Friday, November 26, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (সাতাশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (সাতাশ পর্ব)
  আমাদের বাঙ্গালী সমাজটা খুব নোংরা।ভালো চোখে কেউ কিছু দেখতে পারে না।তারা কিছুতেই একটা পুরুষ এবং একটা নারীর বন্ধুত্বকে মেনে নিতে পারেনা।অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের দৃষ্টি শক্তি এতটাই নিম্নমানের হয় তারা রক্তের সম্পর্কের মাঝেও খারাপ কিছু দেখতে পায়।এইসব মানুষরা 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ -' তারিয়েই যেন জীবনে সুখ খুঁজে পায়।
 আকাশ ৮৫ সালে পাটনা পড়তে যায়।ছুটি পেলেই সে মামাবাড়ি চলে আসে। মামা,তার এই ছোটমসি,সায়নীর ছেলে রামা আর তন্দ্রা অর্থাৎ খুকু তাদের একটা দল।সব সময় চলছে ঝগড়া-ঝাটি,চেঁচামেচি আর হাহা হিহি।আকাশ যখন কলকাতা থাকতো তখন বিকেল হলেই ছন্দা আর সে দুজনে মিলে চলে যেত এগরোল খেতে। রোজ রোজ এই এগরোল খাওয়ার ফলে ছন্দার প্রচণ্ড এসিড হত।মনোতোষ দুজনকে একদিন এমন বকলো যে তারা সারা জীবনের জন্য  এগরোল খাওয়া ভুলেই গেলো।আসলে মনতোষ তার ভালোবাসা,আদর দিয়ে রায় চৌধুরী পরিবারের সকলের শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছিল।
 এরই মধ্যে একদিন আগরতলা থেকে লক্ষীর বড় ছেলে অনল আসলো কলকাতা ডাক্তার দেখাতে।যেদিন অনল আসলো তার পরদিন ছন্দা আর আকাশের স্টারে থিয়েটার দেখতে যাওয়ার কথা।যা বাড়িতে একমাত্র অমরেশবাবু ছাড়া আর কেউই জানতেন না।কিন্তু ছন্দার ভাই কিভাবে যেন টের পেয়ে গেলো আকাশরা থিয়েটার দেখতে যাচ্ছে।বাড়ি থেকে চারজন বেরোলো ভিন্ন সময়ে। অনল আর প্রণয় একদলে অন্যদলে ছন্দা ও আকাশ।বিরতিতে হলের ভিতর দুই পক্ষর দেখা।
 এইভাবে জীবনের অনেকটা সময় হাসি,আনন্দ মান অভিমানে কেটে গেছে।কি সুন্দর দিনগুলি সব ছিল কল্পনারও বাইরে আজ।একসাথে সিনেমা দেখা,ভিক্টোরিয়ায় ঘোরা।কিন্তু সব সময়ের জন্যই রক্তের সম্পর্কটা মনে রেখে।ছন্দা এবং আকাশের মধ্যে চীনের প্রাচীর হয়ে সব সময় দাঁড়িয়ে ছিল ওই রক্তের সম্পর্ক।তারা সেটা মনে রাখলেও আত্মীয় স্বজনরা কিন্তু দুকথা থেকে শুরু করে পাঁচ কথা বলতে ছাড়তো না।সব কথায় একদিন কানে গেলো দুজনের।এদিকে পাটনায় পাঁচ বছরের কম্পিউটার ট্রেনিংও শেষ।চলে গেলো আকাশ তার নিজবাড়ি আগরতলায়।মাঝেমধ্যে চিঠি আদানপ্রদান চললেও আস্তে আস্তে সেগুলিও কমতে থাকে শুধুমাত্র সকলের কাছে প্রমাণ করতে 'এই সম্পর্কের মধ্যে কোন কালিমা ছিলনা।তোমরা নিজেরাই একে কালিমালিপ্ত করেছো।' 
 ছন্দার বিয়ে ঠিক হল। রাজ্য সকারের অধীনে কর্মরত একটি অতি সাধারণ পরিবারে।বারবার বলা সত্ত্বেও আকাশ তার মাসীর বিয়েতে এলোনা।
 এর ঠিক তিনমাস আগেই বিয়ে হয় ছন্দার দিদি তন্দ্রা বা খুকুর।কিন্তু বিয়ে ঠিক হয় ছন্দার আগে।ভারতী তখন ঠিক করে যেহেতু ছন্দা ছোট তাই তার আগেই সে তন্দ্রার বিয়ে দেবে যাতে তন্দ্রার ছোটবোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে মনে কোন কষ্ট না থাকে।তিনমাসের অক্লান্ত চেষ্টায় ছেলেও পেয়ে যায় এবং বিয়ে হয়েও হয়ে যায়।বৈশাখে তন্দ্রার বিয়ে হয় আর আষাঢ় এ ছন্দার।পুরো দুটো বিয়ের খরচই কিন্তু ভারতীর।কারণ একমাত্র সেই এই এতগুলি অবিবাহিত বোনদের পড়াশুনা আর বিয়ের দায়িত্ব পালন করেছে।সাথে ভায়েরও।অমরেশবাবু তার আগেই গত হয়েছেন।আর যে বোনেরা চাকরি করতো তাদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার ফলে বোনদের বিয়েতে গিফট দেওয়া ছাড়া আর কোন দায়িত্ব তারা পালন করেনি।
  ছন্দার তখন বিয়ে করার মোটেই ইচ্ছা নয়।সে চাকরি করতে চায়।অমরেশবাবুর মৃত্যুর পর অনিচ্ছাতে ছন্দাকে আর্টস নিয়ে পড়তে হয়।কারণ প্রণয় আর ছন্দা দুজনকে সায়েন্স পড়ানোর মত ক্ষমতা ভারতীর ছিল না।এখানেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় ছন্দা।সারাজীবন সায়েন্সের বিষয়গুলি পড়তে ভালো লাগা ছন্দা আর্টসের বিষয় মাথায় ঢোকাতে পারেনা।তখন রেজাল্টও তার খারাপ হতে থাকে।দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালিন হঠাৎ করেই দিদি তার বিয়ে ঠিক করে। পাত্রপক্ষ দেখতে আসে।ছন্দা দিদিকে অনেক করে বুঝিয়েছিল যাতে অন্তত তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা পর্যন্ত যেন তাকে সুযোগ দেওয়া হয়।কিন্তু বাবুর মৃত্যু ভারতীর কাঁধের উপর এতগুলি বোনদের পাত্রস্ত করার দায়িত্ব এসে পড়ায় সেও চারিদিক অন্ধকার দেখতে শুরু করে।তবে একথা স্বীকার করতেই হয় কোন বোনদের বা ভাইকে সে কোনদিন কোন অবহেলা করেনি।সবাইকেই সে নিজ সন্তানের মত ভালোবাসতো এবং আজও বাসে।নিজের পুরো জীবনটাই সে বাবুর অবর্তমানে তারই সংসারটা আগলে গেছে।পারেনি এই বোনদের এবং ভায়ের জন্য নিজ সংসারী হতে।ছন্দা বিয়ের পর তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে।
  পাত্রপক্ষ যখন ছন্দাকে দেখতে আসে আর এখন বিয়েতে মত না থাকায় ছন্দা অন্য দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে স্বপ্নার বাড়িতে ওঠে।ছন্দাকে ঘরে খুঁজে না পেয়ে ভারতী বুঝতে পারে সে স্বপ্নার বাড়ি গিয়ে বসে আছে।ভাই প্রণয়কে একটা চিঠি লিখে সাইকেলে পাঠিয়ে দেয় অন্তত এসে যেন সে পাত্রপক্ষের সামনে বসে।তানাহলে তার সম্মানহানি হবে।চিঠিতে এও লেখে সে ছন্দার আপত্তি থাকলে সে এখানে তাকে বিয়ে দেবে না।ছন্দা ভায়ের সাইকেলে করে ফিরে আসে এবং পাত্রপক্ষের সামনে বসে।কপাল এমন তারা মেয়ে দেখে পছন্দ করে।
 ভারতী ঘটক মারফৎ খবর পাঠায় এই মুহূর্তে তারা ছন্দার বিয়ে দেবে না তার বড়বোন তন্দ্রার বিয়ে না দিয়ে।তারা ঘটককে দিয়ে খবর পাঠায় যতদিন না ছন্দার দিদির বিয়ে হচ্ছে ততদিন তারা অপেক্ষা করবে।ভারতী কম করে ছ'মাস সময় চায়।তাই ছন্দার বিয়েটা ঠিক হওয়ার পরেও ছ'মাস দেরি হয়।
 একসময় ছন্দা যখন প্রবল আপত্তি করছে সেই মুহূর্তে বিয়ে করবে না বলে তখন ভারতী তার কাছে জানতে চায়,
--- কেমন ছেলে তোর পছন্দ?
--- আমার বিয়ে যদি দিতেই হয় তাহলে একটা সরকারি চাকরি করা ছেলের সাথে বিয়ে দিবি।
--- ঠিক আছে।আর কিছু?
---  তার চেহারা,বাড়ি,গাড়ি কিচ্ছু দেখার দরকার নেই।শুধু একটাই দাবি ছেলেটি যাতে সৎ হয়।
  ভারতী সত্যিই ছন্দার দাবিগুলো মেনে নিয়ে ঠিক সেইরূপ একটি ছেলের সাথেই তার বিবাহ দিয়েছিল।এখানে বলা ভালো ছন্দার দাবি অনুযায়ী যে ছেলেটার সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছিল তাকে যেন ছন্দার দাবি অনুযায়ী তৈরি করেই ঈশ্বর পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন।বিমান সরকারি চাকুরে,অতি সাধারণ পরিবার। চার ভায়ের মধ্যে সেই বড়।বাবার অবর্তমানে পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার মাথার উপর।নিজেদের বাড়ি।মায়ের সাথে চার ছেলের সুখের সংসার।
 ছন্দার বিয়ের দু'বছর পর সে যখন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট তখন আকাশ আসে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে।এসেই মামা প্রণয়কে নিয়ে ছোটে তার মাসীর বাড়ি।কিছুক্ষনের মধ্যেই মেসোর সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।আসলে আকাশ এমন একটা ছেলে ছিল তার সাথে সেভাবে না মিশলে তার মনটা ঠিক সকলে বুঝতে পারবে না।বাইরেটা তার মস্তবড় এক কঠিন আবরণে ঢাকা হলেও ভিতরটা তার শিশুর মত নরম।সেদিন চলে গেলেও ডাক্তার দেখিয়ে আগরতলা চলে যাওয়ার আগে মেসোর সাথে অফিসে দেখা করে গেছিলো।ছন্দার বিয়ের পর থেকে ছন্দার চাইতেও যেন মেসো তার বেশি আপন হয়ে উঠেছিল।

ক্রমশঃ
 

No comments:

Post a Comment