Wednesday, November 10, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (তেরো পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (তেরো পর্ব)
  অমরেশবাবুর পঞ্চম কন্যাটি ছিলো বেশ ডাকাবুকো স্বভাবের।গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে সে কিন্তু শহরে আসেনি কলেজে পড়তে।হুট করে প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের এক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করে দিলো।বয়স তখন তার সতেরো বছর।তখনকার দিনে তো একবারেই গিয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে হত।তাই মাধ্যমিক পাশ করতে করতেই পনেরো,ষোলো বছর।এমতাবস্থায় প্রাইমারী স্কুলে টিচার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখে ওই বয়সেই দরখাস্ত করে বসলো কাউকে কিছুই না জানিয়ে।
 চাকরির পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড যখন এলো তখন তার বয়স আঠারোতে পড়েছে সবে।আর অদ্ভুত ব্যাপার হল ইরা চাকরির এই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে গেলো।কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো তার পোষ্টিং নিয়ে।
  বাড়ি থেকে ঘোর আপত্তি এ চাকরি নিয়ে।এই বয়সে এতটা পথ হেঁটে যাতায়াত করতে গিয়ে শরীর তো ভাংবেই উপরন্তু রাস্তাঘাটে নানান বিপদ-আপদ ঘটতে পারে তাই বাড়ির কেউই চায় না রোজ বারো মাইল হেঁটে ইরা এ চাকরি করুক।বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ছ'মাইল।যেতে আসতে তার বারো মাইল পথ হাঁটতে হবে।কারণ পুরোটাই হল মাটির রাস্তা।বর্ষাকালে জলকাদায় ভর্তি থাকে গ্রামের রাস্তাগুলি।মাঝে মধ্যে রিক্সা ভ্যান চলে ঠিকই কিন্তু তা যে সব সময় পাওয়া যায় তাতো নয়।আর প্রথম অবস্থায় মাইনেই বা কটা টাকা যে রোজ রিক্সা,ভ্যানে যাতায়াত করবে? মোদ্দা কথা এ চাকরিতে যোগদান করা যাবে না। আরও পড়াশুনা করে আরও ভালো চাকরির চেষ্টা করতে হবে।
 কিন্তু ইরা শুনবে না সে কথা।সে এই চাকরি করবেই।সে রোজ ওই বারো মাইল পথ হেঁটেই যাতায়াত করবে।কেউই তাকে বোঝাতে পারলো না এতে তার শারীরিক মারত্মক ক্ষতি হবে। ঝড়,বৃষ্টি,রাত-বিরেতে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।সে গো ধরে বসে থাকলো এ চাকরি সে করবেই।চাকরিতে সে জয়েন করলো।নিত্য এ বারো কিলোমিটার (তখনকার দিনে কিলোমিটার বলা হত না মাইল ই বলা হত)পথ সে অনায়াসে হেঁটে যাতায়াত করতো।
  হঠাৎ করেই তার মনেহল সে প্রাইভেটে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।যেমন ভাবা ঠিক তেমনই কাজ।বইপত্র জোগাড় করে সে শুরু করলো অতোটা পথ হেঁটে যাতায়াত করার পর বাড়িতে এসে পড়াশুনা।কি অদ্ভুত তার শারীরিক এবং মানসিক দৃরতা।এইভাবে সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে।কিন্তু নানানভাবে চেষ্টা করেও সে কিছুতেই বাড়ির কাছে বদলী হয়ে আসতে পারে না।যেন কোন এক অদৃশ্য শক্তি তার মানসিক দৃরতা যেমন বাড়িয়ে চলেছে ঠিক তেমনই সেই অদৃশ্য শক্তিই তার বদলীর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।এইভাবে পাঁচ থেকে ছ'বছর চাকরি করার পর সে গ্রামের বাড়ির পাশের স্কুলে আসতে সক্ষম হয়।
 তবে এই যাতায়াতের মধ্যে সে বন্ধু,দাদা কিংবা গার্জিয়ান হিসাবে পাশে পেয়েছে তাদের খোকনদাকে।( যার পুরো নাম শেখ আহম্মদ আলী খোকন।পড়ে তার প্রসঙ্গে আসছি।একটি ভিন্ন ধর্মের ছেলে কিভাবে তার অমায়িক ব্যবহার আর ভালোবাসার গুনে একটা ব্রাহ্মণ বাড়ির ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিলো)যেকোন সময় যে কেউ যখন বিপদে পড়েছে খোকন কিন্তু সেখানে যমদূতের মত এসে হাজির হয়েছে।
 একবার ঈদের সময় খোকন বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ করলো তার বাড়িতে ঈদ উপলক্ষে যেতে হবে শুধু নয় রাতে তার বাড়িতে থাকতেও হবে।বাড়ি ফাঁকা রেখে সকলের পক্ষে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।অগত্যা ঠিক হল ইরা থাকবে বাড়িতে কারণ রাতে একা থাকতে তার কোন ভয় করবে না।আর ঈদের জন্য কোর্ট বন্ধ থাকায় সেদিন অমরেশবাবুও শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে আসেন।দিন থাকতে থাকতেই খোকন ইরা আর অমরেশবাবু বাদে অন্য  সবাইকে নিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো।বাড়িতে থেকে গেলেন বাপ আর বেটি।খোকনের দিয়ে যাওয়া ঈদের খাবার খেয়ে তারা সেদিন একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েন।রাত তখন প্রায় একটা হবে।কিছু শব্দে ইরার ঘুম ভেংগে যায়।সে বুঝতে পারে বাড়িতে চোর এসেছে।অন্ধকারের মধ্যে পা টিপে টিপে শব্দটা যেদিক থেকে আসছে সেখানে যায়। হ্যাঁ তার অনুমান সঠিক। চোরে সিদ কাটছে।আগেই বলেছি অমরেশবাবুর বাড়িটি ছিল কাঠের বেড়া দেওয়া আর মেঝে ছিল মাটির।কিন্তু উঠোন থেকে খুব উচুঁ ছিল তাদের ঘরগুলি।বারান্দা ছিল তিনদিকে।যেদিকে বারান্দা ছিলো না সেখানে ছিল ঠাকুর ঘর।
 আগেকার দিনে গ্রামের অবস্থাপন্ন বাড়িগুলোতে চুরি,ডাকাতি লেগেই থাকতো।তাই বাড়ির প্রোটেকশনের জন্য চারিপাশে বারান্দা থাকতো।ডাকাত আসলে আলাদা ব্যাপার কিন্তু চোর আসলে অন্তত সিদ কাটতে পারবে না।(হয়ত আজকের যুগে অনেকেই এই সিদ কথাটার অর্থ  বুঝতে পারবেন না।তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি এই সিদ হচ্ছে মাটির ঘরের যে মেঝে থাকে তা শাবল জাতীয় কিছু দিয়ে কেটে বড় গর্তের মত করা হয় যা দিয়ে সরাসরি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করা যায়।এমনভাবে ওই ফাঁকাটা বা গর্ত করা হয় যার ভিতর দিয়ে একটি মানুষ অনায়াসে ঘরের ভিতরে ঢুকতে পারে)চোর গ্রামেরই লোক।সে জানতো এই বাড়ির কোথায় কিভাবে সিদ কেটে ঢুকতে হবে তাই সে ঠাকুরঘরের দিকেই সিদ কাটতে থাকে।ইরা তার বাবুকে গিয়ে সব জানালে তিনি তাকে বলেন,
--- চুপচাপ শুয়ে থাকো ওরা ঘরে ঢুকে যা নেবার নিয়ে যাক।
 কিন্তু ইরা তো অকুতোভয়।সে তার বাবুর এ কথা মানতে পারলো না।সে তার বাবুকে জানালো,
--- তুমি চুপচাপ এই ঘরে বসে থাকো।কোন অবস্থাতেই ঘর থেকে বেরোবে না।যা করার আমিই করছি।
 অমরেশবাবু অনেকবার তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন।কিন্তু এত সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র তো ইরা নয়।সে তার বাবুর অনুরোধ,আদেশ কোনটার তোয়াক্কা না করে মাছ মারার কোচটা নিয়ে (এই কোচ হচ্ছে অনেকটা বড় ত্রিশূলের মত।ত্রিশূলে তিনটে চ্যাপ্টা লোহা আর কোচে থাকে দশ থেকে বারোটা কিংবা তারও বেশি লম্বা ধারালো সরু লোহা।যা খালবিলে বড় বড় মাছ দেখলে এই কোচ সেই মাছের উপর ফেলে মারা হয়।) যেখানে চোরে সিদ কাটছে সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আগেই সে একটি ধানের বস্তা একাই টেনে এনে ঠাকুরঘরে রাখে।একটা চল্লিশ কিলোর বস্তা টেনে আনা ইরার পক্ষে কোন ব্যাপারই ছিলনা।(এত পরিশ্রম আর ভারী জিনিস টানাটানির ফল অবশ্য সে বৃদ্ধা বয়সে এসে হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে)এই সব কাজই কিন্তু সে অন্ধকারের মধ্যে অতি সন্তর্পনে করেছে যাতে বিন্দুমাত্র শব্দ না হয়।আর তার বাবু অন্ধকার ঘরে খাটের উপর বসে ঠকঠক করে কাঁপতে থেকেছেন।চোর সিদ কেটে সবে মাত্র যেই তার মাথাটি ওই গর্তের ভিতর দিয়ে ঢুকানোর চেষ্টা করেছে অমনি ইরা তার হাতের কোচটি দিয়ে চোরের মাথায় আঘাত করেছে। চোরটি আর্তনাদ করে তার মাথাটি বের করে নেওয়ার সাথে সাথেই ইরা ধানের বস্তাটি  ওই গর্তের মুখের কাছে টেনে দিয়ে মুখটি বন্ধ করে দিয়েছে।

ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment