হেঁটে ভিক্ষে করে বেড়ানো হচ্ছে।হঠাৎ এক মুসলিম পরিবার থেকে কিছু লোক ওই মায়ের মূর্তি দেখতে আসে।তারা মায়ের মূর্তি দেখে নাক সিঁটকে অবজ্ঞাভরে বলে,
-- এমা!হিন্দুদের এই মূর্তির মুখটা কি বিচ্ছিরি দেখতে!দেখে মনেহচ্ছে এর সারা গায়ে পক্স হয়েছে।
পড়ে  তারা বাড়ি ফিরে যায়।কিন্তু সেদিন রাতেই তাদের বাড়ির প্রতিটা সদস্যের গায়ে প্রবল ব্যথা নিয়ে জ্বর আসে আর সকলের গায়ে মুখে এমনভাবে পক্স হয় যে তারা হা করে খাবার খাওয়ার মত অবস্থায় থাকে না।প্রথমদিন কেন এরূপ হল বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে তাদের বোধগম্য হল যে কালী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলার ফল এটা।
  তারা ছুটে আসে ওই মন্দিরে যে পুরোহিত পুজো করবেন বলে স্থির করা হয়েছে তার কাছে।তিনি আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে বলেন।তারা পুরোহিতের কথামত সে কাজ করেও।কিন্তু সেদিন রাতে ওই মুসলিম পরিবারের গৃহকর্তা স্বপ্ন দেখেন মাকালী তাকে বলছেন,
--- এই মন্দিরে যতদিন পুজো হবে বংশপরম্পরায় তোদের বাড়ি থেকে চাল যাবে ওই কুলোয় একমাসের শেষ দিনে।ওই চাল দিয়েই আমার পুজো সম্পন্ন হবে।
 সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি অনুভব করেন তার শরীরে ব্যথা কম।ওই অবস্থায় তিনি ছুটে যান রায় চৌধুরী বাড়িতে।সেখানে পৌঁছে সবিস্তারে সব বর্ণনা করেন।সেদিনই ছিল কুলো নিয়ে ভিক্ষে করার শেষ দিন।ওই বাড়ি থেকে চাল নিয়ে সোজা সকলে আজও চলে যায় মায়ের মন্দিরে।আজও ওই মুসলিম পরিবারের দেওয়া চালের সাথে অন্য চাল মিশিয়ে মায়ের ভোগ রান্না করা হয়।যুগের পরিবর্তন হয়েছে,পরিবারের সদস্য পরিবর্তন হয়ে চলেছে কিন্তু সদের বটতলার পুজোয় ওই মুসলিম পরিবারের ভিক্ষে দেওয়া চালে মায়ের ভোগ আজও নিবেদন করা হয়।বহু বহু বছর আগে যে রীতি চালু হয়েছে;আজকের যুগে দাঁড়িয়ে হিন্দু,মুসলমানের মধ্যে যে দাঙ্গার ফলে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে কিন্তু পিলজঙ্গ গ্রামের সেই রীতি আজও চালু রয়েছে।ওই পরিবারের আজও কেউ সাহস পায়না এই রীতি ভাঙ্গার।
 পূর্ব বাংলায় রায় চৌধুরী পরিবারে আজ আর কেউ থাকে না ঠিকই।কিন্তু তারা তাদের এ কাজ অর্পণ করে এসেছে অন্য এক ব্রাহ্মণ পরিবারে।তারা আজও একইভাবে একই নিয়ম মেনে এই পুজো করে থাকে।নেই সেখানে কোন হিন্দু,মুসলিম দাঙ্গা।সবাই সবার বিপদে আজও সেই পূর্বের মতই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
  একবার পুজোর কয়েকদিন আগে থেকে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই এক বাড়ি কি দুই বাড়ি চাল এনে রাখা হত।পুজোর দিনে অর্থাৎ একমাসের শেষদিনে ওই মুসলিম পরিবার থেকে চাল না এনেই কুলো নিয়ে সোজা মায়ের মন্দিরে চলে যাওয়া হয়। তারও কারণ ছিল।ওই পরিবারটি ছিল গ্রামের শেষ প্রান্তে।মাটির রাস্তা।কয়েকটা দিন সমানে ঝড় জল হওয়ায় ইচ্ছা করে বা গাফিলতি করেই হোকনা কেন তারা আর ভিক্ষা আনতে যায় না।কিন্তু সেদিনই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা।যতবারই মাটির উনুনে মায়ের ভোগ চাপানো হয় ততবারই উনুন নিভে তো যায়ই উপরন্তু উনুনের একপাশ ধসে যায়।আবার তা সারিয়ে যখন ভোগ চাপানো হয় তখন সেই একই কান্ড।সকলের মাথায় হাত!কেউই কিছুই বুঝতে পারে না।পুরোহিত সব দেখে ও শুনে বুঝলেন কিছু একটা অনিয়ম হয়েছে।তিনি এই পুজোর ব্যাপারে যারাই ইনভলব সকলের কাছে একে একে জেনে নিয়ে আসল সত্য উদঘাটন করতে পারলেন।সঙ্গে সঙ্গে আবার কুলো নিয়ে মহিলারা ছুটলো জলকাদা ভেঙ্গে ওই মুসলিম পরিবার থেকে চাল আনার জন্য।সেখানে গিয়ে তারা দেখে সেই সময়ের ওই বাড়ির গৃহকর্তা চাল আরো অনেক সামগ্রী নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন পুজোয় সেগুলি দেবেন বলে।সাথে সেবারের পুজোয় দরিদ্র ভোজন করার জন্য একবস্তা চাল।তারা সেসব নিয়ে মন্দিরে ফিরে আসে।এর পরেই তারা নির্বিঘ্নে পুজো সম্পাদন করতে পারে।
 পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা আছে। যার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মেলে না।আগেকার দিনে ঠাকুর দেবতা নিয়ে এমন অনেক ঘটনা আমরা জানি বা শুনি যা আজকের যুগে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস করতে হয়ত অনেকেরই মন সায় দেবে না।কিন্তু একথা অবিশ্বাস করার কোন উপায়ই নেই যে সুপ্রিম পাওয়ার বলে কিছু তো একটা আছেই।রামকৃষ্ণ,ব্যমাক্ষ্যাপা প্রমূখ- ছিলেন মানুষ। তাঁদের সাথে কিন্তু সুপ্রীম পাওয়ার ক্ষমতাধারীর সাথে দেখা হয়েছিল।সুতরাং যুগ যুগ ধরে প্রচলিত সেই সব ঘটনা অস্বীকার করবার কোন উপায়ই কিন্তু নেই।
 আজ আমরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এমন অনেক ঘটনায় জানতে পারি যা আমাদের কাছে যুগ যুগ ধরে গল্পের আকারে এসেছে।বিজ্ঞানের এত উন্নতির ফলে এই শোনা গল্পগুলি যে সত্যি তা স্বীকার করতেই হবে।উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকানগরী।প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা জানতে পারছি সমুদ্রগর্ভে আজও সেই নগরীর অস্তিত্ব।

ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment