Saturday, November 20, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (বাইশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (বাইশ পর্ব)
  অমরেশবাবুর মেয়েরা বড় হওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে তিনি অন্দর মহলের সমস্ত ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।কারণ তিনি বুঝতে পারেন তিনি তার মেয়েদের যেভাবে বড় করেছেন তাতে করে ছোটখাটো কোন সমস্যা হলে সেই সমস্যাগুলি মোকাবেলা করার ক্ষমতা তারা করায়ত্ত করেছে।যদি কোন বিষয়ে তারা মনে করতো তাদের বাবুর উপদেশের দরকার তখন তারা সেই বিষয়ে বাবুর সাথে আলোচনা করে নিত।
 গৃহ শিক্ষক সুশান্ত পালের কথানুযায়ী তারা তাদের ছোট বোনকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করার জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনাকালে ছন্দা সেখানে উপস্থিত হয়ে ছলছল চোখে তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।( এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।তখনকার দিনে একবারেই ক্লাস ওয়ানে বা টু তে ভর্তি হওয়া যেত।তারজন্য কোন বার্থ সার্টিফিকেটেরও কোন দরকার পড়তো না কারণ তখন বাড়িতেই অধিকাংশ শিশুই জন্ম নিত একজন ধাত্রীর তত্ত্বাবধানে) আবার ভর্তির জন্য কোন পরীক্ষাও দিতে হত না।বড়জোর মাস্টার মশাই জিজ্ঞাসা করতেন "তুমি পারবে তো।"ছোট ছোট শহরগুলিতে কোন সমস্যায় হত না।তাদের দাদা (অর্থাৎ মালতী যাকে তার ছোট সব বোনরাই দাদা বলতো আগেই বলেছি) তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোলে উঠিয়ে নিয়ে আদর করে জানতে চায়,
--- তোমার চোখে জল কেন?তোমার আনন্দ হচ্ছে না স্কুলে ভর্তি হবে বলে?
 ছন্দা পিছন ঘুরে তার দাদার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
--- আমি টু তে ভর্তি হবো না।
--- কেন টু তে ভর্তি হবে না?তুমি তো সব পারো। মাষ্টারমশাই বলেছেন তোমাকে টু তে ভর্তি করলেও তুমি ফাষ্ট হবে।
--- আর ভাই?ও তো ছোট।ওকে কে দেখবে?ও তো ওয়ানে ভর্তি হবে।আমি তো ভায়ের সাথে থাকবো না;তখন যদি ভাইকে কেউ মারে কে দেখবে?ওর তো কষ্ট হবে।
 ছন্দাকে কেউই রাজি করাতে পারে না ক্লাস টু তে ভর্তির জন্য।তার সেই এক গো "আমি ভায়ের সাথেই ভর্তি হবো।তানাহলে ওর কষ্ট হবে।" অগত্যা তাকে টু তে আর ভর্তি করানো গেলো না।দুজনকে নিয়ে গিয়ে একসাথেই ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করা হল।
 ছন্দার জন্মের দেড় বছর পর তার ভায়ের জন্ম হয়।এতগুলো মেয়ের পরে একটা মাত্র ছেলে।স্বভাবতই সকলেই ছেলে বা তাদের ভাইকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো।ব্যতিক্রম একমাত্র অমরেশবাবু।কিন্তু তিনি কতক্ষন সময় আর বাড়িতে থাকেন?অযত্নে কিন্তু অবহেলায় নয় ছন্দা বড় হতে শুরু করে।এই ছোট বয়সেই সে বেশ সাবলম্বী হয়ে ওঠে।নিজের কাজগুলি সে নিজেই করে।নিজের হাতে ভাত খাওয়া,স্নান করা,স্নান করে এসে নিজের প্যান্ট নিজে মেলা - এইরূপ টুকটাক যাবতীয় কাজ সে নিজেই করে নেয়।ভাইকে নিয়ে যে সবাই মত্ত তাতে কোনদিনও সে কখনোই হিংসাবোধ করেনি।প্রতিটা দিদির কাছে ভাই যেমন প্রাণ ছিল;ওই ছোট্ট ছন্দার কাছেও তার ভাই প্রাণ ছিল।কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো ছন্দার কথা বলতে না পারার বিষয় নিয়ে।দু'বছর বয়সেও ছন্দা কথা বলতে পারেনা।কোন শব্দই সে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারেনা।সবকিছু সে সবাইকেই ইশারায় বোঝায়।তখন সকলে ধরেই নিলো এতগুলো মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে বোবাও হল।কিন্তু কিছু করারও নেই।তখনকার দিনে এইসব ব্যাপারে বাড়ির লোক কেউ খুব একটা মাথা ঘামাত না।আর ঘামিয়েই বা করবে কি?আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে চিকিৎসাশাস্ত্রও এত উন্নতির মুখ দেখেনি।তাই ঝাড়া,জলপড়া, মাদুলী,দেবতার স্থানে মানত এইসব করেই চলত।তাকে নিয়ে আকুতু কুতু হয়তো কেউ করতো না কিন্তু তাকে কেউ অবহেলাও করতো না।তবে অধিকাংশ সময় সে তার নিজের মনেই থাকতো।আর যে বিষয়টা তার মধ্যে প্রবলভাবে ছিলো তাহল বড়দের কোন কাজ করতে দেখলে সে সেই কাজ করাটাকে এমনভাবে লক্ষ্য করতো ঐটুকুন বয়সেই পরে সেই কাজগুলি বেশ ভালোভাবেই করতে পারতো।
 তিনবছর বয়স।মুখের থেকে কোন আওয়াজ বের করতেই পারেনা অথচ এই বয়সে সে তার নানান কাজে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে থাকে।ভারতীর প্রচণ্ড জ্বর।বাড়িতে কান্নার রোল ওঠার মত পরিস্থিতি।সেই মুহূর্তে কথা না বলতে পারা ওই ছোট্ট মেয়েটি রান্নাঘরে ঢুকে একটা বাটিতে জল নিয়ে এসে ভারতীর মাথার কাছে বসে শান্তিদেবীর আঁচল ভিজিয়ে তার সেজদির কপালে জলপট্টি দেওয়ার চেষ্টা করে।আবার কখনো হয়ত বাড়িতে অতিথি এসেছে সকলে বসে গল্প করছে সে রান্নাঘরে ঢুকে একটা কাপ নিয়ে ইশারায় তার দিদিদের বুঝিয়ে দেয় অতিথিকে চা করে দেওয়ার জন্য।ভাই একপা,দুপা করে হেঁটে বেড়াচ্ছে।ঘরের মেঝেতে জল পড়ে আছে।সে দৌড়ে গিয়ে হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে ওই জল মুছতে থাকে।আবার হয়ত অনেক সময় ভাই এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে সে পরে যেতে পারে ছোট্ট মেয়েটি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছে।এইরূপ অনেক ঘটনা। তখনও কিন্তু তার পুরোপুরি তিন বছর বয়স হয়নি।
 একবার গ্রামের কালী পূজা উপলক্ষে (এই পুজোর বর্ণনা আমি পড়ে দেবো)একজন সাধু গোছের মানুষ আসেন।এই পুজোতে একটা বিশাল অঙ্কের টাকা রায় চৌধুরী পরিবার থেকে যেত শুধু নয় পুজো প্রাঙ্গণে শান্তিদেবীর এক বিশাল ভূমিকা ছিল।
 ছোট্ট মেয়েটির বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে এবং সে কথা বলতে পারে না শুনে সাধু শান্তিদেবীকে বলেন,
--- মা,মেয়েটি তোমার যথেষ্ঠ বুদ্ধিমতী।কিন্তু তোমার কথামত ওর তিনবছর বয়স হতে চললো ওতো এখনো কথা বলতে পারে না।আমি একটা কথা বলি মন দিয়ে শোনো।আর বিশ্বাস নিয়ে কাজটি করো।আমার মনেহয় আগামী পুজোর আগেই ও কথা বলতে পারবে।
--- অনেক মানত,তাবিজ-কবজ করেছি বাবা।কিছুই হয়নি।
--- আমার কথাটা শুনে দেখো।আমার মনেহয় তাতে কাজ দেবে।
--- বলুন বাবা।
--- তুমি যে কোন কালী মন্দিরে একটা চাল কুমড়ো মানত করো ভক্তিভরে।হয়ত আগামী পুজোতে আমার আসা হবে না।কিন্তু আগামী পুজো আসার আগেই তোমার মেয়ের মুখে বুলি ফুটবে।
 সেদিন সেই পুজো প্রাঙ্গণেই দাঁড়িয়ে লোক মারফত গ্রামের কোন এক বাড়ি থেকে চাল কুমড়ো জোগাড় করে শান্তিদেবী মায়ের কাছে তার ছোট মেয়ের মুখের বুলি ফোটার জন্য মানত করেন।অদ্ভুতভাবে পরবর্তী পুজো আসার আগেই ছন্দা কথা বলতে শেখে।
 আমি আগেই বলেছি আমার এই উপন্যাসে কোন ঘটনায় কাল্পনিক নয়।কারণ সমস্ত ঘটনায় অমরেশবাবুর পরিবারকে কেন্দ্র করে।হয়তো পাঠককুল ভাবছেন চাল কুমড়ো মানত করলে যদি বোবা কথা বলতে পারতো তাহলে এই পৃথিবীতে আর কেউ বোবা থাকতো না।"বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর"-।হয়ত মেয়েটি একটু বেশি বয়সে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে পারতো।অনেকেই দেরিতে কথা বলে।কিন্তু যেহেতু সাধুর কথানুযায়ী কাজটা করার পর সে কথা বলতে পেরেছিলো তাই শুধু ওই পরিবারের লোকজনই নয় গ্রামের মানুষেরাও সাধুর কথাটাকেই প্রাধান্য দিয়েছিল।এখনকার দিনে যুক্তি-তর্ক,বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনেক কিছুই আছে।কিন্তু তখনকার দিনে মানুষ অনেক কিছুই সরল বিশ্বাসে মেনে নিতেন।

ক্রমশঃ
 

No comments:

Post a Comment