জীবনের প্রতি বাঁকে (পনের পর্ব)
অমরেশবাবুর ষষ্ঠ মেয়েটি গেছো বাদর টাইপের।পড়াশুনায় খুব একটা মন নেই। পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা আর যেকোন বড় ফলের গাছে উঠে দুই ডালের মাঝখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া তার কাছে কোন ব্যাপারই না।বাড়ির লোক তাকে সারা পাড়াময় খুঁজে কোথাও না পেয়ে যখন হাল ছেড়ে দিত তখন সে জামার ভিতর করে যে গাছে বসে থাকতো সেই গাছের ফল নিয়ে হেলতেদুলতে বাড়ি ফিরে আসতো।
--- কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
--- কেন পেয়ারা গাছে।পেয়ারাগুলো দেখেও বুঝতে পারছো না যে আমি কোথায় ছিলাম?
--- সারা দুপুর না খেয়ে পেয়ারা গাছে বসে ছিলি ?
--- কেন খেয়েছি তো
--- কি খেয়েছিস?
--- পেট ভর্তি করে পেয়ারা খেয়েছি।
এই হল স্বপ্না।রঙ্গিনীবালা অর্থাৎ তাদের ঠাকুমা যখন বেঁচে তখন স্বপ্না অনেক ছোট।বায়না ধরতো ঠাম্মার হাতে খাবে বলে।তখনকার দিনের বিধবা।মাছ,মাংস খান না।ছুঁয়েও দেখেন না।তিনি গামছা পরে স্বপ্নাকে যখন খাওয়াতে যেতেন সে ঠিক সেই মুহূর্তেই উঠোনে থাকা কোন গাছের উপর চড়ে বসতো। ঠাম্মা একগ্রাস তার মুখে দিতেন সে সেটা মুখে নিয়ে আবার গাছে।মুখের খাবার শেষ হলে দ্বিতীয় গ্রাস নিতে পুনরায় গাছ থেকে নেমে আসতো।এই স্বপ্নাকে খাওয়াতে গেলে বাড়িতে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত।
মাধ্যমিক পাশ করে প্রথম ডিভিশনে।(কি করে প্রথম বিভাগে যায় বাড়ির লোক আজও চিন্তা করে কোন সুরাহা করতে পারেনি)শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়।বন্ধুবান্ধব প্রচুর হতে থাকে।আর তাদের সাথে মেলামেশায় কলেজ কেটে সিনেমা দেখার এক প্রবল প্রবণতা দেখা দেয়।পোশাক,আশাকেরও পরিবর্তন আসে।অমরেশবাবু এটাকে ঠিক ভালোভাবে নিতে পারেন না।
খোকন তখন পঞ্চায়েত অফিসে কাজ করছে।তিনি খোকনকে ডেকে বলেন,
--- স্বপ্নার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করো।
--- কিন্তু বাবু ওতো পড়াশুনা করছে।
--- ওর আর পড়াশুনার দরকার নেই।যেটুকু হয়েছে ওই দিয়েই পঞ্চায়েত অফিসে একটা চাকরি পেয়ে যাবে।দেখো তুমি কিছু করতে পারো কিনা।
খোকনের চেষ্টায় স্বপ্না একটা চাকরি পেয়ে গেলো।তবে কোন অফিসে বসে নয়।তাকে ঘুরে ঘুরে কাজটা করতে হবে।কয়েকমাস বেশ সানন্দেই কাজ করে গেলো।টাকা তো আর সংসারে দিতে হয়না;নিজের প্রয়োজনে বিশেষত জামাকাপড়ের পিছনেই খরচ হতে লাগলো।সে যে শুধু নিজের জন্যই খরচ করে তা কিন্তু নয়।বাড়ির সকলের যার যা দরকার সে কিনে নিয়ে চলে আসে।মাসের শেষে গিয়ে দেখা যায় তার হাতে কোন টাকাপয়সা নেই।তখন সে আবার তার মায়ের কাছ থেকেই ধার করে।কিন্তু ধার সে শোধও করে মাইনে পেয়েই।আবার পরের মাসে সেই একই জিনিষ।আবার মাসের শেষে ধার মায়ের কাছ থেকে,মাসের প্রথমেই মায়ের টাকা শোধ।(এই ধার ও শোধ চলতেই থাকে যতদিন না তার বিয়ে হয়।কারণ বিয়ের আগেই "ভাল লাগছে না এই চাকরি করতে বলে চাকরীটা সে।ছেড়ে দেয়।)"
এই চাকরি করার জন্য তাকে গ্রামের বাড়িতেই চলে আসতে হয়েছিলো।কিন্তু ঘুরে ঘুরে চাকরীর আনন্দ তার আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে আসতে লাগলো।এরই মধ্যে গ্রামের এক বিয়েবাড়িতে তাকে দেখে পছন্দ করায় দিদিরা একজোট হয়ে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য বাবুকে বুঝাতে শুরু করে।বয়স যখন কম ছিলো অমরেশবাবুর তখন তার মনোভাব যা ছিল বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার পরিবর্তন হতে থাকে।তিনিও ভাবতে বাধ্য হন তাঁদের অবর্তমানে মেয়েগুলির কি হবে?আর ছেলে তো সকলের ছোট।হঠাৎ যদি তাঁর কিছু হয়ে যায় ছেলেটিকে দিদিরা ঠিক দেখবে।তিনি বিয়েতে মত দেন।এই বিয়েতে অমরেশবাবুকে কোন টাকা খরচ করতেই হয়না।কারণ তখন তার বেশ কয়েকটি মেয়ে বিশেষত তাঁর সেজো মেয়ে ভারতী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বেশ বড় চাকুরীরত।বলতে গেলে সেই এই বিয়ের সিংহভাগ খরচ করে।ছেলে হোমিওপ্যাথিক ডক্টর।নিজের বাড়ি।মা আর সে।কিন্তু তাদের কাকা,জ্যাঠা নিয়ে বিশাল পরিবার।
এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগেনা ঠিকই।তাই প্রতিটা মেয়েকে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসে মারত্মক কসরত করতে হয় শুধুমাত্র মানিয়ে নেওয়ার জন্য। শারীরিক কষ্টটা মানিয়ে নিতে পারলেও মানসিক কষ্টটা কিছুতেই কেউ মানাতে পারে না।তার উপর স্বামী যদি হয় মায়ের আজ্ঞাধীন।কিন্তু বউকে যে তপন ভালোবাসে না তা কিন্তু নয়। অত্যাধিক সরল-সাদা হওয়ার কারণে মায়ের সমস্ত কথা সে বউকে যেমন বলে দিত ঠিক তেমনই তার বউ মায়ের সম্পর্কে কিছু বললে তাও বলে দিত।
মা ছেলেকে বলে দিয়েছিলেন,
--- দুপুরবেলা বউয়ের কাছে শুতে যাবি না।এটা ভালো দেখায় না।
--- তাহলে কোথায় শোবো?
--- আমার ঘরে আমার খাটে।
আবার কখনো বলেছেন,
--- রাতেরবেলা ঘরে দরজা দিয়ে শুবি না।আমার বয়স হয়েছে।দরজা বন্ধ থাকলে আমি ডাকলে তুই শুনতে পাবি না।তাই দরজা খুলেই ঘুমাবি।
পরিস্থিতিগুলি এমনই যে ঘটনাগুলি স্বপ্নাকে না বলেও উপায় নেই।দুপুরের ঘরে না আসলে স্বামীর কাছে কৈফিয়ত তলব না আসার কারণ।আবার রাতে দরজা বন্ধ করতে না দিলে তার কারণ ব্যাখ্যা করা।এমতাবস্থায় তপনও অসহায়। বাইশ বছরে বিধবা হওয়া মা যে কষ্ট করে তাকে এবং তার দিদিকে মানুষ করেছেন ছেলেবেলা থেকে তার গল্প শোনা আর জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নিজের চোখে দেখাটাকে তো আর সে অস্বীকার করতে পারে না।কিন্তু তাই বলে একটা মেয়েকে এনে বিবেক,মনুষ্যত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে মায়ের কথামত তার সাথে দুর্ব্যবহারও তো করতে পারে না।তার অবস্থা দাঁড়ালো ঠিক যেন শাকের করাত।সে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। পাড়ায় সেরূপ কোন বন্ধুমহলও নেই।একদিকে বউয়ের ঘ্যানঘ্যানানি।অপরদিকে মায়ের চোখ রাঙানি।পরিস্থিতি যখন তুঙ্গে তখন তপন একদিন তার মায়ের কাছেই স্পষ্ট জানতে চায়
--- তাহলে তুমি কি চাও?
--- আমি ওকে সহ্য করতে পারি না।
--- তার কারণটা কি?
--- আমার বুক থেকে ও তোকে কেড়ে নিয়েছে।
--- তাহলে বিয়ে দিয়েছিলে কেন?
--- তখন তো আর বুঝতে পারিনি তোকে বউয়ের হাতে ছেড়ে দিলে আমার এত কষ্ট হবে।
--- বিয়ে যখন দিয়েছো তখন তো আমাকে আমার বউয়ের সাথেই থাকতে দিতে হবে।
--- তুই এক কাজ কর।তোর বউকে বাপের বাড়িতে রেখে আয়।
--- কতদিন?
--- সারা জীবনের জন্য।
--- এটা তুমি কি করে বললে।আমার জীবনে কোন শখ আহ্বলাদ নেই?আমার কোন ভবিতসত নেই?বিয়ে দেওয়ার আগে এসব ভাবোনি কেন?আমি তো ওর জীবনটা নষ্ট করতে পারিনা।তুমি বলছো আমি কটাদিন ওকে ওর বাপের বাড়ি রেখে আসছি।কিন্তু এর মধ্যে তুমি নিজেকে ঠিক করে নাও।তোমার প্রতি সন্তান হিসাবে যেমন আমার দায়িত্ব আছে ঠিক তেমনই স্ত্রী হিসাবে স্বপ্নার প্রতিও আমার দায়িত্ব আছে।আমি কাউকেই অবহেলা করতে পারবো না।কটাদিন পরেই আমি ওকে বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসবো।তারমধ্যে তুমি তোমার মনকে বুঝাবে যে তুমি তোমার ছেলের বিয়ে দিয়ে বাড়িতে ঝি আনোনি।আর ছেলের বিয়ে দিয়ে সেই ছেলেকে বউয়ের কাছে যেতে না দিয়ে নিজের কাছে আটকাতেও পারবে না।কারণ আমিই সেটা হতে দেবো না।তাহলে আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।জেঠু,কাকাদের সব জানাতে হবে।বাকিটা তুমি ভেবে দেখো কি করবে?নিজের সম্মান নিয়ে যেমন আছো ঠিক তেমনই থাকবে নাকি বাড়ির সকলের কাছে তোমার এই আচরণের কথা জানাবো?
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment