Tuesday, November 30, 2021

দাগ

দাগ
বিশ্বাস একবার ভেঙ্গে গেলে আর তা জোড়া যায়না!!কনিনিকার মধ্যে ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে রাহুল ফিরিয়ে দিয়েছিল তার প্রকৃত ভালোবাসা দেবলীনাকে।
 সেই কলেজ লাইফ থেকেই দেবলীনার সাথে বন্ধুত্ব রাহুলের।দেবলীনা কোনদিন মুখ ফুটে রাহুলকে বলেনি যে সে তাকে ভালোবাসে।পাশ করেই রাহুল চাকরি পেয়ে যায়।দেবলীনা ভাবতেই পারেনি কোনদিন রাহুল তাকে ভালোইবাসেনি;শুধুমাত্র বন্ধুত্বের চোখেই তাকে দেখে।চাকরি পাওয়ার পর দেবলীনা আশা করেছিল এবার রাহুল তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।চাকরিতে জয়েন করার তিনমাস পর একদিন রাহুল ফোন করে দেবলীনাকে ডেকে নেয় অফিস ছুটির পর একটা কফিশপে। দেবলীনা তখন ছোটখাটো চাকরি করছে।মনে অনেক আশা নিয়েই নিদৃষ্ট সময়ের আগেই দেবলীনা পৌঁছে যায় কফিশপে।বুকটার ভিতর উথাল-পাতাল এক ঢেউ অনুভব করছে।ঘড়ির কাঁটা মিনিট ছুঁতে ঘণ্টা লাগিয়ে দিচ্ছে তখন।কিছুক্ষণ পর রাহুল আসে কিন্তু একা নয়।
  সেদিন দেবলীনা অনেক কষ্টে চোখের জল সংবরণ করেছিলো।রাহুলের সাথে যে মেয়েটি এসেছিল সে রাহুলের অফিস কলিগ।তিনমাসের আলাপ।তিনমাসেরই রাহুল কনীনিকার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করলো।আর এতগুলো বছর ধরে রাহুল বুঝতেই পারলো না দেবলীনা তাকে পাগলের মত ভালোবাসে। চাকরী পাওয়ার ছ'মাসের মধ্যেই বিয়ে।
  পাঁচ বছর হয়ে গেল রাহুলের বিয়ে হয়েছে।অভিমান আর কষ্ট মিলিয়ে সময় দেবলীনাকে অনেকটাই পরিণত করেছে।পাল্টে ফেলেছে সে তার মোবাইল সীম।এখন সে সুচাকুরে। একটা মাল্টিন্যাশাল কোম্পানিতে বেশ ভালো পোষ্টে আছে এখন।এখনো বিয়ে করেনি।বলা ভালো বিয়ে করবে না বলেই করা হয়ে ওঠেনি।মা আর মেয়ের সংসার।
 এক কলিগের বিয়েতে অনেকের সাথে দেবলীনাও গেছিলো মধ্যমগ্রাম।সবাই একই সাথে রাতের শেষ ট্রেন ধরে ফিরছে।হাসি,ঠাট্টা,গল্প,গুজব চলছে।বেশ ফাঁকা ছিলো ট্রেনটা।তাই নিজেদের মধ্যে আনন্দটাও সকলে বেশ উপভোগ করছিলো।হঠাৎ অনেকদিন আগে শোনা এক কণ্ঠস্বরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেবলীনা তাকিয়ে দেখে রাহুল।
 তাকে দেখেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে দেবলীনা।কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়।নিজেকে সামান্য আড়াল করতে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে।একটু দূরেই একটা ছিট ফাঁকা দেখে রাহুল এগিয়ে গিয়ে বসে।আর দেবলীনা অতীতে বিচরণ করতে থাকে।
 ট্রেন শিয়ালদা এসে থামে।দেবলীনা সকলের শেষে নামে। আড় চোখে দেখে নেয় রাহুল নেমে গেছে।অজান্তেই চোখের কোনটা ভিজে যায়।সাথে যারা ছিল তারা সকলেই শিয়ালদার আগেই নেমেছে। ফ্লাটফর্ম দিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
--- কিরে এত বছরের বন্ধুত্ব আমাদের আমাকে দেখেও না চেনার ভান করলি?
 তাকিয়ে দেখে রাহুল তার পাশে।মনেমনে ভাবলো দেবলীনা এত চেষ্টা করেও রাহুলের দৃষ্টি এড়াতে পারলো না সে। আমতা আমতা করে বলল,
--- ঠিক বুঝতে পারিনি।আসলে গল্পে মজগুল ছিলাম তো।কেমন আছিস বল।
--- এখন আমি খুব ভালো আছি।হ্যারে তুই আমার বিয়েতে এলি না,পড়ে কতবার তোকে ফোন করলাম ;সব সময়ই সুইচ অফ বলতো।আমার সাথে যোগাযোগ রাখবি না বলে নম্বর পাল্টে নিয়েছিস?
 একথার কোন উত্তর দেয়না দেবলীনা।রাহুলের কাছে জানতে চায়,
--- তোর বউ কেমন আছে রে!বাবা হয়েছিস?
--- আরে এসব ছাড় তো।কতদিন পরে দেখা হল আমরা অন্য কথা বলি।
--- কত রাত হয়েছে খেয়াল আছে?উবের ধরতে হবে।বাড়িতে গেলে তোর বউ বকবে না তোকে রাত হয়েছে বলে?
--- আমার বউ?সে আছে নাকি?মা ছেলের সংসার ছিলো এখনো তাই আছে?
--- মানেটা কি?
--- সে অনেক কথা।
--- সেই অনেক কথায় নাহয় আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনি।
 সেদিন রাহুল দেবলীনাকে যে কথাগুলি বলেছিলো তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়
 কনিনিকর সাথে বিয়ের পর থেকেই প্রতিটা মুহূর্তে সে মাসিমার সাথে ঝামেলা করতো।অফিস আর বাড়ি ছাড়া সংসারের কুটোটি সে সরিয়ে রাখতো না।সর্বক্ষণের জন্য কাজের লোক রাখার পরেও কাজ নিয়ে রাহুলের মাকে প্রতিটা মুহূর্তে কথা শুনিয়ে যেত। মাসীমা কখনোই রাহুলকে কোন কথা জানাতেন না।কিন্তু পরে গিয়ে পায়ে আঘাত লাগার পরে যখন মাসিমা কিছুদিনের জন্য হাঁটাচলা করতে পারতেন না তখনো কনিনিকা এটাকে রাহুলের মায়ের নাটক বলে অশান্তি চরমে তুলেছে।শেষে বাড়ি ছেড়েছে।পড়ে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমাও চেয়েছে।ফিরে আসতে চেয়েছে রাহুলের কাছে।মা তাকে পুনরায় মেনে নিতে বললেও রাহুল মানতে পারেনি কারণ দেবলীনাকে নিয়ে কনীনিকা নানান ধরনের কুৎসিত ইঙ্গিত করেছে।
সব ঘটনা শোনার পর দেবলীনা তাকে একটাই কথা বলেছিল সেদিন,
---- একটা সুযোগ দিয়ে দেখতে পারতিস।
 রাহুল তাকে জানিয়েছিল সেদিন,
--- সুযোগ তাকে এর আগেও একবার দেওয়া হয়েছিল।মর্যাদা রাখতে পারেনি।সব থেকে বড় কথা কি জানিস বিশ্বাস একবার ভেঙ্গে গেলে তাকে জোড়াতাপী দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়না।যতই চেষ্টা করা হোকনা কেন দাগ একটা থেকেই যায়।ও একটা কথা তোকে বলি।যে কথাটা আমি অনেক দেরিতে বুঝেছি।অবশ্য বলতে পারিস কনিনীকা বুঝিয়েছে।ঐভাবে তোকে নিয়ে আমায় আঘাত না করলে আমি কোনদিন বুঝতেই পারতাম না আমার জীবনের প্রকৃত ভালোবাসা আমি নিজেই হারিয়েছি।তবে সে আর কোনদিন আমার কাছে ধরা দিতে চাইবে কিনা জানিনা।কিন্তু আমি অপেক্ষায় থাকবো।শুধু এই অপেক্ষা যদি কোনদিন আমার শেষ হয় সেটা জানতে তোর ফোন নম্বরটা আমার দরকার।
 দেবলীনা ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে রাহুলের হাতে দিয়ে উবেরে উঠে পড়ে।


 
 


  

Monday, November 29, 2021

মায়া

মায়া
  নন্দা মুখার্জী
কলকাতা,বেহালা

এ পৃথিবীর রূপ,রস,গন্ধ
ছেড়ে যাবো চলে,
প্রাণ ভরে যেটুকু নিয়েছি
বাকিটা থাক নবজীবনের জন্য পরে।
মনের খেয়ালে কাটিয়েছি জীবন
সবাই যেমন কাটায়,
অলিখিত চুক্তি ছিল সংসারে
ভালোবাসার আদান-প্রদান।

সব জীবনই সুখ খুঁজে বেড়ায়
সুখী কি সবাই হয়?
সুখ-দুঃখের মাঝামাঝি
জীবন এগিয়ে যায়।
জীবনের সব চাওয়া
হয়না পূরণ,
অনেক না চাওয়া হঠাৎ পেয়ে
মন ভরে যায়।
চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কেউ
মিলাতে পারে না জীবনে,
সবকিছুর অবসান হয়
গেলে পৃথিবীর ওপাড়ে।

২৯-১১-২১

পরজনমে হইও রাধা

পরজনমে হোয়ও রাধা
সব প্রয়োজনে আমায় দরকার অথচ কাজ ফুরোলে যেন আমায় চেনেই না!!বুঝতে পারিনা আমার সাথে কেন উনি এটা করেন।
  হঠাৎ করেই শেখরের সাথে বিয়েটা ঠিক হয় অনিন্দিতার।বিয়ের আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না যে আমাদেরই কলেজের বাংলার প্রফেসর অনিরুদ্ধর ভাই শেখর।যেহেতু আমার সাবজেক্ট ছিল বাংলা তাই স্যারের সাথে আমার নিত্য দেখা হওয়াটাই স্বাভাবিক।শেখরের সাথে বিয়ের সন্মন্ধ  হওয়ার আগে আমার একটা সম্মন্ধ এসেছিল।চাকরীটা তার সরকারি ছিল কিন্তু বাবা রাজি হয়েছিলেন না তার কারণ সে ছেলেবেলা থেকেই মাসীর কাছে মানুষ।নিজের বাড়ি নেই।তার যখন ছ'মাস বয়স তার মা,বাবা তাকে তার মাসীর কাছে রেখে বাইরে বিশেষ প্রয়োজনে বেরিয়েছিল।কিন্তু বাইক অক্সিডেন্ট করে দুজনেই মারা যায়।সেই থেকে সে মাসীর কাছেই বড় হয়েছে।যেহেতু সরকারি চাকরি মা রাজী থাকলেও বাবা তার নিজের বাড়ি নেই বলে রাজি হলেন না।সে কে কি তার নাম,কোন কলেজে চাকরি করে আমি কিছুই জানতাম না।কিছুদিনের মধ্যেই শেখরের সাথে বিয়ে ঠিক হয়।
 বিয়েতে স্যার বরযাত্রী গেলেও আমার সাথে দেখা হয়নি।তাকে দেখি বৌভাতের দিনে।আর সেদিনই জানতে পারি স্যার শেখরের মাসতুত দাদা।আমার সাথে পূর্বে সম্মন্ধ হওয়া ছেলেটির ঘটনা মায়ের কাছে জেনেছিলাম।আর বিয়ের কিছুদিন পর স্যারের জীবন বৃত্তান্ত শুনি শেখরের কাছে। দুয়ে দুয়ে তখন চার করি নিজেই।কিন্তু শেখর বা তার মাকে ঘটনাটা লুকিয়ে যাই।
 স্যার কলেজ আর বাড়ি।বাড়ি ঢুকেই বইয়ে পাতায় মুখ গুঁজে থাকা।পরবর্তীতে আমার শ্বাশুড়ী মা অনেক চেষ্টা করেছেন স্যারের বিয়ে দেওয়ার।কিন্তু তিনি রাজি হননি।কখনোই আমার সামনে আসা বা আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেননি।তার সমস্ত কাজই আমার শ্বাশুড়ি মা করতেন।বলা ভালো স্যার আমাকে তার কোন কাজ করতে দিতেন না।শুধু বিয়ের পড়ে একদিন আমায় বলেছিলেন,
--- শেখর আমায় দাদা বলে ডাকে।তুমিও তাই বলবে।
 যদিও কোনদিন ডাকার দরকার পড়েনি তবুও কারো সামনে তার প্রসঙ্গ উঠলে দাদা করেই কথা বলতাম।শেখর একদিন আমার কাছে জানতে চেয়েছিল,
--- তুমি তো দাদার কলেজেই পড়তে।আগে থাকতে পরিচয় ছিলনা?
 পুরো অস্বীকার করে গেছিলাম অনিরুদ্ধ স্যারের কোন ক্লাস আমার ছিলনা।মুখ ফস্কে কেন যে মিথ্যা বেরিয়েছিল নিজেই বুঝতে পারিনি।
 তারপর শ্বাশুড়ী মা মারা গেলেন।একসাথেই হবিষ্যি করতাম। আমি তখন সাত মাসের প্রেগন্যান্ট।দাদা রান্না করে গুছিয়ে আমাদের ডাকতেন।কারণ শেখর কিছুই পারেনা ওই অফিসের কাজ ছাড়া।মেয়ে হল আমার।দাদা দুরাত হাসপাতালের বাইরে বসে।কারণ শেখর তখন অফিসের কাজে বাইরে।ওর ছিল রেলে চাকরি।মাঝে মধ্যে ওকে অডিট করতে বাইরে ছুটতে হত।
 স্যার রিটায়ার করলেন।একটা মানুষ সব সময়ের জন্য বাড়িতে অথচ তার মুখে কোন কথা নেই শুধুমাত্র আমার সাথে।মেয়ে অদিতি তার প্রাণ।তার সাথে অনর্গল কথা বলে চলেন স্যার।আমি সামনে দাঁড়ালেই চুপ।মেয়ের যখন আঠারো বছর বয়স হল বেশ কয়েকদিন তাকে সাথে নিয়ে ব্যাংকে গেলেন।জানতে চাইনি কেন?অদিতি এসে জানিয়েছে জেঠু সবকিছুর নমিনি করলো আমায়।
 হঠাৎ করে বুকে সর্দি বসে বেশ অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন।কিছুতেই হাসপাতালে ভর্তি করা গেলো না তাকে।বাড়িতে আর কতটুকু চিকিৎসা হয়।হাসপাতাল ভর্তির জন্য জোর জবরদস্তি করতে লাগলে করুণভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- শুধুমাত্র দুটো রান্না করে দিও আমায়।আর কিছু করতে হবেনা।অদিতি আছে তো।
 সে দৃষ্টিতে কি ছিল আমি জানিনা। বুকটার ভিতর ধড়াস করে উঠেছিল তখন।তারপর আস্তে আস্তে অবস্থার অবনতি।তখন তার সব কাজেই আমাকে তলব।কিন্তু কাজ হয়ে যাওয়ার পরই বলতেন,
--- তুমি এবার ঘরে যাও।
 শেষদিনে আমি তার গালে জল দেওয়ার পরেই তিনি চোখ বোজেন।
 মাসখানেক পরে দাদার আলমারি খুলে তার ডাইরিটা হাতে পাই।
 "আমি যেন পরজনমে তোমায় পাই অনিন্দিতা।"



Sunday, November 28, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (ত্রিশ ও শেষ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (ত্রিশ ও শেষ পর্ব)
  আমি আগেই পাঠককুলকে জানিয়েছি আমার এই উপন্যাসের প্রতিটা ঘটনা সত্যি।আমি এটাকে উপন্যাস বলছি ঠিকই।আদতে আমার পিতা অমরেশ রায় চৌধুরীর জীবনকে ঘিরে গড়ে ওঠা নানান দিক।আমি এখানে কোন ঘটনা বা একটি শব্দও চয়ন করিনি যা তার পরিবারে ঘটেনি।ঠিক যেভাবে ঘটনাগুলি ঘটেছে সেইভাবে ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছি মাত্র।মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী।তাই লিখে রেখে গেলাম নিজ পরিবারের মূল ঘটনাগুলি।
  লেখাটি শুরু করেছিলাম অমরেশবাবুকে নিয়ে এবং তাকে ঘিরে আর যারা আছেন তাদের নিয়ে।আজ লিখবো তার একমাত্র পুত্র সন্তানটিকে নিয়ে।এটাই আমার শেষ পর্ব।কারণ আজ ২০২১ আঠাশে নভেম্বর।আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে ১৯৮৬ সালে আজকের দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেন।
  তার একমাত্র ছেলে হারা ওরফে প্রণয়।সহজ,সরল যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে।দিদিদের চোখের মণি সে আজও। সেজদি ভারতী তাকে আজও সেই ছোট্ট ভাইটিই ভাবে।জীবনে সেভাবে কিছু করে উঠতে না পারলেও একটি বেসরকারী সংস্থায় সে কর্মরত।ভারতী তার বিয়ে দিয়েছে।দুটি ছেলে হয়েছে।ভাই এবং ভায়ের পরিবারের প্রতি আজও ভারতী তার সমস্ত দায়িত্ব পালন করে চলেছে।ভারতী তার ভায়ের জন্য আজও যেভাবে ভাবে হয়তো কোন মা ও এই ছিয়াত্তর বছর বয়সে এসে তার সন্তানের জন্য এতটা ভাববে না।কারণ ছেলের বিয়ে দেওয়ার পর অধিকাংশ মায়েরা তার সমস্ত দায়িত্ব তার বৌমার হাতেই ছেড়ে দেয়।মা না হয়েও কিভাবে মা হয়ে উঠা যায় তা এই ভারতীকে না দেখলে বোঝা যাবে না।তার ছেলেদের লেখাপড়া এবং সমস্ত রকম বায়না,সাধ আহ্লাদ সবকিছুর দায়িত্ব এই ভারতীর।বিবাহিত জীবন খুব একটা সুখের না হলেও জীবন এগিয়ে চলেছে।
 যে ছেলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিল,যে মানুষটির অর্থ সম্পদে কোন কমতি নেই - জীবনে কিন্তু সে সুখী হতে পারেনি।অর্থ সম্পদ যে জীবনে সুখ বয়ে আনতে পারেনা প্রণয়ের জীবন তা প্রমাণ করে দিয়েছে।জীবনে সুখী হওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে ঠিকই কিন্তু দুটি হৃদয়ের মিল না থাকলে কোনদিনও সুখ ধরা দেয়না।প্রণয়ের জীবনও অর্থ প্রাচুর্যের মধ্যে বসে থেকে সুখহীন ভাবেই এগিয়ে চলেছে।
 প্রতিটা মানুষের পুরো জীবনটাই এক একটা বাস্তব উপন্যাস ।আর এই উপন্যাস কখনোই যবনিকা টানতে পারেনা।কারণ সেই মানুষটি চলে গেলেও তার উত্তরসূরিরা কিন্তু থেকে যায়।গল্প কিন্তু এগিয়েই চলে।কাহিনীর সূত্রপাত আমরেশবাবুকে নিয়ে হলেও তিনি চলে যাওয়ার পরেও কিন্তু কাহিনী শেষ হয়নি।আজ পঁয়ত্রিশ বছর তিনি নেই কিন্তু তাকে ঘিরে যে মানুষগুলি ছিল এবং এখনো অনেকেই আছেন কারো জীবনই কিন্তু থেমে নেই।এগিয়ে চলেছে।আমার এ উপন্যাস শেষ হওয়ার নয়।কিন্তু সবকিছুরই একটি দাড়ি আমাদের টানতেই হয়।তাই যাকে নিয়ে আমার এই গল্পের শুরু তার মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে আমার গল্প বা উপন্যাস কিংবা আত্মজীবনী যাই বলুন না কেন আমি তার পরিসমাপ্তি ঘটাবো।
 আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে ১৯৮৬ সালের ২৮ শে নভেম্বর শুক্রবার দুপুর ১২টা পাঁচ মিনিটে  অমৃতযোগে বেহালা ঠাকুরপুকুর কদমতলা নিজ বাড়িতে অমরেশবাবু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর ১১ মাস।
 ছেলেবেলায় তার জন্মের পর যখন বাড়ি থেকে তার কুষ্ঠি করেছিলো সেই কুষ্ঠিতে ছিল (ঠাম্মার কাছে দিদিদের গল্প শোনা।যা পরবর্তীতে বাড়ির অন্য সকলেই জানতেন) তাঁর বয়স যখন ছিয়াত্তর বছর হবে তখন তাঁর একটি ফাড়া আছে।উনি সেটি যদি ডিঙ্গতে পারেন তাহলে শতায়ু বৎসর আয়ু পাবেন।পরিবারের দূর্ভাগ্য তিনি ওই বয়সটি ডিঙ্গতে পারেননি।
 তিনি ছিলেন অ্যাজমার রোগী আগেই পাঠককুলকে জানিয়েছি।আগেরদিন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় ডাক্তার বললেন বাড়িতে অক্সিজেন আনতে।আনা হল।দূর-দূরান্ত যত জায়গায় রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়রা রয়েছেন সকলেই টেলিগ্রাম করা হল।একে একে বাড়িতে লোকে লোকারণ্য।আত্মীয়-স্বজনরাই অধিকাংশ। তাঁর মৃত্যুর মাত্র মিনিট দশেক আগে বাড়িতে এসে পৌঁছায় সুদূর আগরতলা থেকে তার বড় মেয়ে লক্ষী।কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে,
--- বাবু আমি তোমার বড় মেয়ে।তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?
 মৃত্যুর একটু আগে সামান্য চোখ খুলে তিনি মাথা কাত করে জানিয়ে যান তিনি সে কথা শুনেছেন।
 শোকে পাথর পুরো পরিবার,আত্মীয়-স্বজন।তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে জজ সেই মুহূর্তের রায় ঘোষণা স্থগিত রাখেন।ছুটি হয়ে যায় কোর্ট চত্বর।
 কত মানুষ তাঁর মৃত্যুর খবর না জেনে বাড়িতে এসেছে তাদের মাসিক সাহায্য নিতে।আবার কত মানুষ এসেছে তার ছেলেমেয়ে জীবনে দাঁড়িয়েছে তাই বাবুকে মিষ্টি মুখ করাতে।
  জীবনে কোনদিন যে মানুষটা উচ্চ স্বরে কারো সাথে কথা বলেননি সেই মানুষটাই কেসে হেরে গেলে বিনা কারণে চিৎকার করে কথা বলতেন।কোন মেয়েকে কোনদিন নাম ধরে ডাকতেন না।যদি কখনো ডেকেছেন তখনই বুঝে ফেলতো তাঁর প্রতিটা মেয়েই 'বাবু আজ কেসে হেরে গেছেন।'
 প্রতিটা মেয়েই ছিলো তার মা।সবাইকেই তিনি মা বলেই ডাকতেন।মহালয়ার ভোরে সব সন্তানদের ডেকে নিয়ে রেডিও চালিয়ে সকলের সাথে বসে মহালয়া শুনতেন।মহালয়া শেষে সবাই উঠে যখন ঘুমাতে যেত তিনি শুরু করতেন চণ্ডীপাঠ।এইভাবে পুজোর আগে পর্যন্ত তিনি রোজ চণ্ডীপাঠে বসতেন সূর্যদোয়ের আগে।সেই আওয়াজ আজও যেন কানে ভেসে আসে কোথাও চণ্ডীপাঠ শুনলেই।
 ছন্দা যখন প্রতি ক্লাসে প্রথম হয়ে ক্লাসে উঠতো আর তার বাবুর কাছে এসে  প্রোগ্রেসরিপোর্টটা হাতে দিত তিনি শুধু মাথার উপরে হাসিমুখে হাতটা রাখতেন।স্বপ্ন দেখতেন তার এই ছোট মেয়েটা জীবনে একদিন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাবে।কিন্তু তিনি জানতেন না মাথার উপর থেকে তাঁর হাতটা সরে গেলে তাঁর সন্তানদের জীবনগুলো গতানুগতিকভাবেই চলবে।
 এমন প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষের দশটি সন্তান হওয়ার পরেও অধিকাংশ সন্তানদের তিনি যথেষ্ট শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলেও একটা সন্তানও তার জীবনে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।কিন্তু তিনি চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর অবর্তমানে তাঁর সেজ মেয়ে ভারতীও চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
  হয়ত ভারতী তার জীবনে স্বামী,সন্তান,নিজ সংসার পায়নি।কিন্তু সে তাঁর বাবুর অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার জন্য নিজের পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেছে।ভাই এবং বোনগুলোকে লেখাপড়া শিখিয়েছে,বিয়ে দিয়েছে সংসারী করেছে।দিদি হয়েও সে একাই বাবা এবং মায়ের দায়িত্ব পালন করে চলেছে এই ছিয়াত্তর বছর বয়সেও।যা অনেকেই পারেনা কিংবা পারলেও করেনা।
  মানুষ তার ভাগ্য নিয়েই জন্মায়।কেউ কারো ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা।সব সময় চেষ্টা পরিশ্রমই যে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে তা কিন্তু নয়।পাঠককুল আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন।কিন্তু আমার জীবনের ঘটনাসমুহ আর আমার অভিজ্ঞতার কথায় লিখলাম।
 জীবন উপন্যাস শেষ হয়না।তাই আমার পরিবারের এ গল্পও কখনো শেষ হবে না।কিন্তু আমি এখানেই দাড়ি টেনে দিলাম।
  এতক্ষনে নিশ্চয় আপনারা জেনে গেছেন এই পরিবারের আমি কোন মেয়েটি? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন।আমি হলাম সেই মেয়েটি যার জন্য তার মা সাধুর কথামত মায়ের মন্দিরে চালকুমড়ো মানত করেছিলেন।আমি হলাম ছন্দা ওরফে আপনাদের নন্দা মুখার্জি রায় চৌধুরী।
 পুনশ্চ আজ সেই অভিশপ্ত দিন ২৮শে নভেম্বর।

    সমাপ্ত
 

জীবনের প্রতি বাঁকে (ঊনত্রিশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (ঊনত্রিশ পর্ব)
  ছন্দার বিয়ের দুবছরের মাথায় তার প্রথম সন্তান মৌ তার কোল জুড়ে আসে। চার পুরুষ পর বংশে কন্যা সন্তান।স্বভাবতই বাড়ির সকলে খুব খুশি।সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছন্দার স্বামী। ছ'জনের দায়িত্ব তার মাথার উপর।অভাব নিত্যসঙ্গী।যে ছন্দা জন্মের পর থেকে অভাব কি জিনিষ জানতো না বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে ঢুকে সে বুঝতে পারে অভাব কি!
 শ্বাশুড়ী এবং তার দেওরেরা এক কথায় বলতে গেলে বলা যায় তারা খুবই ভালো।কিন্তু কিছু আত্মীয় তাদের খুব ভালো চাইতে দিতে লাগলো তাদের কানে কুমন্ত্রণা।আর তার জের পড়তে লাগলো ছন্দার উপর।টুকটাক ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা ঝক্কি পোহাতে পোহাতে একসময় বাধ্য হয়ে ছন্দা চলে আসে তার বাপের বাড়িতে।
  আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়।ছন্দা তার সমস্ত গয়না বিক্রি করে সামান্য একটুখানি জমি কিনে বাড়ি করে সেখানে চলে যায়।মেয়ের জন্মের ন'বছর পর ছন্দার একটি পুত্রসন্তান হয়।
 হঠাৎ করেই ছন্দার স্বামীর এজমা ধরা পরে।যে বাড়িটা ছন্দা করেছিলো সেটা ছিল একটু গ্রামের দিকে।ফলে ফাঁকা জমি ছিলো প্রচুর।ঠান্ডার সময় ঠান্ডা একদম দার্জিলিংয়ের মত।অফিসে যাতায়াতের অসুবিধা।ছন্দা সিদ্ধান্ত নেয় ওই বাড়ি বিক্রি করে সে কলকাতার দিকে বাড়ি করবে।
 ছন্দা তার জীবনে এমন একজন স্বামী পেয়েছিলো যে ছন্দার কোন কাজকেই বাঁধা দিত না। স্বামীর কাছে কোন পরামর্শ চাইলে সে বলতো,
--- তুমি যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করো।আমি তোমার সাথে আছি।
 ছেলের বয়স যখন পনের আর মেয়ের কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে বিমান তখন অবসর নেয়।অবসর নেওয়ার পরের মাসেই প্রচন্ডভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে বিমান।ডাক্তার জানিয়ে দেন বাঁচার আশা ক্ষীণ।তবুও ছন্দা এবং তার ছেলেমেয়ে,জামাই,ভায়েরা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাহায্যে এক নার্সিংহোম থেকে আর এক নার্সিংহোম করে বেড়ায়।বিমান চলে যায় ভেন্টিলেশনে।
 জীবনে অনেক কিছুরই মীরাক্কেল ঘটে।টানা সতেরদিন ভেন্টিলেশনে থাকার পরে বিমান আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে ওঠে।প্রথম দিকে তাকে নানান নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়।লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হওয়ার পর যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তখন তৎকালীন কলকাতা মেয়রের সাহায্যে পিজি হাসপাতালের আইসিসিইউ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করা হয়। ডাক্তারের হাত যশে এবং ভগবানের অশেষ কৃপায় বিমান সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফেরে।
 একবছর পড়ে সেই আবার তাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি।কিন্তু এবারে ঈশ্বর মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।এবারের সব চেষ্টা অর্থ দণ্ড সবই বিফলে গেলো।ফিরলো না সে।চলে গেলো চিরতরে।মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও ছেলে তখন সবে একাদশ শ্রেণী।এখন সে বিটেক পড়ছে।ছন্দা হয়ে গেলো সারাজীবনের মত একা।সময় কাটাতে ছেলেবেলার অভ্যাসকে জড়িয়ে ধরলো।শুরু করলো আবার লেখালেখি।সকাল হলেই মা ছেলের জন্য দুটি রান্না করেই সে ছুটে যায় তার ছাদ বাগানে।যেখানে দিনের অনেকটা সময় সে মনের খুশিতে কাটিয়ে দেয়।প্রতিটা গাছের পাতা,ফুল,কুড়ি তার সাথে কথা বলে।ছন্দা রোজ একটু একটু করে তাদের বেড়ে ওঠা দেখে। গাছে ফুটে থাকা ফুলগুলি ক্ষণিকের জন্য হলেও ছন্দার মনের সব কষ্ট ভুলিয়ে মন খুশিতে ভরিয়ে দেয়।
  আজকাল ভার্চুয়াল জগতের সূত্র ধরে সে বাইরে গড়ে তুলেছে একটি নিজের জগৎ।বেশ কয়েকটি বইও তার বেরিয়েছে।নেই নেই করে অনেক মানুষই আজ তাকে চেনে।নিঃসঙ্গ জীবনে লেখালেখির সূত্র ধরে পরিচয় হয়েছে তার আজ বহু মানুষের সাথে।মাঝে মধ্যে মেয়ে জামাইয়ের পাল্লায় পরে ছেলেকে সাথে নিয়ে ভারতবর্ষের নানান প্রান্তে তারা ঘুরে বেড়ায়।কিন্তু মাঝে মাঝে একাকী ঘরের কোনে প্রিয় মানুষটির জন্য আজও তার চোখে জল ঝরে।আসলে আমাদের জীবনের ফেলে আসা অতীত কখনোই আমাদের পিছু ছাড়েনা।
 সেই অতীত যে অতীত এক সময়ে আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দ দিয়েছে,খুশি দিয়েছে।মজা করে সময় কাটানোর সুযোগ দিয়েছে।আমৃত্যু আমরা কেউই সেই অতীতকে ভুলতে পারিনা।অতীত যেন আমাদের শরীরের সাথে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।আমরা কেউই শত চেষ্টা করেও অতীতকে আমাদের মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনা।
 অতীত ফিরে আসে বারবার আমাদের সামনে যখন সে আমাদের একা পায়।এই অতীত অনেক সময় আমাদের নিসঙ্গতাকে সঙ্গী দিতে আসে। লোকালয়কে অতীত ভয় পায়। কারো পদশব্দ বা কারো আগমনে যেভাবে সে চুপিচুপি আসে ঠিক সেইভাবেই সে পালিয়ে যায়।একাকী হলেই ছেলেবেলা,কৈশোর,যৌবন,মধ্য বয়স - সব যেন চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে।সব সময় অতীত যে আমাদের শুধু কষ্ট দেয় তা কিন্তু মোটেই নয়।অনেক হাসি,মজা,আনন্দের অতীত আজও আমাদের মনে পড়লে আমরা মজা পাই।ছেলেবেলার কোন বন্ধুর সাথে দেখা হলে অতীতের সেই গল্পগুলিই বারবার আমরা আলোচনা করি আর তার থেকে মজার রস আজও সংগ্রহ করে থাকি।দুঃখের অতীতকে আমরা ভুলতে চাইলেও মজা বা আনন্দের অতীতকে কিন্তু আমরা সকলে জড়িয়ে থাকতে চাই।
 পঞ্চাশ পেরোনো ছন্দার জীবনে এখন একটাই স্বপ্ন ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করা।মেয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে সুখেই আছে।মেয়েটি তার গাছ পাগল,ধর্মভীরু আর ভালোবাসে সে তার মায়েরই মত নানান ধরনের রান্নার এক্সপেরিমেন্ট।
 জীবন থেকে অনেকটা সময় হারিয়ে গেছে।শুধু সময় নয় হারিয়েছে সব থেকে কাছের প্রিয় মানুষগুলিও।প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী হঠাৎ হারানোর ব্যথা মানুষকে কিছুটা সময় থমকে দেয়।ঠিক যেমন কালবৈশাখী ঝড়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়।কিন্তু মানব জীবন গড়ে দেওয়ার সব থেকে ভালো ওষুধ হচ্ছে সময়।আর সেই সময়ের সাথে সাথে আসে নানান দিক।জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে মানুষ বেছে নেয় তার উপযুক্ত একটি দিক।যেদিকে সে খুঁজে পায় তার আনন্দ এবং সময় কাটানোর এক অনাবিল সুযোগ।
 সরকারি চাকুরী করা স্বামীর পেনশন,বাড়িভাড়া আজ মা ছেলের সামনের দিকে এগিয়ে চলতে আর্থিক অসুবিধা না থাকলেও মাথার উপর যে বটগাছটা চিরতরে হারিয়ে গেছে যার ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে ছন্দা ছাড়াও তার ছেলেমেয়ে সেই অভাব ছন্দা হয়ত কোনদিনও ঘোচাতে পারবে না।কিন্তু সে যতদিন বেঁচে আছে সে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তার সন্তানদের পিতৃশোক ভুলিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে।কিন্তু এ শোক কেউ কোনদিনও ভুলতে পারেনা।তবুও মা হিসাবে ছন্দা সে চেষ্টা করে যাবে।
 ২০১৭ সালে ছন্দা হারিয়েছে তার একান্ত প্রিয় কাছের মানুষটিকে।কিন্তু কাঁদার সময়টুকুও সে পায়নি।পনের বছরের ছেলে সেই মুহূর্তে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছে পিজির উদ্দেশ্যে।শোক ভুলে ছেলের জন্য টেনশনে তার সময় কেটেছে।মেয়ে ঘরের ভিতর বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কাটা কইমাছের মত ছটফট করছে।তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আর একহাতে ফোনে নিজেই তার স্বামীর মৃত্যু খবর জানাচ্ছে আত্মীয়দের।কতটা শক্তমনের মানুষ হলে এগুলো করা যায়!নাকি ছন্দা সেই সময়ে পাথর হয়ে গেছিলো।এই সতের সাল কেড়ে নিয়েছে ছন্দার আর এক খুব কাছের প্রিয় মানুষকে।হারিয়ে গেছেন ছন্দার জীবন থেকে তার মা শান্তিলতাদেবী।এই সাল কেড়েছে পিতৃসম তার বড় ভগ্নিপতিকে।আর আঠারো সালের শুরুতেই কেড়েছে তার জীবনের সব থেকে ভালো বন্ধু আকাশকে।
 জীবন কিন্তু থেমে থাকেনা।সে এগিয়ে চলেছে তার নিয়ম মেনেই।

ক্রমশঃ

Saturday, November 27, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (আঠাশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (আঠাশ পর্ব)
  মানুষের জীবনে পারিপার্শ্বিক নানান ঘটনা অপরের কাছ থেকে বহু দূরে সরিয়ে দেয়।ইচ্ছা বা অনিচ্ছা যায় হোকনা কেন মানুষ চাইলেও আগের মত আর সময় দিতে পারেনা তার কাছের মানুষগুলোকে।মানুষের একটু একটু করে বয়স বাড়ে আর তার চারিপাশের গণ্ডিটা বড় হতে থাকে।একে অপরকে অভিযোগ করি যোগাযোগ রাখে না বলে।কিন্তু নিজেরা কখনোই ভেবে দেখিনা আমিও আর সেই আগের মত নেই।
 আকাশ তার রাজনীতির জীবন,সমাজ সেবা আর মেধাবী গরীব মানুষগুলিকে দাঁড় করানোর স্বপ্নে বিভোর।পারিবারিক নানান ঘাত প্রতিঘাত নিয়ে জর্জরিত।তার দাদা অনল ভালোবাসলো নীচু ঘরের (??)একটি মেয়েকে।মেয়েটি পেশায় নার্স।আকাশের অসুস্থ্যতার সময়ে হাসপাতালে যাতায়াতের সূত্র ধরে তার সাথে পরিচয়। অনল তখন সবে চাকরি পেয়েছে।মেয়েটি আকাশকে জানালো যে সে তার দাদাকে ভালোবাসে। তাছাড়াও একই পাড়ায় ছিল উভয়ের বাড়ি।অনল মেয়েটিকে জানিয়ে দিল তার ছোটভাই চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত সে গোপাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কিছু জানাতে পারবে না।বাড়িতে বাবা,মা জেনে গেলেন।শুরু হল চরম অশান্তি।তখন অবশ্য ছন্দার বিয়ে হয়নি।এবং ঘটনাক্রমে সে তখন আগরতলায় ছিল।বন্ধুত্ব হয়ে গেলো ছন্দার সাথে গোপার।সমস্ত ঘটনায় গোপা ছন্দাকে জানালো।দেখালো অজস্র চিঠি।ওই বয়সেই দিদি,ভগ্নিপতিকে বোঝানোর চেষ্টা করলো ছন্দা।তারা ফুৎকারে সবকিছু উড়িয়ে দিলেন।সরল,নরম মনের ছেলে অনল বেশ কয়েকবার সুইসাইড করতে গেলো।কিন্তু প্রতিবারই সেই সময় কেউ না কেউ দেখে ফেলে তাকে সে পথ থেকে সরিয়ে আনলো।
  খুব তাড়াহুড়ো করে যেমন তেমন একটি মেয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক করলো তার বাবা,মা।ভেঙ্গে গেলো দুটি হৃদয়ের স্বপ্ন শুধুমাত্র গোপা ব্রাহ্মণ নয় বলে। অনলের বিয়ের পাঁচ বছর বাদে আমেরিকাপ্রবাসী একটি ছেলের সাথে গোপার বিয়ে হয়।
 নানান ঝামেলা ঝক্কি প্রতিটা পরিবারকেই পোহাতে হয়। আস্তে আস্তে ঝড় থেমেও যায়।সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
 দীর্ঘ পনের বছর আকাশের সাথে কলকাতার কারো কোনোই যোগাযোগ ছিল না।মাঝেমধ্যে ফোনে কেউ কখনো হয়ত কারো খবর নিয়েছে।পনের বছর বাদে হঠাৎ একটি ফোন মারফৎ জানতে পারে ছন্দারা আকাশের এক বিশাল অক্সিডেন্ট হয়েছে।কোমরের হাড় সব গুড়ো গুড়ো। কিডনীর ঠিক ছ'ইঞ্চির নীচ থেকে সমস্ত হাড় ভেঙ্গে চৌচির।আটচল্লিশ ঘণ্টা সে অজ্ঞান। কান,নাক,মুখ এবং ক্ষতস্থান থেকে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে অনবরত।ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।আগরতলায় উন্নতমানের চিকিৎসা না থাকায় তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাক্তার সমেত তাকে স্ট্রেচারে উঠিয়ে প্লেনে করে কলকাতা নিয়ে আসবে।সেইমত নখানা ছিটের জায়গা লাগে আকাশের।সাথে বাকি আরও অনেকেই।প্রচুর অর্থব্যয়ে আকাশকে ডক্টর সমেত কলকাতা আনা হয়।তখন অবশ্য তার জ্ঞান ফিরেছে এবং ব্লিডিংও বন্ধ হয়েছে।ছুটে গেলো তার সমস্ত মাসতুত ভাইবোন, মামা, মাসিরা, মেসোরা।ছন্দার তখন দুই ছেলেমেয়ে।ছেলেটি তখন খুবই ছোট।সেও ছুটে যায়।সবাইকে দেখেই আকাশ খুব কান্নাকাটি করতে লাগে।আকাশের অসীম মানসিক বল, ধর্য্য,কষ্ট সহ্য করার এক প্রবল ক্ষমতা আর ডাক্তারের হাতজশ আকাশ ফিরে পেলো নবজন্ম।
 হাসপাতাল থেকে ফিরে এলো সে ছন্দার বাড়িতে।তারপর থেকে বছরে তিন থেকে চারমাস সে কলকাতা আসতো এবং সমস্ত কলকাতা জুড়ে এত আত্মীয়-স্বজন থাকার পরেও সে এসে থাকতো তার ছোটমাসীর বাড়িতেই।ভুলে যাওয়া বা থিতিয়ে যাওয়া সেই নোংরা কথাগুলি আবার শুরু করে সকলেই।
 ছন্দার ছেলেমেয়ে তখন বড় হয়েছে।তাদের কানেও কথা যাচ্ছে।স্বামীর কানেও কথা তুলছে সকলে।ছন্দার স্বামী এমনই একটি মানুষ ছিলেন যিনি তার স্ত্রীকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করতেন।তিনি ছন্দাকে জানিয়ে দিলেন,
--- আরে এটা হচ্ছে ভারতবর্ষ। বাঙ্গালী সমাজ।এখানে একটা পুরুষ আর একটা নারীর সম্পর্ককে সকলেই মনে করে তাদের মধ্যে রয়েছে যৌণ সম্পর্ক।এর বাইরে বাঙ্গালীরা আর অন্যকিছু ভাবতেই পারে না।এই সমাজটা এতটাই নোংরা যে এরা বিধবা মেয়ে যদি বাবার কাছে থাকে বা মেয়ের বয়স হয়ে গেলে তার যদি ঠিক সময়ে বিয়ে বাবা না দেয়,ছেলে যদি বিয়ে না করে মাকে নিয়ে থাকে - এইসব মানুষরা তাদের নিয়েও কথা বলতে ছাড়েনা।এসব নিয়ে ভেবো না।কেউ তো তোমায় খাওয়ায় পড়ায় না।সুতরাং এসব নিয়ে মন খারাপ করনা।যেমন আছো তেমন থাকো।সকলের কথা শুনে চলতে গেলে মানুষের সাথে কোন সম্পর্ক রাখায় কঠিন হয়ে পড়বে।আমি তোমায় বিশ্বাস করি।কে কি বলল তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে মানসিক শান্তি নষ্ট কোরো না।
 এমন একটা মানুষ ছিলো ছন্দার স্বামী। পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয়-স্বজন সকলেই তাকে খুব ভালোবাসত। কারো বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা,ঝগড়া-বিবাদ কোনদিন সে করেনি।
 হঠাৎ করেই ধরা পড়ে আকাশের সুগার।অবিবাহিত আকাশ সারাজীবন নিজের কষ্ট চেপে রেখে অন্যের জন্য করে গেছে।বৃদ্ধা মা তার বাবাকে নিয়েই থাকতেন বেশি ব্যস্ত।অন্য ভায়েরা সবাই বিবাহিত।সুতরাং আকাশের দেখভাল করার মত পরিবারে কেউই তখন নেই।অবহেলা,অযত্নে তার দিন চলতে থাকে।আর ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে তারা যে বাবা,মায়ের বাধ্য হয়ে থাকবে তা সবসময় হয়না।স্বাধীনচেতা আকাশ তার শরীরের কষ্টটাও অন্যকে জানিয়ে তাকে বিব্রত করতে চায়নি।কিন্তু যখন তার ভায়েরা জেনেছে তখন কিন্তু তারা আকাশের চিকিৎসার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি।কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
  কলকাতা,ভেলোর,চেন্নাই,হায়দ্রাবাদ কোথাও বাদ দেয়নি তার ভায়েরা।সুগারের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেলো যে সে মারাত্মকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়ল।শুরু হল তার ডায়ালিসিস।অধিকাংশ সময়েই কিন্তু সে তার প্রিয় মাসীর বাড়িতেই থেকে ট্রিটমেন্ট করতো। কিডনী ট্রান্সপ্লান্টও করা হল প্রচুর অর্থব্যয়ে।একটা বছর সুস্থ্য ছিল তারপর।যতবার চেকআপে এসেছে ততবারই সে ছন্দার বাড়িতেই উঠেছে।কথা আগেও হত অসুস্থ্য থাকাকালীন সময়েও তা বন্ধ হয়নি।
 হঠাৎ করেই ন'বছর আগের ঘটে যাওয়া অক্সিডেন্টের কারণে কিডনীর ঠিক নীচু থেকে এক যন্ত্রণা শুরু হয়।তড়িঘড়ি বাড়ির লোকেরা তাকে নিয়ে পুনরায় কলকাতা আসে।জ্ঞান থাকলেও বসার ক্ষমতা তার ছিলনা।ডাক্তারের কথানুযায়ী সেই অক্সিডেন্টের ফলে যে অপারেশন হয়েছিল সেখান থেকেই কিছু হওয়ার ফলে ওই ব্যথা এবং বসতে না পারা।সঠিকভাবে কোন ডাক্তারই তার এই রোগের লক্ষন ধরতে পারেননি।এক একবার তারা এক এক রকম বলেছেন।কখনো বলেছেন হাড়ের জয়েন্ট থেকে হাড় সরে গিয়ে রক্তের সাথে মিশে গিয়ে সেপটিসিমিয়া হয়ে গেছে।আবার হেপাটাইটিস বি ধরা পড়েছে।তার বাড়ির লোকের কোন কার্পণ্য ছিলনা তাকে সুস্থ্য করে তোলার জন্য।কিন্তু বিধাতা যে তাকে ওইটুকুই আয়ু দিয়ে পাঠিয়েছিলেন।
 আকাশের মৃত্যুর দিন অনেকেই হাসপাতাল থাকলেও ছন্দা সেদিন যেতে পেরেছিলো না।সে যখন ভুল বকছিলো নার্স এসে তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন,
--- কি বলছেন?
--- আমি তো ফোনে কথা বলছি।
--- কার সাথে কথা বলছেন?
--- আমার ছোটমাসীর সাথে।

ক্রমশঃ

সময় কথা বলে

 সময় কথা বলে
"দরজা খুলতেই তাকে সামনে দেখে চমকে গেলাম।কোনদিন ভাবিনি ওর সাথে আবার আমার দেখা হবে।হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোথাও ওর সন্ধান পাইনি।রাজেশের পুরো পরিবারটাই যেন রাতারাতি উদাও হয়ে গেলো।"
  --- এই পায়েল, এই এইদিকে আরে তোর পিছনে --
 বন্ধু কামনার ডাকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো পায়েল।অবশ্য প্রথম অবস্থায় বুঝতে পারেনি পায়েল যে কামনা ওকে ডাকছে।একটা শপিংমলে হঠাৎ করেই ওদের দেখা প্রায় ছ'বছর বাদে।পায়েলের বিয়ের সময় শেষ দেখা দু'বন্ধুর।পায়েল তাকিয়ে দেখে কামনা।দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে।কেনাকাটা যে যেটুকু করেছিলো তাই নিয়েই দুজনে বেরিয়ে পরে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
 কামনা কথায় কথায় পায়েলের কাছে জানতে চায়,
--- কিংশুকের কোন খবর জানিস?
 অনেকদিন পর কিংশুকের নামটা শুনে পায়েল কিছুটা সময় চুপ করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে,
--- জানতাম না।তবে বছর তিনেক আগে একবার হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেছিলো আমার বাড়িতেই।ও অবশ্য না জেনেই এসেছিল আমার বাড়ি।
--- মানে?
--- হ্যাঁ এটাই সত্যি।নিজের প্রাণ বাঁচাতে পুলিশের তাড়া খেয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল পুলিশ ইন্সপেক্টর সোমেশ সেনের বাড়িতে।
--- কি বলছিস তুই এসব?
--- হ্যাঁরে।বছর তিনেক আগে হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে আমার কলিংবেলটা বেজে ওঠে।নির্জন জায়গা।মাসখানেক আগেই ওখানে সোমেশ বদলী হয়েছে।বদলীর চাকরী।আজ এখানে তো কাল সেখানে।তখনো সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারিনি।লোক চলাচলও খুব একটা নেই কোয়ার্টারের আশেপাশে।সবই দরিদ্র শ্রেণীর লোকের বাস।সবুজে ঘেরা পুরো জায়গা।তাই জায়গাটাও আমার খুব পছন্দ হয়ে যায়।তখন সন্ধ্যা হয়হয়।কাজের মেয়ে শাকিলা রাতের রান্না করে সবে বেরিয়েছে।অনেক দূরের পথ তার বাড়ি।রাস্তাতে তখন লাইট ছিলো না।তাই বিকেলে এসে রাতের রান্না করে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে যেত।শাকিলা বেরোনোর পর সবে দরজাটা দিয়ে পিছন ঘুরেছি ;সঙ্গে সঙ্গে বেলটা বেজে উঠলো।ভাবলাম শাকিলাই আবার ফিরে এসেছে।দরজা খুললাম।একজন আমায় ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।ভয়ে আমি তখন ঠকঠক করে কাঁপছি।আমার মুখের থেকে কোন শব্দ বেরোচ্ছে না।লোকটা আমার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিজের মুখ থেকে কালো কাপড়টা সরিয়ে দিলো।তাকিয়ে দেখি কিংশুক।কিংশুক আমায় বলল,
--- আমি বুঝতে পারিনি এটা তোমার বাড়ি।আসলে এক ভদ্রমহিলাকে এখান থেকে বেরোতে দেখলাম।ভাবলাম রাতটা যদি কাটাতে পারি এখানে তাই বেল বাজালাম।
 কিংশুককে দেখে আর তার কথা শুনে তার বিপদের একটা গন্ধ পেলাম।তোমাকে কি পুলিশে তারা করেছে? তুমি জানো আমার স্বামী কি চাকরি করেন?
--- আমি কিছু জানিনা আর জানার কোন আগ্রহও নেই।আমাকে এখনো কিছুদিন বাঁচতে হবে।পুরো কাজ আমার শেষ হয়নি।তোমাকে বিপদের মধ্যে ফেলার আমার কোন উদ্দেশ্য ছিল না।আসলে আমি তো বুঝতেই পারিনি এটা তোমার বাড়ি।আমি এখনি চলে যাচ্ছি।
 আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।বললাম কেন পুলিশ তোমায় খুঁজছে?উত্তর দিলো না।চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকলো।ইতিমধ্যে বাইরে সোমেশের গাড়ির আওয়াজ পেলাম।দৌড়ে গিয়ে পিছনের দরজা খুলে দিয়ে বললাম,
--- আমার স্বামী আসছেন।তিনি একজন ইন্সপেক্টর।তুমি এই দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাও।কোথাও লুকিয়ে থেকে পনের কুড়ি মিনিট বাদে গেট দিয়ে বেরিয়ে যেও।কিন্তু সেই অজানা কথাটা আজও জানা হলনা।কেন করেছিলে তুমি আমার সাথে এরূপ।
 করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আমাকে অন্ধকারে রেখেই কিংশুক বেরিয়ে গেলো।
 কামনা সবটুকু শুনে বললো,
--- বাকিটা তাহলে আমার কাছ থেকে শোন। কিংশুকের বোনের উপর শারীরিক নির্যাতন হওয়ায় হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়।কিন্তু বাঁচানো যায়নি।মৃত্যুর আগে কিংশুককে সে জানিয়ে যায় কারা একাজ করেছে।এক হেভিওয়েট নেতার ছেলে এর ভিতর থাকায় সব বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।কিংশুক তার মা আর ভাইকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।খুন করে তিন ধর্ষকের একজনকে।তারা কিংশুকের গ্রামের বাড়ি পৌঁছে রাতের অন্ধকারে জীবন্ত দগ্ধ করে তার মা ভাইকে।পুলিশ হন্যে হয়ে কিংশুককে খুঁজতে থাকে।বাকি দুজনেরও একই ব্যবস্থা করে কিংশুক।উপর মহল থেকে চাপ আসতে থাকে কিংশুককে জীবিত অথবা মৃত ধরার জন্য।
--- তুই এত কথা জানলি কি করে?
--- আমার সাথে কিংশুকের দেখা হয়েছিলো একবার কোর্ট চত্বরেই।সব কাজ শেষ করে ও নিজেই এসে ধরা দিয়েছিল।এখন জেলে আছে।আমি ওর পক্ষের উকিল ছিলাম।যাবতজীবন কারাদণ্ড হয়েছে।মাঝে মাঝে দেখা করতে যাই ওর সাথে।এখন ও সেই আগের কিংশুক।জীবন থেকে ওর সবকিছু হারিয়ে গেছে।হয়ত কিছুদিন আগেই ছাড়া পেয়ে যাবে।একটা নূতন জীবন ওকে দেওয়ার খুব ইচ্ছা আমার।জানিনা ও রাজি হবে কিনা।তবে আমি আশাবাদী। ও যা হারিয়েছে তা আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না কিন্তু ওর জীবনটা ভালোবাসায় ভরিয়ে নূতন পথের সন্ধান দিতে পারবো এ বিশ্বাস আমি রাখি।

    

Friday, November 26, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (সাতাশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (সাতাশ পর্ব)
  আমাদের বাঙ্গালী সমাজটা খুব নোংরা।ভালো চোখে কেউ কিছু দেখতে পারে না।তারা কিছুতেই একটা পুরুষ এবং একটা নারীর বন্ধুত্বকে মেনে নিতে পারেনা।অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের দৃষ্টি শক্তি এতটাই নিম্নমানের হয় তারা রক্তের সম্পর্কের মাঝেও খারাপ কিছু দেখতে পায়।এইসব মানুষরা 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ -' তারিয়েই যেন জীবনে সুখ খুঁজে পায়।
 আকাশ ৮৫ সালে পাটনা পড়তে যায়।ছুটি পেলেই সে মামাবাড়ি চলে আসে। মামা,তার এই ছোটমসি,সায়নীর ছেলে রামা আর তন্দ্রা অর্থাৎ খুকু তাদের একটা দল।সব সময় চলছে ঝগড়া-ঝাটি,চেঁচামেচি আর হাহা হিহি।আকাশ যখন কলকাতা থাকতো তখন বিকেল হলেই ছন্দা আর সে দুজনে মিলে চলে যেত এগরোল খেতে। রোজ রোজ এই এগরোল খাওয়ার ফলে ছন্দার প্রচণ্ড এসিড হত।মনোতোষ দুজনকে একদিন এমন বকলো যে তারা সারা জীবনের জন্য  এগরোল খাওয়া ভুলেই গেলো।আসলে মনতোষ তার ভালোবাসা,আদর দিয়ে রায় চৌধুরী পরিবারের সকলের শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছিল।
 এরই মধ্যে একদিন আগরতলা থেকে লক্ষীর বড় ছেলে অনল আসলো কলকাতা ডাক্তার দেখাতে।যেদিন অনল আসলো তার পরদিন ছন্দা আর আকাশের স্টারে থিয়েটার দেখতে যাওয়ার কথা।যা বাড়িতে একমাত্র অমরেশবাবু ছাড়া আর কেউই জানতেন না।কিন্তু ছন্দার ভাই কিভাবে যেন টের পেয়ে গেলো আকাশরা থিয়েটার দেখতে যাচ্ছে।বাড়ি থেকে চারজন বেরোলো ভিন্ন সময়ে। অনল আর প্রণয় একদলে অন্যদলে ছন্দা ও আকাশ।বিরতিতে হলের ভিতর দুই পক্ষর দেখা।
 এইভাবে জীবনের অনেকটা সময় হাসি,আনন্দ মান অভিমানে কেটে গেছে।কি সুন্দর দিনগুলি সব ছিল কল্পনারও বাইরে আজ।একসাথে সিনেমা দেখা,ভিক্টোরিয়ায় ঘোরা।কিন্তু সব সময়ের জন্যই রক্তের সম্পর্কটা মনে রেখে।ছন্দা এবং আকাশের মধ্যে চীনের প্রাচীর হয়ে সব সময় দাঁড়িয়ে ছিল ওই রক্তের সম্পর্ক।তারা সেটা মনে রাখলেও আত্মীয় স্বজনরা কিন্তু দুকথা থেকে শুরু করে পাঁচ কথা বলতে ছাড়তো না।সব কথায় একদিন কানে গেলো দুজনের।এদিকে পাটনায় পাঁচ বছরের কম্পিউটার ট্রেনিংও শেষ।চলে গেলো আকাশ তার নিজবাড়ি আগরতলায়।মাঝেমধ্যে চিঠি আদানপ্রদান চললেও আস্তে আস্তে সেগুলিও কমতে থাকে শুধুমাত্র সকলের কাছে প্রমাণ করতে 'এই সম্পর্কের মধ্যে কোন কালিমা ছিলনা।তোমরা নিজেরাই একে কালিমালিপ্ত করেছো।' 
 ছন্দার বিয়ে ঠিক হল। রাজ্য সকারের অধীনে কর্মরত একটি অতি সাধারণ পরিবারে।বারবার বলা সত্ত্বেও আকাশ তার মাসীর বিয়েতে এলোনা।
 এর ঠিক তিনমাস আগেই বিয়ে হয় ছন্দার দিদি তন্দ্রা বা খুকুর।কিন্তু বিয়ে ঠিক হয় ছন্দার আগে।ভারতী তখন ঠিক করে যেহেতু ছন্দা ছোট তাই তার আগেই সে তন্দ্রার বিয়ে দেবে যাতে তন্দ্রার ছোটবোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে মনে কোন কষ্ট না থাকে।তিনমাসের অক্লান্ত চেষ্টায় ছেলেও পেয়ে যায় এবং বিয়ে হয়েও হয়ে যায়।বৈশাখে তন্দ্রার বিয়ে হয় আর আষাঢ় এ ছন্দার।পুরো দুটো বিয়ের খরচই কিন্তু ভারতীর।কারণ একমাত্র সেই এই এতগুলি অবিবাহিত বোনদের পড়াশুনা আর বিয়ের দায়িত্ব পালন করেছে।সাথে ভায়েরও।অমরেশবাবু তার আগেই গত হয়েছেন।আর যে বোনেরা চাকরি করতো তাদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার ফলে বোনদের বিয়েতে গিফট দেওয়া ছাড়া আর কোন দায়িত্ব তারা পালন করেনি।
  ছন্দার তখন বিয়ে করার মোটেই ইচ্ছা নয়।সে চাকরি করতে চায়।অমরেশবাবুর মৃত্যুর পর অনিচ্ছাতে ছন্দাকে আর্টস নিয়ে পড়তে হয়।কারণ প্রণয় আর ছন্দা দুজনকে সায়েন্স পড়ানোর মত ক্ষমতা ভারতীর ছিল না।এখানেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় ছন্দা।সারাজীবন সায়েন্সের বিষয়গুলি পড়তে ভালো লাগা ছন্দা আর্টসের বিষয় মাথায় ঢোকাতে পারেনা।তখন রেজাল্টও তার খারাপ হতে থাকে।দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালিন হঠাৎ করেই দিদি তার বিয়ে ঠিক করে। পাত্রপক্ষ দেখতে আসে।ছন্দা দিদিকে অনেক করে বুঝিয়েছিল যাতে অন্তত তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা পর্যন্ত যেন তাকে সুযোগ দেওয়া হয়।কিন্তু বাবুর মৃত্যু ভারতীর কাঁধের উপর এতগুলি বোনদের পাত্রস্ত করার দায়িত্ব এসে পড়ায় সেও চারিদিক অন্ধকার দেখতে শুরু করে।তবে একথা স্বীকার করতেই হয় কোন বোনদের বা ভাইকে সে কোনদিন কোন অবহেলা করেনি।সবাইকেই সে নিজ সন্তানের মত ভালোবাসতো এবং আজও বাসে।নিজের পুরো জীবনটাই সে বাবুর অবর্তমানে তারই সংসারটা আগলে গেছে।পারেনি এই বোনদের এবং ভায়ের জন্য নিজ সংসারী হতে।ছন্দা বিয়ের পর তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে।
  পাত্রপক্ষ যখন ছন্দাকে দেখতে আসে আর এখন বিয়েতে মত না থাকায় ছন্দা অন্য দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে স্বপ্নার বাড়িতে ওঠে।ছন্দাকে ঘরে খুঁজে না পেয়ে ভারতী বুঝতে পারে সে স্বপ্নার বাড়ি গিয়ে বসে আছে।ভাই প্রণয়কে একটা চিঠি লিখে সাইকেলে পাঠিয়ে দেয় অন্তত এসে যেন সে পাত্রপক্ষের সামনে বসে।তানাহলে তার সম্মানহানি হবে।চিঠিতে এও লেখে সে ছন্দার আপত্তি থাকলে সে এখানে তাকে বিয়ে দেবে না।ছন্দা ভায়ের সাইকেলে করে ফিরে আসে এবং পাত্রপক্ষের সামনে বসে।কপাল এমন তারা মেয়ে দেখে পছন্দ করে।
 ভারতী ঘটক মারফৎ খবর পাঠায় এই মুহূর্তে তারা ছন্দার বিয়ে দেবে না তার বড়বোন তন্দ্রার বিয়ে না দিয়ে।তারা ঘটককে দিয়ে খবর পাঠায় যতদিন না ছন্দার দিদির বিয়ে হচ্ছে ততদিন তারা অপেক্ষা করবে।ভারতী কম করে ছ'মাস সময় চায়।তাই ছন্দার বিয়েটা ঠিক হওয়ার পরেও ছ'মাস দেরি হয়।
 একসময় ছন্দা যখন প্রবল আপত্তি করছে সেই মুহূর্তে বিয়ে করবে না বলে তখন ভারতী তার কাছে জানতে চায়,
--- কেমন ছেলে তোর পছন্দ?
--- আমার বিয়ে যদি দিতেই হয় তাহলে একটা সরকারি চাকরি করা ছেলের সাথে বিয়ে দিবি।
--- ঠিক আছে।আর কিছু?
---  তার চেহারা,বাড়ি,গাড়ি কিচ্ছু দেখার দরকার নেই।শুধু একটাই দাবি ছেলেটি যাতে সৎ হয়।
  ভারতী সত্যিই ছন্দার দাবিগুলো মেনে নিয়ে ঠিক সেইরূপ একটি ছেলের সাথেই তার বিবাহ দিয়েছিল।এখানে বলা ভালো ছন্দার দাবি অনুযায়ী যে ছেলেটার সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছিল তাকে যেন ছন্দার দাবি অনুযায়ী তৈরি করেই ঈশ্বর পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন।বিমান সরকারি চাকুরে,অতি সাধারণ পরিবার। চার ভায়ের মধ্যে সেই বড়।বাবার অবর্তমানে পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার মাথার উপর।নিজেদের বাড়ি।মায়ের সাথে চার ছেলের সুখের সংসার।
 ছন্দার বিয়ের দু'বছর পর সে যখন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট তখন আকাশ আসে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে।এসেই মামা প্রণয়কে নিয়ে ছোটে তার মাসীর বাড়ি।কিছুক্ষনের মধ্যেই মেসোর সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।আসলে আকাশ এমন একটা ছেলে ছিল তার সাথে সেভাবে না মিশলে তার মনটা ঠিক সকলে বুঝতে পারবে না।বাইরেটা তার মস্তবড় এক কঠিন আবরণে ঢাকা হলেও ভিতরটা তার শিশুর মত নরম।সেদিন চলে গেলেও ডাক্তার দেখিয়ে আগরতলা চলে যাওয়ার আগে মেসোর সাথে অফিসে দেখা করে গেছিলো।ছন্দার বিয়ের পর থেকে ছন্দার চাইতেও যেন মেসো তার বেশি আপন হয়ে উঠেছিল।

ক্রমশঃ
 

Wednesday, November 24, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (ছাব্বিশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (ছাব্বিশ পর্ব)
  মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হল।তার দুবছর আগেই অমরেশবাবুর একমাত্র পুত্র সন্তান প্রণয় গ্রাম থেকে শহরে এসে ছন্দার স্কুলেই ভর্তি হল।দুই ভাইবোন একই সাথে মাধ্যমিক পাশ করলো।ছন্দার রেজাল্ট খুবই ভালো আর প্রণয় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে।বাড়ির সকলেই খুব খুশি।
 ঠিক এই সময়েই আগরতলা থেকে অমরেশবাবুর বড় মেয়ের মেজো ছেলে আর তার বড় জামাই আসেন। লক্ষীর মেজো ছেলেটি ছন্দার থেকে বছর দুয়েকের বড়।মাসী,বোনপোর প্রথম সাক্ষাৎ তাদের এটা।
  তখনকার দিনে অধিকাংশ পরিবারেই দেখা যেত মায়ের এবং তার নিজ মেয়ের একই সাথে সন্তান ভূমিষ্ঠ হত।অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হত এবং এখনকার দিনের মত সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর কিছু যেমন নির্ভর করত না ঠিক তেমনই সন্ধান ধারণটাও আটকানোর কোন পথ জানা ছিলনা।এমতাবস্থায় যতদিন সন্তান ধারণের ক্ষমতা থাকতো ততদিনই সন্তান হত তখনকার বিবাহিত নারীদের।
  সমবয়সী হওয়ার কারণে সেই প্রথম দিন থেকেই ছন্দা এবং আকাশ ভীষণ ভালো বন্ধু হয়ে যায়।তবে ছন্দা যেমন খুব খোলামেলা টাইপের আকাশ কিন্তু সম্পূর্ণ তার বিপরীত।পাঁচটা কথা বললে একটার উত্তর করে।আর চারটার উত্তর নিজের মনের মধ্যেই পুষে রাখে।মানুষের সাথে সঙ্গে সঙ্গে মিশতে পারে না।খুব পরিচিত না হলে তার সাথে একাকী বসে গল্প করে না।এক্ষেত্রে তার কাছে সেই অপরিচিত মানুষটি ছেলে কিংবা মেয়ে এসব ফ্যাক্টর করেন।কিন্তু যদি কারো সাথে একবার তার মতের মিল হয়ে যায় তাহলে আর রক্ষে নেই।ভীষণ জেদী,একরোখা কিন্তু মনটি শিশুর মত সরল।ছন্দার জীবনের কথা বলতে গেলে আকাশকে বাদ দিয়ে বলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
 আকাশ ছিল একজন রাজনৈতিক নেতা।কিন্তু সচ্ছ মনের।অন্যায়,অসাধু কিছু দেখলেই সে গর্জে উঠতো সে নিজের দলের বা অন্য যে কোন দল হোকনা কেন।ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সে তার নীতি থেকে বিন্দুমাত্র সরেনি।এরজন্য তাকে বহুবার মৃত্যুর সম্মুখীন পর্যন্ত হতে হয়েছে।প্রথম জীবনে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর থেকে সে শুরু করে টিউশনি পড়াতে।অধিকাংশ গরীব ছেলেমেয়েদেরই সে পড়াত বিনা পয়সায়।যে সব পরিবার থেকে মাস মাইনে পেতো তা নিজের জন্য ব্যয় করতো না। ওই টাকাটা সে সেইসব দরিদ্র ছেলেমেয়েদের বই,খাতা এমনকি তাদের দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থাও করতো।এইভাবেই অনেক ছেলেমেয়েদের সে তাদের জীবনে দাঁড় করিয়েছে।সচ্ছল পরিবার হওয়ার কারণে পরিবারের কোন দায় তাকে নিতে হতনা ঠিকই কিন্তু পরিবারের লোকেদের কাছে তার এই স্বভাবের জন্য বেশ কটু কথা শুনতে হত।আকাশের মধ্যে একটা ব্যাপার কাজ করতো আর তা হল সে যদি মনে করতো সে কোন অন্যায় করছে না এবং তার এই কাজের ফলে অন্যে উপকৃত হচ্ছে তাহলে সেই পথ থেকে তাকে কেউ কোনদিনও সরাতে পারত না।নিজের সবটুকু দিয়ে অন্যের জন্য করে যেত।একটা অদ্ভুদ চরিত্রের মানুষ ছিল সে।ছেড়া জামা,ছেড়া স্যান্ডেল,আধপেটা খাবার খেয়েও অন্যের জন্য নূতন জামা,নূতন চটি আর খাবারের সংস্থান করে যেত।সচ্ছ মানুষ হওয়ার কারণে নানান দিক থেকে তারই সমকক্ষ কিছু মানুষের কাছ থেকে অনেক সময় অনেক সাহায্যও পেয়েছে।অন্যের বিপদে-আপদে, রাত বিরেতে ছুটে যেত।নিজের শরীর,নিজের ভবিৎসত নিয়ে কোনদিনও ভাবেনি।আর এই না ভাবার কারণে অকালেই তাকে চলে যেতে হয়েছে।কিন্তু সেসব অনেক পরে।
 মানুষটা অত্যন্ত ভালো হওয়ার কারণে এবং নিজ পার্টির পিছনে দিনরাত পরিশ্রম করার পরেও পার্টি থেকে সে নিজের জন্য কিন্তু কোনদিনও কোন সুযোগ নেয়নি বা দাবী করেনি।একবার তাকে পার্টি থেকে একটা সরকারি চাকরির অফার করায় সে জানিয়েছিল,
--- আমি তো দুবেলা পেট পুড়ে খেতে পারি।কিন্তু এই পার্টিতে অনেকেই আছেন যাদের সে সামর্থ্যও নেই।আপনারা তাদের দেখুন।
 নিজ পার্টির তাবড় তাবড় নেতাদেরও ভুলভ্রান্তি হলেও তাদের মুখের উপর বলে দিত।এইসব কারণে তাকে অনেকেই একটু সমীহ করে চলতো বলা ভালো এড়িয়েই চলতো।এইভাবেই হয়ত চলত কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনে রাজ্যে অন্য পার্টি ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চায়েত প্রধান তার বন্ধু স্থানীয় হওয়ার সুবাদে তিনি অনেক বুঝান আকাশকে তার দপ্তরে একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে বসার জন্য।
--- ভোট তুমি আমাকে না দিয়ে অন্যকে দাও তাতে আমার আপত্তি নেই।কিন্তু আমি আমার অফিসের এই দায়িত্বপূর্ণ পদে তোমাকেই চাই।কারণ এই পদে কাজ করার জন্য একমাত্র তুমিই যোগ্য লোক।
--- আমাকে তুমি কাজটা দিলেও কিন্তু কোনদিনও আমি আমার পার্টির নীতি থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসবো না।
--- সেটা আমি জানি।আর এটাও জানি তুমি ভোটটাও কোনদিন আমার পার্টিকে দেবে না।কিন্তু আমার প্রয়োজন একজন নির্লোভ,দায়িত্ববান মানুষ।তাই তোমার সব শর্ত মেনেই আমি তোমাকে কাজটা দিতে চাই।
  তিনমাস কাজ করার পর হঠাৎ একদিন প্রধানের সাথে রাস্তায় দেখা।
--- কি আকাশ তুমি তো মাইনে পেয়ে আমায় মিষ্টি খাওয়ালে না?
--- মাইনে?আমি তো কোন মাইনে পাইনা।
--- সে কি?তোমার নামে তো প্রতিমাসেই টাকা ইস্যু হচ্ছে।তবে সেগুলো যাচ্ছে কোথায়?
 আকাশ হাসতে হাসতে বলে,
--- যাদের প্রয়োজন তারাই নিচ্ছে।তবে কাজটা করতে আমার খুব ভালো লাগছে।আমার সময়ও কেটে যাচ্ছে।
--- দেখি আমি সব খোঁজ খবর নিচ্ছি।তবে তোমার মত এইরূপ অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ আমি জীবনে একটাও দেখিনি।তিনমাস ধরে ফ্রী সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছ?
 আকাশ হো হো করে হাসতে লাগে।
 পরের মাস থেকে সরকারি নিয়ম মেনেই আকাশের মাইনে আসতে লাগলো।এতে আরও বেশি উপকৃত হল গরীব,অসহায় মানুষগুলো।এই হল ছন্দার বড়দির মেঝ ছেলে আকাশ।
  নিজ মাসীর সাথে প্রথম পরিচয়ের পর (এর আগে অমরেশবাবুর বড় মেয়ের সাথে বহু বছর দেখা সাক্ষাৎ ছিলনা বললেই চলে।কারণ যাতায়াতটা ছিল বেশ ব্যয় সাপেক্ষ।তবে চিঠির আদানপ্রদান ছিল প্রতিনিয়ত।ছন্দার বড়দি মাঝে মধ্যেই বাপেরবাড়ি আসতো।তার চার ছেলের তখন ছাত্রাবস্থা।তারাও খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি মামাবাড়িতে আসার।ছন্দার বড় দিদিরা মাঝে মধ্যে সেখানে গেলেও ছন্দা কোনদিনও তখনও পর্যন্ত আগরতলা যায়নি বা কোনদিন যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি।আসলে ছন্দা ঘোরা,বেড়ানো কোনদিনও পছন্দ করত না।তার মনে হত কোথাও ঘুরতে গেলেই তার পড়াশুনার ক্ষতি হবে।এই ভাবনা থেকেই কোথাও ঘুরতে যাওয়া থেকে সে সর্বদা বিরত থাকতো।পুজোর সময় যখন সবাই ঠাকুর দেখতে বেরত তখন সে বইয়ের টেবিলে বসে তার প্রিয় বিষয় অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে।তবে একদিন সে বেরত ঠিকই।সেদিন সারা দুপুর বসে পড়াটা করে নিত।জীবনে যে মেয়েটা পড়াশুনাটাকে এত ভালোবাসতো ,ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সেই মানুষটার জীবন থেকে কিভাবে যে সবকিছু হারিয়ে গিয়ে পুরো জীবনটাকেই তছনছ করে দিলো -- আজও যার কূলকিনারা সে খুঁজে পেলো না।

ক্রমশঃ 
 

জীবনের প্রতি বাঁকে (পঁচিশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (পঁচিশ পর্ব)
 প্রতিটা মানুষ তার জীবনে ভাবে এক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অন্যকিছু বিধাতা আগেই ঠিক করে রেখেছেন।স্বপ্ন ভঙ্গ আর ব্যর্থতা জীবন নামক উপন্যাসের একটা পার্ট।পৃথিবীতে খুব কম মানুষ পাওয়া যাবে যারা তাদের জীবনে যা ভেবেছে তাইই ঘটেছে বা তারা তাই পেয়েছে।জীবনে প্রতিটা মুহূর্তেই পথটা থাকে কন্টকাকীর্ণ।সেই কণ্টকাকীর্ণ পথে হাঁটতে সবাই পারে না।অধিকাংশই পিছলে যায়।জীবনে কোন কোন সময় আসে তখন একটা ভুল সিদ্ধান্তই পুরো জীবনের চালচিত্র পাল্টে দেয়।আবার অনেকের স্বপ্ন ভাঙ্গে পরিবার বা পার্টিকুলালি কোন একটা মানুষের ভবিৎসতের কথা ভেবে।অমরেশবাবুর অসুস্থ্যতা এবং অবর্তমানে তার পরিবারের কয়েকজন ঠিক এইভাবেই তাদের স্বপ্নের বলিদান দিয়েছে।
 সেবার স্বরসতী পুজোর দিন স্যার, দিদিমনিরা ছাড়াও সেই বছরের পরীক্ষার্থীরা কয়েকদিন আগের থেকেই প্রচণ্ড ব্যস্ত।পুজোর দিনই খাওয়ানো হবে লুচি আর করাইশুটি দিয়ে বাঁধা কফির তরকারি।একটা ক্লাসরুমের মেঝে খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে তার উপরেই যার যার বাড়ি থেকে বটি নিয়ে গিয়ে কফি কাটা হত।সে এক আলাদা আনন্দ!এখনকার দিনের মত লোক দিয়ে নয় নিজেরা সবাই মিলে সব কাজ করা হত।আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা সেসব ভাবতেই পারবে না।কাটা বাঁধা কফির যেন ছোট এক পর্বত।এখন তো স্কুলের ছেলেমেয়েরা স্কুলে ঢুকলেই গেটে তালা পরে যায়।পুজোর খাওয়ার দিনেও তার ব্যতিক্রম নয়।কিন্তু সেই সময় আশেপাশের স্কুল থেকেও ছাত্রছাত্রীরা অন্য স্কুলে এসে খেয়ে যেত।সেসব এক আলাদা মজা!আজও চোখ বুজে সেসব মজার পরশ পাওয়া যায়।যাদের বাড়ি একটু দূরে থাকতো রাত হয়ে গেলে স্যারেরা তাদের সাথে করে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন।প্রত্যেক শিক্ষক তাদের প্রতিটা ছাত্রছাত্রীকে নিজ সন্তানের মত দেখতেন এবং ভালোবাসতেন।অপরদিকে ছাত্রছাত্রীরাও প্রতিটা শিক্ষক শিক্ষিকাকে অসীম ভক্তি,শ্রদ্ধা করতো।আর ভয় তো ছিল জমের মত।
 ছন্দাও তার বাড়ি থেকে বটি নিয়ে বিকালেই হাজির।অনভিজ্ঞ হাতে কফি কাটতে কাটতে আগুল কেটে গেলো।হেড মাস্টার এবং কিছু শিক্ষক কিছুটা দূরেই চেয়ারে বসে ছিলেন।ছুটে এলেন তারা।কেউ বলে এ টি এস দিতে হবে কেউবা দৌড়ে গিয়ে টিচার্স রুম খুলে ডেটল তুলো এনে তার আঙ্গুলে চেপে ধরে বসে থাকেন।তখনকার শিক্ষকেরা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের সামান্য কিছু হলেও যে ব্যকুলতা তাঁদের মধ্যে দেখা যেত আজ আর তা খুঁজে পাওয়া যায় না।সকলের জীবন থেকে সেই দিনগুলি যেন খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেছে।সেদিন ছন্দাকে কৃষ্ণকান্ত পাল স্যার রিক্সা করে বাড়ি পৌঁছে দেন কারণ ছন্দার বাড়িটা একটু দূরেই ছিল।এই কৃষ্ণকান্ত স্যারকে স্কুলের সকলেই কেষ্ট স্যার বলে ডাকতো।লম্বা প্রায় সাড়ে ছ'ফুটের কাছে।কালো কুচকুচে চেহারা।সবসময় ধুতি পাঞ্জাবি,আর পায়জামা পাঞ্জাবী পড়তেন।জীবনে কোনদিনও তিনি প্যান্ট শার্ট পরেননি।
 এই কাজগুলি সব পুজোর আগের দিন করা হত।পরদিন পুজো হত।তখন রাধুনী এসে রান্না করতো।ক্লাসরুমগুলির পিছনের দিকে একটা বিশাল বড় জায়গা ছিল ছন্দাদের স্কুলে।সেখানেই রান্না হত।এই কেষ্ট স্যার হাতে একটা বেত নিয়ে এই রান্নার জায়গায় অদূরেই এক চেয়ারের উপর বসে থাকতেন।কারণ দুটো মাটির বড় বড় উনুন জ্বালানো হত।কোন ছাত্রছাত্রী সেখানে গেলে হঠাৎ করে যদি কোন বিপদ হয় তাই স্যারের বেত নিয়ে সদা সতর্ক পাহারায় সেখানে বসে থাকা।
 ছন্দা স্যারের কাছে গিয়ে এগিয়ে বলে,
--- স্যার আজকে আমরা ঠাকুরের সাথে সবাই ছবি তুলবো।
--- দেখি তোর হাতটা কেমন আছে?ব্যথা কমেছে?
--- ঠিক হয়ে গেছে স্যার।ব্যথা-ট্যথা কিছু নেই।আপনি শুধু একটু অনুমতি দিন আমরা ক্যামেরাম্যানকে বলে আসি।
---যা বলে আয়,তবে বিকেলের দিকে বলিস।পুজোর পরে খেতে খেতে বিকেল হয়ে যাবে।তখন সব্বাই ফ্রী থাকবে।
 বেশ কয়েকজন মিলে সেখানকার নাম করা স্টুডিও আলোছায়াতে গিয়ে দেবাশীষ কাকুকে বলে আসলো ছবি তোলার কথা।এদিকে খাওয়ার জায়গায় রসগোল্লা দেওয়া নিয়ে ছন্দার সাথে পণ্ডিতস্যার মণিশঙ্কর চক্রবর্তীর (সংস্কৃত পড়াতেন তাই পণ্ডিত স্যার বলেই ডাকতো সবাই)সামান্য মনোমালিন্য হয়।ব্যাপারটা ছিল এরূপ - ছন্দা সবাইকে রসগোল্লা দিচ্ছিল কেউ একজন দুটোর বেশি রসগোল্লা চাওয়ায় ছন্দা যখন সেটা দিতে যায় পণ্ডিত স্যার তাকে কটূক্তি করেন।কারণ কথা ছিল সকলকে দুটোর বেশি দেওয়া যাবে না।
 ছন্দা এতে ভীষণ অপমানিত বোধ করে এবং কাউকে কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে আসে।শেষ খাওয়ার ব্যাচে ছন্দাকে দেখতে না পেয়ে তাকে সবাই খুঁজতে শুরু করে।কেষ্ট স্যার ঘটনার কথা জেনে বুঝতে পারেন তার অভিমানী এই ছাত্রীটি রাগ করেই বাড়ি চলে গেছে।তিনি ও তার এক সহকর্মী তিমির কুমার দে দুজনে মিলে পারিজাত ও আসাদকে নিয়ে ছন্দাদের বাড়ি এসে উপস্থিত।এই মানুষগুলিও কিন্তু না খেয়েই ছিলেন।ছন্দাকে নিয়ে গিয়ে তারপর খান।এদিকে ক্যামেরাম্যান এসে ফিরে যায় দিনের আলো নেই বলে।তাকে বলে দেওয়া হয় পরদিন ভাসানের আগে ছবি তোলা হবে।
  ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক শিক্ষিকার মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল তখনকার দিনে আজকের দিনে উভয় পক্ষই সেসব বুঝতে যেমন পারবেন না এমন কি ভাবতেও পারবে না।সেই ভালোবাসা,স্নেহ,শ্রদ্ধা সবই ছিল হৃদয় কেন্দ্রিক।অভিনয়ের কোন প্রয়োজন সেখানে হত না।
 ছবি তুলতে দেবাশীষ কাকু এলেন।পণ্ডিত স্যার পুনরায় ব্যগরা দিলেন
--- মৃত ঠাকুরের ছবি তুলতে নেই।
 আসলে সব যুগেই কিছু মানুষ তো এরূপ থাকেই।স্যারের কথা শুনে কেষ্ট স্যার বললেন,
--- কথায় কথায় তো শ্লোক বলেন।শ্লোক বলে বুঝিয়ে দেন মৃত ঠাকুরের ছবি তুলতে গীতায় কোথায় নিষেধ আছে?
 স্যারদের মধ্যে হাসির রোল উঠলো।পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ালো পণ্ডিত স্যার নিজেও হাসতে শুরু করলেন।তারপর নির্বিঘ্নেই ছবি তোলা হল।
 এই স্কুলেই অমরেশবাবু ছিলেন গার্জিয়ান তরফ থেকে একমাত্র মেম্বার।স্কুল কর্তৃপক্ষ কোন আইনী জটিলতার সম্মুখীন হলে সেটিও অমরেশবাবুই দেখতেন।তখনো স্কুলটি সরকারি হয়নি।কিন্তু তিনি একটি নিয়ম স্কুলে চালু করেছিলেন।যে ক্লাসে যে ফাষ্ট হবে সে বিনা বেতনে পড়বে।বলা বাহুল্য ছন্দা কোনদিনও বেতন দিয়ে পড়েনি।কারণ প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী সে প্রতিবার প্রতি ক্লাসেই প্রথম হয়ে উঠতো।
 যেহেতু স্কুলটি কোএড ছিল ছেলেমেয়েরা একই সাথে ক্লাস করতো;ভাবলে অবাক হতে হয় এইসব ছেলেগুলো কোনদিন কোন মেয়ের সাথেই অভদ্রতা করেনি।তারা ক্লাসমেট হিসাবে যেভাবে মেয়েরা ছেলেদের এবং ছেলেরা মেয়েদের সাহায্য করতো আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এখনকার ছেলেমেয়েরা সেগুলি কল্পনাও করতে পারবে না।দু একটি ক্ষেত্রে যে কিছু ঘটেনি তা কিন্তু নয়।যেমন হাতের পাঁচটা আঙ্গুল সমান নয়।কিন্তু সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি সংখ্যায় এতটাই নগন্য সেগুলিকে হিসাবের বাইরেই রাখা যায়।

ক্রমশঃ

 

Tuesday, November 23, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (চব্বিশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (চব্বিশ পর্ব)
  ছন্দা আর তার দেড় বছরের ছোট ভাই একই ক্লাসে ভর্তি হল।ছন্দা তার ভাইকে আগলে রাখে এই বয়সেই মায়ের মত।একদিন অসাবধানতাবশত ভাই তার স্কুলের খোলা ছাদে উঠে গেলো।বাড়িতে যখন সবাই এ খবর জানলো তখন গ্রামের বাড়ি থেকে বাঁশ কেটে এনে পুরো স্কুল ছাদ ব্যারিকেড করা হল।
  গ্রামের বাড়ির প্রচুর সম্পত্তি আর ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখভালের অভাবে তাই ঠিক হল ছেলেকে নিয়ে (সাথে দুই মেয়েও - ইরা এবং স্বপ্না কারণ ওদের চাকরি করতে ওখান থেকেই সুবিধা হয়)শান্তিদেবী গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন।ছন্দা নিজেই যেতে চাইলো না কারণ গ্রামের বাড়িতে তখন ইলেকট্রিক ছিলো না।হ্যারিকেনের আলোতে পড়তে হত।আর বর্ষাকালে মাটির রাস্তায় কাদা পায়ে স্কুলে যেতে হত যা ছন্দার একদমই পছন্দ নয়।তাই সে শহরেই থেকে গেলো। শান্তিদেবী পুনরায় ছেলে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান।
  ক্লাস ওয়ান থেকে প্রথম হয়ে ক্লাসে উঠলো ছন্দা। ঝড়,জল কোনকিছুতেই ছন্দা স্কুল বন্ধ করে না।প্রতিদিন সে যেভাবেই হোক স্কুলে উপস্থিত হবেই।বছরে দুটো পুরস্কার তার বাঁধা।একটা হল ক্লাসে প্রথম হওয়ার কারণে আর একটা হল নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত হওয়ার কারণে।অসুস্থ্য হলেও ছন্দা স্কুল কামাই করবে না।দু তিন বছরের মধ্যেই পুরো স্কুল শুধুই নয় ছোট্ট শহরটাতে সকলেই জেনে গেলো "এই মেয়েটা কোনদিনও স্কুল কামাই করে না"।প্রথমত অমরেশবাবুর ছোট মেয়ে আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে পুরো বছর ধরে স্কুলে নিয়মিত উপস্থিতি আর মেধাবী হওয়ার কারণ।
 সেই ক্লাস ওয়ান থেকেই প্রতিটা ক্লাসে সেই হচ্ছে মনিট্রেস।ক্লাসমেটরাও সকলেই তাকে খুব ভালোবাসে আর তার কথাও শোনে।সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার যেটা সেটা হল সকলেই তার টিফিন ছন্দাকে দিয়েই খেত।তখন ছন্দার পরিস্থিতিটা ছিল এরূপ নিজের জন্য কোন টিফিন সে আনলে সেটা আর তার খাওয়া হত না।তাই সে সব সময়ের জন্যই বাড়ি থেকে টাকা (সে সময়ে পঞ্চাশ পয়সা হলেও বাদাম বা অন্যকিছু হয়ে যেত)নিয়েই আসতো।তাই দিয়ে কিছু কিনে সকলকেই ভাগ করে দিত।বাড়ি থেকে স্কুল খুব একটা দূরত্ব না হলেও রাস্তাটা খুব কম ছিল না।কেউ কেউ আবার ছন্দার সাথে একসাথেই যাবে বলে অনেক আগেই তার বাড়ি চলে আসতো।
 নবম শ্রেণী।সুনীল নামে একটি ছেলে ছন্দার পিছনে খুব লাগতো।কিন্তু ছন্দা এসব মোটেই পছন্দ করতো না।সে বেশ কয়েকবার তাকে নিষেধ করেছে।কিন্তু কিছুতেই ছেলেটি তার কথা শুনতো না।এমন কি ছন্দা যখন সন্ধ্যায় স্যারের কাছে পড়তে যেত তখন সে সাইকেল নিয়ে তার পিছু পিছু চলত।একদিন খুব মাথা গরম হয়ে যায় তার।পড়তে যাওয়ার আগেই সে সটান চলে যায় সুনীলের বাড়ি।রীতিমত সুনীলের মাকে গিয়ে শাসিয়ে আসে সুনীলকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য।সুনীল যদি ভবিৎসতে আর তাকে বিরক্ত করে তাহলে সে স্কুলে হেডমাস্টারকে তো জানাবেই উপরন্তু সে তার বাবুকেও বলবে।
 সেদিন সুনীলের মা ছন্দার কথা শুনে হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।হয়ত তিনি মনেমনে ভেবেছিলেন মেয়েদের গার্জিয়ানরা আসে তাদের মেয়েদের বিরক্ত করলে সেই ছেলের বাড়িতে।আর এ তো দেখছি সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। এ মেয়ে তো সাংঘাতিক।ভদ্রমহিলা ছন্দার কোন কথার উত্তর দিয়েছিলেন না ঠিকই কিন্তু বয়াম থেকে নারকেল নাড়ু বের করে দিয়ে বলেছিলেন,
--- আমি তোমায় কথা দিচ্ছি আর কোনদিন সুনীল তোমায় বিরক্ত করবে না।কিন্তু মা এইভাবে তুমি কত ছেলের বাবা,মায়ের কাছে যাবে?তুমি দেখতে সুন্দর,পড়াশুনায় ভালো।ছেলেরা তো তোমার পিছনে পিছনে ঘুরঘুর করবেই।তবে তোমার এই সাহসকে আমি সম্মান জানিয়েই বলছি - সব ছেলেরা যেমন ভালো হয় না,ঠিক তেমনি তাদের সব গার্জিয়ানরাও কিন্তু ভালো হয় না।তাই নিজে একটু সতর্ক হয়ে রাস্তায় চলাফেরা কোরো।
 না এরপর সুনীল কোনদিন ছন্দাকে বিরক্ত করেনি।সে বছর ফাইনাল পরীক্ষার পর সুনীল অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছিল।পরবর্তীতে সুনীলের সাথে রাস্তায় বহুবার ছন্দার দেখা হয়েছে।সুনীল তাকে প্রতিবারই এড়িয়ে গেছে।সুনীলের প্রতি ছন্দার কোন অনুরাগ না জন্মালেও হঠাৎ রাস্তায় দেখে যখন সুনীল তাকে এড়িয়ে যেত তখন ছন্দার ভিতর অদ্ভুত একটা অপরাধবোধ কাজ করতো কেন সেটা করতো তা ছন্দা কোনদিনও বুঝতে পারেনি।
যারা যে বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী থাকতো তাদের হাতেই থাকতো সে বছরের স্বরসতী পুজোর সব দায়িত্ব।এমনকি স্কুলে স্কুলে গিয়ে নিমন্ত্রণের দায়িত্বও থাকতো।সুনীল যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সেখান থেকে যারা এসেছিল ছন্দার স্কুলে নিমন্ত্রণ করতে তাদের মধ্যে কিন্তু সুনীলও ছিল।কিন্তু সুনীল স্কুলের মধ্যে না ঢুকে বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল।আর ঠিক সেই মুহূর্তে ছন্দা তার বান্ধবীদের সাথে কাছেই এক স্কুলে নিমন্ত্রণ করে যখন ফিরছে তখন স্কুল গেটের কাছেই সুনীলের সাথে দেখা।ছন্দা ইচ্ছা করেই চলার গতিটা একটু শ্লথ করে যাতে তার বন্ধুরা আগে এগিয়ে যায়।বন্ধুরা এগিয়ে গেলে ছন্দা সুনীলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
--- কি এমন করেছি যে তুমি একেবারে এই স্কুলই ছেড়ে দিলে?(তখনকার দিনে কোএডে পড়া অনেক ছেলেমেয়েরা একে অপরকে প্রথম অবস্থায় তুমি বলেই কথা বলতো।তারপর আস্তে আস্তে তুই তে আসতো।সব ক্ষেত্রে যে এটা হত তা কিন্তু নয়)
--- আমিও তো এমন কিছুই করেছিলাম না।কিন্তু তুমি তো আমার বাড়িতেই পৌঁছে গেলে আমায় শায়েস্তা করতে।পুলিশ যখন চোরকে মারে কোনদিন দেখেছো?আমার বাবা আমায় ঠিক চোরের মার মেরেছেন।আমি তো কোনদিন তোমায় কোন অসম্মান করিনি।শুধু তুমি যেখানে যেতে তোমার পিছন পিছন যেতাম।কোনদিন জানতে চেয়েছো কেন যেতাম?
--- কেন যেতে?
--- আজ আর সে কথা বলে কোন লাভ নেই।আর আমি সেকথা বলবোও না আর।তবে তোমার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
 ছন্দা কি বুঝলো সেই জানে।সে আর কোন কথা না বলে স্কুলের মধ্যে ঢুকে গেলো।এরপর সুনীলের বাবা বদলী হয়ে যাওয়াতে সুনীলরা যে কোথায় চলে গেলো তা সুনীলের অনেক বন্ধুরাই জানে না আর ছন্দা তো কোন ছার!কিন্তু আজও ছন্দা যখন একা থাকে তখন বসে ভাবে তবে কি ওই বয়সেই সুনীল তাকে ভালোবাসতো?
 ছন্দার পড়াশুনার জীবনে কোন কিছুর জন্য তার ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে মনে করলেই সে কিন্তু অবলীলায় সেই সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারতো।তারজন্য যতটা কঠোর হতে হয় সে হত।হয়ত বিধাতা পুরুষ তার এই কঠোরতা দেখে অলক্ষ্যেই হেসেছিলেন।তাই হয়ত পরবর্তীতে ছন্দার জীবনে সবকিছু থাকার পরেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বলতে যা বোঝায় সেইখানে সে কোনদিনও পৌঁছাতে পারেনি।বিধাতা তার ভিতর সবকিছু দিয়েও হঠাৎ করেই যেন সেই সবকিছুই তার জীবন থেকে কেড়ে নিলেন।

ক্রমশঃ 

Monday, November 22, 2021

বড্ড ভালোবাসি

বড্ড ভালোবাসি
" মানুষটা যে এভাবে বদলে যাবে চিন্তাও করে উঠতে পারিনি - সবই ঠিক ছিল।কি যে হঠাৎ করে ওর হল কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না সেই মুহূর্তে।"
  প্রথম দেখাতেই প্রেম।কালিম্পং বেড়াতে গিয়ে রাতুল আর রণিতার প্রথম দেখা।রণিতারা পাঁচ বন্ধু মিলে কালিম্পং ঘুরতে গেছিলো।সবাই স্কুল শিক্ষিকা।আর এদিকে রাতুল তার বাবা,মায়ের সাথে গেছে।এখন কোথাও ঘুরতে যাওয়া মানেই তো শুধু ছবি তোলা।পাঁচ বন্ধু মিলে অনেক সেলফি তোলা হলেও একসময় রণিতা অপরিচিত রাতুলকে দেখে বলে,
-- কাইন্ডলি আমাদের একটা ছবি তুলে দেবেন?
--- ও সিওর।
 গলায় ঝুলানো ডিএসএলআর টা রেডি করতেই রণিতা বলে ওঠে,
__না,না আমার মোবাইলে তুলে দিন।
 রাতুল হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নেয়।বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দেয় রণিতাদের 
 নিজের ক্যামেরায় ওদের কিছু ছবি তুলতে চায়।রণিতা আপত্তি জানালেও অন্য বন্ধুরা সম্মতি জানায়।ফলে রণিতাকে রাজি হতেই হয়।হোটেলে ফিরে ওদের ছবিগুলি পাঠিয়ে দেবে বলে রণিতার কাছ থেকে ফোন নম্বরটা চেয়ে নেয়।অনিচ্ছা সত্বেও দিতে বাধ্য হয় সে কারণ রাতুল তার কাছেই নম্বরটা চায়।
 সেদিন রণিতার সব বন্ধুরা তার খুব পিছনে লেগেছিলো।ওদের দুজনের নামের মিল দেখে।রণিতারও প্রথম দেখাতেই রাতুলকে খুব ভালো লেগেছিলো।সেই শুরু।
 কাছাকাছি আসতে খুব একটা বেশি সময় নেয়নি দুজনেই।রাতুল ব্যবসায়ী।ছবি তোলা তার নেশা।নানান জায়গায় ঘুরতে যায়।কখনো একা আবার কখনো বা বাবা,মাকে সঙ্গে করেই।নানান জায়গায় তার ছবি পুরস্কৃত হয়।
 দুই বাড়ির সম্মতিক্রমে ছ'মাসের মধ্যেই ওরা বিয়ে করে।বিয়ের পরেই প্রথম ট্যুর আবার সেই কালিম্পং।পনেরটা দিন ওদের যেন ঘোরের মধ্যেই কেটে গেলো 
 শ্বশুর,শ্বাশুড়ী রণিতাকে নিজেদের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।কিন্তু রাতুলের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিল এক বছরের মাথায় রণিতার এক বন্ধুকে কেন্দ্র করে।ছেলেবেলায় একই পাড়ায় থাকতো।এখন সেই বন্ধু শাহীন আমেরিকা থাকে।ফেসবুকের সৌজন্যে পুনরায় নূতন করে আবার দুজনের পরিচয়। লাঞ্চ টেবিলে সকলের সামনে বসেই রণিতা হাসতে হাসতে শাহীনের গল্প করছিলো।রণিতা ছেলেবেলার বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে খুবই এক্সসাইটেড ছিল তা তার গল্প বলার ধরণেই সকলে বুঝতে পারছিল।হঠাৎ রাতুল প্রশ্ন করে,
--- নাম শুনে তো বোঝার উপায় নেই ছেলে না মেয়ে বন্ধু।
 রাতুলের কথা বলার ধরনে খেতে খেতে সকলেই তার মুখের দিকে তাকায়।ছেলের কথা শুনে তার বাবা বলে ওঠেন,
--- সে যে ওর বন্ধু এটাই যথেষ্ঠ নয় কি?সে ছেলে না মেয়ে তা জানার দরকার আছে কি?বন্ধু তো বন্ধুই হয়।সেখানে ছেলেমেয়ে,ছোট-বড়,বয়সের পার্থক্য কোনটাই ম্যাটার করে না।
 কোন কথা না বলে রাতুল খাওয়া শেষের আগেই উঠে চলে যায়।রণিতা সব কাজ সেরে ঘরে ঢুকে দেখে রাতুল ঘুমিয়েই পড়েছে।যা বিয়ের পর এই প্রথম ঘটলো।বিয়ের পর থেকেই ছুটির দিনে দুপুরে খেয়েদেয়ে দুজনে প্লান করতে বসে সন্ধ্যায় তারা কোথায় ঘুরতে যাবে।রণিতা ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত রাতুলকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,
--- বাব্বা আমার ছেলেবেলার বন্ধুর কথা শুনে এত্ত রাগ হয়েছে?
 এরপর থেকেই রাতুলের মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে।রাতুল যখনই দেখেছে রণিতা ফোন নিয়ে খুটখুট করছে তখনই রাতুলের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে
--- কি শাহীনের সাথে কথা হচ্ছে?
 অনেক বুঝিয়েছে রণিতা রাতুলকে।কিন্তু দিনকে দিন নানান কারণে রাতুল তাকে অপমান করতে থাকে।শেষে রণিতা একদিন রাতুলকে বলে,
--- আসলে তুমি একজন সাইকো পেসেন্ট।ডাক্তার দেখানো উচিত তোমার।
 সুখের সংসারে যখন তখন যেন আগুন জ্বলে ওঠে।রাতুলের মধ্যে এই পরিবর্তন তার বাবা,মাও মেনে নিতে পারে না।শ্বশুর,শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে আরও দুটি বছর কেটে যায় মাঝিহীন নৌকার মত।রাতুল ডাক্তারও দেখাবে না, বুঝালেও বুঝবে না।
 সহকর্মী সুস্মিতার সাথে গল্প প্রসঙ্গে রণিতা বলে,
--- ওর কাছ থেকে চলে এসেছি ঠিকই কিন্তু ওর বাবা,মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ রয়েছে।ওকে আমি ডিভোর্স দিইনি; দেবোও না কোনদিন আর ও নিজেও চায়নি।ওর বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রেখে ওকে কাউন্সিলিং করিয়েছি।ট্রিটমেন্ট চলছে।ওর বাবা,মা সব জানেন।কিন্তু রাতুল জানে না এগুলো আমিই করাচ্ছি।একদিন ও পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠবে।আর সেদিন ও ওর নিজের ভুল বুঝতেও পারবে।আর সেদিনই ও ছুটে আসবে আমার কাছে।আমি যে ওকে বড্ড ভালোবাসি।



    

Sunday, November 21, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে(তেইশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (তেইশ পর্ব)
  অমরেশবাবুর ষষ্ঠ মেয়েটির জন্মের পর তাঁর একটি পুত্র সন্তান হয়েছিল।একবার গ্রামের এক কালী পুজোয় তাকে কোলে করে শান্তিদেবী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর কোল থেকেই হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে সে অন্য এক ভদ্রমহিলার কোলে 'মা' বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।সেই থেকে ওই ভদ্রমহিলা রায় চৌধুরী পরিবারে সব সন্তানদের মা হয়ে ওঠেন।সকলেই তাকে মা বলেই ডাকতো।গরীব ঘরের মানুষ ছিলেন মহিলা।বিপদে,আপদে যেকোন সময় রায় চৌধুরী বাড়িকে সে পাশে পেয়েছে।আবার রায় চৌধুরী পরিবারে যে কোন দুর্যোগের সময় তিনি ছুটে এসেছেন।পাশে থেকে নানান কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।(সেই সন্তানটি যে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় মারা গেছিল আমি আগেই তা উল্লেখ করেছি)
 গ্রামের এই কালী পুজোকে ঘিরে নানান কথা সেই সময় লোকের মুখে মুখে ঘুরতো।এই পুজো হত এবং আজও হয়ে চলেছে জৈষ্ঠ মাসের এক অমাবস্যায়।এই পুজোর নাম সদের গাছতলার পুজো।একমাস ধরে বাড়ি বাড়ি কুলো নিয়ে শাক উলুধ্বনি সহকারে চাল,ডাল,টাকা ভিক্ষা করে বেড়ানো হয়।কথিত আছে এই রায় চৌধুরী বাড়ির কোন এক পূর্বপুরুষ একসময় রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে আসছিলেন তখন তিনি দেখেছিলেন একজন বৃদ্ধা মলিন বস্ত্র পরে ওই রাস্তার উপর এমনভাবে শুয়ে আছেন যে যিনি আসছিলেন তাকে আসতে গেলে উনাকে টপকে আসতে হয়।তিনি ভদ্রমহিলাকে বলেন,
--- মা তুমি এইভাবে রাস্তার উপর পড়ে আছো কেন?
--- ছেলেমেয়েরা যে আমায় দেখে না বাবা।তাই যেখানে সেখানে পড়ে থাকি।
--- আমায় বল কোথায় থাকে তোমার ছেলেমেয়েরা।আমি ওদের বুঝিয়ে বলবো।
--- বলবো বাবা।
 সেদিনই রাতে ওই ভদ্রলোক স্বপ্নে দেখেন স্বয়ং মা কালী তাকে বলছেন তার থাকার আস্তানা করে দিতে।এবং তিনিই জানিয়ে দেন তাঁর পুজো কিভাবে হবে। জায়গাও ঠিক করা হয় মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েই।উপরে খড়ের ছাউনি এবং বাঁশের বেড়া দিয়ে মন্দির তৈরি করা হয়।তারপর মায়ের মূর্তি তৈরি করা হয়।এদিকে কুলো নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি খালি পায়ে হেঁটে ভিক্ষে করে বেড়ানো হচ্ছে।হঠাৎ এক মুসলিম পরিবার থেকে কিছু লোক ওই মায়ের মূর্তি দেখতে আসে।তারা মায়ের মূর্তি দেখে নাক সিঁটকে অবজ্ঞাভরে বলে,
-- এমা!হিন্দুদের এই মূর্তির মুখটা কি বিচ্ছিরি দেখতে!দেখে মনেহচ্ছে এর সারা গায়ে পক্স হয়েছে।
পড়ে  তারা বাড়ি ফিরে যায়।কিন্তু সেদিন রাতেই তাদের বাড়ির প্রতিটা সদস্যের গায়ে প্রবল ব্যথা নিয়ে জ্বর আসে আর সকলের গায়ে মুখে এমনভাবে পক্স হয় যে তারা হা করে খাবার খাওয়ার মত অবস্থায় থাকে না।প্রথমদিন কেন এরূপ হল বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে তাদের বোধগম্য হল যে কালী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলার ফল এটা।
  তারা ছুটে আসে ওই মন্দিরে যে পুরোহিত পুজো করবেন বলে স্থির করা হয়েছে তার কাছে।তিনি আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে বলেন।তারা পুরোহিতের কথামত সে কাজ করেও।কিন্তু সেদিন রাতে ওই মুসলিম পরিবারের গৃহকর্তা স্বপ্ন দেখেন মাকালী তাকে বলছেন,
--- এই মন্দিরে যতদিন পুজো হবে বংশপরম্পরায় তোদের বাড়ি থেকে চাল যাবে ওই কুলোয় একমাসের শেষ দিনে।ওই চাল দিয়েই আমার পুজো সম্পন্ন হবে।
 সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি অনুভব করেন তার শরীরে ব্যথা কম।ওই অবস্থায় তিনি ছুটে যান রায় চৌধুরী বাড়িতে।সেখানে পৌঁছে সবিস্তারে সব বর্ণনা করেন।সেদিনই ছিল কুলো নিয়ে ভিক্ষে করার শেষ দিন।ওই বাড়ি থেকে চাল নিয়ে সোজা সকলে আজও চলে যায় মায়ের মন্দিরে।আজও ওই মুসলিম পরিবারের দেওয়া চালের সাথে অন্য চাল মিশিয়ে মায়ের ভোগ রান্না করা হয়।যুগের পরিবর্তন হয়েছে,পরিবারের সদস্য পরিবর্তন হয়ে চলেছে কিন্তু সদের বটতলার পুজোয় ওই মুসলিম পরিবারের ভিক্ষে দেওয়া চালে মায়ের ভোগ আজও নিবেদন করা হয়।বহু বহু বছর আগে যে রীতি চালু হয়েছে;আজকের যুগে দাঁড়িয়ে হিন্দু,মুসলমানের মধ্যে যে দাঙ্গার ফলে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে কিন্তু পিলজঙ্গ গ্রামের সেই রীতি আজও চালু রয়েছে।ওই পরিবারের আজও কেউ সাহস পায়না এই রীতি ভাঙ্গার।
 পূর্ব বাংলায় রায় চৌধুরী পরিবারে আজ আর কেউ থাকে না ঠিকই।কিন্তু তারা তাদের এ কাজ অর্পণ করে এসেছে অন্য এক ব্রাহ্মণ পরিবারে।তারা আজও একইভাবে একই নিয়ম মেনে এই পুজো করে থাকে।নেই সেখানে কোন হিন্দু,মুসলিম দাঙ্গা।সবাই সবার বিপদে আজও সেই পূর্বের মতই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
  একবার পুজোর কয়েকদিন আগে থেকে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই এক বাড়ি কি দুই বাড়ি চাল এনে রাখা হত।পুজোর দিনে অর্থাৎ একমাসের শেষদিনে ওই মুসলিম পরিবার থেকে চাল না এনেই কুলো নিয়ে সোজা মায়ের মন্দিরে চলে যাওয়া হয়। তারও কারণ ছিল।ওই পরিবারটি ছিল গ্রামের শেষ প্রান্তে।মাটির রাস্তা।কয়েকটা দিন সমানে ঝড় জল হওয়ায় ইচ্ছা করে বা গাফিলতি করেই হোকনা কেন তারা আর ভিক্ষা আনতে যায় না।কিন্তু সেদিনই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা।যতবারই মাটির উনুনে মায়ের ভোগ চাপানো হয় ততবারই উনুন নিভে তো যায়ই উপরন্তু উনুনের একপাশ ধসে যায়।আবার তা সারিয়ে যখন ভোগ চাপানো হয় তখন সেই একই কান্ড।সকলের মাথায় হাত!কেউই কিছুই বুঝতে পারে না।পুরোহিত সব দেখে ও শুনে বুঝলেন কিছু একটা অনিয়ম হয়েছে।তিনি এই পুজোর ব্যাপারে যারাই ইনভলব সকলের কাছে একে একে জেনে নিয়ে আসল সত্য উদঘাটন করতে পারলেন।সঙ্গে সঙ্গে আবার কুলো নিয়ে মহিলারা ছুটলো জলকাদা ভেঙ্গে ওই মুসলিম পরিবার থেকে চাল আনার জন্য।সেখানে গিয়ে তারা দেখে সেই সময়ের ওই বাড়ির গৃহকর্তা চাল আরো অনেক সামগ্রী নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন পুজোয় সেগুলি দেবেন বলে।সাথে সেবারের পুজোয় দরিদ্র ভোজন করার জন্য একবস্তা চাল।তারা সেসব নিয়ে মন্দিরে ফিরে আসে।এর পরেই তারা নির্বিঘ্নে পুজো সম্পাদন করতে পারে।
 পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা আছে। যার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মেলে না।আগেকার দিনে ঠাকুর দেবতা নিয়ে এমন অনেক ঘটনা আমরা জানি বা শুনি যা আজকের যুগে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস করতে হয়ত অনেকেরই মন সায় দেবে না।কিন্তু একথা অবিশ্বাস করার কোন উপায়ই নেই যে সুপ্রিম পাওয়ার বলে কিছু তো একটা আছেই।রামকৃষ্ণ,ব্যমাক্ষ্যাপা প্রমূখ- ছিলেন মানুষ। তাঁদের সাথে কিন্তু সুপ্রীম পাওয়ার ক্ষমতাধারীর সাথে দেখা হয়েছিল।সুতরাং যুগ যুগ ধরে প্রচলিত সেই সব ঘটনা অস্বীকার করবার কোন উপায়ই কিন্তু নেই।
 আজ আমরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এমন অনেক ঘটনায় জানতে পারি যা আমাদের কাছে যুগ যুগ ধরে গল্পের আকারে এসেছে।বিজ্ঞানের এত উন্নতির ফলে এই শোনা গল্পগুলি যে সত্যি তা স্বীকার করতেই হবে।উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকানগরী।প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা জানতে পারছি সমুদ্রগর্ভে আজও সেই নগরীর অস্তিত্ব।

ক্রমশঃ 

Saturday, November 20, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (বাইশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (বাইশ পর্ব)
  অমরেশবাবুর মেয়েরা বড় হওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে তিনি অন্দর মহলের সমস্ত ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।কারণ তিনি বুঝতে পারেন তিনি তার মেয়েদের যেভাবে বড় করেছেন তাতে করে ছোটখাটো কোন সমস্যা হলে সেই সমস্যাগুলি মোকাবেলা করার ক্ষমতা তারা করায়ত্ত করেছে।যদি কোন বিষয়ে তারা মনে করতো তাদের বাবুর উপদেশের দরকার তখন তারা সেই বিষয়ে বাবুর সাথে আলোচনা করে নিত।
 গৃহ শিক্ষক সুশান্ত পালের কথানুযায়ী তারা তাদের ছোট বোনকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করার জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনাকালে ছন্দা সেখানে উপস্থিত হয়ে ছলছল চোখে তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।( এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।তখনকার দিনে একবারেই ক্লাস ওয়ানে বা টু তে ভর্তি হওয়া যেত।তারজন্য কোন বার্থ সার্টিফিকেটেরও কোন দরকার পড়তো না কারণ তখন বাড়িতেই অধিকাংশ শিশুই জন্ম নিত একজন ধাত্রীর তত্ত্বাবধানে) আবার ভর্তির জন্য কোন পরীক্ষাও দিতে হত না।বড়জোর মাস্টার মশাই জিজ্ঞাসা করতেন "তুমি পারবে তো।"ছোট ছোট শহরগুলিতে কোন সমস্যায় হত না।তাদের দাদা (অর্থাৎ মালতী যাকে তার ছোট সব বোনরাই দাদা বলতো আগেই বলেছি) তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোলে উঠিয়ে নিয়ে আদর করে জানতে চায়,
--- তোমার চোখে জল কেন?তোমার আনন্দ হচ্ছে না স্কুলে ভর্তি হবে বলে?
 ছন্দা পিছন ঘুরে তার দাদার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
--- আমি টু তে ভর্তি হবো না।
--- কেন টু তে ভর্তি হবে না?তুমি তো সব পারো। মাষ্টারমশাই বলেছেন তোমাকে টু তে ভর্তি করলেও তুমি ফাষ্ট হবে।
--- আর ভাই?ও তো ছোট।ওকে কে দেখবে?ও তো ওয়ানে ভর্তি হবে।আমি তো ভায়ের সাথে থাকবো না;তখন যদি ভাইকে কেউ মারে কে দেখবে?ওর তো কষ্ট হবে।
 ছন্দাকে কেউই রাজি করাতে পারে না ক্লাস টু তে ভর্তির জন্য।তার সেই এক গো "আমি ভায়ের সাথেই ভর্তি হবো।তানাহলে ওর কষ্ট হবে।" অগত্যা তাকে টু তে আর ভর্তি করানো গেলো না।দুজনকে নিয়ে গিয়ে একসাথেই ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করা হল।
 ছন্দার জন্মের দেড় বছর পর তার ভায়ের জন্ম হয়।এতগুলো মেয়ের পরে একটা মাত্র ছেলে।স্বভাবতই সকলেই ছেলে বা তাদের ভাইকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো।ব্যতিক্রম একমাত্র অমরেশবাবু।কিন্তু তিনি কতক্ষন সময় আর বাড়িতে থাকেন?অযত্নে কিন্তু অবহেলায় নয় ছন্দা বড় হতে শুরু করে।এই ছোট বয়সেই সে বেশ সাবলম্বী হয়ে ওঠে।নিজের কাজগুলি সে নিজেই করে।নিজের হাতে ভাত খাওয়া,স্নান করা,স্নান করে এসে নিজের প্যান্ট নিজে মেলা - এইরূপ টুকটাক যাবতীয় কাজ সে নিজেই করে নেয়।ভাইকে নিয়ে যে সবাই মত্ত তাতে কোনদিনও সে কখনোই হিংসাবোধ করেনি।প্রতিটা দিদির কাছে ভাই যেমন প্রাণ ছিল;ওই ছোট্ট ছন্দার কাছেও তার ভাই প্রাণ ছিল।কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো ছন্দার কথা বলতে না পারার বিষয় নিয়ে।দু'বছর বয়সেও ছন্দা কথা বলতে পারেনা।কোন শব্দই সে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারেনা।সবকিছু সে সবাইকেই ইশারায় বোঝায়।তখন সকলে ধরেই নিলো এতগুলো মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে বোবাও হল।কিন্তু কিছু করারও নেই।তখনকার দিনে এইসব ব্যাপারে বাড়ির লোক কেউ খুব একটা মাথা ঘামাত না।আর ঘামিয়েই বা করবে কি?আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে চিকিৎসাশাস্ত্রও এত উন্নতির মুখ দেখেনি।তাই ঝাড়া,জলপড়া, মাদুলী,দেবতার স্থানে মানত এইসব করেই চলত।তাকে নিয়ে আকুতু কুতু হয়তো কেউ করতো না কিন্তু তাকে কেউ অবহেলাও করতো না।তবে অধিকাংশ সময় সে তার নিজের মনেই থাকতো।আর যে বিষয়টা তার মধ্যে প্রবলভাবে ছিলো তাহল বড়দের কোন কাজ করতে দেখলে সে সেই কাজ করাটাকে এমনভাবে লক্ষ্য করতো ঐটুকুন বয়সেই পরে সেই কাজগুলি বেশ ভালোভাবেই করতে পারতো।
 তিনবছর বয়স।মুখের থেকে কোন আওয়াজ বের করতেই পারেনা অথচ এই বয়সে সে তার নানান কাজে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে থাকে।ভারতীর প্রচণ্ড জ্বর।বাড়িতে কান্নার রোল ওঠার মত পরিস্থিতি।সেই মুহূর্তে কথা না বলতে পারা ওই ছোট্ট মেয়েটি রান্নাঘরে ঢুকে একটা বাটিতে জল নিয়ে এসে ভারতীর মাথার কাছে বসে শান্তিদেবীর আঁচল ভিজিয়ে তার সেজদির কপালে জলপট্টি দেওয়ার চেষ্টা করে।আবার কখনো হয়ত বাড়িতে অতিথি এসেছে সকলে বসে গল্প করছে সে রান্নাঘরে ঢুকে একটা কাপ নিয়ে ইশারায় তার দিদিদের বুঝিয়ে দেয় অতিথিকে চা করে দেওয়ার জন্য।ভাই একপা,দুপা করে হেঁটে বেড়াচ্ছে।ঘরের মেঝেতে জল পড়ে আছে।সে দৌড়ে গিয়ে হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে ওই জল মুছতে থাকে।আবার হয়ত অনেক সময় ভাই এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে সে পরে যেতে পারে ছোট্ট মেয়েটি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছে।এইরূপ অনেক ঘটনা। তখনও কিন্তু তার পুরোপুরি তিন বছর বয়স হয়নি।
 একবার গ্রামের কালী পূজা উপলক্ষে (এই পুজোর বর্ণনা আমি পড়ে দেবো)একজন সাধু গোছের মানুষ আসেন।এই পুজোতে একটা বিশাল অঙ্কের টাকা রায় চৌধুরী পরিবার থেকে যেত শুধু নয় পুজো প্রাঙ্গণে শান্তিদেবীর এক বিশাল ভূমিকা ছিল।
 ছোট্ট মেয়েটির বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে এবং সে কথা বলতে পারে না শুনে সাধু শান্তিদেবীকে বলেন,
--- মা,মেয়েটি তোমার যথেষ্ঠ বুদ্ধিমতী।কিন্তু তোমার কথামত ওর তিনবছর বয়স হতে চললো ওতো এখনো কথা বলতে পারে না।আমি একটা কথা বলি মন দিয়ে শোনো।আর বিশ্বাস নিয়ে কাজটি করো।আমার মনেহয় আগামী পুজোর আগেই ও কথা বলতে পারবে।
--- অনেক মানত,তাবিজ-কবজ করেছি বাবা।কিছুই হয়নি।
--- আমার কথাটা শুনে দেখো।আমার মনেহয় তাতে কাজ দেবে।
--- বলুন বাবা।
--- তুমি যে কোন কালী মন্দিরে একটা চাল কুমড়ো মানত করো ভক্তিভরে।হয়ত আগামী পুজোতে আমার আসা হবে না।কিন্তু আগামী পুজো আসার আগেই তোমার মেয়ের মুখে বুলি ফুটবে।
 সেদিন সেই পুজো প্রাঙ্গণেই দাঁড়িয়ে লোক মারফত গ্রামের কোন এক বাড়ি থেকে চাল কুমড়ো জোগাড় করে শান্তিদেবী মায়ের কাছে তার ছোট মেয়ের মুখের বুলি ফোটার জন্য মানত করেন।অদ্ভুতভাবে পরবর্তী পুজো আসার আগেই ছন্দা কথা বলতে শেখে।
 আমি আগেই বলেছি আমার এই উপন্যাসে কোন ঘটনায় কাল্পনিক নয়।কারণ সমস্ত ঘটনায় অমরেশবাবুর পরিবারকে কেন্দ্র করে।হয়তো পাঠককুল ভাবছেন চাল কুমড়ো মানত করলে যদি বোবা কথা বলতে পারতো তাহলে এই পৃথিবীতে আর কেউ বোবা থাকতো না।"বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর"-।হয়ত মেয়েটি একটু বেশি বয়সে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে পারতো।অনেকেই দেরিতে কথা বলে।কিন্তু যেহেতু সাধুর কথানুযায়ী কাজটা করার পর সে কথা বলতে পেরেছিলো তাই শুধু ওই পরিবারের লোকজনই নয় গ্রামের মানুষেরাও সাধুর কথাটাকেই প্রাধান্য দিয়েছিল।এখনকার দিনে যুক্তি-তর্ক,বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনেক কিছুই আছে।কিন্তু তখনকার দিনে মানুষ অনেক কিছুই সরল বিশ্বাসে মেনে নিতেন।

ক্রমশঃ
 

Friday, November 19, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (একুশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (একুশ পর্ব)
  অমরেশবাবুর তখন অনেকটাই বয়স।কিন্তু ডক্টর,উকিল এই ধরনের স্বাধীন প্রফেশনের লোকদের মত তো আর অবসর থাকে না।তিনি নিত্যই অফিস যাতায়াত করেন।বংশানুক্রমিক রোগ অ্যাজমায় জর্জরিত থাকতেন সবসময়।আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে ডক্টর সি.সি.করকে দেখিয়ে ইনহেলার নিয়ে চলাচল করতেন।নিজের প্রফেষণকে শেষ বয়স অবধি উচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিত্য তিনি আইনের বই পড়াশুনা করতেন।তার চেম্বারের একটি বড় আলমারি এবং ঘরের একপাশে থাকা আট ফুট বাই চার ফুটের যে বিশাল টেবিল ছিল তার সবটাই জুড়ে যত্রতত্র বইপত্র ঢিপ দিয়ে পরে থাকতো।কিন্তু সেসব যদি তার কোন মেয়ে গুছিয়ে রাখতো তাহলেই তিনি তার প্রয়োজনীয় জিনিসটিই সেদিন খুঁজে পেতেন না।তাই পারতপক্ষে টেবিল এবং আলমারি ঝারপোষ করা হলেও কেউ গুছিয়ে রাখতো না।
 অনেক সময় অনেক কাগজপত্র,দলিল,প্রয়োজনীয় আইনের বই অফিসে থাকাকালীন সময়ে দরকার পড়তো।তিনি লোক পাঠিয়ে দিতেন সেইসব নিতে কিন্তু সাথে থাকতো একটি চিরকুট।সেই চিরকুটে লেখা থাকতো প্রয়োজনীয় কাগজের বিবরণ। এবং নিচুতে তার নাম সই।যেহেতু বহু মানুষের অনেক প্রয়োজনীয় কাগজ থাকতো তাই তিনি বলেই রেখেছিলেন তার মেয়েদের দরকারে কোন লোককে কাগজ নিতে পাঠালে তিনি চিরকুট লিখে নিজের নাম সই করে দেবেন।কারণ প্রতিটা যুগেই দুষ্ট লোকের তো আর অভাব নেই।কেউ যদি অসাধু উপায়ে কোন কাগজ তার কাছ থেকে হাসিল করতে চায় এবং তার বাড়িতে এসে যদি বলে অমরেশবাবু নিজেই ওই কাগজ নিতে পাঠিয়েছেন এবং মেয়েরা যদি তা দিয়ে দেয় তাহলে তার নিজের মাধ্যমে সেই লোকের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে।তাই কিছু নিতে লোক পাঠালে তিনি সাথে একটি চিঠি লিখে পাঠাতেন।
 আইন সম্পর্কে তিনি এতটাই অভিজ্ঞ ছিলেন হাকিম পরবর্তীতে জজদের সাথে একদম বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক ছিল তাঁর।দিনগুলি ছিল যেহেতু কয়েক যুগ আগে - তখনকার দিনে গুণী মানুষের কদর করতে সকলেই জানতেন।অনেক সময় অমরেশবাবুকে অনেক আইনী দিক জানতে বা কোন বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রধান বিচারক তার আর্দালিকে দিয়ে ডাকিয়ে নিতেন।এইসব মানুষগুলি অমরেশবাবুকে অসীম শ্রদ্ধা ও মান্য করতেন।আর যার ফলে তাঁর সহকর্মীরাও তাকে অন্য চোখে দেখতেন।
 কিছুদিনের জন্য হলেও একটা সময় তার বাড়ি আর কোর্ট এর দূরত্বটা খুব একটা ছিল না।তখন তার ভাড়া বাসা ছিল।হেঁটেই যাতায়াত করা যায়।কিন্তু অমরেশবাবু মোটেই হাঁটাচলা করতে পারতেন না।তিনি রিক্সা করেই যাতায়াত করতেন।এইসময় তার যাতায়াতের রাস্তায় ছিল ছোটখাট এক বাজার।রিক্সাতে বসেই তিনি বাজার করতে শুরু করতেন কোর্ট চত্বর থেকে ফেরার সময়।সাথে ব্যাগ থাকতো না।তিনি ওই রিক্সার পা দানীর কাছে মাছ তরকারি রেখেই রিক্সা করে আসতেন।তখনকার দিনে তো আর ক্যারিব্যাগ ছিল না।বড়জোর কাগজের ঠোঙ্গা।অনেক সময় রিক্সা চালকেরা তাদের গামছাটা এই তরকারি আর মাছ বাঁধার কাজেই লাগিয়ে দিত।ছোট মফরসল শহর হেতু অমরেশবাবুকে চিনতো না এমন মানুষ খুব কম আছে।
 অফিস করে এইভাবেই একদিন বাজার করে পা দানীতে রেখে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরলেন একজন অপরিচিত রিক্সাওয়ালার রিক্সায়।বাড়ি ফিরে তিনি যখন তার মেয়েদের ডেকে বললেন,
--- ব্যাগ নিয়ে গিয়ে রিক্সার উপর থেকে তরকারিগুলো নিয়ে এসো।
 ব্যাগ নিয়ে তাঁর এক মেয়ে দৌড় দিলো তরকারি আনতে।গিয়ে তো অবাক! রিক্সায় যে তরকারি আছে তা তো সে হাতে করেই নিয়ে আসতে পারতো।তাহলে বাবু খামোখা ব্যাগ নিয়ে আসতে বললেন কেন? ঘরে গিয়ে বাবুকে বলল,
--- বাবু মাত্র তো কটা তরকারি।তুমি ব্যাগ নিয়ে যেতে বললে কেন?
--- কেন মা আমি তো অনেক তরকারি কিনেছি।কই দেখি কটা তরকারি তুমি পেয়েছ?
 মেয়ে ব্যাগ খুলে তার বাবুকে দেখালো।তিনি বুঝলেন সব তরকারীই তার রিক্সার ঝাঁকুনিতে রাস্তায় পড়ে গেছে।কারণ আজকের রিক্সা চালক তাঁর অপরিচিত ছিলেন তাই হয়ত সে বুঝে রিক্সা চালাতে পারেনি।
 শান্তিদেবী সব শুনে বললেন,
--- এরজন্য তোমার মেয়েরাই দায়ী।তোমার মেয়েরা তোমায় আদর,যত্ন করে করে এতটাই অলস প্রকৃতির করে দিয়েছে যে রিক্সার পা দানীতে তরকারি কিনে রেখে সেগুলির দিকে একটু তাকিয়েও তুমি দেখো না।তোমার মত অলস মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি।এরপর থেকে পকেটে থলে( তখনকার দিনে বাজারের ব্যাগকে থলে বলতো কোন কোন পরিবার)ব্যাগ নিয়ে যাবে।
 শান্তিদেবী যখন তার স্বামীকে কথাগুলো বলছেন তখন বাইরে কে যেন 'বাবু বাবু' বলে ডাকছে।(পরিচিত সকলেই তাকে বাবু বলেই ডাকতেন। একথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি)বাইরে বেরিয়ে দেখা গেলো একজন অপর রিক্সা চালক তার গামছায় পুঁটুলি করে বেঁধে কিছু তরকারি নিয়ে এসে শান্তিদেবীর হাতে দিয়ে বলছে,
--- সমস্ত রাস্তায় তরকারি পরে থাকতে দেখে আমি বুঝতে পেরেছি বাবু কোর্ট থেকে ফেরার পথে নিশ্চয় বাজার করে ফিরছিলেন কিন্তু বাবু তো একটু আত্মভোলা টাইপের মানুষ হয়ত বেখেয়ালেই তার কেনা সমস্ত তরকারি রাস্তায় পড়ে গেছে।
 অমরেশবাবু তাকে ভিতরে ডাকলেন।তরকারিগুলো ছাড়াও তাকে কিছু টাকা দিলেন।তার সাথে দীর্ঘক্ষণ গল্প করে জানলেন তার তিনটি ছেলেমেয়ে।পয়সার অভাবে মেয়ে দুটিকে স্কুলে ভর্তি করতে পারেনি।ছেলেটি স্কুলে পড়ছে।অমরেশবাবু সব শুনে সেই মুহূর্তেই তাকে কথা দিলেন তার ছেলেমেয়ের সমস্ত দায়িত্ব তিনি নিলেন।সে যেন মেয়ে দুটিকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়।ওই রিক্সাচালক তখন ঢিপ হয়ে অমরেশবাবুর পায়ের উপর পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
--- আপনি মানুষ না বাবু আপনি ভগবান।আমি সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকবো।
--- আগে ওদের মানুষ করো।বিয়ে থা দিয়ে সংসারী করো পরে এসব কথা বলার সুযোগ পাবে।ছেলেমেয়েদের জন্য যা যা যখন লাগবে তুমি চলে আসবে তোমার বাবুর কাছে।
 পরবর্তীতে এই রিক্সাচালক তার মেয়েদুটিকে মাধ্যমিক পাশ করিয়ে তারপর বিয়ে দেয়।তারমধ্যে একটি মেয়ে সামান্য একটি চাকরীও পেয়ে যায়।আর ছেলেটি গ্র্যাজুয়েশন করে একটা প্রাইমারী স্কুলে চাকরি পায়।বলা বাহুল্য সবই কিন্তু অমরেশবাবুর সাহায্যার্থে।মেয়েদের বিয়ের সময়ও তিনি প্রচুর সাহায্য করেন।এরপর থেকেই অমরেশবাবুর অফিস যাওয়ার সময় হলেই তিনি রিক্সা নিয়ে হাজির হতেন।যদিও সে পয়সা (ভাড়া ছিল দশ পয়সা) নিতে চাইতো না কিন্তু কোনদিনও অমরেশবাবু ভাড়া না দিয়ে তার রিক্সা থেকে নামতেন না।মেয়েদের বিয়ে দিয়ে তার জামাইদের নিয়ে এসে তার জীবনের ভগবানকে দেখিয়ে গেছে।ছেলের চাকরি হওয়ার আনন্দে খারোই ভর্তি ( খারোই হচ্ছে বাঁশের তৈরি। বাঁশগুলিকে ছোট ছোট করে কেটে তা দিয়ে বুনতে হত।মাছ কেটে পুকুরে ধোঁয়া ও জল থেকে মাছ মেরে রাখার জন্য এগুলি ব্যবহার করা হত।ফাঁকা ফাঁকা থাকতো সেই হেতু এগুলোর মধ্যে জল থাকতো না।)অমরেশবাবুর প্রিয় কৈ মাছ নিয়ে এসে প্রণাম করে গেছে।যতদিন অমরেশবাবু বেঁচে ছিলেন তার সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলেছে। নাতি,নাতনী হলেও তাদের এনে দেখিয়ে যেত।শুধু মুখেই নয় মনেপ্রাণে সে অমরেশবাবুকে ভগবান বলেই মনে করতো।

ক্রমশঃ

ধর্যের ফল হয় মিঠা

ধর্য্যের ফল হয় মিঠা
" সন্তান আমার অথচ তার ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা নাকি আমার নেই!!আমার বাবা,মা আমায় কোন শিক্ষা দিতে পারেননি তাই আমিও নাকি আমার সন্তানকে কোন শিক্ষা দিতে পারবো না।তাই সাহেবের জন্মের পর আতুর উঠে যাওয়ার সাথে সাথেই তাকে আমার ঘর থেকে নিয়ে যাওয়া হল আমার একমাত্র বিধবা নিঃসন্তান ননদের ঘরে।সেখানেই আমার শ্বাশুড়ি এবং ননদ মিলে তাকে দেখাশুনা করে।"
--- এ আবার কি ধরনের কথা!তুই ওকে বুকের দুধ খাওয়াসনি?
--- ওই যখন ও খিদেতে কান্নাকাটি করতো তখন কেউ একজন নিয়ে আমার কাছে আসতো।আমি ওকে দুধ খাওয়ানোর সাথে সাথে কাকের মত ছো মেরে ওকে নিয়ে চলে যেত।আর আমি চোখের জলে ভাসতাম।
--- তোর স্বামী কিছু বলতেন না?
--- না,বলতো না।সে তো মায়ের ভয়ে জবুথবু।একদিন তার মায়ের সাথে অন্য কোন বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কিতে আমার কানে আসলো তার মা তাকে চেঁচিয়ে বলছে,
--- আমার কথার অবাধ্য হলে আমি আমার সবকিছু তোর বোনকে দিয়ে যাবো।ওই তো কটা মাইনে পাস;মাথার উপর ছাদ না থাকলে ঘরভাড়া দিয়ে খাবি কি?ব্যাস আমার বীরপুরুষ স্বামী ফুটো বেলুনের মত চুপসে গেলো।
--- এরূপ করার কারণটা কি তোর শ্বাশুড়ির?
  মা মরা গরীবের মেয়ে রেখার চেহারা দেখে পছন্দ করে বাড়ির ছেলের বউ করে নিয়ে এসেছিলেন সুপ্রিয়াদেবী।বিধবা সুপ্রিয়াদেবীর এক ছেলে ও এক মেয়ে। বাপের বাড়ির একমাত্র মেয়ে হওয়ার ফলে সেখানকার সমস্ত সম্পত্তি আর টাকাপয়সার মালিক বনে যান তিনি।আর এদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরি করা স্বামীর মোটা অঙ্কের পেনশন।মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েরই পছন্দ করা ছেলের সাথে।জামাই এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো।পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ছেলে হওয়ার কারণে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এ বিয়ে মানতে বাধ্য হয়েছিল।বিয়ের একবছরের মাথায় রমলা প্রেগন্যান্ট হয়।রমলার যখন তিনমাস চলছে তখন জামাই তপন রোড অ্যাকসিডেন্ট করে মারা যায়।শুরু হয় রমলার প্রতি অত্যাচার।এই অত্যাচারের ফলেই তার গর্ভস্থ শিশুটি নষ্ট হয়ে যায়।চলে আসে সে তার মা, দাদার কাছে।সেই থেকে সে এখানেই থাকে।এগুলি সবই বিয়ের আগে থাকতেই জেনে এসেছে রেখা।কিন্তু কখনো এটা সে ভাবতে পারেনি তার সন্তান তার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে শ্বাশুড়ী তার নিজের মেয়ের কোল ভরাবেন।
 রেখা ভাবে একই সাথে তো দুজনেই ছেলেটিকে নিয়ে থাকতে পারতাম।কিন্তু তার যেন কোন অধিকারই নেই নিজের সন্তানকে কাছে রাখার।নিজের মেয়ের মন ভালো রাখতে পরের মেয়ের কোল থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিলেন।
 রেখার স্বামী সবকিছু বুঝেও নিজ স্বার্থের জন্য চুপ করে থাকলো ঠিকই কিন্তু অফিস কলিগের সাথে আলোচনা করে সুন্দর একটি উপায়ও বের করলো।অফিসেরই একটি ছেলে সদ্য বাবা হয়েছে।কিন্তু সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সে তার স্ত্রীকে হারিয়েছে।তাকে গিয়ে বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।সদ্য স্ত্রী হারা ছেলেটি প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে বাড়ির লোকের সাথে পরামর্শ করে সে বিয়েতে মত দেয়।বাড়িতে এসে মা বোনকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করে।রমলা ছেলে নিয়ে যেতে চাইলে তার হবু স্বামী আপত্তি জানায়।
 রমলা চলে যায় তার শ্বশুরবাড়ি রেজিস্ট্রি বিয়ে করে।আর ছেলে ফিরে আসে তার মায়ের কোলে।
 অনেকদিন পর বন্ধু বিশাখার সাথে মন খুলে গত দুবছরের ঘটনা বলতে পেরে রেখাও অনেকটা হালকা হয়।
    

Thursday, November 18, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (কুড়ি পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (কুড়ি পর্ব)
   অমরেশবাবুর ছোট মেয়েটি ছেলেবেলা থেকেই একটু বিজ্ঞ টাইপের।পড়াশুনায় সে তুখোড়।ছোটবেলা থেকে সংসারের কাজকর্মেও তার জুড়ি মেলা ভার।ন্যায়,নীতি বোধ তার টনটনে।সত্যি কথা মুখের উপর বলে দিতে এক সেকেন্ডও দেরি করেনা।কেউ বলে ঠোঁট কাটা,কেউ বলে মুখরা।আর অমরেশবাবু স্বয়ং বলেন, "বিষ"।এবং এই বিষ নামেই মাঝে মধ্যে তিনি ডাকতেন।
--- বিষের মত ঝাঁঝ ওর কথায়।সত্যি কথা অনেক সময় যে বলা যায় না এটা ওকে বুঝাতেই পারলাম না কোনদিন।
  পৃথিবীতে যারা সৎপথে চলে,সত্যি কথা বলে তাদের শত্রু সংখ্যা সব সময়ের জন্যই একটু বেশি হয়।উদাহরণ স্বরূপ একটি কথা বলি।একজন খুব সেজেগুজে এসে জানতে চাইলো,
--- এই আমায় কেমন লাগছে দেখতে?
 তাকে খুশি করতে সকলেই এক বাক্যে বলে উঠবে,
--- ওহ্ দারুন লাগছে।
 কিন্তু অমরেশবাবুর ছোটমেয়ে ছন্দা মিথ্যা কথা বলে কাউকে খুশি করতে পারে না।তার চোখে ভালো লাগলে ভালো বলবে আবার খারাপ লাগলে খারাপ বলবে।আর এই কারণেই অনেকেই তাকে ঠিক পছন্দ করেনা।কিন্তু যারা পছন্দ করে তারা তাদের সবটুকু দিয়েই তাকে ভালোবাসে।প্রতিবছর ক্লাসে প্রথম হয়ে ওঠে সেই ছোট্টবেলা থেকেই।অঙ্ক ছিল তার প্রিয় বিষয়।ক্লাসের অনেকেই ছিল অঙ্কে কাচা।তাই স্বইচ্ছায় সে টিফিন আওয়ারে সেইসব ক্লাসমেটদের নিয়ে অঙ্ক করতে বসতো।পড়াশুনার দিক থেকে যারা একটু দুর্বল তাদের বিষয়গুলি বুঝিয়ে দেওয়া,পরীক্ষার সময় নানানভাবে তাদের সাহায্য করা এগুলোতেই ছিল ছন্দার আনন্দ।ছন্দা সব সময় পড়াশুনা নিয়েই থাকতে ভালবাসত।পুজোর সময় সন্ধ্যায় ঠাকুর দেখতে বের হবে পড়ার সময় নষ্ট - তাই সে সারা দুপুর বসে সন্ধ্যার পড়াটা করে নিত।মাঝে মধ্যে বিকেলবেলায় বাড়ি থেকে অনেকটা দূরত্বে মাঠে খেলতে যেত।
  শুধুমাত্র একটি পুত্র সন্তানের আশায় পরপর অনেকগুলি মেয়ে হতে থাকলে মেয়েগুলোকে এক একজনকে এক এক অদ্ভুত নামে ডাকা হত। আন্না (আর চাইনা),সমাপ্তি, ক্ষ্যান্ত,  ( বন্ধ),ইতি, চাইনা (চায়না নয় কিন্তু) এরূপ আরো কত কি!
 প্রতিবারই সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় শান্তিদেবী ছাড়াও বাড়ির সকলেই আশা করতেন এবারেরটা নিশ্চয়ই ছেলে হবে।কিন্তু আঁতুড়ঘরে শিশুর ক্রন্দন শুনে সকলে অধীর আগ্রহে যখন বুড়ি পিসিমার (ধাত্রী মা) কাছে জানতে চাইত বোন না ভাই?প্রতিবারই তারা নিরাশ হত আর সকলের চোখ থেকে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়তো।ছন্দার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।যে ব্লেডে নাড়ি কাটা হবে সেটি না পুড়িয়েই বুড়ি পিসিমার হাতে চলে আসে।অমরেশবাবুর বকা খেয়ে তারপর আবার সেই ব্লেড নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে ফুটিয়ে নিয়ে আসা হয়।পরপর মেয়ে হওয়ায় সকলে অসন্তুষ্ট হলেও অমরেশবাবু কিন্তু কখনোই এই কারণে মন খারাপ করতেন না।তিনি বলতেন,
--- মেয়েরা হচ্ছে ঘরের লক্ষী।মা লক্ষী সবসময়ই আমার মেয়েদের রূপ ধরে আমার ঘরে বিরাজিত।এর ফলে আমার সংসারে কত উন্নতি হচ্ছে দিনকে দিন।আমি কিন্তু খুশি।
 কিন্তু তিনি খুশি হলে হবে কি?তার মা এবং তার স্ত্রী শান্তিদেবী তো খুশি নন।তারা তো বংশের প্রদীপ চান।
 কোথার থেকে ধরে আনলেন এক নামকরা জ্যোতিষীকে।তিনি শান্তিদেবীর হাত দেখে বললেন,
--- এবারের সন্তান তোমার ছেলে হবে।তবে ভবিতসতে তার অগাধ সম্পত্তি থাকলেও সে যে তা ভোগ করতে পারবে এমন কোন গ্যারান্টি আমি কিন্তু দিতে পারছি না।শুধু এই একটাই বাড়ি নয়,তার বেশ কয়েকটি বাড়িও হবে।সম্পত্তি,টাকা পয়সার কারণে তার শত্রু সংখ্যাও কিন্তু কম থাকবে না।
 বোঝো ঠেলা!যে সন্তান পৃথিবীতে এখনো ভূমিষ্টই হলনা তার পুরো জীবনের ঘটনা জানিয়ে গেলেন তার মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে।অমরেশবাবু গেলেন ক্ষেপে।জ্যোতিষী বা তার মাকে তো আর ভৎসনা করতে পারেন না ;কিন্তু রাগে গজগজ করতে লাগলেন।কারণ জ্যোতিষী,হাত দেখা,ভবিৎসত বলে দেওয়া এসব তিনি মোটেই বিশ্বাস করতেন না।তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন মানুষই তার ভবিতসত কারিগর।পরিশ্রম করলে তার ফল মিঠা হবেই।জীবনে কিছু অর্জন করতে গেলে লক্ষ্যটাকে ঠিক রেখে পথ যতই কণ্টকাকীর্ণ হোকনা কেন সামনে এগিয়ে চলতেই হবে।তখন নিজে এসে সফলতা জীবনে ধরা দেবে।তাই তিনি জ্যোতিষীর বলে যাওয়া কথা নিয়ে মা এবং শান্তিদেবীকে চিন্তা করতে নিষেধ করেন।
 ছন্দার জন্মের পড়ে মাত্র দেড় বছর বাদে সত্যিই রায় চৌধুরী বংশের বংশধর আসে কার্তিকের মত চেহারা নিয়ে।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যে মেয়েটি মাত্র দেড় বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছে যে মাকে ছাড়া,মায়ের বুকের দুধ ছাড়া যার এক মুহুর্ত চলে না সে কিন্তু একটু একটু করে বঞ্চিত হতে লাগলো।দুজনে দুপাশ থেকে মায়ের দুধ খেত।কিন্তু অদ্ভুতভাবে দু'মাসের মধ্যে শান্তিদেবীর বা পাশের ব্রেস্টে এক মস্তবড় ফোঁড়া হয়।রঙ্গিনীবালাদেবী তার বৌমাকে বলেন,
--- ফোঁড়া হওয়া দুধটা কিন্তু তুমি ছেলেকে খাওয়াবে না।ওটা তুমি আহ্লাদীকে খাওয়াবে।( ছেলে প্রণয়ের জন্মের পর রঙ্গিনীবালাদেবী ছন্দাকে আদর করে আহ্লাদী বলে ডাকতেন।তার বক্তব্য ছিল আহ্লাদীই রায় চৌধুরী পরিবারে বংশের প্রদীপকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছে।তাই তিনি সকলের চাইতে আহ্লাদী বা ছন্দাকেই একটু বেশি ভালবাসতেন।)কিন্তু কখনোই হারানো মানিককে বঞ্চিত করে নয়।( প্রণয়ের ডাক নাম ছিল হারা।তার কারণ পাঁচ বছর বয়সে এ বাড়ির একটি ছেলের মৃত্যু হয়েছিল যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি)
 রায় চৌধুরী বাড়িতে মুখে ভাত উঠে যাওয়ার কারণে গোবিন্দ মন্দির থেকে একটু পায়েস এনে প্রণয়ের মুখেভাত করা হয়।পড়ে জাকজমক করে পাঁচ বছরের জন্মদিন পালন করা হয়।এই জন্মদিনে শহর এবং গ্রাম মিলিয়ে কয়েকশ লোক নিমন্ত্রিত ছিলেন।
 হারার বয়স তিন বছর।ছন্দার বয়স সাড়ে চার বছর।রাখা হল হারার জন্য একজন শিক্ষক।কিন্তু ছন্দার কথা কেউ ভাবলো না।রোজ শিক্ষক সুশান্ত পাল হারাকে পড়াতে আসেন ভাই পড়ে আর হা করে বসে চেয়ে থাকে ছন্দা।তার পড়তে খুব ইচ্ছা করে কিন্তু অতটুকু মেয়ে কাকে বলবে? কি বলবে?ভাইকে স্যারের পড়ানো শুনতে শুনতেই তার অ, আ, ক,খ মুখস্ত হয়ে গেলো।সাহসে ভর করে একদিন স্যারকে জানালো যে সে ভায়ের পড়া মুখস্ত বলতে পারে।স্যার তাকে সুযোগ দিলেন।মেয়েটির প্রচণ্ড মেরিট দেখে তিনি সেদিনই বাড়ির লোককে জানালেন ছন্দাকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার কথা। বড় দিদিরা তখন তাকে সুশান্ত স্যারের কাছেই পড়ার জন্য ঠিক করে।তখন এসব ব্যাপারে তাদের বাবু বা মা খুব একটা মাথা ঘামাতেন না।বড় মেয়েদের উপরই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন।কিন্তু অভিজ্ঞ শিক্ষক কয়েক মাসের মধ্যেই বুঝে গেলেন এ মেয়েকে যদি সরাসরি ক্লাস টু তে ভর্তি করা হয় সেখানেও সে তরতরিয়ে এগিয়ে যাবে।ঠিক হল ছেলেকে ক্লাস ওয়ানে এবং মেয়েকে ক্লাস টু তে ভর্তি করানো হবে।কিন্তু ছন্দা নিজেই বেঁকে বসলো।সে কিছুতেই ক্লাস টু তে ভর্তি হবে না।তার কারণটাও কিন্তু সে ব্যাখ্যা করে সকলে বুঝিয়ে বলছে।সবাই কেন সেটা বুঝতে পারছে না ;সেটাই ছন্দা বুঝতে পারছে না।

ক্রমশঃ

জীবনের প্রতি বাঁকে (উনিশ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (উনিশ পর্ব)
   সম্মিলিত মতের কাছে অমরেশবাবু হলেন পরাজিত।রাজি তাকে হতেই হল একটা চৌদ্দ বছরের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য।রায় চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে মানে সে এক এলাহী ব্যাপার।শুরু হল সেই বিশাল আয়োজন।তখনকার দিনে বিয়ে মানে ব্যান্ড পার্টি,মাইক আর উপহার।এই উপহার হল পরিবারের সকলের হয়ে কেউ একজন কিছু কবিতা লিখতেন।আর সেগুলি বিয়ের আসরে পড়া হত।যেমন বিশাখার বিয়েতে বাবা,মায়ের তরফ থেকে লেখা হল
"পুত্রী দিয়ে পুত্র পেলাম,আর তো বাবা নহ পর-----"
ছোটদের তরফ থেকে 
"ছুটির পরে বাড়ি গেলে কে আর খাবার দেবে?
আদর করে হাত বাড়িয়ে কে আর বুকে নেবে?---"।এইরূপ বেশ বড় বড় কবিতা ছাপার অক্ষরে লেখা যা কোন একজন বেশ সুন্দর করে বিয়ের আসরে পড়তেন।কবিতাগুলো এত সুন্দর লেখা হত তা শুনে অনেকেই চোখের জলে ভাসতেন।
  বিয়ে সম্পর্কে তখনো বিশাখার কোন সম্যক জ্ঞানই জন্মায়নি।ভগ্নিপতি মনতোষের কাছে গিয়ে বিশাখা বায়না ধরলো
--- জামাইবাবু,আমি মাইকে গান করবো।
 বাড়ির সবাই অবাক।যে মেয়ের বিয়ে সে নিজে চাইছে গান করতে।অমরেশবাবুর কথাগুলো তখন সকলের মাথার মধ্যে বিড়বিড় করছে।"বিয়ের মানেই যে মেয়ে বোঝে না তাকে তোমরা বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছ?"মনোতোষ তখন এ বাড়ির সেরা জামাই।সে তখন বিশাখাকে বললো,
--- নিশ্চয়ই গাইবে। চলো আমিও তোমার সাথে গাইবো।
 বিয়েবাড়িতে সকালে মাইকে শুরু হল যেমন খুশি তেমন গাও।যে যেমন পারে গান,কবিতা --- চলতে লাগলো।
  বিয়ে তো হয়ে গেলো।মেয়ের তো সত্যিই নারী পুরুষের সম্পর্ক সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল না।(তখনকার দিনে ছেলেমেয়েরা এই বয়সে এত পাকা কেউই ছিলনা)ফুলশয্যার রাতে স্বামী ঘরে ঢুকলে সে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে যায়।স্বামী তাকে আটকায়।বলে,
--- আরে আজকে তো আমাদের ফুলশয্যা।
--- সেতো দেখতেই পারছি। খাটটাকে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে।আপনি এই খাটে শুয়ে পড়ুন।আমি আপনার কাছে শোবো না;আমি আপনার মায়ের কাছে শোবো।
 বোঝো কান্ড!
 চলতে লাগলো বেশ কয়েকটা দিন এইভাবে।মেয়ে অস্টমঙ্গলায় বাপের বাড়িতে এসে জানিয়ে দিলো,
--- ওই অসভ্য লোকটার সাথে সে আর তাদের বাড়িতে যাবে না।
 দিদিরা বললো,
--- কেন কি করেছে ও?
--- জানিস ও প্রচণ্ড অসভ্য।আমি খোকনদার কাছে শুয়েছি,দিপুদার (দেবদাস চ্যাটার্জী ও খোকনের কথা আগেই বলেছি) কাছে শুয়েছি তারা কত ভালো।আর ওই লোকটা আমার সাথে কি করতে আসে জানিস?
দিদিরা তো সব অবাক!এত সত্যি দেখতেই বড় হয়েছে।বাবু একে ঠিকই চিনেছিলেন।এর যে স্বামী,স্ত্রী সম্পর্কে কোনোই জ্ঞানই নেই।শুরু হল দিদিদের বদ্ধ দরজার মধ্যে বোনকে নিয়ে শিক্ষাদান।
 অনেক ঝড়ঝাপটা,অনেক অভিযোগ,শারীরিক মানসিক অত্যাচারের পর আজ এই শেষ বয়সে এসে সে চিৎকার করে বলতে পারে "আজ আমি সুখী।'
 কিন্তু তার আগে বিশাখার জীবনের আরও কিছু ঘটনা আমি আমার পাঠককুলের কাছে তুলে ধরবো।
 বিশাখা বিয়ের পর পুনরায় নবম শ্রেণীতে ভর্তি হল।এখানে পুরো স্কুল জেনে গেলো সে একজন ভালো খেলোয়াড়।স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।বিশাখা হাড়িভাঙ্গা,দৌড়, বর্শা নিক্ষেপ - নাম দিয়ে দিলো।তখন তার সেজদি ভারতী ওই প্রাইমারী স্কুলের পঞ্চাশ টাকা মাইনের শিক্ষিকা।তখনো সে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরি পায়নি।কথাটা তার কানে গেলো।বিশাখা তখন সাত মাসের প্রেগন্যান্ট।সেজদি মাঠে ছুটে আসতে আসতে বাঁশিও বেজে উঠলো বিশাখাও দৌড় দিলো।অনেকেই তাকে নিষেধ করেছিল এই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ না নিতে।কিন্তু সে তো নাছোড়বান্দা।ওই অবস্থায় সে সকলের আগে দৌড়ে প্রথম প্রাইজ নিয়ে তবে ফেরে।তবে বাকি দুটো প্রতিযোগিতায় তাকে অংশগ্রহণ করতে তার দিদি আর দেয় না।
 ৭৮ সাল।প্রচণ্ড বন্যায় সকলের ঘর,বাড়ি ভেসে যাচ্ছে।আর ঠিক সেই বন্যার মধ্যে বিশাখার পেইন ওঠে।সমস্ত ঘরময় জল।পথঘাট কিছুই চেনার উপায় নেই।চারিদিকে তাকালে জল ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। পাড়ায় একজনের একটা টাক্সির কথা বলা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এই জলের মধ্যে তাকে তো পাওয়াও সম্ভব নয়।জল ভেঙেই মনোতোষ হাজির হল বিশাখার বাড়িতে।মনোতোষ যেন রায় চৌধুরী পরিবারে সকলের বড়দা হয়ে উঠেছিল।বিশাখার সাহস কয়েকশ গুন বেড়ে গেলো।এতক্ষন সে যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো জামাইবাবুকে দেখেই বললো,
--- আমি এই জলের মধ্যে হেঁটে যেতে পারবো।শুধু আপনি আমার হাতটা ধরে থাকবেন।পড়ে যেতে গেলে টেনে তুলে দেবেন।মনোতোষ হেসে পরে বললো,
--- আমি জানি তো।আর সেই জন্যই তো আমি এই জলের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে এলাম।কেন যে ওরা বলছে তুমি পারবে না আমার মাথায় সেটাই আসছে না।
 ছেলেমানুষের মত মনোতোষ বিশাখার সাথে গল্প করতে করতে প্রায় কোমর সমান জল পেরিয়ে তারা ডায়মন্ডহারবার রোডে উঠে ভাগ্যক্রমে একটা ট্যাক্সি পেয়ে যায়।অল্প বয়স বলেই হয়ত লেবার পেইনটা বিশাখা তার ভগ্নিপতির হাসি,ঠাট্টার কারণে কিছুটা হলেও ভুলতে পেরেছিলো।
 সংসারিক জীবনে বিশাখার স্বামী ছিলো উগ্র মেজাজের। স্বভাবখানা ছিলো তোমাকে আমি বিয়ে করে এনে উদ্দার করেছি।আমি সংসারের পুরুষ,রোজগার করি,ভালো খাওয়া,ভালো থাকা আর সমস্ত রকম সুখ ভোগ করার অধিকার একমাত্র আমার আছে।আমি তোমাকে খাওয়াচ্ছি, পরাছি তুমি আমার বাড়ির ঝি আর আমার দৈহিক ক্ষুদা নিবৃত্তি করার একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে আসার পর এরূপ একটি দানবরুপী মানুষের সংস্পর্শে এসে তারও মন মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে যায় আস্তে আস্তে।যে দিদিরা,ভগ্নিপতি এক সময় তার জন্য দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় খাওয়া,নাওয়া ভুলে গেছিলো বহু বছর পর নানান কারণে অকারণে এদের সাথেই দুর্ব্যবহার করে সম্পর্ক শেষ করেছে।তবে সুখের বিষয় একটাই সে এখন ভালো আছে,সুখী আছে।আর কষ্টের বিষয় যারা তার সুখের জন্য এত কাঠখর পুড়িয়েছে ওই রূপ স্বামীর মারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রাত জেগে বাইরে দরজার কাছে পাহারা দিয়েছে তারা আজ সবাই বিশাখার কাছে খারাপ।আসলে মানুষের জীবনটাই বড় বিচিত্র।সেই ছোট থেকে যতই যার বয়স বাড়ুক না কেন পরিবেশের প্রভাব তার উপরে পড়বেই।সেই ছোট্ট বয়সে সকলকে ছেড়ে এসে এমন একটা মানুষের সাথে তার উঠা,বসা,শোয়া,খাওয়া - আর প্রতিটা মুহূর্তে তার আচার-আচরণ দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই মানুষ ওই মানুষটির মত হয়ে যায়।হয়ে যাওয়ার আরও অনেক কারণ থাকে।কারণ প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষই হচ্ছে সবথেকে স্বার্থপর।সে যদি দেখে তাকে যে মানুষটাকে নিয়ে জীবন কাটাতে হবে পারিপার্শ্বিক কিছু বর্জন করলে অন্তত অশান্তির হাত থেকে সে রেহাই পেতে পারে তখন অনেক সময় নিজের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও ঘরের মানুষটার সাথে অ্যাডজাস্ট করতে অনেক কিছুই সে করে থাকে।মানুষের মনের ভিতরের খবর তো জানা যায় না।কিন্তু মন তো পরিবর্তনশীল।যে কোন সময় যে কোন কারনেই হোক না কেন মনের পরিবর্তন হতেই পারে।আর এই জন্যই তো কৃতজ্ঞ আর অকৃতজ্ঞ শব্দদুটির পাশাপাশি অবস্থান।

ক্রমশঃ
    

Wednesday, November 17, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (আঠারো পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (আঠারো পর্ব)
  অমরেশবাবুর খুকুমা মাত্র সাইত্রিশ বছর বয়সে সব লেনাদেনা চুকিয়ে চিরদিনের মত চলে গেলো ঠিকই কিন্তু রেখে গেলো নাড়ি কাটা ধন।ছোটবোন ছন্দার মেয়ের বয়স তখন সাড়ে তিন বছর।তার স্বামী তাকে জানালো,
--- খুকুদির মেয়েটিকে আমরাই দত্তক নিয়ে নেবো।তুমি বাড়ির সকলের সাথে কথা বলো।কারণ ওর বাবা তো একা মানুষ।সে তো ওকে মানুষ করতে পারবে না।তাছাড়া তার বয়স কম।কবে আবার বিয়ে করবে তার কোন ঠিক নেই।আমরাই ওকে মানুষ করবো।মনে করবো আমাদের দুটো মেয়ে।
 সতেরোটা দিন দুধের শিশু তার মাকে হারানোর পর ছন্দার কাছে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।এদিকে স্বপ্নার বিয়ের আট বছর বাদেও কোন সন্তান হয় না।অনেক ডাক্তার,অপারেশন করার পরেও নিঃসন্তান অবস্থায় তাদের দিনাতিপাত।তার শ্বাশুড়ী বাইরের কোন শিশুকে দত্তক নিতে দেবেন না।আর তাছাড়া তখনকার দিনে দত্তক ব্যাপারটা সকলে তেমন জানতেন না আবার অনেকে জানলেও পছন্দ করতেন না।কিন্তু খুকুর মেয়েটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য স্বপ্নার শ্বাশুড়ী তাকে এবং তার ছেলেকে বলেন।তার কথা অনুযায়ী 
--- আমরা তো এই মেয়েটিকে দত্তক নিতেই পারি।এর বাপ,মা জন্ম-ঠিকুজি আমরা সব জানি।ছন্দার তো একটি মেয়ে আছে।তোমরা গিয়ে ছন্দাকে আর বাড়ির সকলকে বুঝিয়ে বলো।মেয়েটিকে নিয়ে এসে তোমাদের শুন্য কোল পূরণ করো।
 স্বপ্না আর তার স্বামী এসে খুকুর মেয়েকে নিয়ে যায়।পড়ে সমরের কাছ থেকে তারা মেয়েকে আইনী মারফৎ দত্তক নিয়ে নেয়।খুকুর স্বামী কিন্তু ছ'মাসের মধ্যেই আবার বিয়ে করে। স্বপ্না ও তপন তাদের এই মেয়েকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ, মায়া-মমতা দিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করেছে।সব থেকে আশ্চর্য্য কিংবা ভালোলাগার বিষয় যেটি তা হল স্বপ্নার শ্বাশুড়ী একসময় স্বপ্নার সাথে যে দুর্ব্যবহার করেছিলেন সেই তিনিই খুকুর এই মেয়েটিকে নিজ নাতনীর মত ভালোবাসতেন।তার নিজের বিয়ের গয়না যা তিনি তার একমাত্র পুত্রবধূটিকেও দেননি তা তিনি এই নাতনীর বিয়ের জন্য স্বপ্নাকে দিয়েছিলেন।মানুষের কিছু ব্যবহার দেখে যে পুরো মানুষটিকে ভালো কিংবা মন্দ হিসাবে যে বিচার করা ঠিক নয় তা স্বপ্নার শ্বাশুড়ীকে দেখেই বোঝা যায়।একটা মানুষের ভিতরে ভালো মন্দ দুটি দিকই থাকে।পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানুষের মানসিক পরিস্থিতির উপর তার ব্যবহার নির্ভর করে।
 স্বপ্না মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজেরা পছন্দ করে উপযুক্ত ছেলের হাতেই সমর্পণ করে।বর্তমানে এক কন্যা সন্তানের জননী সে।ভালো মন্দ মিশিয়ে সে খুব সুখেই আছে।আর হ্যাঁ একটা সময়ে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো যে সে স্বপ্নার বোনের মেয়ে এবং তারা তাকে দত্তক নিয়েই মানুষ করেছে।এটা জানানো হয়েছিলো এই কারণেই যেহেতু সমস্ত আত্মীয়-বন্ধুরা সমস্ত বিষয়টি জানতেন যদি কখনো অন্যের মাধ্যমে তার কানে যায় এবং সে যদি এই বিষয়ে কোন রিয়াক্ট করে তাই মাধ্যমিক দেওয়ার পরেই তাকে জানানো সকলে শ্রেয় বলে মনে করে।
  রায় চৌধুরী পরিবারে সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে যখন সবেমাত্র অমরেশবাবুর মাত্র দুটি কন্যা মানে বড় ও মেজটির বিয়ে হয়েছে তারপরেই বিয়ে হয় চৌদ্দ বছর বয়সে তার অষ্টম কন্যাটির।বিশাখা তখন নবম শ্রেণীতে পড়ে।খেলাধুলায় ভীষণ ভালো।যেখানেই যায় পুরস্কার নিয়েই ফেরে তা সে যে কোন ধরনের খেলা হোকনা কেন।যেখানেই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কথা তার কানে আসে - নাওয়া,খাওয়া,ঘুম সব বাদ দিয়ে বাড়ির লোককে অধিকাংশ সময় না জানিয়েই ছুটে চলে যায় খেলতে।বাড়ির লোক খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গিয়ে দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনা নিয়ে যখন প্রতিটা সেকেন্ড,মিনিট কাটাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে হাতে পুরস্কার নিয়ে হাসতে হাসতে সে হাজির।তাকে বাড়ির সকলে অনেক বুঝিয়েও পারেনি যে কোথাও খেলতে গেলে অন্তত বাড়ির যে কাউকে একটু বলে যায় যেন সে।এই বলে না যাওয়ার মধ্যেই সে যেন এক বিশাল আনন্দ খুঁজে পেতো।খেলা পাগল এই মেয়েটিকে নিয়ে অমরেশবাবুর চিন্তার শেষ নেই।তখনকার দিনে গ্রাম বা মফরসল শহরগুলোতে এখনকার দিনের মত খেলাধুলার এতো সুযোগ সুবিধা,এবং এই খেলার সোর্স এ চাকরির এত সুযোগ সুবিধা ছিলনা।সেভাবে কোন কোচও তখন পাওয়া যেতনা।
পড়াশুনার প্রতিও তেমন আগ্রহ ছিলোনা।শুধু সারাটা।দিন ধরে খেলা আর খেলা বিশেষত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।আর এই কারণে সারাটাদিন বাইরে থেকে সন্ধ্যায় তার ঘরে ফেরাটা কারোই ভালো লাগতো না।মন্দ মানুষ সব দেশে সব কালেই থাকে।সম্মান এবং প্রাণের আশঙ্কায় মেয়েকে নিয়ে অমরেশবাবু খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন।এমতাবস্থায় বোনকে ঘরমুখো করতে মায়ের সাথে পরামর্শ করে হঠাৎ করেই তার বিয়ে ঠিক করে ফেলে সবাই।অমরেশবাবু শুনে তো থ।
--- এটা কিছুতেই হতে পরে না।একটা বাচ্চা মেয়ের বিয়ে আমি কিছুতেই দিতে দেবো না।ও যা করছে করুক।ওর দেখভাল করার জন্য আমি একজন লোক নিয়োগ করবো।ঘরমুখো করার জন্য এই বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আমি ওর জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারবো না।তোমাদের এই সিদ্ধান্তে আমার কোন মত নেই।
 বাড়িতে বিশাখার বিয়ে নিয়ে নিত্য অশান্তি।শেষমেষ অমরেশবাবু রেগেমেগে বললেন,
--- শোনো তোমরা যদি জোর করে ওর বিয়ে দাও আমি সত্যি বলছি ওকে নিয়ে অন্য কোথাও আমি চলে যাবো।কিছুতেই আমি এ বিয়ে হতে দেবো না।অবস্থা গুরুতর বুঝতে পেরে যে ঘটক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিলো সে ছেলের বাড়ি গিয়ে সবিস্তারে সবকিছু জানালো।একদিন দুপুরের দিকে প্রায় সাত আটজনের এক দল ছেলের বাড়ি থেকে এসে হাজির।এই মেয়েকেই তারা তাদের বাড়ির বউ করতে চায় বলে অমরেশবাবুর হাতদুটি ধরে অনুনয় বিনয় করতে লাগে।তারা কথা দেয় তারা বিশাখাকে বিয়ের পর পুনরায় পড়াবে।
 অমরেশবাবু সব শুনে বলেন,
--- নারী পুরুষের সম্পর্ক বোঝার মত যে মেয়ের জ্ঞান হয়নি তাকে বিয়ে দিলে কতটা সমস্যার মধ্যে আপনাদের পড়তে হতে পারে সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান আছে আপনাদের?
--- সকল বাবা,মায়ের কাছেই চিরকাল তার সন্তান ছোটই থাকে।বাবা,মায়েরা তাদের সন্তানদের ভাবেন তারা কিছুই জানে না,কিছুই বোঝে না।আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।শুধুমাত্র বিয়েটাই মত দিন।মেয়েটিকে আমাদের খুবই পছন্দ।খুবই লক্ষীমন্ত মেয়ে আপনার। এ মেয়ে যে সংসারে যাবে সে সংসার সুখ উপচে পড়বে।
--- আপনাদের সংসারে সুখ উপচে পড়ার জন্য আমি আমার কচি মেয়েটার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবো না।আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন।
 তারাও নাছোড়বান্দা।দুপুর থেকে বিকেল,বিকেল থেকে সন্ধ্যা তারপর রাত।তাদের উঠার কোন নামই নেই।শেষমেষ হাত জোড় করে অমরেশবাবু বললেন,
--- আপনারা আমায় একটু ভাবনার সময় দিন।কয়েকটা দিন পরে আমি আপনাদের আমার মতামত জানাচ্ছি।যদি আমার মতের পরিবর্তন হয় তাহলে কিন্তু আপনাদের আমাকে দেয় কথার মর্যাদা রাখতে হবে।আমার মেয়ের পড়াশুনা কিন্তু বন্ধ করা চলবে না।

ক্রমশঃ 
  
    

Tuesday, November 16, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (সতের পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (সতের পর্ব)
  তখনকার দিনে ন'টি মেয়ে এবং একটি মাত্র ছেলে।শিক্ষা এবং সাংসারিক কাজকর্মে প্রতিটা মেয়েই দক্ষ।অবশ্য এদের মধ্যে ফাঁকিবাজ যে ছিলনা তা কিন্তু নয়।কেউ কেউ এমন ছিল যে এক বোনের কাজ অন্য বোনের ঘাড়ে মিষ্টি কথায় চাপিয়ে দিত।তবে স্কুল এবং পড়াশুনা এগুলো কেউ করতো স্বইচ্ছায় আবার কেউ করতো মায়ের ভয়ে।শাসন যা করার তা করতেন শান্তিদেবী।অমরেশবাবু সারাটা জীবন তার প্রতিটা মেয়েকে শুধু আদর আর ভালোবাসা দিয়ে গেছেন।'মা'আর 'তুমি'বলেই তিনি তার প্রতিটা মেয়ের সাথে কথা বলতেন।প্রতিটা মেয়ের আবদার ছিল তাদের বাবুর কাছেই।
  তার সপ্তম মেয়েটি তন্দ্রা ওরফে খুকু ছিল খুব সরল,সাদা।এই মেয়েটির উপর তার অন্য মেয়েরা তাদের নিজেদের কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতো।খুকুকে অমরেশবাবু ডাকতেন খুকুমা বলে।পরবর্তীতে অমরেশবাবুর সমস্ত নাতি নাতনীরাও তাকে ওই নামেই ডাকতো।মনটা ছিল তার শিশুর মত সরল।কেউ কোন কুকথা বললেও সে বুঝেও না বোঝার ভান করতো।বলতো,
--- কি লাভ অন্যের সাথে ঝগড়া করে।কতদিনই বা বাঁচবো?এড়িয়ে গেলেই তো আর ঝগড়া হবে না।
কেউ হয়ত তখন বলেছে,
--- তাই বলে ওর ওই নোংরা কথাগুলির জবাব দিবি না?
--- ওর ওই কথাগুলির জবাব দিতে গেলে আমাকেও ওই নোংরা ভাষাতেই বলতে হবে।তাহলে ওর আর আমার মধ্যে পার্থক্য কোথায় থাকবে?
 এই ছিলো অমরেশবাবুর খুকুমা।বাড়ির প্রত্যেকের মুখের কথা বেরোনোর আগেই তার সে কাজ সে নিজ হাতে করে দিত।কোন অভিযোগ, কারো বিরুদ্ধে কোন নালিশ তার কোনদিনও ছিল না।অমরেশবাবু একটা কথা প্রায়ই বলতেন কেউ কখনো কোন গালিগালাজ করে  'অমুকের বাচ্চা'যদি বলে কোনদিনও সেই কথাটা তাকে ফিরিয়ে বলবে না।তাকে ভাই বলে সম্মধন করবে।তারমানে তুমি তাকে সেটাই বললে যা সে তোমায় বলেছে।অথচ কথাটা তুমি সরাসরি বললে না।আর তার এই নীতিটা একমাত্র তাঁর খুকুমা ই মেনে চলতেন।অমরেশবাবুর সমস্ত মেয়েরা পড়াশুনা করলেও তাঁর খুকুমা কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরতে পারেনি।আসলে সংসার আর সকলের যত্ন নিয়ে সে এতটাই মাথা ঘামাত যে পড়াশুনার প্রতি তার কোন টান ই সে অনুভব করতো না।বাড়ির সকলেই চেষ্টা করেছিল কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারেনি।
  দিদি,বোন,ভাই সকলেই ছিল তার প্রাণ।সকলের প্রতি তার ছিল এক অসীম দরদ। কার কখন কি দরকার, কার কি অসুবিধা মুখে তাকে কিছু বলতে হত না।সে যেন এক অলৌকিক ক্ষমতাবলে সবকিছু বুঝে যেত।পরিবারের সকল সদস্যের সাথে তার যেন এক অলিখিত চুক্তি ছিলো সকলের  সবকিছু মুস্কিল আসানের।
 নিরীহ,অতি শান্ত সাত চড়ে কথা না বলা মানুষটির জীবনেও প্রেম এসেছিলো।এক অনুষ্ঠান বাড়িতে দেখা হওয়া কোন একটি মানুষের সাথে।চলত তার সাথে লুকিয়ে চিঠি আদানপ্রদান।বাড়ির কেউই কিছুই কোনদিন জানতে পারেনি।
 বাড়ির সকলে খুকুর বিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলে দেখতে শুরু করলে সে এসব কথা জানায় সকলের ছোটবোনকে।তার ছোটবোন ছন্দা তার সেজদিকে একথা জানায়।এই সেজদি তাদের বাবুর বর্তমান এবং অবর্তমানে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।ভাই এবং বোনদের লেখাপড়া শিখিয়ে বোনদের এক এক করে বিয়ে দিতে থাকে।তার জীবনটা ঠিক যেন মালা সিংহা অভিনীত কবিতা সিনেমার মত।নিজের কোন ভালোলাগা,ইচ্ছা নেই।ভাইবোনেরাই তার জীবনের সব।তাদের আবদার,তাদের শখ সবকিছুই এই সেজদি মেটায়।অমরেশবাবুর বয়স হয়ে যাওয়ার পর তাঁর রোজগার যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন থেকেই ভারতী নিজের ইচ্ছায় পুরো সংসারের সমস্ত দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
 অধিকাংশ সংসারে দেখা যায় কোন সদস্য যদি সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে তখন সেই পরিবারের বাবা, মায়েরাও কিছুটা হলে স্বার্থপর হয়ে পড়েন।একটা জীবনের বিনিময়ে অন্য জীবনগুলো যদি একটু সুখ,স্বচ্ছন্দ পায়- তারা সেদিকেই দৃষ্টিপাত করে মূল মানুষটির জীবনের কথা না ভেবে।মা না হয়েও কিভাবে সংসারে সকলের মা হয়ে উঠা যায় ভারতী তার পুরো জীবন দিয়ে রায় চৌধুরী পরিবারে তা বুঝিয়ে দিয়েছে।ছোট বোনেরা,ভাই যেমন তার সন্তানসম আবার তাদের ছেলেমেয়েরাও তার ছেলেমেয়ে।
  খুকুমার সাথে কথা বলে সেই ছেলেটিকে ডেকে আনে তাদের সেজদি।ছেলেটি আসে ঠিকই কিন্তু বিয়ে করতে অস্বীকার করে।কি অদ্ভুত!একটা মেয়ের সাথে আট থেকে দশ বছরের সম্পর্ক।অথচ যখন মেয়েটির বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হল তখন ছেলেটি জানালো,
--- আমি ওকে বন্ধু মনে করতাম।ভালোবাসি কোনদিন তো বলিনি।এরকম বন্ধু আমার অনেক আছে।
 নিরীহ,শান্ত স্বভাবের খুকু এরপর আর কোন কথা তার সাথে বলেনা।সে সোজা উঠে ঘরে চলে যায়।এরপর মাস ছয়েকের মধ্যে স্বল্প শিক্ষিত খুকুর জন্য তার উপযুক্ত পাত্র খুঁজে বের করে ভারতী তার বিয়ে দেয়।
 খুকুর শ্বশুরবাড়িটি শরিকের বাড়ি হলে কি হবে প্রচুর জমিজমা,পুকুর মিলিয়ে সে বিশাল ব্যাপার।কিন্তু যেহেতু খুকু বেশি লেখাপড়া জানতো না তাই তাকে ঠিক সেরূপ পাত্রের হাতেই সমর্পণ করা হয়েছে।ছোটখাট একটা চাকরি করে।কিন্তু অসম্ভব ভালোবাসে তার স্ত্রী তন্দ্রাকে।বাপ,মা মরা সমরকে কে কবে গুছিয়ে খেতে দিয়েছে তা সে মনেই করতে পারেনা।বিয়ের পর খুকুর যত্ন,ভালোবাসায় সমর এক নূতন জীবন খুঁজে পায়।পরস্পর যেন পরস্পরকে চোখে হারায়।ছুটির দিনগুলোতে দুজনে এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়।
 এভাবে দু'বছর কাটার পর তাদের সংসারে নূতন এক অতিথি আসে।সংসারে লক্ষীর আগমনে সংসারে শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে।মেয়েকে নিয়ে দুজনেই নূতন নুতন স্বপ্ন দেখতে থাকে।কিন্তু খুকু, সমরের জীবনে এসুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়না।মেয়ের বয়স তখন এক বছর এক মাস।এতটুকু ছোট বাচ্চাকে নিয়ে খুকু আত্মীয়ের বিয়েবাড়িতে যাবে না বলে বাপের বাড়িতে আসে তার মেয়েটিকে ছোট বোনের কাছে রেখে বিয়েবাড়িতে যাবে বলে।
 মেয়ের খাবারদাবার সবকিছু ছোট বোনকে বুঝিয়ে দিয়ে সে স্নানে ঢোকে।অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও যখন সে বাথরুম থেকে বেরোচ্ছে না তখন বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করে তার ছোট বোন ছন্দা দৌড়ে গিয়ে পাড়ার ক্লাবে জানায়। সেজদি তখন অফিসে।ক্লাবে তখন খুকুর ভাই ও এক বোনপো ছিল। এ খবর শুনেই তারা ছুটে আসে সঙ্গে পাড়ার অনেক ছেলেরা।বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে খুকুকে বের করা হয়।ডাক্তার ডাকা হলে তিনি জানান 'ব্রেন স্ট্রোক'।তবুও তাকে হাসপাতাল নেওয়া হয়।
 তেরো মাসে খুকু তার জীবনের সমস্ত শখ,আহ্বলাদ বিসর্জন দিয়ে একমাত্র মেয়ের কথা না ভেবে বিধাতার এক অমোঘ লিখনে সকলকে ছেড়ে পরপারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো।ছোটবোন ছন্দা তখন দিদির মেয়েকে বুকে আঁকড়ে ধরলো।তখনো খুকুকে শ্মশানে নেওয়া হয়নি।খুকুর মেয়ে খিদেয় তীব্র চিৎকারে বাড়ি মাথায় করছে।ছন্দা নিজের চোখ মুছে তার দিদির বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।দিদিকে হারিয়ে সেই মুহূর্তে ছন্দা একটু কাঁদতেও পারেনি।ছন্দার মাতৃত্বের কাছে সেদিন দিদিকে হারানোর শোকটা মৃয়মাণ হয়ে পড়েছিলো।
  ( পরবর্তী পর্বে জানাবো এই বাচ্চাটা কার কাছে মানুষ হয়েছে।)

ক্রমশঃ