Wednesday, November 24, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (ছাব্বিশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (ছাব্বিশ পর্ব)
  মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হল।তার দুবছর আগেই অমরেশবাবুর একমাত্র পুত্র সন্তান প্রণয় গ্রাম থেকে শহরে এসে ছন্দার স্কুলেই ভর্তি হল।দুই ভাইবোন একই সাথে মাধ্যমিক পাশ করলো।ছন্দার রেজাল্ট খুবই ভালো আর প্রণয় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে।বাড়ির সকলেই খুব খুশি।
 ঠিক এই সময়েই আগরতলা থেকে অমরেশবাবুর বড় মেয়ের মেজো ছেলে আর তার বড় জামাই আসেন। লক্ষীর মেজো ছেলেটি ছন্দার থেকে বছর দুয়েকের বড়।মাসী,বোনপোর প্রথম সাক্ষাৎ তাদের এটা।
  তখনকার দিনে অধিকাংশ পরিবারেই দেখা যেত মায়ের এবং তার নিজ মেয়ের একই সাথে সন্তান ভূমিষ্ঠ হত।অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হত এবং এখনকার দিনের মত সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর কিছু যেমন নির্ভর করত না ঠিক তেমনই সন্ধান ধারণটাও আটকানোর কোন পথ জানা ছিলনা।এমতাবস্থায় যতদিন সন্তান ধারণের ক্ষমতা থাকতো ততদিনই সন্তান হত তখনকার বিবাহিত নারীদের।
  সমবয়সী হওয়ার কারণে সেই প্রথম দিন থেকেই ছন্দা এবং আকাশ ভীষণ ভালো বন্ধু হয়ে যায়।তবে ছন্দা যেমন খুব খোলামেলা টাইপের আকাশ কিন্তু সম্পূর্ণ তার বিপরীত।পাঁচটা কথা বললে একটার উত্তর করে।আর চারটার উত্তর নিজের মনের মধ্যেই পুষে রাখে।মানুষের সাথে সঙ্গে সঙ্গে মিশতে পারে না।খুব পরিচিত না হলে তার সাথে একাকী বসে গল্প করে না।এক্ষেত্রে তার কাছে সেই অপরিচিত মানুষটি ছেলে কিংবা মেয়ে এসব ফ্যাক্টর করেন।কিন্তু যদি কারো সাথে একবার তার মতের মিল হয়ে যায় তাহলে আর রক্ষে নেই।ভীষণ জেদী,একরোখা কিন্তু মনটি শিশুর মত সরল।ছন্দার জীবনের কথা বলতে গেলে আকাশকে বাদ দিয়ে বলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
 আকাশ ছিল একজন রাজনৈতিক নেতা।কিন্তু সচ্ছ মনের।অন্যায়,অসাধু কিছু দেখলেই সে গর্জে উঠতো সে নিজের দলের বা অন্য যে কোন দল হোকনা কেন।ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সে তার নীতি থেকে বিন্দুমাত্র সরেনি।এরজন্য তাকে বহুবার মৃত্যুর সম্মুখীন পর্যন্ত হতে হয়েছে।প্রথম জীবনে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর থেকে সে শুরু করে টিউশনি পড়াতে।অধিকাংশ গরীব ছেলেমেয়েদেরই সে পড়াত বিনা পয়সায়।যে সব পরিবার থেকে মাস মাইনে পেতো তা নিজের জন্য ব্যয় করতো না। ওই টাকাটা সে সেইসব দরিদ্র ছেলেমেয়েদের বই,খাতা এমনকি তাদের দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থাও করতো।এইভাবেই অনেক ছেলেমেয়েদের সে তাদের জীবনে দাঁড় করিয়েছে।সচ্ছল পরিবার হওয়ার কারণে পরিবারের কোন দায় তাকে নিতে হতনা ঠিকই কিন্তু পরিবারের লোকেদের কাছে তার এই স্বভাবের জন্য বেশ কটু কথা শুনতে হত।আকাশের মধ্যে একটা ব্যাপার কাজ করতো আর তা হল সে যদি মনে করতো সে কোন অন্যায় করছে না এবং তার এই কাজের ফলে অন্যে উপকৃত হচ্ছে তাহলে সেই পথ থেকে তাকে কেউ কোনদিনও সরাতে পারত না।নিজের সবটুকু দিয়ে অন্যের জন্য করে যেত।একটা অদ্ভুদ চরিত্রের মানুষ ছিল সে।ছেড়া জামা,ছেড়া স্যান্ডেল,আধপেটা খাবার খেয়েও অন্যের জন্য নূতন জামা,নূতন চটি আর খাবারের সংস্থান করে যেত।সচ্ছ মানুষ হওয়ার কারণে নানান দিক থেকে তারই সমকক্ষ কিছু মানুষের কাছ থেকে অনেক সময় অনেক সাহায্যও পেয়েছে।অন্যের বিপদে-আপদে, রাত বিরেতে ছুটে যেত।নিজের শরীর,নিজের ভবিৎসত নিয়ে কোনদিনও ভাবেনি।আর এই না ভাবার কারণে অকালেই তাকে চলে যেতে হয়েছে।কিন্তু সেসব অনেক পরে।
 মানুষটা অত্যন্ত ভালো হওয়ার কারণে এবং নিজ পার্টির পিছনে দিনরাত পরিশ্রম করার পরেও পার্টি থেকে সে নিজের জন্য কিন্তু কোনদিনও কোন সুযোগ নেয়নি বা দাবী করেনি।একবার তাকে পার্টি থেকে একটা সরকারি চাকরির অফার করায় সে জানিয়েছিল,
--- আমি তো দুবেলা পেট পুড়ে খেতে পারি।কিন্তু এই পার্টিতে অনেকেই আছেন যাদের সে সামর্থ্যও নেই।আপনারা তাদের দেখুন।
 নিজ পার্টির তাবড় তাবড় নেতাদেরও ভুলভ্রান্তি হলেও তাদের মুখের উপর বলে দিত।এইসব কারণে তাকে অনেকেই একটু সমীহ করে চলতো বলা ভালো এড়িয়েই চলতো।এইভাবেই হয়ত চলত কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনে রাজ্যে অন্য পার্টি ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চায়েত প্রধান তার বন্ধু স্থানীয় হওয়ার সুবাদে তিনি অনেক বুঝান আকাশকে তার দপ্তরে একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে বসার জন্য।
--- ভোট তুমি আমাকে না দিয়ে অন্যকে দাও তাতে আমার আপত্তি নেই।কিন্তু আমি আমার অফিসের এই দায়িত্বপূর্ণ পদে তোমাকেই চাই।কারণ এই পদে কাজ করার জন্য একমাত্র তুমিই যোগ্য লোক।
--- আমাকে তুমি কাজটা দিলেও কিন্তু কোনদিনও আমি আমার পার্টির নীতি থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসবো না।
--- সেটা আমি জানি।আর এটাও জানি তুমি ভোটটাও কোনদিন আমার পার্টিকে দেবে না।কিন্তু আমার প্রয়োজন একজন নির্লোভ,দায়িত্ববান মানুষ।তাই তোমার সব শর্ত মেনেই আমি তোমাকে কাজটা দিতে চাই।
  তিনমাস কাজ করার পর হঠাৎ একদিন প্রধানের সাথে রাস্তায় দেখা।
--- কি আকাশ তুমি তো মাইনে পেয়ে আমায় মিষ্টি খাওয়ালে না?
--- মাইনে?আমি তো কোন মাইনে পাইনা।
--- সে কি?তোমার নামে তো প্রতিমাসেই টাকা ইস্যু হচ্ছে।তবে সেগুলো যাচ্ছে কোথায়?
 আকাশ হাসতে হাসতে বলে,
--- যাদের প্রয়োজন তারাই নিচ্ছে।তবে কাজটা করতে আমার খুব ভালো লাগছে।আমার সময়ও কেটে যাচ্ছে।
--- দেখি আমি সব খোঁজ খবর নিচ্ছি।তবে তোমার মত এইরূপ অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ আমি জীবনে একটাও দেখিনি।তিনমাস ধরে ফ্রী সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছ?
 আকাশ হো হো করে হাসতে লাগে।
 পরের মাস থেকে সরকারি নিয়ম মেনেই আকাশের মাইনে আসতে লাগলো।এতে আরও বেশি উপকৃত হল গরীব,অসহায় মানুষগুলো।এই হল ছন্দার বড়দির মেঝ ছেলে আকাশ।
  নিজ মাসীর সাথে প্রথম পরিচয়ের পর (এর আগে অমরেশবাবুর বড় মেয়ের সাথে বহু বছর দেখা সাক্ষাৎ ছিলনা বললেই চলে।কারণ যাতায়াতটা ছিল বেশ ব্যয় সাপেক্ষ।তবে চিঠির আদানপ্রদান ছিল প্রতিনিয়ত।ছন্দার বড়দি মাঝে মধ্যেই বাপেরবাড়ি আসতো।তার চার ছেলের তখন ছাত্রাবস্থা।তারাও খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি মামাবাড়িতে আসার।ছন্দার বড় দিদিরা মাঝে মধ্যে সেখানে গেলেও ছন্দা কোনদিনও তখনও পর্যন্ত আগরতলা যায়নি বা কোনদিন যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি।আসলে ছন্দা ঘোরা,বেড়ানো কোনদিনও পছন্দ করত না।তার মনে হত কোথাও ঘুরতে গেলেই তার পড়াশুনার ক্ষতি হবে।এই ভাবনা থেকেই কোথাও ঘুরতে যাওয়া থেকে সে সর্বদা বিরত থাকতো।পুজোর সময় যখন সবাই ঠাকুর দেখতে বেরত তখন সে বইয়ের টেবিলে বসে তার প্রিয় বিষয় অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে।তবে একদিন সে বেরত ঠিকই।সেদিন সারা দুপুর বসে পড়াটা করে নিত।জীবনে যে মেয়েটা পড়াশুনাটাকে এত ভালোবাসতো ,ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সেই মানুষটার জীবন থেকে কিভাবে যে সবকিছু হারিয়ে গিয়ে পুরো জীবনটাকেই তছনছ করে দিলো -- আজও যার কূলকিনারা সে খুঁজে পেলো না।

ক্রমশঃ 
 

No comments:

Post a Comment