মানুষের জীবনে পারিপার্শ্বিক নানান ঘটনা অপরের কাছ থেকে বহু দূরে সরিয়ে দেয়।ইচ্ছা বা অনিচ্ছা যায় হোকনা কেন মানুষ চাইলেও আগের মত আর সময় দিতে পারেনা তার কাছের মানুষগুলোকে।মানুষের একটু একটু করে বয়স বাড়ে আর তার চারিপাশের গণ্ডিটা বড় হতে থাকে।একে অপরকে অভিযোগ করি যোগাযোগ রাখে না বলে।কিন্তু নিজেরা কখনোই ভেবে দেখিনা আমিও আর সেই আগের মত নেই।
আকাশ তার রাজনীতির জীবন,সমাজ সেবা আর মেধাবী গরীব মানুষগুলিকে দাঁড় করানোর স্বপ্নে বিভোর।পারিবারিক নানান ঘাত প্রতিঘাত নিয়ে জর্জরিত।তার দাদা অনল ভালোবাসলো নীচু ঘরের (??)একটি মেয়েকে।মেয়েটি পেশায় নার্স।আকাশের অসুস্থ্যতার সময়ে হাসপাতালে যাতায়াতের সূত্র ধরে তার সাথে পরিচয়। অনল তখন সবে চাকরি পেয়েছে।মেয়েটি আকাশকে জানালো যে সে তার দাদাকে ভালোবাসে। তাছাড়াও একই পাড়ায় ছিল উভয়ের বাড়ি।অনল মেয়েটিকে জানিয়ে দিল তার ছোটভাই চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত সে গোপাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কিছু জানাতে পারবে না।বাড়িতে বাবা,মা জেনে গেলেন।শুরু হল চরম অশান্তি।তখন অবশ্য ছন্দার বিয়ে হয়নি।এবং ঘটনাক্রমে সে তখন আগরতলায় ছিল।বন্ধুত্ব হয়ে গেলো ছন্দার সাথে গোপার।সমস্ত ঘটনায় গোপা ছন্দাকে জানালো।দেখালো অজস্র চিঠি।ওই বয়সেই দিদি,ভগ্নিপতিকে বোঝানোর চেষ্টা করলো ছন্দা।তারা ফুৎকারে সবকিছু উড়িয়ে দিলেন।সরল,নরম মনের ছেলে অনল বেশ কয়েকবার সুইসাইড করতে গেলো।কিন্তু প্রতিবারই সেই সময় কেউ না কেউ দেখে ফেলে তাকে সে পথ থেকে সরিয়ে আনলো।
খুব তাড়াহুড়ো করে যেমন তেমন একটি মেয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক করলো তার বাবা,মা।ভেঙ্গে গেলো দুটি হৃদয়ের স্বপ্ন শুধুমাত্র গোপা ব্রাহ্মণ নয় বলে। অনলের বিয়ের পাঁচ বছর বাদে আমেরিকাপ্রবাসী একটি ছেলের সাথে গোপার বিয়ে হয়।
নানান ঝামেলা ঝক্কি প্রতিটা পরিবারকেই পোহাতে হয়। আস্তে আস্তে ঝড় থেমেও যায়।সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
দীর্ঘ পনের বছর আকাশের সাথে কলকাতার কারো কোনোই যোগাযোগ ছিল না।মাঝেমধ্যে ফোনে কেউ কখনো হয়ত কারো খবর নিয়েছে।পনের বছর বাদে হঠাৎ একটি ফোন মারফৎ জানতে পারে ছন্দারা আকাশের এক বিশাল অক্সিডেন্ট হয়েছে।কোমরের হাড় সব গুড়ো গুড়ো। কিডনীর ঠিক ছ'ইঞ্চির নীচ থেকে সমস্ত হাড় ভেঙ্গে চৌচির।আটচল্লিশ ঘণ্টা সে অজ্ঞান। কান,নাক,মুখ এবং ক্ষতস্থান থেকে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে অনবরত।ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।আগরতলায় উন্নতমানের চিকিৎসা না থাকায় তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাক্তার সমেত তাকে স্ট্রেচারে উঠিয়ে প্লেনে করে কলকাতা নিয়ে আসবে।সেইমত নখানা ছিটের জায়গা লাগে আকাশের।সাথে বাকি আরও অনেকেই।প্রচুর অর্থব্যয়ে আকাশকে ডক্টর সমেত কলকাতা আনা হয়।তখন অবশ্য তার জ্ঞান ফিরেছে এবং ব্লিডিংও বন্ধ হয়েছে।ছুটে গেলো তার সমস্ত মাসতুত ভাইবোন, মামা, মাসিরা, মেসোরা।ছন্দার তখন দুই ছেলেমেয়ে।ছেলেটি তখন খুবই ছোট।সেও ছুটে যায়।সবাইকে দেখেই আকাশ খুব কান্নাকাটি করতে লাগে।আকাশের অসীম মানসিক বল, ধর্য্য,কষ্ট সহ্য করার এক প্রবল ক্ষমতা আর ডাক্তারের হাতজশ আকাশ ফিরে পেলো নবজন্ম।
হাসপাতাল থেকে ফিরে এলো সে ছন্দার বাড়িতে।তারপর থেকে বছরে তিন থেকে চারমাস সে কলকাতা আসতো এবং সমস্ত কলকাতা জুড়ে এত আত্মীয়-স্বজন থাকার পরেও সে এসে থাকতো তার ছোটমাসীর বাড়িতেই।ভুলে যাওয়া বা থিতিয়ে যাওয়া সেই নোংরা কথাগুলি আবার শুরু করে সকলেই।
ছন্দার ছেলেমেয়ে তখন বড় হয়েছে।তাদের কানেও কথা যাচ্ছে।স্বামীর কানেও কথা তুলছে সকলে।ছন্দার স্বামী এমনই একটি মানুষ ছিলেন যিনি তার স্ত্রীকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করতেন।তিনি ছন্দাকে জানিয়ে দিলেন,
--- আরে এটা হচ্ছে ভারতবর্ষ। বাঙ্গালী সমাজ।এখানে একটা পুরুষ আর একটা নারীর সম্পর্ককে সকলেই মনে করে তাদের মধ্যে রয়েছে যৌণ সম্পর্ক।এর বাইরে বাঙ্গালীরা আর অন্যকিছু ভাবতেই পারে না।এই সমাজটা এতটাই নোংরা যে এরা বিধবা মেয়ে যদি বাবার কাছে থাকে বা মেয়ের বয়স হয়ে গেলে তার যদি ঠিক সময়ে বিয়ে বাবা না দেয়,ছেলে যদি বিয়ে না করে মাকে নিয়ে থাকে - এইসব মানুষরা তাদের নিয়েও কথা বলতে ছাড়েনা।এসব নিয়ে ভেবো না।কেউ তো তোমায় খাওয়ায় পড়ায় না।সুতরাং এসব নিয়ে মন খারাপ করনা।যেমন আছো তেমন থাকো।সকলের কথা শুনে চলতে গেলে মানুষের সাথে কোন সম্পর্ক রাখায় কঠিন হয়ে পড়বে।আমি তোমায় বিশ্বাস করি।কে কি বলল তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে মানসিক শান্তি নষ্ট কোরো না।
এমন একটা মানুষ ছিলো ছন্দার স্বামী। পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয়-স্বজন সকলেই তাকে খুব ভালোবাসত। কারো বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা,ঝগড়া-বিবাদ কোনদিন সে করেনি।
হঠাৎ করেই ধরা পড়ে আকাশের সুগার।অবিবাহিত আকাশ সারাজীবন নিজের কষ্ট চেপে রেখে অন্যের জন্য করে গেছে।বৃদ্ধা মা তার বাবাকে নিয়েই থাকতেন বেশি ব্যস্ত।অন্য ভায়েরা সবাই বিবাহিত।সুতরাং আকাশের দেখভাল করার মত পরিবারে কেউই তখন নেই।অবহেলা,অযত্নে তার দিন চলতে থাকে।আর ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে তারা যে বাবা,মায়ের বাধ্য হয়ে থাকবে তা সবসময় হয়না।স্বাধীনচেতা আকাশ তার শরীরের কষ্টটাও অন্যকে জানিয়ে তাকে বিব্রত করতে চায়নি।কিন্তু যখন তার ভায়েরা জেনেছে তখন কিন্তু তারা আকাশের চিকিৎসার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি।কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কলকাতা,ভেলোর,চেন্নাই,হায়দ্রাবাদ কোথাও বাদ দেয়নি তার ভায়েরা।সুগারের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেলো যে সে মারাত্মকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়ল।শুরু হল তার ডায়ালিসিস।অধিকাংশ সময়েই কিন্তু সে তার প্রিয় মাসীর বাড়িতেই থেকে ট্রিটমেন্ট করতো। কিডনী ট্রান্সপ্লান্টও করা হল প্রচুর অর্থব্যয়ে।একটা বছর সুস্থ্য ছিল তারপর।যতবার চেকআপে এসেছে ততবারই সে ছন্দার বাড়িতেই উঠেছে।কথা আগেও হত অসুস্থ্য থাকাকালীন সময়েও তা বন্ধ হয়নি।
হঠাৎ করেই ন'বছর আগের ঘটে যাওয়া অক্সিডেন্টের কারণে কিডনীর ঠিক নীচু থেকে এক যন্ত্রণা শুরু হয়।তড়িঘড়ি বাড়ির লোকেরা তাকে নিয়ে পুনরায় কলকাতা আসে।জ্ঞান থাকলেও বসার ক্ষমতা তার ছিলনা।ডাক্তারের কথানুযায়ী সেই অক্সিডেন্টের ফলে যে অপারেশন হয়েছিল সেখান থেকেই কিছু হওয়ার ফলে ওই ব্যথা এবং বসতে না পারা।সঠিকভাবে কোন ডাক্তারই তার এই রোগের লক্ষন ধরতে পারেননি।এক একবার তারা এক এক রকম বলেছেন।কখনো বলেছেন হাড়ের জয়েন্ট থেকে হাড় সরে গিয়ে রক্তের সাথে মিশে গিয়ে সেপটিসিমিয়া হয়ে গেছে।আবার হেপাটাইটিস বি ধরা পড়েছে।তার বাড়ির লোকের কোন কার্পণ্য ছিলনা তাকে সুস্থ্য করে তোলার জন্য।কিন্তু বিধাতা যে তাকে ওইটুকুই আয়ু দিয়ে পাঠিয়েছিলেন।
আকাশের মৃত্যুর দিন অনেকেই হাসপাতাল থাকলেও ছন্দা সেদিন যেতে পেরেছিলো না।সে যখন ভুল বকছিলো নার্স এসে তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন,
--- কি বলছেন?
--- আমি তো ফোনে কথা বলছি।
--- কার সাথে কথা বলছেন?
--- আমার ছোটমাসীর সাথে।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment