Sunday, November 28, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (ঊনত্রিশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (ঊনত্রিশ পর্ব)
  ছন্দার বিয়ের দুবছরের মাথায় তার প্রথম সন্তান মৌ তার কোল জুড়ে আসে। চার পুরুষ পর বংশে কন্যা সন্তান।স্বভাবতই বাড়ির সকলে খুব খুশি।সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছন্দার স্বামী। ছ'জনের দায়িত্ব তার মাথার উপর।অভাব নিত্যসঙ্গী।যে ছন্দা জন্মের পর থেকে অভাব কি জিনিষ জানতো না বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে ঢুকে সে বুঝতে পারে অভাব কি!
 শ্বাশুড়ী এবং তার দেওরেরা এক কথায় বলতে গেলে বলা যায় তারা খুবই ভালো।কিন্তু কিছু আত্মীয় তাদের খুব ভালো চাইতে দিতে লাগলো তাদের কানে কুমন্ত্রণা।আর তার জের পড়তে লাগলো ছন্দার উপর।টুকটাক ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা ঝক্কি পোহাতে পোহাতে একসময় বাধ্য হয়ে ছন্দা চলে আসে তার বাপের বাড়িতে।
  আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়।ছন্দা তার সমস্ত গয়না বিক্রি করে সামান্য একটুখানি জমি কিনে বাড়ি করে সেখানে চলে যায়।মেয়ের জন্মের ন'বছর পর ছন্দার একটি পুত্রসন্তান হয়।
 হঠাৎ করেই ছন্দার স্বামীর এজমা ধরা পরে।যে বাড়িটা ছন্দা করেছিলো সেটা ছিল একটু গ্রামের দিকে।ফলে ফাঁকা জমি ছিলো প্রচুর।ঠান্ডার সময় ঠান্ডা একদম দার্জিলিংয়ের মত।অফিসে যাতায়াতের অসুবিধা।ছন্দা সিদ্ধান্ত নেয় ওই বাড়ি বিক্রি করে সে কলকাতার দিকে বাড়ি করবে।
 ছন্দা তার জীবনে এমন একজন স্বামী পেয়েছিলো যে ছন্দার কোন কাজকেই বাঁধা দিত না। স্বামীর কাছে কোন পরামর্শ চাইলে সে বলতো,
--- তুমি যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করো।আমি তোমার সাথে আছি।
 ছেলের বয়স যখন পনের আর মেয়ের কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে বিমান তখন অবসর নেয়।অবসর নেওয়ার পরের মাসেই প্রচন্ডভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে বিমান।ডাক্তার জানিয়ে দেন বাঁচার আশা ক্ষীণ।তবুও ছন্দা এবং তার ছেলেমেয়ে,জামাই,ভায়েরা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাহায্যে এক নার্সিংহোম থেকে আর এক নার্সিংহোম করে বেড়ায়।বিমান চলে যায় ভেন্টিলেশনে।
 জীবনে অনেক কিছুরই মীরাক্কেল ঘটে।টানা সতেরদিন ভেন্টিলেশনে থাকার পরে বিমান আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে ওঠে।প্রথম দিকে তাকে নানান নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়।লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হওয়ার পর যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তখন তৎকালীন কলকাতা মেয়রের সাহায্যে পিজি হাসপাতালের আইসিসিইউ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করা হয়। ডাক্তারের হাত যশে এবং ভগবানের অশেষ কৃপায় বিমান সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফেরে।
 একবছর পড়ে সেই আবার তাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি।কিন্তু এবারে ঈশ্বর মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।এবারের সব চেষ্টা অর্থ দণ্ড সবই বিফলে গেলো।ফিরলো না সে।চলে গেলো চিরতরে।মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও ছেলে তখন সবে একাদশ শ্রেণী।এখন সে বিটেক পড়ছে।ছন্দা হয়ে গেলো সারাজীবনের মত একা।সময় কাটাতে ছেলেবেলার অভ্যাসকে জড়িয়ে ধরলো।শুরু করলো আবার লেখালেখি।সকাল হলেই মা ছেলের জন্য দুটি রান্না করেই সে ছুটে যায় তার ছাদ বাগানে।যেখানে দিনের অনেকটা সময় সে মনের খুশিতে কাটিয়ে দেয়।প্রতিটা গাছের পাতা,ফুল,কুড়ি তার সাথে কথা বলে।ছন্দা রোজ একটু একটু করে তাদের বেড়ে ওঠা দেখে। গাছে ফুটে থাকা ফুলগুলি ক্ষণিকের জন্য হলেও ছন্দার মনের সব কষ্ট ভুলিয়ে মন খুশিতে ভরিয়ে দেয়।
  আজকাল ভার্চুয়াল জগতের সূত্র ধরে সে বাইরে গড়ে তুলেছে একটি নিজের জগৎ।বেশ কয়েকটি বইও তার বেরিয়েছে।নেই নেই করে অনেক মানুষই আজ তাকে চেনে।নিঃসঙ্গ জীবনে লেখালেখির সূত্র ধরে পরিচয় হয়েছে তার আজ বহু মানুষের সাথে।মাঝে মধ্যে মেয়ে জামাইয়ের পাল্লায় পরে ছেলেকে সাথে নিয়ে ভারতবর্ষের নানান প্রান্তে তারা ঘুরে বেড়ায়।কিন্তু মাঝে মাঝে একাকী ঘরের কোনে প্রিয় মানুষটির জন্য আজও তার চোখে জল ঝরে।আসলে আমাদের জীবনের ফেলে আসা অতীত কখনোই আমাদের পিছু ছাড়েনা।
 সেই অতীত যে অতীত এক সময়ে আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দ দিয়েছে,খুশি দিয়েছে।মজা করে সময় কাটানোর সুযোগ দিয়েছে।আমৃত্যু আমরা কেউই সেই অতীতকে ভুলতে পারিনা।অতীত যেন আমাদের শরীরের সাথে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।আমরা কেউই শত চেষ্টা করেও অতীতকে আমাদের মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনা।
 অতীত ফিরে আসে বারবার আমাদের সামনে যখন সে আমাদের একা পায়।এই অতীত অনেক সময় আমাদের নিসঙ্গতাকে সঙ্গী দিতে আসে। লোকালয়কে অতীত ভয় পায়। কারো পদশব্দ বা কারো আগমনে যেভাবে সে চুপিচুপি আসে ঠিক সেইভাবেই সে পালিয়ে যায়।একাকী হলেই ছেলেবেলা,কৈশোর,যৌবন,মধ্য বয়স - সব যেন চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে।সব সময় অতীত যে আমাদের শুধু কষ্ট দেয় তা কিন্তু মোটেই নয়।অনেক হাসি,মজা,আনন্দের অতীত আজও আমাদের মনে পড়লে আমরা মজা পাই।ছেলেবেলার কোন বন্ধুর সাথে দেখা হলে অতীতের সেই গল্পগুলিই বারবার আমরা আলোচনা করি আর তার থেকে মজার রস আজও সংগ্রহ করে থাকি।দুঃখের অতীতকে আমরা ভুলতে চাইলেও মজা বা আনন্দের অতীতকে কিন্তু আমরা সকলে জড়িয়ে থাকতে চাই।
 পঞ্চাশ পেরোনো ছন্দার জীবনে এখন একটাই স্বপ্ন ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করা।মেয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে সুখেই আছে।মেয়েটি তার গাছ পাগল,ধর্মভীরু আর ভালোবাসে সে তার মায়েরই মত নানান ধরনের রান্নার এক্সপেরিমেন্ট।
 জীবন থেকে অনেকটা সময় হারিয়ে গেছে।শুধু সময় নয় হারিয়েছে সব থেকে কাছের প্রিয় মানুষগুলিও।প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী হঠাৎ হারানোর ব্যথা মানুষকে কিছুটা সময় থমকে দেয়।ঠিক যেমন কালবৈশাখী ঝড়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়।কিন্তু মানব জীবন গড়ে দেওয়ার সব থেকে ভালো ওষুধ হচ্ছে সময়।আর সেই সময়ের সাথে সাথে আসে নানান দিক।জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে মানুষ বেছে নেয় তার উপযুক্ত একটি দিক।যেদিকে সে খুঁজে পায় তার আনন্দ এবং সময় কাটানোর এক অনাবিল সুযোগ।
 সরকারি চাকুরী করা স্বামীর পেনশন,বাড়িভাড়া আজ মা ছেলের সামনের দিকে এগিয়ে চলতে আর্থিক অসুবিধা না থাকলেও মাথার উপর যে বটগাছটা চিরতরে হারিয়ে গেছে যার ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে ছন্দা ছাড়াও তার ছেলেমেয়ে সেই অভাব ছন্দা হয়ত কোনদিনও ঘোচাতে পারবে না।কিন্তু সে যতদিন বেঁচে আছে সে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তার সন্তানদের পিতৃশোক ভুলিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে।কিন্তু এ শোক কেউ কোনদিনও ভুলতে পারেনা।তবুও মা হিসাবে ছন্দা সে চেষ্টা করে যাবে।
 ২০১৭ সালে ছন্দা হারিয়েছে তার একান্ত প্রিয় কাছের মানুষটিকে।কিন্তু কাঁদার সময়টুকুও সে পায়নি।পনের বছরের ছেলে সেই মুহূর্তে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছে পিজির উদ্দেশ্যে।শোক ভুলে ছেলের জন্য টেনশনে তার সময় কেটেছে।মেয়ে ঘরের ভিতর বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কাটা কইমাছের মত ছটফট করছে।তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আর একহাতে ফোনে নিজেই তার স্বামীর মৃত্যু খবর জানাচ্ছে আত্মীয়দের।কতটা শক্তমনের মানুষ হলে এগুলো করা যায়!নাকি ছন্দা সেই সময়ে পাথর হয়ে গেছিলো।এই সতের সাল কেড়ে নিয়েছে ছন্দার আর এক খুব কাছের প্রিয় মানুষকে।হারিয়ে গেছেন ছন্দার জীবন থেকে তার মা শান্তিলতাদেবী।এই সাল কেড়েছে পিতৃসম তার বড় ভগ্নিপতিকে।আর আঠারো সালের শুরুতেই কেড়েছে তার জীবনের সব থেকে ভালো বন্ধু আকাশকে।
 জীবন কিন্তু থেমে থাকেনা।সে এগিয়ে চলেছে তার নিয়ম মেনেই।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment