Thursday, November 4, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (এগারো পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে ( এগারো পর্ব)
   জীবন কারো থেমে থাকে না।জীবন এগিয়েই চলে।তাই জীবন নামক উপন্যাসের যবনিকা তার মৃত্যুতেই আসে।এই উপন্যাসে প্রতিটা চরিত্র অমরেশবাবুকে ঘিরে।অমরেশবাবু ছাড়া বাকি চরিত্রগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে গেলে আসল মানুষটার কথা বলা হয়ে উঠবে না।সায়নী মনোতোষের জীবনকাহিনী তাদের সন্তানদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে।এবার অমরেশবাবুর সেজোমেয়েটির কথা বলবো।
 মনোতোষ সায়নীর কাছে আসার পর থেকে চৌদ্দ বছর বেকার থাকার পর ভারতী চাকরি পায় সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ এর মাধ্যমে।এর আগে এই চৌদ্দ বছর সে পাড়ার একটি স্কুলে মাত্র দেড়শ টাকা বেকার ভাতা পেয়ে দিদি,ভগ্নিপতির আশ্রয়ে থাকতো।এই চাকরি পাওয়ার পরেই সে বাবার সাহায্য নিয়ে সামান্য জমি কিনে একে একে সমস্ত ভাইবোনদের দায়িত্ব নিতে শুরু করে খোদ শহর কলকাতাতেই।তখন অমরেশবাবুর শারীরিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়।ইতিমধ্যে অভয়ানন্দের সাথে মালতীর প্রেমের কথা বাড়ির সকলেই জেনে গেছে। অমরেশবাবুর কানে যখন এ খবর পৌঁছালো তিনি চুপচাপই থাকলেন।কারণ তিনি জানতেন এরূপ একটি খবর ঘরের আনাচেকানাচে সর্বত্র ঘোরাঘুরি করছে।
 অভয়ানন্দ তার বাবার কথামত উকালতি পাশ করলেও সেপথে না হেঁটে ব্যাংকে একটা চাকরি জুঠিয়ে নেয়।একইভাবে ওই চাকরির পরীক্ষায় মালতীও পাশ করে এবং সেও চাকরি পেয়ে যায়।অমরেশবাবু অভয়ানন্দকে এতটাই ভালোবাসতেন যে তিনি যখন বাজার করতেন মাছ,মাংসের হিসাবটা অভয়ানন্দকে ধরেই করতেন।তিনি তাকে প্রথম থেকেই সন্তান স্নেহের চোখেই দেখতেন।চাকরি পাওয়ার পরও দুবেলা মালতীদের বাড়িতে ছিল তার অবাধ যাতায়াত।
 মালতী, অভয়ানন্দের প্রতি তার ভালোবাসার কথা ভগ্নিপতি মনোতোষকে জানালে তিনি অর্থাৎ মনোতোষ কথা দেন বাবু এবং মাকে রাজি করানোর দায়িত্ব তার।এই সময় মনোতোষ কিন্তু কলকাতাবাসী এবং সামান্য জমি কিনে একটা ঘরও তুলেছে।
  অমরেশবাবু তার মেয়ের বিয়ের জন্য অতি সহজেই রাজি হয়ে গেলেন।কিন্তু যেহেতু বিয়ের দু তিন বছর আগে থাকতেই মালতী চাকরি করছে তাই বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটা থেকে শুরু করে সামান্য যে লোক খাওয়ানো হয়েছিল সেই সব ব্যাপারে সমস্ত টাকাপয়সা মালতী নিজেই খরচ করেছিলো।এখানে উল্লেখ্য যে অমরেশবাবুর যে সব মেয়েরা তাদের বিয়ের আগে চাকরি পেয়েছে তিনি তাদের কাছ থেকে কোনদিনও কোন টাকাপয়সা নিতেন না।তারা তাদের ইচ্ছামত তাদের রোজগারের টাকা খরচ করতো।
