জীবনের প্রতি বাঁকে (চৌদ্দ পর্ব)
হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে হঠাৎ করেই এক দাঙ্গা শুরু হল।চারিদিকে পরিচিত অনেক মানুষের মৃত্যুর খবর আসতে লাগলো।অমরেশবাবু সারাজীবনই নিরীহ এবং খুবই শান্তি প্রিয় মানুষ।বহু মানুষের সাথে সুসম্পর্ক থাকলেও যেহেতু উকালতি ছিল তার পেশা এবং গ্রামের যে কোন মানুষ বিপদে পড়লেই ঝামেলা, পুলিশ, কোর্ট পর্যন্ত গড়ালেই যে আগে তার কাছে ছুটে আসতো তিনি তার পক্ষ নিয়েই কেস লড়তেন।সে বাদী বা বিবাদী যে কোন পক্ষই হোক না কেন।
উকালতি জীবনে নিজের পক্ষকে জিতিয়ে দেওয়ার তাগিদে প্রত্যেক উকিলই সত্য কে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য - এটাই তাদের কাজ।উকিলদের ( তখনকার দিনে মোক্তারদেরও) প্রফেশনই এটা।যে যত তার কথার মারপ্যাঁচে জজকে বোঝাতে পারবেন তিনিই হবেন জয়ী।
শেখ আহম্মদ আলী খোকনের বিরুদ্ধে একবার একটি কেস তিনি লড়েছিলেন। কেসটি ছিলো এইরূপ - একজন ব্যক্তি তার মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে শহরে এসে কিছু জমি বিক্রি করে সেদিনই তিনি তার মেয়ের বিয়ের গয়না কিনে এবং কিছু ক্যাশ টাকা নিয়ে নৌকা করে তার বাড়ি ফিরছিলেন।সেই সময় নৌকায় ডাকাত পরে।ডাকাতরা নৌকায় উঠেই প্রথমে যে হারিকেন নৌকায় জ্বালানো ছিল সেটি তারা ভেঙ্গে ফেলে।কিন্তু ডাকাতদের তারা চিনতে পারে এবং তাদের নাম উল্লেখ করেই তারা কেস দেয়।সেই কেসে ওই ডাকাতদের মধ্যে খোকনের নামটাও থাকে।আর অমরেশবাবু ছিলেন ওই ডাকাতদের পক্ষের উকিল।
এমতাবস্থায় কেস লড়তে গিয়ে অমরেশবাবু দেখেন ঘটনাটি যে রাত্রে ঘটে বলে অপর পক্ষ দাবী করছে সে রাতটা ছিলো অমাবস্যার রাত।আর ডাকাতরা উঠেই যদি হারিকেন লাঠির আঘাতে ভেঙ্গে ফেলে তাহলে অন্ধকারে ডাকাতদের চেনা সম্ভব নয়।ডাকাতদের মুখ ছিলো কালো কাপড়ে বাঁধা এবং তারা ইশারায় কথা বলছিলো। অপর পক্ষের কথা অনুযায়ী তারা ডাকাতদের চিনেছিল জোছনার আলোতে।
অমাবস্যার রাতে জোছনার আলো! কেসটা অমরেশবাবু জিতেছিলেন।আর এইভাবে খোকনের সাথে তার পরিচয়।অনেক পরে তিনি জেনেছিলেন খোকন ছিল রামচন্দ্রপুর গ্রামের অসহায় মানুষগুলির দীনবন্ধু।গ্রামের যারা মাথা অর্থাৎ মোড়ল টাইপের মানুষেরা এই অসহায় মানুষগুলির প্রতি যে অন্যায় করতো,তাদের জমিতে কাজ করিয়ে পুরো টাকা দিতো না - এইসবের প্রতিবাদ করতো এই খোকন।কিছুতেই তারা খোকন এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে পেরে উঠছিলো না।তাই শেষমেষ খোকন সহ তার এই কাজে সহায়ককারিদের বিরুদ্ধে কেস দেওয়া।আর এখান থেকেই রায় চৌধুরী বাড়ির সাথে খোকনের যোগাযোগ এবং আস্তে আস্তে পরিবারের একজন হয়ে ওঠা।
খোকন অমরেশবাবুকে বাবু এবং শান্তিদেবীকে মা বলে ডাকতো।ছেলেবেলায় বাবা,মাকে হারিয়ে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হয়ে ওঠে।এমনভাবে সে বাবু,মা বলে ডাকতো তাতে যারা তাকে চিনতো না তারা বুঝতেও পারতো না খোকন এ পরিবারের ছেলে নয়।অমরেশবাবু ধর্মের ভেদাভেদ কোনদিনও মানতেন না।তিনি মানুষের মনুষ্যত্ব দেখে তার বিচার করতেন।খোকনের নামাজের সময় হলে যেমন সে বাড়ির যে কোন জায়গায় নামাজ পড়তে পারতো আবার বাড়িতে পুজো পার্বণের দিনে খোকন উপোস থেকে অঞ্জলী দিতো।সে ফুল সে নিজেই মায়ের পায়ের উপর দূর থেকে ছুড়ে ফেলতো।
খোকনের ছিলো সাপে প্রচণ্ড ভয়।রায় চৌধুরী বাড়িতে ঘটা করে মনসা পুজো হত।সেই পুজোতে পুরো গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষজন আসতো।ভীষণ জাগ্রত ছিল এই রায় চৌধুরী বাড়ির মনসা পূজো।গ্রামের বাড়ি-বাগান জঙ্গল চারিপাশে।খোকন যেদিন যেখানেই সাপ দেখতো সেদিনই দুধ আর কাঠালী কলা কিনে এনে মাকে বলতো তার নামে মনসা গাছতলায় পুজো দিয়ে দিতে।খোকন অমরেশবাবুর প্রতিটা মেয়েকেই নিজের দিদি/বোন হিসাবেই দেখতো।শুধু তাই নয় ছোটরা কোন ভুল করলে রীতিমত দাদার মত তাদের শাসন করতো।এতে কিন্তু বাড়ির মালিক কিংবা মালকিন কিছুই মনে করতেন না। তাঁদের সাথে খোকনের যেন এগুলি অলিখিত চুক্তি ছিলো।যেহেতু খোকনের এক দাদা ছাড়া তিনকুলে আর কেউ ছিলো না এবং দাদা ছিলেন বিবাহিত তাই আস্তে আস্তে খোকন সম্পুর্নভাবেই রায় চৌধুরী বাড়ির বাসিন্দা হয়ে ওঠে।তারজন্য আলাদা ঘর তৈরি হয়।সম্পত্তি,জমিজমা এতই ছিলো আর সেইসব জমিতে প্রচুর পরিমাণে ধান ও সবজি চাষ হওয়ার ফলে এরূপ কিছু মানুষের বাসস্থান এই বাড়িতেই হয়ে উঠেছিল।
অমরেশবাবু ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ব্যক্তি আর শান্তিদেবীও ঠিক তাই।ঠিক যেন মানুষের উপকার করার জন্য এই দুটি মানুষ মুখিয়ে থাকতেন।ব্যাপারটা ছিল আগুনের সাথে ঘিয়ের যোগাযোগ।
এভাবে মানুষের উপকার করতে করতে অমরেশবাবু ঠিক করলেন পঞ্চায়েত ইলেকশনে যদি তার স্ত্রীকে দাঁড় করানো যায় আর তিনি যদি জয়লাভ করেন তাহলে আরও অনেক মানুষের উপকারে আসতে পারবেন।শান্তিদেবী ইলেকশনে দাঁড়ালেন। তাঁর প্রতীক ছিলো মাছ।খোকন সহ গ্রামের মানুষ কিছু শ্লোগান তৈরি করলো।"মাছ যায় ভেসে ভেসে,ভোট দেবেন হেসে হেসে", "শান্তিলতাকে দিলে ভোট,শান্তি পাবে গ্রামের লোক"।বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন শান্তিদেবী।
পঞ্চায়েত ইলেকশনে জয়লাভ করার পর প্রথমেই শান্তিদেবী রামকৃষ্ণ আশ্রমের সাহায্যে পাঁচশ শাড়ি গরীব মানুষদের ভিতর বিতরণ করলেন।সবই ব্যবস্থা করেছিলেন অমরেশবাবুই।তারপরের কাজটি ছিল গ্রামের একদম দরিদ্র মানুষদের জন্য পঞ্চায়েত অফিসের পাশেই অস্থায়ী ঘর তৈরি করে সেখানে রান্না করে পরিবারের সদস্যের মাথাপিছু খাবার দেওয়া দুবেলা।এইসব কাজ সম্পূর্ণভাবে খোকন দেখাশুনা করতো।এবং কাজ যাতে সুষ্ঠভাবে হয় অর্থাৎ আদতে দরিদ্র পরিবারগুলি যাতে কোনভাবেই বঞ্চিত না হয় তার সবকিছুই তদারকিতে ছিল খোকন।
সব জায়গাতেই ভালোমন্দ সব রকম মানুষই বাস করে।এই কাজে নানানভাবে নানান দিক থেকে অর্থ সাহায্য আসতে থাকায় কিছু মানুষ সেই অর্থ নিজেদের কবলে নেওয়ার জন্য খোকনকে প্রস্তাব দিলো।খোকন তা অস্বীকার করে।শুরু হয় তাদের সাথে খোকনের শত্রুতা।নানানভাবে খোকনকে ভয় দেখাতে শুরু করে।কিন্তু খোকন অদ্ভুতভাবে সব কথা তার বাবু,মায়ের কাছে গোপন করে যায়।(পড়ে সে জানিয়েছিল বাবু,মাকে চিন্তায় ফেলতে চায়নি) এ সবকিছুর ফলস্বরূপ একদিন রাতে খোকন গ্রামের অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যখন বাড়ি ফিরছে তখন কিছু লোক তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে পরনের লুঙ্গি খুলে পা দুটিকে শক্ত করে বেঁধে ফাঁকা মাঠের ভিতর টেনে নিয়ে গিয়ে আধমরা করে রেখে পালিয়ে যায়।হয়ত তারা ভেবেছিলো খোকন মারাই গেছে।সারাটা রাত মাঠের ভিতর পরে থাকে খোকন।সকালে কিছু মানুষ তাকে মাঠের ভিতর দেখতে পেয়ে অমরেশবাবুর বাড়িতে খবর দেয়।তড়িঘড়ি তাকে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।বেশ কয়েকদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাকে থাকতে হয়।তারপর সুস্থ্য হয়ে বাড়িতে ফিরেই সে দ্বিগুণ কর্মক্ষমতায় কাজ শুরু করে।তখন সে যেন খোচা খাওয়া বাঘ।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment