জীবনের প্রতি বাঁকে (চব্বিশ পর্ব)
ছন্দা আর তার দেড় বছরের ছোট ভাই একই ক্লাসে ভর্তি হল।ছন্দা তার ভাইকে আগলে রাখে এই বয়সেই মায়ের মত।একদিন অসাবধানতাবশত ভাই তার স্কুলের খোলা ছাদে উঠে গেলো।বাড়িতে যখন সবাই এ খবর জানলো তখন গ্রামের বাড়ি থেকে বাঁশ কেটে এনে পুরো স্কুল ছাদ ব্যারিকেড করা হল।
গ্রামের বাড়ির প্রচুর সম্পত্তি আর ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখভালের অভাবে তাই ঠিক হল ছেলেকে নিয়ে (সাথে দুই মেয়েও - ইরা এবং স্বপ্না কারণ ওদের চাকরি করতে ওখান থেকেই সুবিধা হয়)শান্তিদেবী গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন।ছন্দা নিজেই যেতে চাইলো না কারণ গ্রামের বাড়িতে তখন ইলেকট্রিক ছিলো না।হ্যারিকেনের আলোতে পড়তে হত।আর বর্ষাকালে মাটির রাস্তায় কাদা পায়ে স্কুলে যেতে হত যা ছন্দার একদমই পছন্দ নয়।তাই সে শহরেই থেকে গেলো। শান্তিদেবী পুনরায় ছেলে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান।
ক্লাস ওয়ান থেকে প্রথম হয়ে ক্লাসে উঠলো ছন্দা। ঝড়,জল কোনকিছুতেই ছন্দা স্কুল বন্ধ করে না।প্রতিদিন সে যেভাবেই হোক স্কুলে উপস্থিত হবেই।বছরে দুটো পুরস্কার তার বাঁধা।একটা হল ক্লাসে প্রথম হওয়ার কারণে আর একটা হল নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত হওয়ার কারণে।অসুস্থ্য হলেও ছন্দা স্কুল কামাই করবে না।দু তিন বছরের মধ্যেই পুরো স্কুল শুধুই নয় ছোট্ট শহরটাতে সকলেই জেনে গেলো "এই মেয়েটা কোনদিনও স্কুল কামাই করে না"।প্রথমত অমরেশবাবুর ছোট মেয়ে আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে পুরো বছর ধরে স্কুলে নিয়মিত উপস্থিতি আর মেধাবী হওয়ার কারণ।
সেই ক্লাস ওয়ান থেকেই প্রতিটা ক্লাসে সেই হচ্ছে মনিট্রেস।ক্লাসমেটরাও সকলেই তাকে খুব ভালোবাসে আর তার কথাও শোনে।সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার যেটা সেটা হল সকলেই তার টিফিন ছন্দাকে দিয়েই খেত।তখন ছন্দার পরিস্থিতিটা ছিল এরূপ নিজের জন্য কোন টিফিন সে আনলে সেটা আর তার খাওয়া হত না।তাই সে সব সময়ের জন্যই বাড়ি থেকে টাকা (সে সময়ে পঞ্চাশ পয়সা হলেও বাদাম বা অন্যকিছু হয়ে যেত)নিয়েই আসতো।তাই দিয়ে কিছু কিনে সকলকেই ভাগ করে দিত।বাড়ি থেকে স্কুল খুব একটা দূরত্ব না হলেও রাস্তাটা খুব কম ছিল না।কেউ কেউ আবার ছন্দার সাথে একসাথেই যাবে বলে অনেক আগেই তার বাড়ি চলে আসতো।
নবম শ্রেণী।সুনীল নামে একটি ছেলে ছন্দার পিছনে খুব লাগতো।কিন্তু ছন্দা এসব মোটেই পছন্দ করতো না।সে বেশ কয়েকবার তাকে নিষেধ করেছে।কিন্তু কিছুতেই ছেলেটি তার কথা শুনতো না।এমন কি ছন্দা যখন সন্ধ্যায় স্যারের কাছে পড়তে যেত তখন সে সাইকেল নিয়ে তার পিছু পিছু চলত।একদিন খুব মাথা গরম হয়ে যায় তার।পড়তে যাওয়ার আগেই সে সটান চলে যায় সুনীলের বাড়ি।রীতিমত সুনীলের মাকে গিয়ে শাসিয়ে আসে সুনীলকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য।সুনীল যদি ভবিৎসতে আর তাকে বিরক্ত করে তাহলে সে স্কুলে হেডমাস্টারকে তো জানাবেই উপরন্তু সে তার বাবুকেও বলবে।
সেদিন সুনীলের মা ছন্দার কথা শুনে হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।হয়ত তিনি মনেমনে ভেবেছিলেন মেয়েদের গার্জিয়ানরা আসে তাদের মেয়েদের বিরক্ত করলে সেই ছেলের বাড়িতে।আর এ তো দেখছি সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। এ মেয়ে তো সাংঘাতিক।ভদ্রমহিলা ছন্দার কোন কথার উত্তর দিয়েছিলেন না ঠিকই কিন্তু বয়াম থেকে নারকেল নাড়ু বের করে দিয়ে বলেছিলেন,
--- আমি তোমায় কথা দিচ্ছি আর কোনদিন সুনীল তোমায় বিরক্ত করবে না।কিন্তু মা এইভাবে তুমি কত ছেলের বাবা,মায়ের কাছে যাবে?তুমি দেখতে সুন্দর,পড়াশুনায় ভালো।ছেলেরা তো তোমার পিছনে পিছনে ঘুরঘুর করবেই।তবে তোমার এই সাহসকে আমি সম্মান জানিয়েই বলছি - সব ছেলেরা যেমন ভালো হয় না,ঠিক তেমনি তাদের সব গার্জিয়ানরাও কিন্তু ভালো হয় না।তাই নিজে একটু সতর্ক হয়ে রাস্তায় চলাফেরা কোরো।
না এরপর সুনীল কোনদিন ছন্দাকে বিরক্ত করেনি।সে বছর ফাইনাল পরীক্ষার পর সুনীল অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছিল।পরবর্তীতে সুনীলের সাথে রাস্তায় বহুবার ছন্দার দেখা হয়েছে।সুনীল তাকে প্রতিবারই এড়িয়ে গেছে।সুনীলের প্রতি ছন্দার কোন অনুরাগ না জন্মালেও হঠাৎ রাস্তায় দেখে যখন সুনীল তাকে এড়িয়ে যেত তখন ছন্দার ভিতর অদ্ভুত একটা অপরাধবোধ কাজ করতো কেন সেটা করতো তা ছন্দা কোনদিনও বুঝতে পারেনি।
যারা যে বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী থাকতো তাদের হাতেই থাকতো সে বছরের স্বরসতী পুজোর সব দায়িত্ব।এমনকি স্কুলে স্কুলে গিয়ে নিমন্ত্রণের দায়িত্বও থাকতো।সুনীল যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সেখান থেকে যারা এসেছিল ছন্দার স্কুলে নিমন্ত্রণ করতে তাদের মধ্যে কিন্তু সুনীলও ছিল।কিন্তু সুনীল স্কুলের মধ্যে না ঢুকে বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল।আর ঠিক সেই মুহূর্তে ছন্দা তার বান্ধবীদের সাথে কাছেই এক স্কুলে নিমন্ত্রণ করে যখন ফিরছে তখন স্কুল গেটের কাছেই সুনীলের সাথে দেখা।ছন্দা ইচ্ছা করেই চলার গতিটা একটু শ্লথ করে যাতে তার বন্ধুরা আগে এগিয়ে যায়।বন্ধুরা এগিয়ে গেলে ছন্দা সুনীলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
--- কি এমন করেছি যে তুমি একেবারে এই স্কুলই ছেড়ে দিলে?(তখনকার দিনে কোএডে পড়া অনেক ছেলেমেয়েরা একে অপরকে প্রথম অবস্থায় তুমি বলেই কথা বলতো।তারপর আস্তে আস্তে তুই তে আসতো।সব ক্ষেত্রে যে এটা হত তা কিন্তু নয়)
--- আমিও তো এমন কিছুই করেছিলাম না।কিন্তু তুমি তো আমার বাড়িতেই পৌঁছে গেলে আমায় শায়েস্তা করতে।পুলিশ যখন চোরকে মারে কোনদিন দেখেছো?আমার বাবা আমায় ঠিক চোরের মার মেরেছেন।আমি তো কোনদিন তোমায় কোন অসম্মান করিনি।শুধু তুমি যেখানে যেতে তোমার পিছন পিছন যেতাম।কোনদিন জানতে চেয়েছো কেন যেতাম?
--- কেন যেতে?
--- আজ আর সে কথা বলে কোন লাভ নেই।আর আমি সেকথা বলবোও না আর।তবে তোমার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
ছন্দা কি বুঝলো সেই জানে।সে আর কোন কথা না বলে স্কুলের মধ্যে ঢুকে গেলো।এরপর সুনীলের বাবা বদলী হয়ে যাওয়াতে সুনীলরা যে কোথায় চলে গেলো তা সুনীলের অনেক বন্ধুরাই জানে না আর ছন্দা তো কোন ছার!কিন্তু আজও ছন্দা যখন একা থাকে তখন বসে ভাবে তবে কি ওই বয়সেই সুনীল তাকে ভালোবাসতো?
ছন্দার পড়াশুনার জীবনে কোন কিছুর জন্য তার ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে মনে করলেই সে কিন্তু অবলীলায় সেই সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারতো।তারজন্য যতটা কঠোর হতে হয় সে হত।হয়ত বিধাতা পুরুষ তার এই কঠোরতা দেখে অলক্ষ্যেই হেসেছিলেন।তাই হয়ত পরবর্তীতে ছন্দার জীবনে সবকিছু থাকার পরেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বলতে যা বোঝায় সেইখানে সে কোনদিনও পৌঁছাতে পারেনি।বিধাতা তার ভিতর সবকিছু দিয়েও হঠাৎ করেই যেন সেই সবকিছুই তার জীবন থেকে কেড়ে নিলেন।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment