Sunday, November 28, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (ত্রিশ ও শেষ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (ত্রিশ ও শেষ পর্ব)
  আমি আগেই পাঠককুলকে জানিয়েছি আমার এই উপন্যাসের প্রতিটা ঘটনা সত্যি।আমি এটাকে উপন্যাস বলছি ঠিকই।আদতে আমার পিতা অমরেশ রায় চৌধুরীর জীবনকে ঘিরে গড়ে ওঠা নানান দিক।আমি এখানে কোন ঘটনা বা একটি শব্দও চয়ন করিনি যা তার পরিবারে ঘটেনি।ঠিক যেভাবে ঘটনাগুলি ঘটেছে সেইভাবে ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছি মাত্র।মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী।তাই লিখে রেখে গেলাম নিজ পরিবারের মূল ঘটনাগুলি।
  লেখাটি শুরু করেছিলাম অমরেশবাবুকে নিয়ে এবং তাকে ঘিরে আর যারা আছেন তাদের নিয়ে।আজ লিখবো তার একমাত্র পুত্র সন্তানটিকে নিয়ে।এটাই আমার শেষ পর্ব।কারণ আজ ২০২১ আঠাশে নভেম্বর।আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে ১৯৮৬ সালে আজকের দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেন।
  তার একমাত্র ছেলে হারা ওরফে প্রণয়।সহজ,সরল যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে।দিদিদের চোখের মণি সে আজও। সেজদি ভারতী তাকে আজও সেই ছোট্ট ভাইটিই ভাবে।জীবনে সেভাবে কিছু করে উঠতে না পারলেও একটি বেসরকারী সংস্থায় সে কর্মরত।ভারতী তার বিয়ে দিয়েছে।দুটি ছেলে হয়েছে।ভাই এবং ভায়ের পরিবারের প্রতি আজও ভারতী তার সমস্ত দায়িত্ব পালন করে চলেছে।ভারতী তার ভায়ের জন্য আজও যেভাবে ভাবে হয়তো কোন মা ও এই ছিয়াত্তর বছর বয়সে এসে তার সন্তানের জন্য এতটা ভাববে না।কারণ ছেলের বিয়ে দেওয়ার পর অধিকাংশ মায়েরা তার সমস্ত দায়িত্ব তার বৌমার হাতেই ছেড়ে দেয়।মা না হয়েও কিভাবে মা হয়ে উঠা যায় তা এই ভারতীকে না দেখলে বোঝা যাবে না।তার ছেলেদের লেখাপড়া এবং সমস্ত রকম বায়না,সাধ আহ্লাদ সবকিছুর দায়িত্ব এই ভারতীর।বিবাহিত জীবন খুব একটা সুখের না হলেও জীবন এগিয়ে চলেছে।
 যে ছেলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিল,যে মানুষটির অর্থ সম্পদে কোন কমতি নেই - জীবনে কিন্তু সে সুখী হতে পারেনি।অর্থ সম্পদ যে জীবনে সুখ বয়ে আনতে পারেনা প্রণয়ের জীবন তা প্রমাণ করে দিয়েছে।জীবনে সুখী হওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে ঠিকই কিন্তু দুটি হৃদয়ের মিল না থাকলে কোনদিনও সুখ ধরা দেয়না।প্রণয়ের জীবনও অর্থ প্রাচুর্যের মধ্যে বসে থেকে সুখহীন ভাবেই এগিয়ে চলেছে।
 প্রতিটা মানুষের পুরো জীবনটাই এক একটা বাস্তব উপন্যাস ।আর এই উপন্যাস কখনোই যবনিকা টানতে পারেনা।কারণ সেই মানুষটি চলে গেলেও তার উত্তরসূরিরা কিন্তু থেকে যায়।গল্প কিন্তু এগিয়েই চলে।কাহিনীর সূত্রপাত আমরেশবাবুকে নিয়ে হলেও তিনি চলে যাওয়ার পরেও কিন্তু কাহিনী শেষ হয়নি।আজ পঁয়ত্রিশ বছর তিনি নেই কিন্তু তাকে ঘিরে যে মানুষগুলি ছিল এবং এখনো অনেকেই আছেন কারো জীবনই কিন্তু থেমে নেই।এগিয়ে চলেছে।আমার এ উপন্যাস শেষ হওয়ার নয়।কিন্তু সবকিছুরই একটি দাড়ি আমাদের টানতেই হয়।তাই যাকে নিয়ে আমার এই গল্পের শুরু তার মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে আমার গল্প বা উপন্যাস কিংবা আত্মজীবনী যাই বলুন না কেন আমি তার পরিসমাপ্তি ঘটাবো।
 আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে ১৯৮৬ সালের ২৮ শে নভেম্বর শুক্রবার দুপুর ১২টা পাঁচ মিনিটে  অমৃতযোগে বেহালা ঠাকুরপুকুর কদমতলা নিজ বাড়িতে অমরেশবাবু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর ১১ মাস।
 ছেলেবেলায় তার জন্মের পর যখন বাড়ি থেকে তার কুষ্ঠি করেছিলো সেই কুষ্ঠিতে ছিল (ঠাম্মার কাছে দিদিদের গল্প শোনা।যা পরবর্তীতে বাড়ির অন্য সকলেই জানতেন) তাঁর বয়স যখন ছিয়াত্তর বছর হবে তখন তাঁর একটি ফাড়া আছে।উনি সেটি যদি ডিঙ্গতে পারেন তাহলে শতায়ু বৎসর আয়ু পাবেন।পরিবারের দূর্ভাগ্য তিনি ওই বয়সটি ডিঙ্গতে পারেননি।
 তিনি ছিলেন অ্যাজমার রোগী আগেই পাঠককুলকে জানিয়েছি।আগেরদিন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় ডাক্তার বললেন বাড়িতে অক্সিজেন আনতে।আনা হল।দূর-দূরান্ত যত জায়গায় রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়রা রয়েছেন সকলেই টেলিগ্রাম করা হল।একে একে বাড়িতে লোকে লোকারণ্য।আত্মীয়-স্বজনরাই অধিকাংশ। তাঁর মৃত্যুর মাত্র মিনিট দশেক আগে বাড়িতে এসে পৌঁছায় সুদূর আগরতলা থেকে তার বড় মেয়ে লক্ষী।কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে,
--- বাবু আমি তোমার বড় মেয়ে।তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?
 মৃত্যুর একটু আগে সামান্য চোখ খুলে তিনি মাথা কাত করে জানিয়ে যান তিনি সে কথা শুনেছেন।
 শোকে পাথর পুরো পরিবার,আত্মীয়-স্বজন।তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে জজ সেই মুহূর্তের রায় ঘোষণা স্থগিত রাখেন।ছুটি হয়ে যায় কোর্ট চত্বর।
 কত মানুষ তাঁর মৃত্যুর খবর না জেনে বাড়িতে এসেছে তাদের মাসিক সাহায্য নিতে।আবার কত মানুষ এসেছে তার ছেলেমেয়ে জীবনে দাঁড়িয়েছে তাই বাবুকে মিষ্টি মুখ করাতে।
  জীবনে কোনদিন যে মানুষটা উচ্চ স্বরে কারো সাথে কথা বলেননি সেই মানুষটাই কেসে হেরে গেলে বিনা কারণে চিৎকার করে কথা বলতেন।কোন মেয়েকে কোনদিন নাম ধরে ডাকতেন না।যদি কখনো ডেকেছেন তখনই বুঝে ফেলতো তাঁর প্রতিটা মেয়েই 'বাবু আজ কেসে হেরে গেছেন।'
 প্রতিটা মেয়েই ছিলো তার মা।সবাইকেই তিনি মা বলেই ডাকতেন।মহালয়ার ভোরে সব সন্তানদের ডেকে নিয়ে রেডিও চালিয়ে সকলের সাথে বসে মহালয়া শুনতেন।মহালয়া শেষে সবাই উঠে যখন ঘুমাতে যেত তিনি শুরু করতেন চণ্ডীপাঠ।এইভাবে পুজোর আগে পর্যন্ত তিনি রোজ চণ্ডীপাঠে বসতেন সূর্যদোয়ের আগে।সেই আওয়াজ আজও যেন কানে ভেসে আসে কোথাও চণ্ডীপাঠ শুনলেই।
 ছন্দা যখন প্রতি ক্লাসে প্রথম হয়ে ক্লাসে উঠতো আর তার বাবুর কাছে এসে  প্রোগ্রেসরিপোর্টটা হাতে দিত তিনি শুধু মাথার উপরে হাসিমুখে হাতটা রাখতেন।স্বপ্ন দেখতেন তার এই ছোট মেয়েটা জীবনে একদিন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাবে।কিন্তু তিনি জানতেন না মাথার উপর থেকে তাঁর হাতটা সরে গেলে তাঁর সন্তানদের জীবনগুলো গতানুগতিকভাবেই চলবে।
 এমন প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষের দশটি সন্তান হওয়ার পরেও অধিকাংশ সন্তানদের তিনি যথেষ্ট শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলেও একটা সন্তানও তার জীবনে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।কিন্তু তিনি চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর অবর্তমানে তাঁর সেজ মেয়ে ভারতীও চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
  হয়ত ভারতী তার জীবনে স্বামী,সন্তান,নিজ সংসার পায়নি।কিন্তু সে তাঁর বাবুর অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার জন্য নিজের পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেছে।ভাই এবং বোনগুলোকে লেখাপড়া শিখিয়েছে,বিয়ে দিয়েছে সংসারী করেছে।দিদি হয়েও সে একাই বাবা এবং মায়ের দায়িত্ব পালন করে চলেছে এই ছিয়াত্তর বছর বয়সেও।যা অনেকেই পারেনা কিংবা পারলেও করেনা।
  মানুষ তার ভাগ্য নিয়েই জন্মায়।কেউ কারো ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা।সব সময় চেষ্টা পরিশ্রমই যে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে তা কিন্তু নয়।পাঠককুল আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন।কিন্তু আমার জীবনের ঘটনাসমুহ আর আমার অভিজ্ঞতার কথায় লিখলাম।
 জীবন উপন্যাস শেষ হয়না।তাই আমার পরিবারের এ গল্পও কখনো শেষ হবে না।কিন্তু আমি এখানেই দাড়ি টেনে দিলাম।
  এতক্ষনে নিশ্চয় আপনারা জেনে গেছেন এই পরিবারের আমি কোন মেয়েটি? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন।আমি হলাম সেই মেয়েটি যার জন্য তার মা সাধুর কথামত মায়ের মন্দিরে চালকুমড়ো মানত করেছিলেন।আমি হলাম ছন্দা ওরফে আপনাদের নন্দা মুখার্জি রায় চৌধুরী।
 পুনশ্চ আজ সেই অভিশপ্ত দিন ২৮শে নভেম্বর।

    সমাপ্ত
 

No comments:

Post a Comment