জীবনের প্রতি বাঁকে (উনিশ পর্ব)
সম্মিলিত মতের কাছে অমরেশবাবু হলেন পরাজিত।রাজি তাকে হতেই হল একটা চৌদ্দ বছরের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য।রায় চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে মানে সে এক এলাহী ব্যাপার।শুরু হল সেই বিশাল আয়োজন।তখনকার দিনে বিয়ে মানে ব্যান্ড পার্টি,মাইক আর উপহার।এই উপহার হল পরিবারের সকলের হয়ে কেউ একজন কিছু কবিতা লিখতেন।আর সেগুলি বিয়ের আসরে পড়া হত।যেমন বিশাখার বিয়েতে বাবা,মায়ের তরফ থেকে লেখা হল
"পুত্রী দিয়ে পুত্র পেলাম,আর তো বাবা নহ পর-----"
ছোটদের তরফ থেকে
"ছুটির পরে বাড়ি গেলে কে আর খাবার দেবে?
আদর করে হাত বাড়িয়ে কে আর বুকে নেবে?---"।এইরূপ বেশ বড় বড় কবিতা ছাপার অক্ষরে লেখা যা কোন একজন বেশ সুন্দর করে বিয়ের আসরে পড়তেন।কবিতাগুলো এত সুন্দর লেখা হত তা শুনে অনেকেই চোখের জলে ভাসতেন।
বিয়ে সম্পর্কে তখনো বিশাখার কোন সম্যক জ্ঞানই জন্মায়নি।ভগ্নিপতি মনতোষের কাছে গিয়ে বিশাখা বায়না ধরলো
--- জামাইবাবু,আমি মাইকে গান করবো।
বাড়ির সবাই অবাক।যে মেয়ের বিয়ে সে নিজে চাইছে গান করতে।অমরেশবাবুর কথাগুলো তখন সকলের মাথার মধ্যে বিড়বিড় করছে।"বিয়ের মানেই যে মেয়ে বোঝে না তাকে তোমরা বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছ?"মনোতোষ তখন এ বাড়ির সেরা জামাই।সে তখন বিশাখাকে বললো,
--- নিশ্চয়ই গাইবে। চলো আমিও তোমার সাথে গাইবো।
বিয়েবাড়িতে সকালে মাইকে শুরু হল যেমন খুশি তেমন গাও।যে যেমন পারে গান,কবিতা --- চলতে লাগলো।
বিয়ে তো হয়ে গেলো।মেয়ের তো সত্যিই নারী পুরুষের সম্পর্ক সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল না।(তখনকার দিনে ছেলেমেয়েরা এই বয়সে এত পাকা কেউই ছিলনা)ফুলশয্যার রাতে স্বামী ঘরে ঢুকলে সে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে যায়।স্বামী তাকে আটকায়।বলে,
--- আরে আজকে তো আমাদের ফুলশয্যা।
--- সেতো দেখতেই পারছি। খাটটাকে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে।আপনি এই খাটে শুয়ে পড়ুন।আমি আপনার কাছে শোবো না;আমি আপনার মায়ের কাছে শোবো।
বোঝো কান্ড!
চলতে লাগলো বেশ কয়েকটা দিন এইভাবে।মেয়ে অস্টমঙ্গলায় বাপের বাড়িতে এসে জানিয়ে দিলো,
--- ওই অসভ্য লোকটার সাথে সে আর তাদের বাড়িতে যাবে না।
দিদিরা বললো,
--- কেন কি করেছে ও?
--- জানিস ও প্রচণ্ড অসভ্য।আমি খোকনদার কাছে শুয়েছি,দিপুদার (দেবদাস চ্যাটার্জী ও খোকনের কথা আগেই বলেছি) কাছে শুয়েছি তারা কত ভালো।আর ওই লোকটা আমার সাথে কি করতে আসে জানিস?
দিদিরা তো সব অবাক!এত সত্যি দেখতেই বড় হয়েছে।বাবু একে ঠিকই চিনেছিলেন।এর যে স্বামী,স্ত্রী সম্পর্কে কোনোই জ্ঞানই নেই।শুরু হল দিদিদের বদ্ধ দরজার মধ্যে বোনকে নিয়ে শিক্ষাদান।
অনেক ঝড়ঝাপটা,অনেক অভিযোগ,শারীরিক মানসিক অত্যাচারের পর আজ এই শেষ বয়সে এসে সে চিৎকার করে বলতে পারে "আজ আমি সুখী।'
কিন্তু তার আগে বিশাখার জীবনের আরও কিছু ঘটনা আমি আমার পাঠককুলের কাছে তুলে ধরবো।
বিশাখা বিয়ের পর পুনরায় নবম শ্রেণীতে ভর্তি হল।এখানে পুরো স্কুল জেনে গেলো সে একজন ভালো খেলোয়াড়।স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।বিশাখা হাড়িভাঙ্গা,দৌড়, বর্শা নিক্ষেপ - নাম দিয়ে দিলো।তখন তার সেজদি ভারতী ওই প্রাইমারী স্কুলের পঞ্চাশ টাকা মাইনের শিক্ষিকা।তখনো সে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরি পায়নি।কথাটা তার কানে গেলো।বিশাখা তখন সাত মাসের প্রেগন্যান্ট।সেজদি মাঠে ছুটে আসতে আসতে বাঁশিও বেজে উঠলো বিশাখাও দৌড় দিলো।অনেকেই তাকে নিষেধ করেছিল এই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ না নিতে।কিন্তু সে তো নাছোড়বান্দা।ওই অবস্থায় সে সকলের আগে দৌড়ে প্রথম প্রাইজ নিয়ে তবে ফেরে।তবে বাকি দুটো প্রতিযোগিতায় তাকে অংশগ্রহণ করতে তার দিদি আর দেয় না।
৭৮ সাল।প্রচণ্ড বন্যায় সকলের ঘর,বাড়ি ভেসে যাচ্ছে।আর ঠিক সেই বন্যার মধ্যে বিশাখার পেইন ওঠে।সমস্ত ঘরময় জল।পথঘাট কিছুই চেনার উপায় নেই।চারিদিকে তাকালে জল ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। পাড়ায় একজনের একটা টাক্সির কথা বলা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এই জলের মধ্যে তাকে তো পাওয়াও সম্ভব নয়।জল ভেঙেই মনোতোষ হাজির হল বিশাখার বাড়িতে।মনোতোষ যেন রায় চৌধুরী পরিবারে সকলের বড়দা হয়ে উঠেছিল।বিশাখার সাহস কয়েকশ গুন বেড়ে গেলো।এতক্ষন সে যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো জামাইবাবুকে দেখেই বললো,
--- আমি এই জলের মধ্যে হেঁটে যেতে পারবো।শুধু আপনি আমার হাতটা ধরে থাকবেন।পড়ে যেতে গেলে টেনে তুলে দেবেন।মনোতোষ হেসে পরে বললো,
--- আমি জানি তো।আর সেই জন্যই তো আমি এই জলের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে এলাম।কেন যে ওরা বলছে তুমি পারবে না আমার মাথায় সেটাই আসছে না।
ছেলেমানুষের মত মনোতোষ বিশাখার সাথে গল্প করতে করতে প্রায় কোমর সমান জল পেরিয়ে তারা ডায়মন্ডহারবার রোডে উঠে ভাগ্যক্রমে একটা ট্যাক্সি পেয়ে যায়।অল্প বয়স বলেই হয়ত লেবার পেইনটা বিশাখা তার ভগ্নিপতির হাসি,ঠাট্টার কারণে কিছুটা হলেও ভুলতে পেরেছিলো।
সংসারিক জীবনে বিশাখার স্বামী ছিলো উগ্র মেজাজের। স্বভাবখানা ছিলো তোমাকে আমি বিয়ে করে এনে উদ্দার করেছি।আমি সংসারের পুরুষ,রোজগার করি,ভালো খাওয়া,ভালো থাকা আর সমস্ত রকম সুখ ভোগ করার অধিকার একমাত্র আমার আছে।আমি তোমাকে খাওয়াচ্ছি, পরাছি তুমি আমার বাড়ির ঝি আর আমার দৈহিক ক্ষুদা নিবৃত্তি করার একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে আসার পর এরূপ একটি দানবরুপী মানুষের সংস্পর্শে এসে তারও মন মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে যায় আস্তে আস্তে।যে দিদিরা,ভগ্নিপতি এক সময় তার জন্য দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় খাওয়া,নাওয়া ভুলে গেছিলো বহু বছর পর নানান কারণে অকারণে এদের সাথেই দুর্ব্যবহার করে সম্পর্ক শেষ করেছে।তবে সুখের বিষয় একটাই সে এখন ভালো আছে,সুখী আছে।আর কষ্টের বিষয় যারা তার সুখের জন্য এত কাঠখর পুড়িয়েছে ওই রূপ স্বামীর মারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রাত জেগে বাইরে দরজার কাছে পাহারা দিয়েছে তারা আজ সবাই বিশাখার কাছে খারাপ।আসলে মানুষের জীবনটাই বড় বিচিত্র।সেই ছোট থেকে যতই যার বয়স বাড়ুক না কেন পরিবেশের প্রভাব তার উপরে পড়বেই।সেই ছোট্ট বয়সে সকলকে ছেড়ে এসে এমন একটা মানুষের সাথে তার উঠা,বসা,শোয়া,খাওয়া - আর প্রতিটা মুহূর্তে তার আচার-আচরণ দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই মানুষ ওই মানুষটির মত হয়ে যায়।হয়ে যাওয়ার আরও অনেক কারণ থাকে।কারণ প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষই হচ্ছে সবথেকে স্বার্থপর।সে যদি দেখে তাকে যে মানুষটাকে নিয়ে জীবন কাটাতে হবে পারিপার্শ্বিক কিছু বর্জন করলে অন্তত অশান্তির হাত থেকে সে রেহাই পেতে পারে তখন অনেক সময় নিজের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও ঘরের মানুষটার সাথে অ্যাডজাস্ট করতে অনেক কিছুই সে করে থাকে।মানুষের মনের ভিতরের খবর তো জানা যায় না।কিন্তু মন তো পরিবর্তনশীল।যে কোন সময় যে কোন কারনেই হোক না কেন মনের পরিবর্তন হতেই পারে।আর এই জন্যই তো কৃতজ্ঞ আর অকৃতজ্ঞ শব্দদুটির পাশাপাশি অবস্থান।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment