দাগ
বিশ্বাস একবার ভেঙ্গে গেলে আর তা জোড়া যায়না!!কনিনিকার মধ্যে ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে রাহুল ফিরিয়ে দিয়েছিল তার প্রকৃত ভালোবাসা দেবলীনাকে।
সেই কলেজ লাইফ থেকেই দেবলীনার সাথে বন্ধুত্ব রাহুলের।দেবলীনা কোনদিন মুখ ফুটে রাহুলকে বলেনি যে সে তাকে ভালোবাসে।পাশ করেই রাহুল চাকরি পেয়ে যায়।দেবলীনা ভাবতেই পারেনি কোনদিন রাহুল তাকে ভালোইবাসেনি;শুধুমাত্র বন্ধুত্বের চোখেই তাকে দেখে।চাকরি পাওয়ার পর দেবলীনা আশা করেছিল এবার রাহুল তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।চাকরিতে জয়েন করার তিনমাস পর একদিন রাহুল ফোন করে দেবলীনাকে ডেকে নেয় অফিস ছুটির পর একটা কফিশপে। দেবলীনা তখন ছোটখাটো চাকরি করছে।মনে অনেক আশা নিয়েই নিদৃষ্ট সময়ের আগেই দেবলীনা পৌঁছে যায় কফিশপে।বুকটার ভিতর উথাল-পাতাল এক ঢেউ অনুভব করছে।ঘড়ির কাঁটা মিনিট ছুঁতে ঘণ্টা লাগিয়ে দিচ্ছে তখন।কিছুক্ষণ পর রাহুল আসে কিন্তু একা নয়।
সেদিন দেবলীনা অনেক কষ্টে চোখের জল সংবরণ করেছিলো।রাহুলের সাথে যে মেয়েটি এসেছিল সে রাহুলের অফিস কলিগ।তিনমাসের আলাপ।তিনমাসেরই রাহুল কনীনিকার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করলো।আর এতগুলো বছর ধরে রাহুল বুঝতেই পারলো না দেবলীনা তাকে পাগলের মত ভালোবাসে। চাকরী পাওয়ার ছ'মাসের মধ্যেই বিয়ে।
পাঁচ বছর হয়ে গেল রাহুলের বিয়ে হয়েছে।অভিমান আর কষ্ট মিলিয়ে সময় দেবলীনাকে অনেকটাই পরিণত করেছে।পাল্টে ফেলেছে সে তার মোবাইল সীম।এখন সে সুচাকুরে। একটা মাল্টিন্যাশাল কোম্পানিতে বেশ ভালো পোষ্টে আছে এখন।এখনো বিয়ে করেনি।বলা ভালো বিয়ে করবে না বলেই করা হয়ে ওঠেনি।মা আর মেয়ের সংসার।
এক কলিগের বিয়েতে অনেকের সাথে দেবলীনাও গেছিলো মধ্যমগ্রাম।সবাই একই সাথে রাতের শেষ ট্রেন ধরে ফিরছে।হাসি,ঠাট্টা,গল্প,গুজব চলছে।বেশ ফাঁকা ছিলো ট্রেনটা।তাই নিজেদের মধ্যে আনন্দটাও সকলে বেশ উপভোগ করছিলো।হঠাৎ অনেকদিন আগে শোনা এক কণ্ঠস্বরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেবলীনা তাকিয়ে দেখে রাহুল।
তাকে দেখেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে দেবলীনা।কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়।নিজেকে সামান্য আড়াল করতে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে।একটু দূরেই একটা ছিট ফাঁকা দেখে রাহুল এগিয়ে গিয়ে বসে।আর দেবলীনা অতীতে বিচরণ করতে থাকে।
ট্রেন শিয়ালদা এসে থামে।দেবলীনা সকলের শেষে নামে। আড় চোখে দেখে নেয় রাহুল নেমে গেছে।অজান্তেই চোখের কোনটা ভিজে যায়।সাথে যারা ছিল তারা সকলেই শিয়ালদার আগেই নেমেছে। ফ্লাটফর্ম দিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
--- কিরে এত বছরের বন্ধুত্ব আমাদের আমাকে দেখেও না চেনার ভান করলি?
তাকিয়ে দেখে রাহুল তার পাশে।মনেমনে ভাবলো দেবলীনা এত চেষ্টা করেও রাহুলের দৃষ্টি এড়াতে পারলো না সে। আমতা আমতা করে বলল,
--- ঠিক বুঝতে পারিনি।আসলে গল্পে মজগুল ছিলাম তো।কেমন আছিস বল।
--- এখন আমি খুব ভালো আছি।হ্যারে তুই আমার বিয়েতে এলি না,পড়ে কতবার তোকে ফোন করলাম ;সব সময়ই সুইচ অফ বলতো।আমার সাথে যোগাযোগ রাখবি না বলে নম্বর পাল্টে নিয়েছিস?
একথার কোন উত্তর দেয়না দেবলীনা।রাহুলের কাছে জানতে চায়,
--- তোর বউ কেমন আছে রে!বাবা হয়েছিস?
--- আরে এসব ছাড় তো।কতদিন পরে দেখা হল আমরা অন্য কথা বলি।
--- কত রাত হয়েছে খেয়াল আছে?উবের ধরতে হবে।বাড়িতে গেলে তোর বউ বকবে না তোকে রাত হয়েছে বলে?
--- আমার বউ?সে আছে নাকি?মা ছেলের সংসার ছিলো এখনো তাই আছে?
--- মানেটা কি?
--- সে অনেক কথা।
--- সেই অনেক কথায় নাহয় আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনি।
সেদিন রাহুল দেবলীনাকে যে কথাগুলি বলেছিলো তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়
কনিনিকর সাথে বিয়ের পর থেকেই প্রতিটা মুহূর্তে সে মাসিমার সাথে ঝামেলা করতো।অফিস আর বাড়ি ছাড়া সংসারের কুটোটি সে সরিয়ে রাখতো না।সর্বক্ষণের জন্য কাজের লোক রাখার পরেও কাজ নিয়ে রাহুলের মাকে প্রতিটা মুহূর্তে কথা শুনিয়ে যেত। মাসীমা কখনোই রাহুলকে কোন কথা জানাতেন না।কিন্তু পরে গিয়ে পায়ে আঘাত লাগার পরে যখন মাসিমা কিছুদিনের জন্য হাঁটাচলা করতে পারতেন না তখনো কনিনিকা এটাকে রাহুলের মায়ের নাটক বলে অশান্তি চরমে তুলেছে।শেষে বাড়ি ছেড়েছে।পড়ে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমাও চেয়েছে।ফিরে আসতে চেয়েছে রাহুলের কাছে।মা তাকে পুনরায় মেনে নিতে বললেও রাহুল মানতে পারেনি কারণ দেবলীনাকে নিয়ে কনীনিকা নানান ধরনের কুৎসিত ইঙ্গিত করেছে।
সব ঘটনা শোনার পর দেবলীনা তাকে একটাই কথা বলেছিল সেদিন,
---- একটা সুযোগ দিয়ে দেখতে পারতিস।
রাহুল তাকে জানিয়েছিল সেদিন,
--- সুযোগ তাকে এর আগেও একবার দেওয়া হয়েছিল।মর্যাদা রাখতে পারেনি।সব থেকে বড় কথা কি জানিস বিশ্বাস একবার ভেঙ্গে গেলে তাকে জোড়াতাপী দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়না।যতই চেষ্টা করা হোকনা কেন দাগ একটা থেকেই যায়।ও একটা কথা তোকে বলি।যে কথাটা আমি অনেক দেরিতে বুঝেছি।অবশ্য বলতে পারিস কনিনীকা বুঝিয়েছে।ঐভাবে তোকে নিয়ে আমায় আঘাত না করলে আমি কোনদিন বুঝতেই পারতাম না আমার জীবনের প্রকৃত ভালোবাসা আমি নিজেই হারিয়েছি।তবে সে আর কোনদিন আমার কাছে ধরা দিতে চাইবে কিনা জানিনা।কিন্তু আমি অপেক্ষায় থাকবো।শুধু এই অপেক্ষা যদি কোনদিন আমার শেষ হয় সেটা জানতে তোর ফোন নম্বরটা আমার দরকার।
দেবলীনা ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে রাহুলের হাতে দিয়ে উবেরে উঠে পড়ে।