 মালতীর বিয়ের দিন গ্রামের বাড়ি থেকে তার মা ভ্যান ভর্তি করে চাল, তরকারী আর পুকুরের মাছ ধরে পাঠিয়েছিলেন।আর বিয়ের আগেরদিন অমরেশবাবু অভয়ানন্দকে বাড়িতে ডেকে এনে নিজের বিয়ের আংটিটা হাত থেকে খুলে অভয়ানন্দের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, 
--- মেয়ের বিয়ের সমস্ত দায়িত্বই থাকে মেয়ের বাবা,মায়ের।কিন্তু আমি আমার মেয়েকে উপযুক্ত করে তৈরি করেছি।সে ভালো টাকা এখন রোজগার করে।আর হঠাৎ করে এই বিয়ে ঠিক হওয়াতে আমি সেভাবে কিছুই করে উঠতে পারলাম না।কিন্তু এই আংটিটা আমার খুব প্রিয় এবং এটা আমার বিয়ের আংটি।এটাই আমি তোমায় দিয়ে আশীর্বাদ করলাম।
 অভয়ানন্দ অমরেশবাবুকে ভীষণ ভালোবাসতো এবং শ্রদ্ধা করতো।সে আংটিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে।আংটির উপরে একটা 'A' লেখা দেখে বলে,
--- বাবু,এটাতে তো আপনার নাম লেখা।
--- হ্যাঁ বাবা।তোমার নামও তো A দিয়েই।তাই উপস্থিত মতে এটাই তোমায় দেওয়া শ্রেয় বলে মনে করলাম।আর আমি জানি আমার এই আংটির মর্যাদা একমাত্র তুমিই রাখতে পারবে।
--- কিন্তু বাবু আমি এ আংটি নিতে পারবো না।আমি আপনার এই পরিবারের এ আংটির যোগ্য নই।
--- আমি তোমাকে তোমার সেই ছেলেবেলার থেকেই খুব স্নেহ করি বাবা। হ্যাঁ এটাও ঠিক জামাই হিসাবে কোনদিন কল্পনা করিনি ঠিকই কিন্তু তোমার প্রতি আমার স্নেহ ভালোবাসাটা ছিল সম্পূর্ণ নিস্বার্থ।
 অভয়ানন্দ অমরেশবাবুর হাতটা টেনে নিয়ে আংটিটা পরাতে পরাতে বললো,
--- এই আংটিটা আমায় দিলে আমি যে সাময়িক আনন্দ পাবো তার থেকে এই আংটিটা আঙ্গুলে পরে সেই হাতটা আমার মাথায় রাখলে আমি সব থেকে বেশি আনন্দ পাবো।আর সেই আনন্দের জের আমি আজীবন একটু একটু করে মালাকে সাথে নিয়ে ভোগ করবো।
  না বিয়ের দিন তিনি কন্যা সম্প্রদান করতে যাননি।পারতপক্ষে এই যে তার ন'টি মেয়ে তিনি কোন মেয়েকেই সম্প্রদান করেননি।এই সম্প্রদান ব্যাপারটাই ছিল তাঁর কাছে অপছন্দের।সম্প্রদান কথাটার অর্থ শর্ত ত্যাগ করে কোনকিছু দান।যেটা তাঁর ছিলো ভীষণ অপছন্দের।সন্তানকে শর্ত ত্যাগ করে অন্যের হাতে সমর্পণ - এর ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি।তিনি সব সময় যুক্তি তর্ক দিয়ে অন্যদের বুঝানোর চেষ্টা করেছেন নিজ কন্যাকে শর্ত ত্যাগ করে দান করা যায় না।কারণ সন্তান তার বাবা,মায়ের শরীরেরই অংশ।শরীরের কোন অংশকে কেটে বাদ দিয়ে দিলে তা মৃত্যুরই সামিল হয়। কিন্তু সমাজ এবং বাঙ্গালী কালচারে বিষয়টি থাকার ফলে তিনি তার কন্যাদের বিয়ের সময়ে বিষয়টি থেকে বেরিয়ে আসতেও পারেননি।সম্প্রদান হয়েছে ঠিকই কিন্তু কোন মেয়েকেই তিনি নিজে সম্প্রদান করেননি।
  অমরেশবাবুর বাড়িটি ছিল সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি।একবার তিনি মনস্থির করলেন ঢালাই দেওয়া বাড়ি করবেন।তখনকার দিনে যাকে কোঠাবাড়ি বলতো।ব্যাস যা ভাবা তাই কাজ।বাড়ির লাগোয়া বিশাল জমিতে শ্রমিক এনে ইট পোড়ানো শুরু হল।আর এই ইটের মাটি আসতে লাগলো রায় চৌধুরী বাড়ির ভিটে থেকে।সেখানে লোক লাগানো হল একটি পুকুর কাটার জন্য।এদিকে পুকুর কাটা হচ্ছে আর সেই মাটি এনে ইট তৈরি হচ্ছে।বাড়ির বড় বড় গাছপালা ঝোপজঙ্গল কেটে জ্বালানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।পঞ্চাশ থেকে ষাট জন শ্রমিকের নিত্য দুবেলা পেটপুরে খাওয়ার জন্য গ্রামের গরীব মানুষগুলির সাহায্যে রান্নার ব্যবস্থা থাকছে।এদিকে তার নির্দেশ অনুযায়ী দুপুরের রান্নাটা বেশি পরিমাণেই করা হত।তখন তাঁর বাবা যজ্ঞেশ্বর রায় চৌধুরী বেঁচে।ছেলের এ হেন মনোভাবে তিনি তো বেজায় খুশি।কারণ তিনিও মানুষটা যে এই রকমই।ইট তৈরি হয়ে ঢিপ হতে লাগলো।তখন সবেমাত্র তার বড় মেয়ে ও মেজো মেয়ের জন্ম হয়েছে।উঠোন বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে এনে পুরো ঘিরে দেওয়া হয়েছে যাতে মেয়েরা ওইসব কাজের জায়গায় কোনভাবেই এগিয়ে যেতে না পারে।বাড়িতে রোজই চলছে উৎসবের আয়োজনের মত খাওয়াদাওয়া। ইটের ব্যবস্থা সারা হতেই রাজমিস্ত্রির খোঁজখবর শুরু হল।এই পুকুর কাটা,ইট তৈরি তা পোড়ানো এইসব কিছু করতে সময় লেগে গেলো প্রায় বছর খানেক।এদিকে সে বছর বৃষ্টি না হওয়ায় ফসলের ক্ষতি হল মারত্মক।এমন অনেক বাড়ি আছে গ্রামে যারা অন্যদের ধানিজমি সহ নানান ফসলের জমিতে কাজ করে জীবিকানির্বাহ করতো।বৃষ্টি না হওয়ার কারণে জমির ফসলের ক্ষতি হল প্রচণ্ড।তারা কাজ হারালো।খাদ্যের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলো।
 ফলে দেশে শুরু হল দুর্ভিক্ষ।যজ্ঞেশ্বরবাবু সারাটা দিনই এদিকওদিক ঘুরে বেড়াতেন।নানান জায়গা থেকে নানান খবর সংগ্রহ করে তিনি তার ছেলেকে ডেকে বললেন,
--- শোন ক্ষেতো আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অসহায় এবং দরিদ্র শ্রেণীর।তারা পেট পুরে দুবেলা খেতে পারছে না।আর এ সময়ে আমরা যদি কোঠাবাড়ি তৈরি করি তাহলে আমাদের পরিবারের উপর মানুষের হাই লাগবে।এই মুহূর্তে আমাদের উচিত গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়ানো।তুই তোর এই চিন্তাধারা ত্যাগ কর।আমরা যেটুকু পারি বাপ,বেটা মিলে গ্রামের গরিবগুর্ম লোকগুলোর পাশে থাকি। কাল থেকেই আমরা শুরু করি অন্তত আমাদের গ্রামের মানুষগুলির মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে।তুই কালই রান্নার ঠাকুরের(রাধুনী)খোঁজ কর।দেখি কতদিন তাদের মুখে অন্তত একটু খিচুড়ি তুলে দিতে পারি।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment