জীবনের প্রতি বাঁকে (একুশ পর্ব)
অমরেশবাবুর তখন অনেকটাই বয়স।কিন্তু ডক্টর,উকিল এই ধরনের স্বাধীন প্রফেশনের লোকদের মত তো আর অবসর থাকে না।তিনি নিত্যই অফিস যাতায়াত করেন।বংশানুক্রমিক রোগ অ্যাজমায় জর্জরিত থাকতেন সবসময়।আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে ডক্টর সি.সি.করকে দেখিয়ে ইনহেলার নিয়ে চলাচল করতেন।নিজের প্রফেষণকে শেষ বয়স অবধি উচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিত্য তিনি আইনের বই পড়াশুনা করতেন।তার চেম্বারের একটি বড় আলমারি এবং ঘরের একপাশে থাকা আট ফুট বাই চার ফুটের যে বিশাল টেবিল ছিল তার সবটাই জুড়ে যত্রতত্র বইপত্র ঢিপ দিয়ে পরে থাকতো।কিন্তু সেসব যদি তার কোন মেয়ে গুছিয়ে রাখতো তাহলেই তিনি তার প্রয়োজনীয় জিনিসটিই সেদিন খুঁজে পেতেন না।তাই পারতপক্ষে টেবিল এবং আলমারি ঝারপোষ করা হলেও কেউ গুছিয়ে রাখতো না।
অনেক সময় অনেক কাগজপত্র,দলিল,প্রয়োজনীয় আইনের বই অফিসে থাকাকালীন সময়ে দরকার পড়তো।তিনি লোক পাঠিয়ে দিতেন সেইসব নিতে কিন্তু সাথে থাকতো একটি চিরকুট।সেই চিরকুটে লেখা থাকতো প্রয়োজনীয় কাগজের বিবরণ। এবং নিচুতে তার নাম সই।যেহেতু বহু মানুষের অনেক প্রয়োজনীয় কাগজ থাকতো তাই তিনি বলেই রেখেছিলেন তার মেয়েদের দরকারে কোন লোককে কাগজ নিতে পাঠালে তিনি চিরকুট লিখে নিজের নাম সই করে দেবেন।কারণ প্রতিটা যুগেই দুষ্ট লোকের তো আর অভাব নেই।কেউ যদি অসাধু উপায়ে কোন কাগজ তার কাছ থেকে হাসিল করতে চায় এবং তার বাড়িতে এসে যদি বলে অমরেশবাবু নিজেই ওই কাগজ নিতে পাঠিয়েছেন এবং মেয়েরা যদি তা দিয়ে দেয় তাহলে তার নিজের মাধ্যমে সেই লোকের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে।তাই কিছু নিতে লোক পাঠালে তিনি সাথে একটি চিঠি লিখে পাঠাতেন।
আইন সম্পর্কে তিনি এতটাই অভিজ্ঞ ছিলেন হাকিম পরবর্তীতে জজদের সাথে একদম বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক ছিল তাঁর।দিনগুলি ছিল যেহেতু কয়েক যুগ আগে - তখনকার দিনে গুণী মানুষের কদর করতে সকলেই জানতেন।অনেক সময় অমরেশবাবুকে অনেক আইনী দিক জানতে বা কোন বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রধান বিচারক তার আর্দালিকে দিয়ে ডাকিয়ে নিতেন।এইসব মানুষগুলি অমরেশবাবুকে অসীম শ্রদ্ধা ও মান্য করতেন।আর যার ফলে তাঁর সহকর্মীরাও তাকে অন্য চোখে দেখতেন।
কিছুদিনের জন্য হলেও একটা সময় তার বাড়ি আর কোর্ট এর দূরত্বটা খুব একটা ছিল না।তখন তার ভাড়া বাসা ছিল।হেঁটেই যাতায়াত করা যায়।কিন্তু অমরেশবাবু মোটেই হাঁটাচলা করতে পারতেন না।তিনি রিক্সা করেই যাতায়াত করতেন।এইসময় তার যাতায়াতের রাস্তায় ছিল ছোটখাট এক বাজার।রিক্সাতে বসেই তিনি বাজার করতে শুরু করতেন কোর্ট চত্বর থেকে ফেরার সময়।সাথে ব্যাগ থাকতো না।তিনি ওই রিক্সার পা দানীর কাছে মাছ তরকারি রেখেই রিক্সা করে আসতেন।তখনকার দিনে তো আর ক্যারিব্যাগ ছিল না।বড়জোর কাগজের ঠোঙ্গা।অনেক সময় রিক্সা চালকেরা তাদের গামছাটা এই তরকারি আর মাছ বাঁধার কাজেই লাগিয়ে দিত।ছোট মফরসল শহর হেতু অমরেশবাবুকে চিনতো না এমন মানুষ খুব কম আছে।
অফিস করে এইভাবেই একদিন বাজার করে পা দানীতে রেখে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরলেন একজন অপরিচিত রিক্সাওয়ালার রিক্সায়।বাড়ি ফিরে তিনি যখন তার মেয়েদের ডেকে বললেন,
--- ব্যাগ নিয়ে গিয়ে রিক্সার উপর থেকে তরকারিগুলো নিয়ে এসো।
ব্যাগ নিয়ে তাঁর এক মেয়ে দৌড় দিলো তরকারি আনতে।গিয়ে তো অবাক! রিক্সায় যে তরকারি আছে তা তো সে হাতে করেই নিয়ে আসতে পারতো।তাহলে বাবু খামোখা ব্যাগ নিয়ে আসতে বললেন কেন? ঘরে গিয়ে বাবুকে বলল,
--- বাবু মাত্র তো কটা তরকারি।তুমি ব্যাগ নিয়ে যেতে বললে কেন?
--- কেন মা আমি তো অনেক তরকারি কিনেছি।কই দেখি কটা তরকারি তুমি পেয়েছ?
মেয়ে ব্যাগ খুলে তার বাবুকে দেখালো।তিনি বুঝলেন সব তরকারীই তার রিক্সার ঝাঁকুনিতে রাস্তায় পড়ে গেছে।কারণ আজকের রিক্সা চালক তাঁর অপরিচিত ছিলেন তাই হয়ত সে বুঝে রিক্সা চালাতে পারেনি।
শান্তিদেবী সব শুনে বললেন,
--- এরজন্য তোমার মেয়েরাই দায়ী।তোমার মেয়েরা তোমায় আদর,যত্ন করে করে এতটাই অলস প্রকৃতির করে দিয়েছে যে রিক্সার পা দানীতে তরকারি কিনে রেখে সেগুলির দিকে একটু তাকিয়েও তুমি দেখো না।তোমার মত অলস মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি।এরপর থেকে পকেটে থলে( তখনকার দিনে বাজারের ব্যাগকে থলে বলতো কোন কোন পরিবার)ব্যাগ নিয়ে যাবে।
শান্তিদেবী যখন তার স্বামীকে কথাগুলো বলছেন তখন বাইরে কে যেন 'বাবু বাবু' বলে ডাকছে।(পরিচিত সকলেই তাকে বাবু বলেই ডাকতেন। একথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি)বাইরে বেরিয়ে দেখা গেলো একজন অপর রিক্সা চালক তার গামছায় পুঁটুলি করে বেঁধে কিছু তরকারি নিয়ে এসে শান্তিদেবীর হাতে দিয়ে বলছে,
--- সমস্ত রাস্তায় তরকারি পরে থাকতে দেখে আমি বুঝতে পেরেছি বাবু কোর্ট থেকে ফেরার পথে নিশ্চয় বাজার করে ফিরছিলেন কিন্তু বাবু তো একটু আত্মভোলা টাইপের মানুষ হয়ত বেখেয়ালেই তার কেনা সমস্ত তরকারি রাস্তায় পড়ে গেছে।
অমরেশবাবু তাকে ভিতরে ডাকলেন।তরকারিগুলো ছাড়াও তাকে কিছু টাকা দিলেন।তার সাথে দীর্ঘক্ষণ গল্প করে জানলেন তার তিনটি ছেলেমেয়ে।পয়সার অভাবে মেয়ে দুটিকে স্কুলে ভর্তি করতে পারেনি।ছেলেটি স্কুলে পড়ছে।অমরেশবাবু সব শুনে সেই মুহূর্তেই তাকে কথা দিলেন তার ছেলেমেয়ের সমস্ত দায়িত্ব তিনি নিলেন।সে যেন মেয়ে দুটিকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়।ওই রিক্সাচালক তখন ঢিপ হয়ে অমরেশবাবুর পায়ের উপর পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
--- আপনি মানুষ না বাবু আপনি ভগবান।আমি সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকবো।
--- আগে ওদের মানুষ করো।বিয়ে থা দিয়ে সংসারী করো পরে এসব কথা বলার সুযোগ পাবে।ছেলেমেয়েদের জন্য যা যা যখন লাগবে তুমি চলে আসবে তোমার বাবুর কাছে।
পরবর্তীতে এই রিক্সাচালক তার মেয়েদুটিকে মাধ্যমিক পাশ করিয়ে তারপর বিয়ে দেয়।তারমধ্যে একটি মেয়ে সামান্য একটি চাকরীও পেয়ে যায়।আর ছেলেটি গ্র্যাজুয়েশন করে একটা প্রাইমারী স্কুলে চাকরি পায়।বলা বাহুল্য সবই কিন্তু অমরেশবাবুর সাহায্যার্থে।মেয়েদের বিয়ের সময়ও তিনি প্রচুর সাহায্য করেন।এরপর থেকেই অমরেশবাবুর অফিস যাওয়ার সময় হলেই তিনি রিক্সা নিয়ে হাজির হতেন।যদিও সে পয়সা (ভাড়া ছিল দশ পয়সা) নিতে চাইতো না কিন্তু কোনদিনও অমরেশবাবু ভাড়া না দিয়ে তার রিক্সা থেকে নামতেন না।মেয়েদের বিয়ে দিয়ে তার জামাইদের নিয়ে এসে তার জীবনের ভগবানকে দেখিয়ে গেছে।ছেলের চাকরি হওয়ার আনন্দে খারোই ভর্তি ( খারোই হচ্ছে বাঁশের তৈরি। বাঁশগুলিকে ছোট ছোট করে কেটে তা দিয়ে বুনতে হত।মাছ কেটে পুকুরে ধোঁয়া ও জল থেকে মাছ মেরে রাখার জন্য এগুলি ব্যবহার করা হত।ফাঁকা ফাঁকা থাকতো সেই হেতু এগুলোর মধ্যে জল থাকতো না।)অমরেশবাবুর প্রিয় কৈ মাছ নিয়ে এসে প্রণাম করে গেছে।যতদিন অমরেশবাবু বেঁচে ছিলেন তার সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলেছে। নাতি,নাতনী হলেও তাদের এনে দেখিয়ে যেত।শুধু মুখেই নয় মনেপ্রাণে সে অমরেশবাবুকে ভগবান বলেই মনে করতো।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment