সায়নীর বড় মেয়েটি শাওন তার বাবা,মায়ের প্রাণ।প্রতিটা বাবা,মায়ের জীবনে তাদের প্রথম সন্তান তাদের চোখের মনিই হয়।কিন্তু শাওন তার বাবা,মায়ের এই অন্ধ ভালোবাসাকে হাতিয়ার করে সমবয়সী ছেলেগুলির সাথে খোলামেলা জীবনযাপন করতে লাগলো। পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সবকিছু জানার পরেও মেয়ের কথাই তারা বিশ্বাস করে অন্ধের মত চলতে থাকেন।ছেলেবন্ধুর সংখ্যা এতই যে তার আসল প্রেমিকটি কে এটা নিয়ে আত্মীয়দের তো বটেই প্রতিবেশীদের মধ্যেও কানাঘুষো চলতে থাকে।
একদিন মনোতোষ অফিস থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সাথে একটি হোটেলে একজন কলিগের জন্মদিন উপলক্ষ্যে খেতে যায়।যখন তারা বেরোবে মনতোষ দেখতে পায় তার শাওন একটি ছেলের সাথে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো।অফিস কলিগরা সাথে থাকায় সে দেখেও না দেখার ভান করে বাড়িতে ফিরে এসে সায়নীকে সব জানায়।তখনো মেয়ে বাড়িতে ফিরে আসেনি। এ পর্যন্ত তার যতদিন দেরি হয়েছে তারা কিছু মনে করতো না কারণ শাওন বেরোনোর সময় বলতো কোচিংয়ে যাচ্ছে আর দেরি হলে বাড়িতে ফিরে জানাতো স্যার দেরি করে ছেড়েছেন।তারা তাদের মেয়েকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে কোনদিন তারা মনেই করেননি মেয়ে তাদের কাছে মিথ্যা বলছে বা সে তাদের মিথ্যা বলতে পারে।
স্বামী,স্ত্রী উদ্বিগ্ন চিত্তে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।মনোতোষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।কারণ এর আগে সে বহুবার শুনেছে তার মেয়েকে রাতে বাইকে করে বড় রাস্তার মোড়ে একটি ছেলে এসে ছেড়ে দিয়ে যায়।এতদিন তারা বিশ্বাস না করলেও আজ নিজের চোখে দেখে সবকিছু তাদের কাছে জলের মত সব পরিস্কার হয়ে গেছে।
মেয়ে বাইক থেকে নেমে তার বাবাকে দেখে ঘাবড়ে যায়।মনোতোষ ছেলেটির কাছে তার নামধাম,সে কি করে সব জেনে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।সারা রাস্তা বাপ,মেয়ের কোনোই কথা হয়না।
অতি শান্তভাবে মেয়ের কাছ থেকে ছেলেটি সম্পর্কে সবকিছু জেনে নিয়ে তার খুব কাছের এক বন্ধু এবং তার স্ত্রীকে পাঠায় ছেলেটির সম্পর্কে তার বাড়িতে।খোঁজ খবর আনতে।কিন্তু তারা এসে অমিত সম্পর্কে যা জানায় তাতে মনোতোষ তার আদরের মেয়েকে সেখানে বিয়ে দেবে না পরিস্কার জানিয়ে দেয়।কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা।
বাধ্য হয়ে মেনে নেয় তারা মেয়ের এই সিদ্ধান্তকে।কারণ এই ছাড়া মেয়ের জীবন রক্ষা করার আর কোন উপায় তাদের কাছে ছিলো না।অতি আদর আর যখন যা চেয়েছে তাই দেওয়ার ফলে শাওন হয়ে উঠেছে অত্যন্ত অভিমানী প্রকৃতির।অন্য কোনকিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে এই চিন্তাধারা স্বামী,স্ত্রীর উভয়ের মনে ভীষণভাবে ঢুকে যায় শাওনের কান্না মিশ্রিত নানান কথায়।নিরুপায় বাবা,মা মেয়ের উপযুক্ত না জেনেও শুধুমাত্র তার জীবন রক্ষার তাগিদেই তারা অমিতকে মেনে নিয়েছে।অমিত তখনও বেকার।শাওন গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর অমিত মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ পদে একটি চাকরি জোগাড় করে নেয়।অতি দহরম-মহরম করে মেয়ের বিয়ে দিলেও আদতে তার শ্বশুরবাড়িটি ছিল ফস্কাগেরো।
বিয়ের ছ'মাসের মধ্যেই শাওন সবকিছুই বুঝে ফেলে।কিন্তু তখন সে তো নিরুপায়।শ্বশুর সামান্য একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করেন।বাউন্ডুলে এক দেওর।সংসারের কাজ,খাওয়াদাওয়া সবকিছু নিয়েই শ্বাশুড়ির সাথে চলে মতবিরোধ।অমিত আর কটা টাকায় বা মাইনে পায়! শুরু হয় সায়নীর তার মেয়ের সংসারে নাক গলানো।মেয়ে অর্থ কষ্টে আছে,মেয়ের দিনরাত সংসারে কাজ করতে হচ্ছে এসব কিছুতেই মেনে নিতে পারে না সায়নী।কিন্তু মনতোষ তাকে বারবার নিষেধ করে মেয়ের সংসারে যাতে সে নাক না গলায়।
--- বারবার বলছি তোমায় শানু তুমি সানার সংসারে মাথা ঘামিও না।ওকে ওর মত করে মানিয়ে নিতে দাও।
--- সারাটা দিন মেয়েটাকে দিয়ে সংসারের কাজ করায়।মেয়েটা আমার এক মুহুর্ত সময় পায় না একটু বিশ্রাম নেওয়ার।
কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে সায়নী।
--- কিছু করার নেই আমাদের।ওকে অনেক বুঝানো হয়েছিল ওই ছেলেকে বিয়ে না করতে।ও যেভাবে মানুষ হয়েছে তাতে ও যে ওই বাড়িতে মানিয়ে নিতে পারবে না সেটা তো আমরা ভালোভাবেই বুঝে গেছিলাম।কিন্তু ও কি শুনলো আমাদের কথা?আমাদের ভয় দেখালো অমিতের সাথে বিয়ে না দিলে ও সুইসাইড করবে।অনন্যোপায় হয়ে আমরা বিয়েতে মত দিই।কিন্তু একটা কথা মনে রেখো তুমি যদি ওকে ওই বাড়ি থেকে বের করে আনার চেষ্টা করো সেটা কিন্তু একদম ঠিক হবে না।ওকে ওর মত করে সবকিছু মানিয়ে নিতে দাও।কিন্তু তুমি যদি তোমার মতামত ওর সংসারে দেওয়ার চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু মারত্মক ভুল করবে।
--- কিন্তু অত বড় সংসার চালানো তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
--- কে তোমাকে ওদের সংসার দেখতে বলেছে?তারা তো কোন সাহায্য তোমার কাছে চায়নি?
--- আরে মেয়েটা একটু ভালোমন্দ খেতে পারে না,তাই তো আমি বাজার করে নিয়েl।
--- ভুল করছো।মারত্মক ভুল করছো।সানার সংসারটা ভেঙ্গে দিও না।অধিকাংশ মেয়ের মায়েরা মেয়েদের সংসারে নাক গলিয়ে সেই সংসার থেকে ভালো থাকা,ভালো খাওয়ার জন্য মেয়েকে বের করে নিয়ে আসে।মেয়েদের থেকে মেয়েদের মায়েরাই সংসার ভাঙ্গার জন্য দায়ী।মেয়ের বিয়ের পরে অনেককিছুই তার শ্বশুরবাড়ির পছন্দ হয়না মেয়েটির বাপের বাড়ির লোকের।এটাই স্বাভাবিক।দুটো সম্পূর্ণ আলাদা পরিবার।আমাদের পরিবারের অনেককিছুই ওদেরও পছন্দ হয় না।কিন্তু মেয়ের ভালোর জন্য একটু চুপ করে থাকতে হয়।তারা তো তোমার মেয়ের প্রতি কোন অত্যাচার করছে না,না খাইয়ে রাখছে না।হয়ত তাকে একটু বেশি কাজ করতে হচ্ছে।তুমিও তো বিয়ের পর আমাদের বাড়িতে এসে সব কাজ করতে।আমি সব জানি।কিন্তু কিছু বলতাম না।কারণ বাবা,মাকে ছাড়তে চাইনি আমি কখনোই ।হয়ত রোজ মাংস ভাত সে পাচ্ছে না কিন্তু না খেয়ে সে থাকছে না।আমি তোমায় অনুরোধ করছি তুমি ওই বাড়ি থেকে ওকে বের করে আনার জন্য অমিতের সাথে কোন আলোচনা করনা।অমিত কিন্তু জীবনেও তোমায় ক্ষমা করবে না।ও কিন্তু সম্পূর্ন অন্য ধরণের ছেলে।আমি ওকে ঠিক চিনতে পেরেছি।
মনোতোষের সব কথায় অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়।শুধু মেয়েকেই নয় সময়ে,অসময়ে তাদের কানে নানান কথা বলে সায়নী তাদের বাড়ি থেকে বের করে এনে ঘর ভাড়া করে রাখে।সায়নী ভেবেছিলো অমিত যা মাইনে পায় তাতে সে ঘরভাড়া দিয়ে খুব ভালোভাবেই সংসার চালিয়ে নিতে পারবে।আর মাঝে মধ্যে সে নানানভাবে ওদের সংসারটাকে দেখবে।একবারের জন্যেও বুঝতে পারেনি অমিতের মাইনে অতি সামান্য আর সে যেটা মুখে বলে সেটা সঠিক নয়।মনোতোষ তাকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেছিল কারণ একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের মাইনে কত হতে পারে তার মোটামুটি একটা ধারনা ছিল।কিন্তু সায়নী কষ্ট পাবে মনেকরে সঠিক সত্যটা সে সামনে আনতে পারেনি।
সংসার যে একটা বড় রাজনীতির জায়গা। যত কাছের লোকই হোকনা কেন এমন অনেক ঘটনা,এমন অনেক কথা অতি প্রিয়জনের কাছ থেকেও মাঝে মধ্যে লুকিয়ে যেতে হয়।কারণ এমন অনেক সত্য আছে যে সত্য সব সময় সবাই নিতে পারে না। অন্যেকে দুঃখের হাত থেকে বাঁচাতে,কষ্ট না দিতে চাওয়ার কারণে অতি বড় প্রিয়জনকেও অনেক কথা লুকিয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়।আর এরই নাম সংসার।সব থেকে বড় নাটকের মঞ্চ।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment